#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৩৭
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বিস্ময়ে হতবাক তুলি। এতক্ষণের মন খারাপের রেশ হুট করেই উবে গেল। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের উপর হাত রেখে মিনমিন করে বললো,
” কালো জামদানি তে শ্যামলা মেয়েদের এতো অমায়িক লাগে!এতো কাল কেন চোখে পড়ে নি আমার?আমি তো কখনও কালো শাড়ি পড়ি নি। তবে কি আমার ডাক্তার সাহেবের কল্পনায় এতোটা সুন্দর আমি?”
আনন্দপূর্ণ হাসি ফুটে উঠল তুলির চোখে মুখে। চুল গুলো খোঁপা করে বকুল ফুলের মালা টা পেঁচিয়ে নিল। দু’হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি তুলির হাত নাড়বার তালে তালে রিনঝিন আওয়াজ তুলছে পুরো উদ্যমে। আমরিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। একটু থেমে হেসে বললো,
” ঠিকি তো পড়লি। শুধু শুধু আমার ভাই কে এতো সময় যাবত গালাগাল করলি। এখুনি নিচে যাবো এখুনি গিয়ে ভাই কে বলব।”
আমরিনের কথায় আঁতকে উঠল তুলি। তড়িঘড়ি করে বললো,
” আমি কিন্তু তোর বেস্ট ফ্রেন্ড, ভাবী,খালাতো বোন। পারবি এই তিন তিনটে সম্পর্কের সাথে বেইমানি করতে?এতো বেইমান তুই আমরিন!ভাবতেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।”
” হয়েছে আমাকে দমানোর জন্য আর নাটকের প্রয়োজনীয়তা নেই ভাবী সাহেবা। চলুন এবার। পায়েল আপু কে নিচে নিয়ে যেতে হবে।”
তুলি ও আমরিন দু’জনে একসাথে রুমে প্রবেশ করে স্তব্ধ। পায়েলের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টি তাক রেখেই পার হল কয়েক মুহুর্ত। শুভ্রতার রঙে মুড়ানো পায়েল কে দেখে চোখ ধাঁধিয়ে আসছে সকলের। মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। তবুও চেহারায় মায়ার ছড়াছড়ি। হাসি টা থাকলে বোধহয় চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ত সকলের পক্ষে। সাদা একটা সিল্কের শাড়ি পড়েছে পায়েল। পুরো মেকআপ সাউথ ইন্ডিয়ান নায়িকাদের বিয়ের সাজের মতো। তুলি ভেবেই কুল পাচ্ছে না গায়ে হলুদে কেউ অমন করে সাজে!কি অপরূপ সৌন্দর্য্য ফুটে আছে পায়েলের মধ্যে, তা বলেও প্রকাশ করা কঠিন তুলির জন্য। সন্ধ্যা থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করে নি পায়েল। পাথরের মতো স্থির বসে আছে। রিমি,তুলির নিকট পায়েলের এই মৌনতা পালনের কারণ অজানা নয়। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে তুলিসহ সবাই পায়েলকে নিয়ে দরজার কাছে আসতেই পা থেমে গেল। মুখশ্রী তে দৃশ্যমান হলো উৎসুকভাব।
আদ্র,নিবিড়, সাগর,অন্তু দাঁড়িয়ে আছে অভিমুখে। হাতে সাদা একটা ওড়না। সাগর,অন্তু,নিবিড় সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। আদ্রর ফর্সা শরীরে কালো রঙের পাঞ্জাবি টা ফুটন্ত কালো গোলাপের মতো। তুলির প্রখর স্পৃহা জাগল ফুটন্ত গোলাপ কে ছুঁয়ে সবটুকু সুবাস নিজের মধ্যে টেনে নিতে। কেমন হবে সুবাস টা?নিশ্চয়ই উম্মাদ করে তুলার মতো। ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে অন্তু পায়েলের কাছে এসে দাঁড়াল। দাঁত দেখিয়ে বললো,
” মাশাল্লাহ। আমার কথা শুনার ফায়দা পেয়েছিস?আয়নায় দেখেছিস নিজেকে?সাউথ ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতো হহহ,,,”
পায়েলের তীক্ষ্ণ চাউনিতে থমকে গেল অন্তু। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বললো,
