আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-৪৫

0
2227

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪৫

রাজশাহী থেকে ফিরার দু’দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। এতো জলদি সময়গুলো চলে যাচ্ছে অথচ টের পাচ্ছে না তুলি। সময় তো এমনই, কারো জন্য অপেক্ষা করার নিয়ম নেই। হিজাব বাঁধতে বাঁধতে তুলি সারা রুমে চোখ বুলালো। শূণ্যতায় ছেয়ে আছে পুরোটা কক্ষ। তুলির মনটা মাত্র কয়েক ঘন্টায় আদ্র দেখতে না পারার বিতৃষ্ণায় ক্লান্তিতে ভুগছে। আদ্র বিহীন বিষাক্ত, যন্ত্রণাময় লাগছে সবকিছু। ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে নেমে এল নিচে। সায়েরা বেগম, রাদিফ সাহেব নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছেন তার জন্য। তুলি রাদিফ সাহেবকে উদ্দেশ্যে করে বললো,

” আসসালামু আলাইকুম বাবা।”

রাদিফ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে তুলির মুখের দিকে তাকালেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে আওড়ালেন,

” চেহারাটা মলিন হয়ে আছে কেন প্রিন্সেস?”

আচমকা এমন প্রশ্নে তুলি হকচকালো। নিরব থেকে ভাবল কয়েক পল। কোনো সদুত্তর খুঁজে পেল না। মেকি হাসার ভান করে ক্ষীণ স্বরে প্রতুত্তরে বললো,

” কই না তো বাবা। আমি একদম ঠিক আছি।”

উত্তর টা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকল না রাদিফ সাহেবের কাছে। তুলির প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন,

” তুই দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস। আজ আমার সামনে বেশি বেশি খাবি। কাজের ব্যস্ততার জন্য তো সুযোগ পায় না তোদের সাথে টাইম স্পেন্ড করার। আদ্র কে কতবার বললাম ডাক্তারির পাশাপাশি আমার বিজনেস টা একটু আকটু সামলাতে। ছেলেটা শুনেও যেন শুনে না। কবে যে নিস্তার পাবো কাজ থেকে আর কবে যে তোকে নিয়ে,আমরিন,ইনশিতা কে নিয়ে লং লং ট্যুর দিতে পারবো সেটাই ভাবছি। ”

খলখলিয়ে হাসল তুলি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাদিফ সাহেবের মন রাখতে খেয়ে নিল। কোচিং এর জন্য উঠে দাঁড়াতেই সায়েরা বেগম পিছু ডেকে উঠলেন। কর্ণপাত হওয়া মাত্র অগ্রবর্তী পা টা ফিরিয়ে আনল তুলি। সায়েরা বেগম দরজার কাছাকাছি এসে বললেন,

” আমরিন তো নিবিড়দের বাসায়। হয়ত আজকেও আসবে না। তুই একা যেতে পারবি তো মা?”

” কেন পারব না খালা মণি?ড্রাইভার আংকেল তো নিয়ে যাবে আমাকে। তুমি একদম টেনশন করবে না। পরে তোমার কিছু হলে ডা.আদ্র আহনাফ আমাকে শূলে চড়াবে।”

সায়েরা বেগম কে অবয়ব দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। গাড়িতে উঠে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিণে নজর দিতেই মন খারাপ,অভিমান টা বেড়ে গেল হুড় হুড় করে। গত রাতে বেরিয়ে গেছে তারপর আর ফিরে নি আদ্র। রাতে কল দিয়ে জানিয়েছে হসপিটালে ইমারজেন্সি থাকায় আজ ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে। ইদানীং তুলির একা থাকতে খুব ভয় লাগে। কেমন উল্টো পাল্টা অনুভূতি জাগে মনে। কারণবশত, গত রাতে সায়েরা বেগম কে তুলির সাথে থাকতে বলেছিল আদ্র। রাতে ফোন দিয়েছে অনেকবার। কিন্তু সকাল হতে একটা কলও আসে নি। মোবাইলটাও কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে। তুলি কয়েকবার কল দিয়েছে প্রতিবারে কানে ভেসে আসছে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না। শেষমেশ সাগরকে কল দিল। কয়েক সেকেন্ড পার হতেই অপরপাশ থেকে কানে এলো,

” মাত্রই তোমাকে কল দিতে যাচ্ছিলাম বউ।”

সাগরের ফোনে পরিচিত সেই কন্ঠ শুনে তুলির বুকের উচাটন বেড়ে গেল হঠাৎ। ঝটপট মোবাইলটা চোখের সামনে আনল। ভালো করে চেক করে দেখল নাম্বার টা সাগর এর। তাহলে আদ্রর কাছে কি সাগরের মোবাইল টা?আদ্রের টা কোথায়?পুনরায় কানের কাছে ফোন টা নিল। বিচলিত স্বরে বলে উঠল,

” আপনার ফোন কোথায় ডাক্তার সাহেব?”

