#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৩৬
ঝড় বিদায় নিয়েছে। শুকিয়ে গেছে তুলির চোখের নোনাজল। বুকে কেবল বিরাজমান তীব্র আর্তনাদ। এই আর্তনাদ তুলির নিজের জন্য নয়। এই বুক ফাটা আর্তনাদ মাঠে বসে আর্তচিৎকার করা অন্তুর জন্য। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে হারানোর বেদনায়। প্রকৃতির নিরবতা ভেঙে বিলিয়ে দিচ্ছে চাপা কষ্ট গুলো কে। অহরহ অল্প তে চোখের জল ঝরানো তুলির ডাগর আঁখিতে এক ফোঁটাও অশ্রু নেই। চোখ দুটো শান্তভাবে অপলক দেখে যাচ্ছে অন্তু কে। ছেলে টা দুই পা ভেঙে আনত মস্তকে বসে আছে। চোখ থেকে টুপ টুপ করে গড়ানো অশ্রু ধরা দিচ্ছে তুলির দু’নয়নে। লাল তরল চোখে বিঁধতেই পাশে উপস্থিত আদ্রর হাত টা খামচে ধরল তুলি। আঁতকে উঠা গলায় বললো,
” র,,রক্ত ঝরছে আদ্র। অন্তু ভাইয়ার চোখের পাশ থেকে রক্ত ঝরছে। কপাল থেকেও,,”
তুলি কে আর বলতে দিল না আদ্র। টেনে বুকে চেপে ধরল শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে। তুলির ব্যথা হচ্ছে তবে দেহে আদ্রের চাপে নয়,অন্তুর ঝরে পড়া রক্ত দেখে। এত বিরহ প্রণয়ে!পায়েল কি এক ফোঁটাও ভালোবাসে নি অন্তু কে? ভেসেছে তো। তুলি স্পষ্ট ভালোবাসা দেখেছে পায়েলের অক্ষিপটে। মুখ যদি মনের দর্পণস্বরূপ হতো তবে মুখে কিছু প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ত না,আর না মনে চাপা পড়ে থাকত হাজারো অব্যক্ত অনুভূতি। আদ্রর বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠল তুলি। এতো সময় অব্দি এক বিন্দুও জল গড়ায় চক্ষু কোটর হতে। পাথরের ন্যায় নির্জীব রূপ ধারণ করে রেখেছিল। আদ্রর বুকে যেতেই সমস্ত কষ্ট উগড়ে উঠলো। মনটা নেতিয়ে পড়ল প্রকটভাবে। ফুঁপানো, অস্পষ্ট স্বরে বললো,
” ডাক্তার সাহেব, কিছু করুন প্লিজ। কিছু করুন। আমি পারব না এই কষ্ট সহ্য করতে। অন্তু ভাইয়া মরে যাবে তো। দেখতে পাচ্ছেন না আপনি কতটা কষ্ট হচ্ছে উনার। কেমন করে কাঁদছে, আপনার বন্ধুর জন্য, আপনার বুকটা কাঁপছে না? ব্যথা করছে না,,”
চোখের পাতায় ভেজা অনুভব করতেই তুলি তড়িৎ গতিতে মুখ তুলে চাইল আদ্রর পানে। সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ চিরে ঝলক দেওয়া বিদ্যুতের আগুনের ন্যায় তুলির বুক চিরে বিষাক্ত যন্ত্রণা সর্বাঙ্গ দেহে বিস্তার লাভ করল। তার ডাক্তার সাহেবের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছে এই জল টুকু। আদ্র কন্ঠ নরম রেখে বললো,
” গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি অন্তু কে নিয়ে আসছি।”
মলিন,বিবর্ণ মুখে সম্মতি জানিয়ে তুলি মন্থরগতিতে হেঁটে এসে গাড়িতে বসল। চারদিকে অন্ধকারে থৈ থৈ করছে। বৃষ্টি না থাকলেও কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে পড়েছে নীল বর্ণী গগণ। গাড়ির হেডলাইটের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকখানি জায়গাজুড়ে। সেই আলোতে তুলি নিমেষ চেয়ে আছে আদ্রর যাওয়ার পথে। মৃদু বাতাসে শিরশির করে উঠল তুলির দেহ। বৃষ্টি একা যায় নি বরং সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সঙ্গী করে নিয়ে গেছে আগুন ঝরানো উত্তাপ কে। ধরণীতে ঢেলে দিয়েছে শীতলতা। একটু জড়োসড়ো হয়ে বসল তুলি। ব্যথিত নয়ন জোড়া স্থবির করল পাশাপাশি বসে নিরবতায় মুহূর্ত কাটানো দুই বন্ধুর দিক।
‘দৈবক্রমে যদি বেড়ে যায় অন্তরস্থ পীড়ন,তবে তা সহ্য করতে নেই। সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে নিজের প্রাণ ত্যাগ করা বোকামি, নিহাতই বোকামি। ‘
অন্তু এক পলক তাকালো আদ্রের মুখের দিকে। আনতস্বরে বললো,
” একটু পানি খাওয়াবি আদ্র?”
