#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_৩৩
উষ্ণতা বোধহয় প্রেমময় চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে প্রকৃতির সাথে। প্রকৃতির উপর দিনকে দিন তার প্রেমের গভীরতা বাড়িয়ে চলছে তো চলছেই,সামান্য একটু নিজের তেজী প্রেম কমানোর নাম পর্যন্ত নিচ্ছে না। হায় এ কেমন বেহায়া উত্তাপ!ঠিক যেন তুলির ডাক্তার সাহেবের মতো। সময়ের সাথে গম্ভীরতার খোলস ভেঙে নিজেকে আবৃত করে নিয়েছে বেপরোয়া খোলসে। গোসল সেড়ে এসে কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে নিল তুলি। জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে অংশুমালী কে ঘরে আসার সুযোগ করে দিল। তুলির দয়ায় আনন্দিত হয়ে সূর্য প্রথম কিরণ টা শ্যামবতীর বদনে আলিঙ্গন করে ছুঁয়ে দিতে লাগল পরম যত্নে। কিন্তু শ্যামবতীর ডাক্তার সাহেবের তা একটুও পছন্দ হয় নি। একটুখানিও না।
উন্মুক্ত কোমরে ঠান্ডা হাতের স্পর্শে উত্তাল ঢেউ গর্জে উঠলো তুলির হৃদপিণ্ডের প্রতি অংশে। মৃদু কাঁপন ধরলো দেহের সর্বাঙ্গ জুড়ে। ভেজা চুল গুলো একপাশে সরিয়ে ঠোঁটের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে অনবরত আদ্র। পেটে হাতের চাপ প্রগাঢ় হতেই তুলির বুকের উচাটন বেড়ে গেল। তরঙ্গের ন্যায় শিহরণ খেলে গেল সারা কায়ায়,অভ্যন্তরস্থানে। আদ্রর হাতের বাঁধন শীতল হওয়া মাত্র ঝটপট পিছন ফিরল। চোখের পাতায় ভেসে উঠল আদ্রর অর্ধ নগ্ন দেহ। সদ্য স্নান সেরে এসেছে আদ্র। শরীরে শুধু টাওয়াল জড়ানো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার উপক্রম তুলির। বিয়ের এতগুলো মাস পার হয়েছে। পার হয়ে গেছে এক বসন্ত। তবুও তুলির কাছে আজও অসম্ভব হয়ে উঠেছে আদ্র এহেন রূপ দেখা। যখনই ভুলবশত নেত্রযুগলে ধরা পরে যায় আদ্রর অর্ধ উম্মুক্ত ফর্সা বলিষ্ঠ দেহ তখনই এক আকাশসম লজ্জা তুলি কে ঘিরে,আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় তীব্রভাবে। তুলির ভাবতেই কাঁপুনি ছুটে যায় এই সুদর্শন পুরুষের ছোঁয়ার বিচরণ তার দেহ জুড়ে। চুল টা ভালো করে ঝেড়ে রুম থেকে বের হওয়ার জন্য অগ্রবর্তী হতেই আদ্রর শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়ল। মুহুর্তেই জমে গেল পুরো দেহ।
নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আদ্র অন্য হাত মেলে ধরল তুলির দিকে। হাতের মুঠোয় জিনিস টা দেখে তুলির হুঁশ উড়ে গেল। ভয়ে ধুকপুক শুরু হয়ে গেল বুকের। আদ্রর চোখের মণি লাল হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল তুলির দিকে।
” হোয়াট ইজ দিস তুলা?লুকোচুরি, ফাঁকিবাজি শুরু করেছো আমার সাথে?তোমাকে কতোবার বলতে হবে বেবী এখন নিব না আমরা। তুমি এখনও পারফেক্ট না মা হওয়ার জন্য। আর মাস খানেক পরেই তো তোমার ফাইনাল এক্সাম। একটু সবুর করো,ধৈর্য ধরো। কেন আমার কথা অমান্য করছো তুৃমি?তুমি না বোকা ছিলে?এতো চালাক হলে কিভাবে?কে শিখিয়েছে আমার কথা অমান্য করা? টেল মি।”
তুলি কাঁপা কাঁপা হস্তে হাতে দলা মোচড়ানো ছোট্ট কাগজ টা নিয়ে নিল আদ্রর হাত থেকে। মেলে দেখল লিখা টা ঠিকঠাক লিখেছিল কিনা!” আপনি কি বাবা হতে চান ডাক্তার সাহেব?” হ্যাঁ একদম সঠিক লিখেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ভোর বেলা তুলি এই এক বাক্য ছোট্ট কাগজে লিখে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আটকে রাখে। মুখে বলতে খুব সংকোচ তার। লজ্জায় ভারি হয়ে যায় মনটা তৎক্ষনাৎ। অতঃপর চেয়েও অসম্পূর্ণ থেকে যায় মুখের বুলি। তাই তো কাগজে মনের কথা, ইচ্ছা জানানোর উপায়,মাধ্যমের উৎপত্তি ঘটিয়েছে ইদানীং। কাগজ টা আদ্রর হাতে আবারও গুঁজে দিয়ে মায়াময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তুলি। নিমিষেই নিভে গেল আদ্রর রোষপূর্ণ অগ্নিময় চাহনি। তুলি কে টেনে এনে বিছানায় বসালো। নিজে বসে পড়ল তুলির সামনে হাঁটু মুড়ে। শাড়ি সরিয়ে পেটে চুমু খেল গভীরভাবে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে আদ্রর চুল খামচে ধরল তুলি। আদ্র তুলির পেটের দিকে চোখ জোড়া নিবদ্ধ করে, ম্লান হেসে বলে উঠল,
” তুমি চাও তোমার এই ছোট,কোমল পেটে আমাদের প্রণয়ের ফলস্বরূপ একটা কোমলপ্রাণ বেড়ে উঠুক?”
