আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-৪৩

0
2380

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪৩

হন্তদন্ত হয়ে আদ্র ছুটে গেল গেটের ভিতরে। তুলি বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনেকটা সময়। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে হকচকালো,দৈবাৎ দৃষ্টি ফেলল পাশে। আমরিন কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা মলিন কন্ঠে বললো,

” ভিতরে চল।”

প্রভাতের স্নিগ্ধ বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে তুলির সমস্ত দেহ। কি হচ্ছে,কোথায় এসেছে কিছুই তুলি জানে না তবে আদ্রর পাগলের মতো ছুটে যাওয়া তুলির হৃদয়পটে তীরের ন্যায় কিছু একটা বিঁধেছে। যার ফলে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে তুলি। হয়ত রক্তাক্ত হয়েছে হৃদপিণ্ড। বুকের বা পাশে বিরাজমান ব্যাথা নিয়ে তুলি পা বাড়ালো। নিত্যি নিত্যি পায়ে হেঁটে গেইটের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করল। নত মস্তক সম্মুখে নিবদ্ধ করা মাত্র দেখতে পেল স্কুল ঘরের মতো লম্বা একটা তিন তালা বিল্ডিং। কৌতূহল দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বুলাতে লাগল অনবরত। কন্ঠনালি হতে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল,

” এটা কি কোনো এতিমখানা?”

পাশে অবস্থিত আমরিন সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

” এটা এতিমখানা নয় তুলি। তবে এমন কিছু চাইল্ডরা এখানে বাস করে যাদের খাওয়া,পড়া,চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে এই জায়গায়। ”

আমরিনের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না তুলি। উৎসুক এবং প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আমরিনের দিক। তা বুঝতে পেরে আমরিন পুনরায় বলতে শুরু করল,

” ক্যান্সার আক্রান্ত বাচ্চাদের রাখা হয় এখানে। ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল সেটা তো জানিস। আবার অল্প বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাচ্চারা কেমন নেতিয়ে পড়ে,ভয় পায়। সেই সকল বাচ্চাদের এখানে রেখে সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। ”

এতক্ষণে তুলি বুঝতে সক্ষম হলো সবটুকু। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

” বাচ্চা টা যে মারা গেছে ক্যান্সার আক্রান্ত ছিল?”

“হু।”

জবাব দিতে গিয়ে গলা ধরে এল আমরিনের। এই বাচ্চাগুলোর জন্য অনেক কষ্ট হয় তার। যতবারই দেখতে আসে বাচ্চাগুলোকে তখন মনে হয় কেন তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল এত সামান্য!কিছুটা দীর্ঘ হলে কি খুব ক্ষতি হতো? পরক্ষণেই মনে হয় আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তুলির চোখ থেকে টপটপ করে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে গেল। চাপা যন্ত্রণায় বিষাক্ত হয়ে উঠল ভিতরটা।
সবার সাথে দু’তলায় এসে দেখল আদ্র স্থির দাঁড়িয়ে আছে রুমের সামনের লম্বা বারান্দা টায়। দৃষ্টি তার সূদুর কোথাও। মুখ দেখে বুজবার জো নেই ভিতরকার অনুভূতি।

