আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-৩৯

0
2372

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৩৯

নিকষকৃষ্ণ রজনীর প্রহর চলছে। বাহিরে বইছে নির্মল পবন। এ যেন শুধু নির্মল নয় সুখের হাওয়া ও বটে। সুখময় হাওয়া বয়ে চলেছে মানব মনের দুয়ারে দুয়ারে। কখনও কখনও মনের দুয়ারে খুলে প্রবেশ করছে গহীনে, জানান দিচ্ছে নিজস্ব অস্তিত্ব। রুমের পর্দা গুলো মৃদু মৃদু উড়ছে বাতাসের দাপটে। চার দেয়ালের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ছে ফুলের সুবাস। আহা কি মনোমুগ্ধকর সুবাস টুকু!বিশেষ করে সাদা গোলাপের ঘ্রাণ তুলির মন নাড়িয়ে দিচ্ছে,খুব করে টানছে নিজের কাছে। ডাগরডাগর শান্তিপূর্ণ আঁখি মেলে তুলি ফুলশয্যার ঘর সাজানো অবলোকন করতে মগ্ন। তবে তার মগ্নতা বার বার নষ্ট করতে চাইছে ফুলগুলোর মনোমুগ্ধকর,মন মাতানো সুবাস।

আদ্র,নিবিড়, সাগর মিলে রুম টা সাজাচ্ছে। তুলি কখনও কারো বাসর সাজানো দেখে নি। তাই তো অদ্ভুত হলেও স্পৃহা জাগল বাসর ঘর সাজানো দেখবে। যদিও লজ্জায় ভুগছে মন,তবুও গুটিসুটি মেরে বসে আছে এক কোণে। আচমকা আদ্রের কন্ঠস্বর শুনে চমকে তাকাল তুলি। দেখল আদ্রর হাতে একটা শুভ্র সাদা গোলাপ। দেখা মাত্রই চকচক করে উঠল তুলির চক্ষু যুগল। নেত্রে গোলাপের ন্যায় ফুটে আছে অনাবিল আনন্দ। কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিহীন আদ্রর হাত থেকে ফুল টা নিয়ে নিল। নিমিষেই নাক ডুবিয়ে সবটুকু সুবাস টেনে নিল নিজের মাঝে। অথচ একটা বার জানতেও চাইল না ফুল টা তার জন্য কিনা!মুখ তুলে আদ্রর দিকে চেয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। লজ্জা লুকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে বলে উঠল,

” গোলাপ টা কি আমার জন্য না?”

” দেওয়ার আগে যখন ছিনিয়ে নিলে তবে সেটা তোমারই।”

মুচকি হেসে প্রতুত্তর করল আদ্র। শার্টের হাতা দু’টো ভালো করে ফোল্ড করে তুলির পাশের টুলে বসে পড়ল। তুলি এই মুহুর্তে একটা চোখ জুড়ানো দৃশ্য হৃদয়পটে গেঁথে নিল। ভালো লাগে তার কাছে। খুব ভালো লাগে যখন আদ্র শার্টের হাতা গুটিয়ে নেয় তার সামনে। এই মানুষ টার সবকিছুই তার খুব পছন্দ। যদি কখনও পরস্পর পাশাপাশি দাঁড়ানো হয় আরশির সামনে তখনও তুলি শুধু আরশিতে আদ্র তেই বিমোহিত থাকে। সেই সাথে কতশত নতুন নতুন অনুভূতির সাথে যে পরিচয় হয় তুলির তার হিসেব সে কোনো কালেই রাখে নি। এতো এতো অনুভূতির হিসাব রাখা তুলির পক্ষে অসম্ভব। কেননা সে তো রোজ রোজ প্রতি মুহুর্তে, প্রতি ক্ষণে, প্রতি সেকেন্ডে পরিচয় লাভ করে নয়া নয়া অনুভূতির সঙ্গে।