জবাবে হ্যাঁ বা না কোনো রূপ প্রতুত্তর করল না আদ্র। উঠে গেল পাশ থেকে। বড় বড় পা ফেলে তুলির কাছে এসে ঝুঁকল। অত্যন্ত শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” ঠান্ডা লাগছে তুলা?”
” হুম।”
” গাড়িতে পানির বোতল আছে। দাও তো।”
নিঃশব্দে পানির বোতল টা আদ্রর হাতে তুলে দিল তুলি। মুহুর্তেই সূক্ষ্ম কম্পন অনুভত হলো হৃদপিণ্ডে। হাত টা মুঠোয় আঁকড়ে শুষ্ক অধর যুগল পুনরায় বুলালো আদ্র। গালে ঠান্ডার হাতের ছোঁয়া দিয়ে স্মিত হেসে বলে উঠল,
” সব ঠিক করে দিব ইনশাআল্লাহ। গাড়ির জানালা লাগাও। জ্বর বাঁধালে কষ্ট পাব তো। এতগুলো কষ্ট আদৌ কি মানতে পারবে মন!তুৃমি আমার অস্তিত্ব। অন্তু,রিমি,সাগর,পায়েল,নিবিড় আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।”
অপলক চেয়ে রইল তুলি। চেয়ে রইল নির্নিমেষ দৃষ্টি ফেলে। প্রশান্তিরা জড়ো হয়ে বাসা বেঁধেছে মনের সবটুকু অংশ জুড়ে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত নয় সে, তবে তার ডাক্তার সাহেবের কথায় তার অগাধ বিশ্বাস।
ঢকঢক করে বোতলের প্রায় অর্ধেক পানি পান করে ফেলল অন্তু। চোখে মুখে পানি ছিটানো মাত্রই প্রকট জ্বলনে দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। সহ্য করে নিল কিছুটা সময় নিয়ে। পকেট থেকে রুমাল টা এগিয়ে দিল আদ্র। অন্তু হাতে নিয়ে ধরা গলায় বললো,
” পায়েলের বিয়ের কথা শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি। বিয়ে তো আগেই ঠিক করা তবু আজও সেটা মেনে নেওয়া হয়ে উঠে নি আমার। শুধু এটুকু মনে হয়েছে পায়েলের চলে যাওয়াতে আমার জীবনের হাসি টা হারিয়ে যাবে। ঝড়ের তান্ডবের চেয়েও আমার ভিতরের তোলপাড় অত্যাধিক ছিল। চোখ ঘোলা হয়ে আসছিল বার বার। তারপর ছোটখাটো এক্সিডেন্ট। সামনের গাড়ির ড্রাইভার টা ভালো ছিল,হয়তো মায়া হচ্ছিল তাই কল লিস্টে তোর নাম্বার পেয়ে তোকে জানাল। তবে আমি খুশি হতাম আমার অবস্থা যদি খুবই বিধস্ত হতো,শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেত। ইচ্ছাকৃত তো মৃত্যুবরণ করতাম না। অনিচ্ছাকৃতই যদি হয়ে যেত,মুক্তি মিলতো আমার। মুক্তি মিলত হৃদয়ে দানা বেঁধে রাখা যন্ত্রণার।”
” হার মেনে নিলি?তুই আসলেই একটা ফালতু লোক অন্তু।”
তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বললো আদ্র। বিনিময়ে অন্তু আদ্রর কাঁধে হাত রেখে স্মিত হাসল। অবিশ্রান্ত নিঃশ্বাস কে মুক্তি দিয়ে বললো,
” আই নো ভাই। শুধু মাত্র তোদের জন্য, পায়েলের জন্য অন্তু চিরকালই ফালতু উপাধিতে ভূষিত হতে রাজি। আমার হার মানার মাঝে অসম্ভব শান্তি লুকিয়ে আছে,কারণ আমার পায়েল বাবার রাজকন্যা হিসেবে জিতে গিয়েছে। আমি জানি পায়েল আমাকে ভালোবাসে। আমি ততটাও বোকা নয় যে কারো নেত্রে ভাসমান ভালোবাসা আমার চোখে পড়বে না। আমি এটাও জানি পায়েল মেডিক্যাল এর প্রথম থেকেই আমার মনে ওর জন্য সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিটা আঁচ করতে পেরেছিল। কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবতা এমন হয় দু’টো