” এভাবে তাকালে কলিজা ছোট্ট হয়ে যায় রে পায়েল। অত্যন্ত বিয়ের আগের রাতে একটু রহম কর আমার উপর। এতগুলো বছর তো বেশ টর্চার করলি। তোর তো আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত আমার সাজেশনে তুই ডাকিনী থেকে সাদা পেত্নী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিস।”
অগ্নিকুন্ডের ন্যায় জ্বলে উঠল পায়েল। দীর্ঘ সময় আঁকড়ে ধরা মৌনতা ভেঙে গেল নিমিষেই। উঁচানো স্বরে দাঁত কিড়মিড় করে প্রতিবারের ন্যায় ঝাঁঝের সহিত বলে উঠল,
” অন্তুর বাচ্চা সন্তু। খুন করব তোকে।”
” আমার আত্মার খুন তো করেছিস তুই বহু আগে।”
আনমনে,ক্ষীণ স্বরে আওড়ালো অন্তু। ঠোঁটে বহমান হাসি নিয়ে বললো,
” তোকে রাগিণী রূপে ভীষণ ভালো লাগে। এটার অভাব ছিল তোর মাঝে। পূর্ণ করে দিলাম। আবার অতিরিক্ত জ্বলে উঠিস না পরে আবার দেখবি তোকে হনুমান,হনুমান লাগছে।”
শেষমেশ পায়েলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেই গেল। ধুম করে কিল বসিয়ে দিল অন্তুর বুকে। ব্যাথায় আহ্ করে মৃদু চিৎকার করে উঠল অন্তু। সেই সাথে চারদিকে পড়ে গেল হাসির রোল। অন্তুর চিৎকারে কর্ণপাত করছে না পায়েল। পিছন থেকে পিঠে কিল বসানো মাত্র সুপুষ্ট হস্তে আটকানোর প্রয়াসে কিছু টা কাছে টেনে নিল অন্তু। চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে বেচারার। তবুও হাসতে হাসতে বললো,
” মেরে মেরে মাংস খুবলে নিয়ে কংকাল বানানোর ধান্ধা?ব্যাথায় চিৎপটাং হয়ে থাকলে তোর বিয়েতে মেয়ে পটাবো কেমন করে? তুই চিরকালই আমার সাথে শত্রুতা করে গেলি। পারলে অভিক কে মেরে দেখাস। দেখব সহ্য করে কিনা। লাথি যদি না খেয়েছিস তবে আমার অন্তু না,সন্তু হবে।”
” কিভাবে করবে?অভিক তো অন্তু নয়। কোনো কালে হতেও পারবে না। ”
মনে উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ, বর্ণ পায়েল মনেই সুপ্ত কোণে সঞ্চিত রেখে দিল। মুখে বললো,
” বেশি ব্যাথা লেগেছে?”
” মেরে মেরে ঢং দেখানো হচ্ছে। আমি কি বুঝিনা?যদি বলি পেয়েছি তাহলে তুই তো আরও কষিয়ে দিবি।”
এবার আর না হেসে পারল না পায়েল। ঠোঁট ছড়িয়ে হেসেই দিল। অন্তু নিচু স্বরে বলে উঠল,
” এটারও অভাব ছিল। অবশেষে মনের শেষ চাওয়া টা পূর্ণ হল। দেখার সৌভাগ্য হল তোর গোলাপি ঠোঁটের স্নিগ্ধ,নির্মল হাসি টুকু।”
তুলি নিষ্পলক তাকিয়ে রইল পায়েল ও অন্তুর দিকে। অপ্রকাশিত, খুনশুটিময় ভালোবাসার ইতি ঘটবে এই রাত টা পোহালেই,মনে পড়লেই তুলির বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে চায়। এই যে,এই মুহুর্তে চোখ দুটো জলে টুইটুম্বুর হয়ে উঠেছে,অশ্রু কণারা গলায় আটকে আছে অথচ চেয়েও তুলি মুক্তি দিতে পারছে না তাদের। দম টা বন্ধ হয়ে আসছে তুলির। কোমরে আকস্মিক স্পর্শে শিউরে উঠল। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। পাশ ফিরে দেখল আদ্র দাঁড়িয়ে। চক্ষুদ্বয়ের প্রখর দৃষ্টি কেবল তার দিকেই নিবদ্ধ। লজ্জা অনুভব করল তুলি। চোখ এদিকে সেদিকে বুলিয়ে দেখল সবার দৃষ্টি পায়েল,অন্তুর দিক। তবুও পাছে যদি কেউ দেখে ফেলে? তাই তুলি সংকোচ নিয়ে কিছু একটা বলার নিমিত্তে উদ্যত হলো। কিন্তু কন্ঠস্বর বাঁধা পড়ল আদ্রর কাছে। তুলির রক্ত হিম হয়ে গেল। ক্রমশই তার দিকে ঝুঁকে আসছে আদ্র। ভয়ে তিরতির করে কাঁপছে তার ঠোঁট দুটো। আদ্র কি পাগল হয়ে গেল?সবার সামনে?আঁতকে উঠল তুলি। মুখ ফিরিয়ে নিল তৎক্ষনাৎ। কর্ণে এলো আদ্রর লহু স্বর।
“সুন্দর লাগছে তুলা।”
অতি সামান্য একটা বাক্য। অথচ কি মারাত্মক ভাবে প্রভাব ফেলল তুলির ছোট্ট মনে। হৃদয়ের গহীনে তোলপাড় সৃষ্ট করল নিমেষ। বক্ষস্থল কেঁপে উঠল সাংঘাতিকভাবে। অতঃপর তুলির মনে হলো শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে, ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। এবং ভয়ংকরভাবে তাকে লজ্জায় ডোবানোর জন্য প্রস্তুত থাকে তার ডাক্তার সাহেব। তৎপরে মনে হলো তুলির অন্তস্থলে প্রতি প্রহরে কম্পন ধরানোর দায়িত্ব নিয়েছে আদ্র।