তুলি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দোটানায় পড়ে গেল আদ্রর কাছে যাবে নাকি কক্ষের অভ্যন্তরে। মাথা উঁচিয়ে সামান্য উঁকি দিল রুমের মধ্যে। মুহুর্তেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল তার। সারা শরীর কাঁপতে লাগল ক্রমাগত। ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে শুয়ে রাখা হয়েছে বাচ্চা টাকে। চেহারাটা উম্মুক্ত। কি স্নিগ্ধ, সৌন্দর্য স্থির হয়ে আছে মুখটাতে!পাঁচ – ছয় বছর হবে বাচ্চা টার। খুব সুন্দর করে প্রাণহীন দেহটা এলিয়ে রেখেছে। মুখটা হাসোজ্জল। কেন এত কম আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আগমন হলো মেয়েটার? মুখে হাত চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল তুলি। তার কোমল মন মেনে নিতে পারছে না কঠিন এই দৃশ্যটুকু। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগল ফুপিয়ে ফুপিয়ে। কেন এতো মায়া-মমতায় জড়িয়ে গেছে জীবনটা?এই বাচ্চা টা নাহয় অবুঝ ছিল কিন্তু তুলি?মৃত,নির্জীব দেহ টা তুলির মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড অভিশঙ্কায় ভুগছে মন। বাচ্চাটার সাথে কোনো রকম সম্পর্ক নেই তবুও বুক ফেটে বেরিয়ে আসছে জল। কিন্তু প্রিয় মানুষ গুলো?যাদের সাথে রয়েছে আত্মার সম্পর্ক?তাদের এমন পরিণতি দেখার আগে নিজের মৃত্যু কামনা করে ফেলল তুলি মনে মনে। বেড়ে গেল ফুঁপানোর শব্দ। লম্বা বারান্দায় তড়তড় করে ছড়িয়ে পড়ল শব্দটা মৃদু মৃদু।

কর্ণ খাড়া হয়ে গেল আদ্রর। ভঙ্গ হলো বিমূর্ত দৃষ্টি। পিছন ঘুরে তাকাতেই ধুক করে উঠল বুক টা। হুট করেই অজানা এক ব্যাথায় পুরো শরীর অসাড় হয়ে পড়ল। সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তুলি কাঁদছে। চোখে মুখে বিধস্ত ভাব। শরীর টা নেতিয়ে পড়ার উপক্রম। আকস্মিক তুলির এমতাবস্থায় আদ্রর দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। বহু কষ্টে পা ফেলে তুলির সামনে বসল। কিন্তু তুলির অবস্থার নড়চড় হলো না। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিল আদ্র। দ্রুত পায়ে ছুটে এল অন্য একটা খালি কক্ষে। তুলি কে খাটে বসিয়ে গালে হাত রেখে অস্থির কন্ঠে ডাকল,

” তুলা।”

স্তব্ধ হয়ে আছে তুলি। নিরুত্তর হয়ে করুন চাহনি নিক্ষেপ করল আদ্রর রক্তিম চক্ষু যুগলে। ইতিমধ্যেই আদ্রর ফর্সা চেহারায় অস্থির ভাব স্পষ্ট। তুলি নিজের হাত টা আদ্রর চুলের ভাঁজে ডুবালো। এতো ভালো কেন বাসে এই ডাক্তার সাহেব তাকে?সামান্য একটু শকই তো পেয়েছে আচমকা ছোট একটা বাচ্চার নিথর দেহ দেখে, তাই বলে এত অস্থির হতে হবে আদ্র কে?আচ্ছা এই বাচ্চা টার মতো তো তুলি নিজেও একদিন চলে যাবে তখন কি তার ডাক্তার সাহেব কাঁদবে নাকি অতীত পিছনে ফেলে জীবনে অগ্রবর্তী হবে?প্রশ্ন টা তুলির মস্তিষ্কে উদয় হলেও মন বললো,” প্রাণ এবং তোকে যদি বাছাই করার শর্ত উঠে তাহলে আদ্র নিঃসন্দেহে তোকেই বেছে নিবে তুলি। তোকে ছাড়া তোর ডাক্তার সাহেব কখনও থাকতে পারবে না। ”

নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো তুলি। আদ্রর বুকে মুখ গুঁজে সাদা শার্ট টা খামচে ধরল। চোখ ছাপিয়ে নেমে এল জল। অশ্রুতে মেখে দিতে লাগল শার্ট টা। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

” আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি আদ্র। কখনও ছেড়ে যেতে চাই না আপনাকে। আপনি আমায় শক্ত করে জড়িয়ে রাখুন প্লিজ। ”