” ভেঙে গেছে।”

আদ্রর সাদামাটা উত্তরে তুলি চমকালো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” ভেঙে, ভেঙে গেছে মানে?”

” এক ওয়ার্ড বয়ের সাথে খুব রাগ উঠেছিল। রাগ তো ওর উপর দেখাতে পারব না তাই মোবাইলের উপর দিয়ে গেল। এখন আর চলছে না। সাগরের কেবিনে এসে ওর থেকে মোবাইল নিয়ে কল দিলাম তোমাকে। ”

এতটুকু বলে থেমে গেল আদ্র। তুমি নিশ্চুপ হয়ে আদ্রর নিঃশ্বাসের শব্দ অনুভব করতে লাগল। পিনপতন নীরবতা বিরাজমান দু’জনের মধ্যে। আবেগি স্বরে ডাকল আদ্র।

” তুলি!”

মাদকতায় ভরপুর ছিল যেন ডাকটা। তুলির সারা দেহে বয়ে গেল শীতল স্রোত। কম্পিত কন্ঠে সাড়া দিয়ে বললো,

” জ্বি!”

“ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত ছিলাম আমি। তোমার রিনঝিনে স্বর এক নিমিষেই প্রশান্তিতে ভরে দিয়েছে মন টা। তুমি শুধু তুলা নয়,জাদুকরী লাগছে আমার কাছে। ”

আদ্রের কথায় তুলি আলতো হাসল। খুব করে বলতে ইচ্ছে করল,

” আপনার কথাবার্তা কলেজ প্রেমিকদের মতো মনে হচ্ছে আদ্র। আপনি কি কলেজে এভাবে ফ্লার্ট করতেন?ইশ!জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

কথাটা মনে চেপে রেখে তুলি মুখে কিছু বলবে তার পূর্বেই আদ্র বলে উঠল ব্যস্ত কন্ঠে,

” খুব জলদি ফিরব বউ। সাবধানে যেও।”

তুলি ফোন টা রেখে মাথা এলিয়ে দিল সিটে। হুট করে শরীর টা খারাপ করতে শুরু করল। মাথা টা ঝিমঝিম করে উঠল। গলায় উঠে এলো খাবারগুলো। ড্রাইভার কে বহু কষ্টে বলে উঠল,

” চাচা গাড়ি একসাইডে থামান।”

ড্রাইভার এক সাইডে গাড়ি থামাল। তুলি দ্রুত পায়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। পেটে হাত দিয়ে গড় গড় করে ঢেলে দিল সবকিছু। একটু আগে যা খেয়েছিল তা সব বেরিয়ে গেল। বমি করে দাঁড়ানোর মতো শক্তি অবশেষ রইল না যেন শরীরে। ড্রাইভার পানির বোতল নিয়ে দৌড়ে এলো। তুলি মুখ ধুয়ে,সামান্য একটু পানি পান করে দুর্বল কন্ঠে বললো,

” অতিরিক্ত গরমের কারণে হয়ত শরীর টা একটু খারাপ লাগছে চাচা। বাড়িতে কাউকে জানাবেন না প্লিজ। পরে দেখা যাবে আদ্র,খালা মণি অস্থির হয়ে পড়বেন।”

“আইচ্ছা মা। তাহলে বাড়িতে ফিরে চলো এহন। তোমার শরীল ডা বেশি দুর্বল মনে হইতাছে।”

ক্লান্ত স্বরে বলে উঠল তুলি,

” না চাচা। কোচিং সেন্টারে নিয়ে চলুন। ফিরে গেলে খালা মণির মনে সন্দেহ জাগবে। এছাড়া ঠিক আছি আমি। যেতে যেতে আরও সুস্থ হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। ”

তুলির কথার পৃষ্ঠে আর কিছু বললো না ড্রাইভার চাচা। কোচিং সেন্টারের সামনে গাড়ি থেমে গেল। তুলি নেমে বললো,

” ক্লাস শেষে আমাকে নিয়ে গেলেই হবে চাচা। আপনি এখন বাড়িতে চলে যান।”

” আইচ্ছা মা। তুমি সাবধানে থাইকো। আবার শরীর খারাপ লাগলে কিন্তু আদ্র বাবাজি রে ফোন দিবা। নইলে আমার সাথে রাগ করব।”

” ঠিক আছে। ”

ড্রাইভার কে বিদায় দিয়ে তুলি ভিতরে প্রবেশ করল। ক্লাসে ব্যাগ রেখে বসতে না বসতেই কোচিং এর একজন কর্মচারী এসে জানালো অফিস রুমে অনেকক্ষণ যাবত কেউ অপেক্ষা করছে তার জন্য। তুলি কন্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে বললো,

“আমার জন্য?”