তুলি শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবল। রুমের চারদিকে নজরকরণ করে কিছু একটা মিসিং মিসিং ঠেকল তার নিকট। কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করল আদ্র কে বলবে কিনা। কিন্তু বললে বেশ হতো,রুমটা দেখতেও ভালো লাগত। সময়টা খুবই সল্প,হুট করেই তো হয়ে গেল সবকিছু। অতি অল্পতে কাহিনি টা ঘটে গেলেও খুশি টা চিরকালের জন্য চিরস্থায়ী হয়েছে। তুলি আলতো হেসে লজ্জাসংকোচ ধাবিয়ে ফেলল। আদ্রর ঘা ঘেঁষে বসল কিছুটা। ক্ষীণ স্বরে ডাকল,

” ডাক্তার সাহেব! ”

তুলির দিকে নজর নিবদ্ধ করে বিস্তর হাসল আদ্র। কোমল স্বরে সাড়া দিয়ে বললো,

” বলুন বউ।”

তুলির চোখ বুঁজে এলো আবেশে। এই যে কথায় কথায় আদ্র বউ বলে,তুলা বলে ডেকে উঠে একবারও কি অনুধাবন করার প্রয়াস চালিয়েছে তুলির বক্ষস্থলের প্রকান্ড ঝড়?চেষ্টা করেছে কি প্রবল কম্পন অনুভত করার?করেছে হয়ত। নয়তো তার দিব্যি জানা আছে তুলির বুকে কিভাবে তোলপাড় সৃষ্টি করতে হবে। পিটপিট করে নেত্রপল্লব মেলে তুলি পুনরায় প্রস্তুত হলো মনে সদ্য উদয় হওয়া কথাটুকু ব্যক্ত করার লক্ষ্যে। আমতা আমতা করে বললো,

” ফুলশয্যার ঘর,,”

” তোমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে তাই না?”

মুহুর্তেই তুলির কপালে ভাজ পড়ল। আঁখিপল্লব ললাটে স্পর্শ করল কিঞ্চিৎ। বিস্ফোরিত নয়ন জোড়া নিক্ষেপ করল আদ্রর দিকে। ছোট্ট করে বললো,

” হু। কিন্তু! ”

আদ্র দৃষ্টি গভীর করল। সবার অগোচরে কোমর জরিয়ে কাছে নিয়ে এলো তুলিকে। সমস্ত দেহে শিহরণ খেলে যেতে লাগল তুলির। সবার সামনে লজ্জায় রাঙা হতে গিয়েও চুপসে যাচ্ছে সে। বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। আদ্রর দিক করুণ চাহনি ফেলতেই বাঁকা হাসল আদ্র। ফিচেল স্বরে বলে উঠল,

” পছন্দ হলে পুনর্বার আমাদের কক্ষ টাকে বাসর ঘরে পরিণত করবো। লাল টকটকে বেনারসিতে জড়িয়ে আমার এই প্রশস্ত বক্ষে পুনরায় আবদ্ধ করবো তোমাকে। অতঃপর লজ্জায় স্থবির হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকবে তুমি যখন আমি চেয়ে থাকব তোমার পানে অহর্নিশ। বক্ষস্থলের তান্ডব যখনি সামলাতে ব্যর্থ হব আমি তখনই একটু একটু করে অনেকখানি, গভীরভাবে ছুঁয়ে দিব তোমাকে,এঁকে দিব যত্ন করে আমার ভালোবাসার প্রলেপ।”