মানুষের অপ্রকাশিত ভালোবাসা জীবনের সমীকরণে চিরকাল অপ্রকাশিত রয়ে যায়। অভিক পায়েলের জীবনে আগে এসেছে আমি নয়। পায়েল তো ভুলবশত মন দিয়ে ফেলেছে আমায়। আজ যদি আমরা দু’জন একসাথে হয় তবে অন্যায় হবে অভিকের সাথে। বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাবে পায়েল তার বাবার কাছে। অভিকের বাবার সাথে ওনার বন্ধুত্বে ফাটল ধরবে। এসব উনি মানতে পারবেন না। তাই নিতে পারলাম না রিস্ক। কিছু সম্পর্ক ঠিক রাখতে বিসর্জন হোক মনের হাজারো অব্যক্ত অনুভূতি। আমি জানি পায়েল একদিন অনেক সুখী হবে,অনেক। আমিও হব। পায়েলের সুখীতে সুখী।”
শেষ কথা টা বলতে গিয়ে অন্তুর কন্ঠ জড়িয়ে এলো। তাৎক্ষণিক উঠে দাঁড়াল। আদ্র বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অন্তুর দিকে। অন্তুর এই রূপ তো কেউ দেখে নি। কারোই চোখে পড়ে নি এতো বছরের বন্ধুত্বে। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে অন্তুর সাথে হেঁটে আসল গাড়ি পর্যন্ত। ড্রাইভিং সিটে বসতেই অন্তু পিছনে উঠে বসল। দাঁত কেলিয়ে বললো,
” আমার গাড়ি তো অক্কা পাওয়ার পথে। তোদের সাথেই যায়।”
হতভম্ব চোখে তাকাল তুলি। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা কি সেই ছেলে যে কিনা না পাওয়া ভালোবাসা হারানোর বেদনায় চিল্লিয়ে কাঁদছিল!এক আকাশ অবাকতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল তুলি কে। আদ্র গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ফাস্ট এইড বক্স টা বাড়িয়ে দিল অন্তর দিকে। একটা ফাস্ট এইড বক্স গাড়িতে থাকে সবসময়। প্রয়োজন হতে পারে ভেবে রেখে দেয় আদ্র। সাথে সাথেই এক প্রকার ছিনিয়ে নিল অন্তু বক্সটা। ভাব এমন যেন ব্যাথা সহ্য হচ্ছে না তার। কিন্তু কিছু সময় আগে এই ছেলেটাই বৃষ্টি তে ভিজে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করেছে। তুলির হতবিহ্বল দৃষ্টি দেখে আলতো হাসল অন্তু। হেসে উঠে বললো,
” আমাকে কি খুব খারাপ দেখাচ্ছে তুলি?গেল আমার এতো সুন্দর চেহারা টা। শীগ্রই ঠিক করতে হবে নয়তো পায়েলের বিয়েতে সুন্দর সুন্দর রমনী পটানো হবে না আমার। জীবন টাই আমার বৃথা।”
তুলির কি হলো সে নিজেও জানেনা। অন্তুর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বললো,
” আপনি খুব স্ট্রং ভাইয়া।”
” তবুও তোমার জামাইয়ের চোখে আমি ইডিয়ট, ফালতু।”
অন্তুর হাসিমুখের কথা শুনে তুলির ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। পুরোপুরি পিছনের দিকে ঘুরে ব্যান্ডেজ লাগাতে খানিকটা সাহায্য করল অন্তু কে।
__________
হলুদে কালো শাড়ি কে পড়ে!তুলির মুখে লেপ্টে আছে দুঃখ দুঃখ ভাব। এক তো পায়েলের বিয়ে নিয়ে মনে সৃষ্ট হয়েছে দুঃখের সাগর তার উপর কালো শাড়ি পড়ার আবদার করে আদ্র দুঃখের সাগরে দুই ফোঁটা দুঃখ ঢেলে দিল। এমনিতেই গায়ের রং শ্যামলা। কালো শাড়ি পড়লে মনে হবে গায়ে হলুদে ভূতের আগমন ঘটেছে এটাই তুলির বর্তমান ধারণা।
#চলবে,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।)
পিক ক্রেডিটঃ Sumaiya akter🖤