আদ্রের দৈবাৎ প্রশ্নে তুলি হকচকালো। ক্ষীণ লজ্জা অনুভব করল। তৎপরে আলগোছে সরিয়ে আনল হাত। গাল গুলো কেমন উত্তাপে গরম হয়ে এসেছে। এমন অস্বস্তি কেন হচ্ছে আমার?আমি নিজেই তো চাইছি ডাক্তার সাহেবের ভালোবাসা অস্তিত্ব রূপে আমার গর্ভে আসুক। মনে মনে আওড়াল তুলি। ডাগরডাগর আখিঁ পল্লব সরিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানালো। ঠোঁটে লজ্জালু রেখা স্পষ্ট প্রতীয়মান। ক্লান্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল আদ্র। তুলির হাত নিজের দু’হাতের ভাঁজে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললো,
” আমার চোখের দিকে তাকাও তুলা।”
অমান্য করল না তুলি আদ্রের আদেশ সূচক বাক্য। বুকে উঠা তোলপাড় সংযত করে চক্ষু স্থির করল আদ্রর নীল চোখের মণিতে। অন্যরকম কম্পন অনুভত হয় তুলির এই চোখ জোড়ায় চোখ রাখলে। দৃষ্টিতে প্রখর মাদকতা ভরপুর,সেই সাথে ফুটে আছে একরাশ মুগ্ধতা। ঘোর লেগে এলো তুলির। আদ্র অত্যন্ত শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
” কি দেখতে পাচ্ছো?”
” ভালোবাসা। ”
ঘোর লাগা কন্ঠেই বিনা সময় বিলম্বে তুলির দ্রুত প্রতুত্তর। জবাব দিয়ে সে নিজেই বিস্মিত। ঠোঁটে ছড়িয়ে হাসল আদ্র। তুলির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,
” ইয়েস ভালোবাসা। শুধু ভালোবাসা নয়,তুমি আমার অস্তিত্ব। আমার তুলার গর্ভে আমার অন্য এক ভালোবাসার আগমন ঘটবে এটা আমার জন্য জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া হবে। সত্যি খুব বড় পাওয়া হবে। কিন্তু তার জন্য যে আমি আমার তুলা কে কষ্ট দিতে পারব না । জেনেশুনে তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারব না। আমি পায়েলের সাথে কথা বলেছি তুলা। মনে নেই গত মাসে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে তুমি?পায়েল তখন জানিয়েছে তোমার শরীর খুব দুর্বল। এখন বাচ্চা নিলে তোমার জন্য রিস্ক। তাই পরীক্ষা অব্দি খেয়ে দেয়ে নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করো,আমি বিনা দ্বিধায় মেনে নিব। জাস্ট এটাই মনে রেখো তোমার নিঃশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তোমার ডাক্তার সাহেবের প্রাণ টিকে আছে। জীবনে কোনো এক মহৎ কর্মের উপহারসরূপ হয়তো মহান আল্লাহ তায়া’লা তোমাকে আমার জীবনে পাঠিয়েছেন। আমি বহু বছর বাঁচতে চাই। তাহলে কি করে নিজের প্রাণের রিস্ক নেই বলো?স্বার্থপর মনে হলে তোমার দৃষ্টিতে আমি স্বার্থপরই। কেননা আমার স্বার্থপরতার পিছনে একটাই লক্ষ্য আমি চিরকাল আমার তুলা কে আমার বুকে চাই। যদি তোমার ইচ্ছে হয় তাহলে কেঁড়ে নাও আমার প্রাণ।”
টুপ টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল তুলির চোখ থেকে। আদ্রের শেষ কথাটা তীরের মতো বিঁধেছে হৃদপিণ্ডে। কোনো কিছু না ভেবে আছড়ে পড়ল আদ্রর বুকে। আকস্মিক হামলে পড়ায় আদ্র তাল সামলাতে পারল না। তুলি কে নিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। তুলি চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল আদ্রর দিকে। অশ্রু সিক্ত কন্ঠে বললো,
” ডা. আদ্র আহনাফ দ্যা বেস্ট হার্ট সার্জন। শুনুন,,”
” শুনছি বলুন।”
” যদি একবারও আবল তাবল বকেছেন তবে আপনার হার্ট অসুস্থ হয়ে যাবে। ”
” যতদিন আদ্রের সংস্পর্শে তার কুমিল্লার তুলা আছে,ততদিন এই হার্ট একদম সবল থাকবে। ইনশাআল্লাহ। ”