সাদা ওড়না টা মেলে ধরল আদ্র,সাগর,নিবিড়,অন্তু। চারকোণায় চারজন দাঁড়িয়ে পায়েল কে দাঁড় করাল মাঝে। এতো কষ্টের মাঝেও বন্ধুদের ভালোবাসায় তার অক্ষিকোটর হতে অশ্রু ঝরে পড়ার অভিপ্রায়। সিঁড়ি বেয়ে একে একে নেমে এল সবাই। পায়েলের বাবা দাড়িয়ে ছিলেন সিঁড়ির মুখে। মেয়ের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন। প্রত্যেক বাবার নিকট তার মেয়ে রাজকন্যা কিন্তু পায়েল শুধু রাজকন্যা নয় বরং উনার প্রাণ।
বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে সবার মন টা প্রশান্তিতে ভরে গেল।
বাহির থেকে পায়েলের চাচাতো বোন নিহা দ্রুত গতিতে ছুটে আসল। রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল,” অভিক ভাইয়াদের বাড়ি থেকে লোকজন চলে এসেছে ছোট আব্বু।”
কথাটা শোনামাত্র ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। আদ্র দের উদ্দেশ্যে বললেন, ” তাড়াতাড়ি পায়েল কে নিয়ে স্টেজে বসাও আদ্র। উনাদের পায়েল কে হলুদ লাগানোর জন্য আসার কথা ছিল। এসে গেছেন। বরণ করতে হবে তো। তাড়াতাড়ি করো বাবা।”
পায়েল কে স্টেজে বসিয়ে তুলি একবার দেখে নিল সব ঠিকঠাক আছে কিনা। আদ্র খাবারের দিক টা দেখে আসল। যেহেতু পায়েলের অভিভাবক বলতে শুধু তার বাবা তাই নিজেদের উপর সব দায়িত্ব নিয়েছে আদ্ররা। প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা। পায়েলের বড় চাচা বছর খানেক আগে হৃদরোগে মারা গেছেন। বাবার শরীরটাও খুব একটা ভালো না। দু’ দুই বার কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে উনার। তাই তো পারে নি পায়েল এই বিয়ে হতে পিছিয়ে যেতে। ভয় হয়। ভয়ংকর ভয় হয় বাবা কে হারানোর। একদিকে বাবা, অন্যদিকে অন্তু। বাবার মন জিততে পারলেও অন্যদিক থেকে নৃশংসভাবে হেরেছে সে। ছুরি গেঁথেছে হৃদপিণ্ডে নিজের হাতে।
আদ্র স্টেজে এসে তুলির পাশে দাঁড়াল। পায়েল,অন্তু,রিমি,নিবিড়, সাগরের দিকে নজর যেতেই দেখল সবাই বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনের দিকে। হুট করে সবার এমন দৃষ্টি পাতের কারণ তুলি পর্যন্ত ঠাওর করতে ব্যর্থ হলো। সবার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাল আদ্র। মুহুর্তে ভ্রুঁ কিঞ্চিত কপাল স্পর্শ করল। সামনের মানুষ টা হলুদ লেহেঙ্গা টা আঁকড়ে ধরে দৌড়ে উপস্থিত হল আদ্রর কাছাকাছি। কেউ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই মেয়েটা আদ্রর হাত ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বিস্তর হেসে জিজ্ঞেস করল,
” কেমন আছো আদ্র?”
মুহুর্তেই তুলির মনে হলো কেউ তার গলা টিপে ধরেছে। আকস্মিক হৃদপিণ্ডের প্রবল ধাক্কায় পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল। বিষাক্ত যন্ত্রণার বিষ দেহের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল ইতিমধ্যে। আদ্রর দিকে ব্যথিত নয়ন জোড়া স্থবির করতেই বক্ষে কাটা হয়ে বিঁধল ঠোঁটের কার্ণিশে বহমান হাসি। না চাইতেও তুলির চোখের কোল ভিজে উঠতে লাগল বারংবার। ঠোঁট ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর খুব চেষ্টা তার। কিন্তু অশ্রু কণা তুলি কে ভেঙে চুরমার করে,দুর্বল করে ছুটে আসতে চাইল এবং তা গড়িয়েও পড়ল গাল বেয়ে অতি সন্তর্পণে।
#চলবে,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
p.c: Sumaiya akter