ঘোরের মাঝে ডুবে যেতে লাগল তুলি। কথাগুলো কর্ণ ভেদ করে সোজা বুকের বা পাশে বিঁধছে। প্রভাব ফেলছে প্রগাঢ়ভাবে। তীব্র থেকে তীব্র রূপ ধারণ করছে বুকে উঠা প্রবল ঝড়। হুট করে উঠে দাঁড়াল তুলি৷ বড় বড় পা ফেলে পালিয়ে এলো এক প্রকার। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরালো। লুব্ধনেত্রে তাকাল আদ্রর ঠোঁটের দিকে। স্পষ্ট চোখে বিঁধছে আদ্রর ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত স্মিত হাসি টুকু। অনুভূতিরা সাদরে লুফে নিল হাসি টা। প্রায়ই তুলির খেয়ালে এসেছে যখনই আদ্র তাকে লজ্জার বান ছুঁড়ে মারে ঠিক তখনই এই হাসিটা অভ্যাসবশত আদ্রর অধর স্পর্শ করে। ইশ! কি মাদকতা ভরপুর এই হাসি তে। তুলি বিড়বিড় করে বললো,

” ভয়ংকর, মারাত্মক,সাংঘাতিক শব্দগুলো যেন আপনার জন্যই মানানসই আদ্র। কি যে ভয়ংকর আপনার হাসি কি করে বুঝাবো আমি আপনাকে?বুঝানো বড়ই মুশকিল।”

আনমনে ভাবতে ভাবতে তুলি যে দরজায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে তা নিজেই ভুলে বসল। আদ্র কে সম্মুখে দেখতে পেয়ে উল্টো পিঠে ঘুরে দাঁড়াল তৎক্ষনাৎ। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে শাড়ির কুঁচি আঁকড়ে ধরে দৌড়ে নেমে আসল নিচে। তুলির যাওয়ার পথে আদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে উঠল,

” তুমি আজকাল প্রবলভাবে কাঁপাচ্ছ হৃদপিণ্ড। বাড়িয়ে তুলছো তোমাকে চাওয়ার প্রখরতা। আমাকে উম্মাদ করে তোলা লাজুকলতা তুমি, আমার তুলা।”

বুঝ হওয়ার পর থেকে তুলি দেখে এসেছে সর্বদা বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে বন্ধ বান্ধব, ভাবী,কাজিনের দল। কিন্তু আজ পুরো উল্টোই দেখছে তুলি। মনে হচ্ছে সে বুঝি চাঁদের উল্টোপিঠ দেখতে পেয়েছে। পায়েল ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। বেচারা অন্তু মুখ কাচুমাচু করে তাকিয়ে আছে পায়েলের দিকে। তার গজদন্তিনী দাবি করেছে টাকা না দিলে বাসর ঘরে ঢুকবে না সে। ব্যাপার টা সত্যিই হাস্যকর। অন্তুর মুখ দেখে তুলিসহ সকলের পেট ফেটে হাসি আসার উপক্রম। বিয়ে করে চরমভাবে ফেঁসে গেছে বেচারা। কোনো কালেই হয়ত কল্পনায় ও ভাবে নি নিজের বউ বিয়ের রাতে টাকা না দিলে বাসর ঘরে ঢুকবে না বলে দাবি করবে। অসহায় মুখ করে অন্তু পায়েলের হাত টা ধরতে গেল। ঝারি মেরে সরিয়ে দিল পায়েল। ঠোঁট ছড়িয়ে বললো,

“বহুদিনের ইচ্ছে আমার তোর বাসর রাতে মোটা অংকের টাকা আদায় করব। এই ইচ্ছে টা মাটিতে মেশানোর পাত্রী আমি নই। বান্ধবী হিসেবে টাকা আমার চাই মানে চাই। নয়তো যা রুমে,কর গিয়ে একা একা ফুলশয্যা।”

অন্তুর অসহায় দৃষ্টি আরও করুণ রূপ ধারণ করল। বিয়ে করে যা খুশি হয়েছিল তা সবটা দলা মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল পায়েল। প্রথমত নিজের বর কে তুই ডাকছে,দ্বিতীয়ত ফুলশয্যার রাত টুকু শেষ করে দিচ্ছে টাকার দাবিতে। শেষমেশ হার মানল অন্তু। বিড়বিড় করে বললো,

” কত দিতে হবে?”