হার্ট বরাবর নরম অধর ছুঁয়ে দিল তুলি। আদ্র তুখোড় দৃষ্টিতে তাকালো,যা দেখে নতজানু হয়ে উঠে পড়ল তুলি। ওই চোখে চোখ রাখার সাহস নেই আর। আদ্র উঠে একটানে তুলি কে কাছে টেনে নিল। আচমকা টানে তুলি দৃষ্টি ফেলার পূর্বেই আদ্র ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরল তুলির ওষ্ঠযুগলে। হতবাক, বিস্ময় তুলি। আদ্রর বুকে খামচে ধরল শক্ত করে। যতবার কাছে আসবে আদ্রর হাত,বুকে রক্তাক্ত করা যেন তুলির অভ্যেস হয়ে উঠেছে। আদ্রও মুখ বুঁজে সহ্য করে নেয় তার তুলার দেওয়া সূক্ষ্ম ব্যাথাটুকু। গলায় ঠোঁট ছুঁয়ে সরে এলো আদ্র। বুকে অয়েন্টমেন্ট লাগাতে লাগাতে বললো,
” ট্রাস্ট মি তুলা, তুমি বুকে ঝড় না তুললে আক্রমণ করতাম না তোমাকে।”
ব্যাস আদ্রর এইটুকু কথাই যথেষ্ট তুলির মুখে রক্তিম আভা ছড়ানোর জন্য। শাড়ি ঠিক করে চলে যেতে নিলে পা বাড়িয়েও ফিরে এলো আবার। আদ্রর ওয়ালেট বের করে দিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। আমতা আমতা করে বললো,
” রিমি আপুর তো প্রেগন্যান্সির তিন মাস রানিং। কই ওনার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছেন।”
তড়তড় করে মাথায় রাগ চড়ে বসল আদ্রর। বুঝে গেল তুলি কে যতই বুঝানো হোক না কেন এই মেয়ে বুঝবে না। বুঝার চেষ্টাই করছে না। আজকাল রাগ দেখাতে গেলেও এই মেয়ের মুখ দেখে সবটুকু রাগ উবে যায়। অভ্যন্তর, মস্তিষ্কে সব জায়গায় জুড়ে হিম শীতল হাওয়া বয়ে যেতে থাকে। শার্টের বোতাম গুলো লাগিয়ে কলার ঠিক করে নিল আদ্র। জবাবের আশায় দাঁড়িয়ে থাকা তুলির দিকে নজর দিয়ে বলে উঠল,
” তুমি বড় নাকি রিমি বড়?”
” রিমি আপু।”
” তোমার আগে বিয়ে হয়েছে নাকি রিমির বিয়ে হয়েছে? ”
” রিমি আপুর।”
” বিয়ের কয় বছর পর বাচ্চা হচ্ছে রিমির?”
” দু’ বছরের মাথায়।”
” তোমার বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে ক’ মাস হয়েছে? ”
তুলি একটু ভাবল। হিসেবে করে উত্তর দিল।
” নয় মাস।”
” এক্সাক্টলি। রিমি যেহেতু বিয়ের দু’বছরের মাথায় কন্সিভ করেছে তাহলে তোমার এতো অধৈর্য হওয়ার কিছু নেই বউ। সবুর করো। ”
একটু থেমে হাসি মুখে বললো আদ্র,
” ইউ নো না? সবুরে মেওয়া ফলে।”
তুলি এতোক্ষণে ঠাওর করতে পারল রিমির উদাহরণ দিয়ে তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়েছে আদ্র। বিয়ের দেড় বছরেও তো সাগর-রিমির মাঝে ছিল অভিমানের দেয়াল। যেই দেয়াল ভেঙ্গেছে তুলিদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। মনে মনে বললো,আমি তো অবুঝ নই আদ্র। আমার বেবী লাগবেই লাগবে। মনের জাগ্রত অনুভূতি কে সায় দিয়ে আদ্রের কথার প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ করে বলে উঠল,
” কিন্তু ফুলশয্যা তো আমাদের হয়েছে আগে।”
সাথে সাথেই ভ্রুঁ উঁচিয়ে চাইল আদ্র তুলির দিকে। তুলি নিজের কথায় নিজে ফাঁসলো। মুখ চেপে ধরল শক্ত করে। এটা কি বলল সে। কিভাবে হতে পারল এতোটা নির্লজ্জ! আদ্র কে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে পিছিয়ে ধপ করে খাটে বসে পড়ল। তুলির দু দিকে দু-হাত রেখে ঝুঁকল আদ্র। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল তুলি। হৃদস্পন্দনের শব্দ বিনা বাঁধায় আদ্রর কর্ণধার হচ্ছে ক্রমাগত। হুট করে আদ্র নিজের অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন অনুভব করল। তুলি কে বিব্রত করার জন্য নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আওড়ালো,
” তুমি বলতে চাচ্ছো, আমাদের ফুলশয্যায় ঘাটতি ছিল?”
# চলবে,,,
( ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন। পরবর্তীতে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।)
p.c: Tayeebur Rahman Tayeeb