আদ্র বুঝতে পারল বাচ্চা টাকে দেখে কষ্টদায়ক প্রভাব পড়েছে তুলির মনে। এমনিতেই মেয়েটা খুবই নরম প্রকৃতির,চোখের সামনে এমন একটা সিচুয়েশন মেনে নিতে হিমশিম খাচ্ছে রীতিমতো। হাতের বাঁধন প্রগাঢ় করল আদ্র। তুলির দু’গালে হাত রেখে ললাটে অধর জোড়া ছুঁয়াল। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না স্পর্শ টুকু। তুলির গাল থেকে হাত সরিয়ে এনে সোজা হয়ে বসল আদ্র। ঠোঁটের কার্ণিশে স্মিত হাসি নিয়ে বললো,

” তোমার বয়স কতো?”

আদ্রের এমন প্রশ্নে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল তুলি। ভেজা কন্ঠে বললো,

” উনিশ।”

” আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার বউয়ের বয়স ২-৩ বছর। ২-৩ বছরের বাচ্চা রা যেমন করে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদে ঠিক তেমনভাবেই আমার বউ আমার বুকে আসার জন্য কাঁদছিল। সত্যি বলছি না বউ?”

আদ্রের কথায় কান্নার মাঝেই ফিক করে হেসে দিল তুলি। লজ্জাও পেল খানিকটা। সাথে এটাও বুঝল আদ্র তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই জায়গাটার সাথে,বাচ্চাগুলোর সাথে আদ্রর কি সম্পর্ক কিছুই তো জানতে পারল না। হাত টানে সম্বিৎ ফিরে পেল। আদ্র নিচু কন্ঠে বললো,

” চলো।”

গুটি গুটি পায়ে পাশাপাশি হেঁটে এসে একটা জায়গাতে স্থির হলো দু’জন। সামনে তাকিয়ে দেখল অনেকটা দূরে সাইনবোর্ডে লিখা আছে, কবরস্থান। তুলি তব্দা খেয়ে গেল খানিকক্ষণের জন্য। আদ্র তাকে কেন এখানে নিয়ে এল একদম ঠাহর করতে পারল না। পিছনে তাকাল তুলি। তিন তলা বিল্ডিং হতে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। তার মানে এই কবরস্থান টা এই জায়গারই অংশ। কিন্তু এখানে কবরস্থান কেন?তুলি কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই শুনতে পেল আদ্রর বিষাদমাখা কন্ঠ।

” আজ এখানে আসার কারণ কি তোমাকে তো বলা হয় নি তুলা। কেউ বলেছে?”

তুলি মাথা নাড়িয়ে না করল। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রের দিকে। আদ্র সেদিকে এক পলক চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলতে লাগল,

” আজ আমার দাদার মৃত্যুবার্ষিকী। দূরে যেই কবরস্থান টা দেখতে পাচ্ছো এখানেই আমার দাদা কে সমাহিত করা হয়েছে।”

তুলি চমকালো। আদ্রর ফ্যামিলি সম্পর্কে এতোটা জানা নেই তার। সে ভেবেছিল হয়ত আদ্রের দাদা বান্দরবানে নিজ বাড়িতে মারা গেছেন কিন্তু আজ, এই মুহুর্তে জানল অন্যকিছু। চমকিত নয়নে চাইতেই চোখে আটকা পড়ল আদ্রর দু’চোখ। আদ্র আলতো স্বরে প্রশ্ন করল,

” বান্দরবানে যে ডায়েরি টা দিয়েছিলাম,পড়েছিলে বউ?”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গতকাল গল্প দেই নি তার জন্য দুঃখিত। আগামীকাল থেকে আমার প্র্যাক্টিক্যাল ফাইনাল এক্সাম। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও আজ গল্পটা দিয়েছি। পরীক্ষার কারণে কিছুটা অনিয়মিত হচ্ছি গল্প দেওয়ায়। তবুও আমি চেষ্টা করব রেগুলার দেওয়ার। খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। রি-চেইক করি নি।)

পিক ক্রেডিট ঃ রুবি🥰🥰🥰🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here