” পঞ্চাশ হাজার। ”

অন্তুর মনে হলো তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। বউ নিয়ে রুমে ঢুকার জন্য পঞ্চাশ হাজার?মনের দুঃখে অন্তুর একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, ‘তোর কি বাসর করার সাধ নেই ডাকিনী?’ কিন্তু প্রশ্নটা চেপে গেল সে। ভালো করে জানে এই প্রশ্ন করলে তিন বছরেও পায়েল কে কাছে পাবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। রাজি হয়ে গেল পায়েলের দাবিতে। কারণ অন্তুর মস্তিষ্ক তাকে বলেছে বউয়ের চেয়ে টাকা বেশি নই। তবুও আমতা আমতা করে বললো,

” এতো টাকা দিয়ে কি করবি?তোর একটু দরদ দেখানো উচিত নিজের জামাইয়ের টাকার উপর।”

ক্ষিপ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল পায়েল। হেসে বললো,

” দরদ দেখিয়েছি তো তোর উপর। তোকে বিয়ে করেছি। ইশ!কি কান্না করছিলি তুই আমাকে বিয়ে করার খুশিতে গাড়িতে বসে।”

চোখ বড় বড় করে তাকাল অন্তু। সব ফাঁস করে দিচ্ছে এই মেয়ে বন্ধুমহলের সামনে। এই মেয়েকে পাওয়ার খুশিতে নাহয় একটু আকটু কেঁদেছিল, তাই মান সম্মান এভাবে ডুবিয়ে দিবে!

রুমে যাওয়ার পূর্বে নিবিড়, সাগর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,

” বান্ধবী এখন ভাবী। আজ ভাবী সম্পর্ক টা কে সম্মান জানিয়ে তোর কানে কানেই বলি,বাঘিনী শিকার করে সফল হয়ে কাল আমাদের মুখ দেখাস অন্তু। ভয়ে আবার বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাস না যেন।”

অন্তু সূক্ষ্ম ঢোক গিলল। প্রচন্ড সাহসের সহিত বলে উঠল,

” এটা তো আমার বা হাতের খেল।”
__________

কখন কে কোথায় অবস্থান করবে তা কেউ জানে না। কত সেকেন্ড আর পৃথিবীর বুকে নিঃশ্বাস ফেলবে তাও কারো জানা নেই। অন্তুদের বাড়ির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে তুলি। গতকাল অব্দি নিঃশ্বাস টা বার বার বন্ধ হয়ে আসছিল। সারাক্ষণ মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল সব ঠিক হবে আদৌ!নিমিষেই সব ঠিক করে দিল আদ্র। কাউকে ভাসতে দেয় নি কষ্টের সাগরে। তুলির মনে পড়ে গেল সেই মুহুর্ত টা,যেই মুহুর্তে আদ্র খুব রিস্ক নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল পায়েলের বাবার নিকট।

নিকষ কালো আঁধার ডিঙিয়ে ধরণীতে সবেমাত্র সূর্য উজ্জ্বলতা ছড়াতে শুরু করেছিল। তুলি ও আদ্র ধীর পায়ে হেঁটে এসে উপস্থিত হলো পায়েলের বাবার রুমে। তখন দু’টো ভয় কাজ করছিল উনি কথাটা কিভাবে নিবেন? কি হবে এর পরিণাম?তুলির বুকটা কাঁপছিল ভয়ে অথচ আদ্র নির্ভয় ভঙ্গিতে একটা প্রশ্ন ছুড়েছিল অতি বিনয়মিশ্রিত কন্ঠে।

” ধরে নিন,পায়েল অন্য কাউকে ভালোবাসে তাহলে তাকে অভিকের সাথে বিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত আংকেল?”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।ভেবেছিলাম আজ দেওয়া হবে না। খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। রি-চেইক করা হয় নি।)

p.c: Sumaiya Akter

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here