ছেলেটা সম্মতিসূচক উত্তর দিল। তুলি প্রচন্ড অবাক হলো এতে। কে হতে পারে কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলেটার পিছু পিছু রুমে ঢুকল। চোখের সামনে যাকে দেখল তাতে মনে হলো তুলির পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। মুখখানা বিষিয়ে এসেছে তবুও শান্তকন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” আপনি এখানে?আমার জন্য কেন অপেক্ষা করছিলেন?”

ইতি ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললো,

” যাক চিনতে পারলে। তোমার মেমোরাইজিং খুব ভালো তো। নয়তো এক দেখায় এভাবে চেনা যায়?তাও কয়েক পলকের দেখাতে!”

ইতির ঠেস মেরে কথাতে তুলির বিরক্তি ধরে গেল। এমনিতেই প্রথম দেখাতেই এই মেয়কে ভালো লাগে নি তার। উদ্যেগি সুরে বলে উঠল,

” কেন এসেছেন?”

বাঁকা হাসল ইতি। আফসোসের সুরে বললো,

” তোমার সাথে জরুরি অনেক কিছু বলার আছে আমার। যেগুলো না শুনলে তুমি খুব প্রস্তাবে। দিনের পর দিন কিভাবে ঠকে যাচ্ছো সেটাও জানতে পারবে না কখনও লিটল গার্ল। ভীষণ আফসোস হয় আমার তোমার জন্য। তাই ভাবলাম তোমাকে সবকিছু জানানো দরকার। ধরে নাও আমি তোমার বড় আপু হিসেবে তোমাকে হেল্প করতে চাইছি।”

” কিন্তু আমি আপনার হেল্প চাই না। সেধে সেধে হেল্প করতে চেয়ে নিজেকে নিচে নামাচ্ছেন।”

কাঠকাঠ গলায় বলে তুলি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। ইতি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে সামনে এসে বাঁধা প্রদান করলো। স্থির হয়ে পড়ল তুলি। বিরক্তি যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ইতি তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠল,

” এতটুকু মেয়ের এত বেশি কনফিডেন্স ভালো নয়। তুমি কি জানো তুমি আদ্রের মন স্পর্শ করা প্রথম মেয়ে নয়?”

তুলি চকিতে মুখ তুলে তাকাল। কেঁপে উঠল অন্তস্থল। চোখ জোড়া ছলছল করছে। ইতির উচ্চারিত বাক্য টা বোধগম্য না হলেও কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বার বার। ধরা গলায় বললো,

” মমমম,মানে?”
______________

ভ্যাপসা গরমে অবস্থা নাজেহাল আদ্রর। কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে কল দিয়ে যাচ্ছে তুলি কে। কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আসছে। মেজাজ চওড়া হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। হাতের মোবাইলটা চেপে ধরে নিজের রাগ নিবারণের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাল। পরক্ষণেই অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠল বুক টা। তড়িঘড়ি করে কল দিল সায়েরা বেগমকে। রিসিভ হতেই ব্যগ্র কন্ঠে প্রশ্ন করল,

” আমার বউ কোথায় মা?”

সায়েরা বেগম বিস্তর হাসলেন। স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

” তোর বউ আসছে বোধ হয়।”

গাড়ির আওয়াজ শুনে ফের বলে উঠলেন,

” গাড়ি চলে এসেছে। আমি গিয়ে দেখছি তুলি এলো কিনা।”

আদ্র ফোন টা রেখে মাথার চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে নিল। পাশে দাঁড়ানো সাগরের উদ্দেশ্যে বললো,

” রিমি ফোন দিয়েছিল। তখন পেশেন্ট দেখায় বিজি ছিলি তুই। মোবাইল তো আমার কাছে ছিল। এখন কথা বলে নে।”

মোবাইলটা সাগরের হাতে দেওয়ার আগেই পুনরায় শব্দ সৃষ্ট করে বেজে উঠল। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সায়েরা বেগমের নাম্বার টা। বিলম্ব না করে ফোনটা রিসিভ করল। মুহুর্তেই কর্ণধার হলো সায়েরা বেগমের আশঙ্কাজনক কন্ঠস্বর।

” তুলি কে কোচিং সেন্টারে পাওয়া যায় নি আদ্র। ড্রাইভার একা ফিরে এসেছে। এটাও বললো ওর নাকি সকাল থেকে শরীর খারাপ ছিল। আমার চিন্তা হচ্ছে। তুই ওকে খুঁজে বের কর বাবা। কোথায় গেল মেয়েটা,,”

মায়ের কথা শোনার তর সইল না আদ্রের। ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল হৃদস্পন্দন। সূক্ষ্ম ব্যাথা করে উঠল বুকের বা পাশ টা। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ল পুরো বক্ষে। পাথরের মতো ভার হয়ে গেল বুক টা।সাগর ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। আদ্রর রক্তিম চোখ দেখে পিলে চমকে উঠল তার। তড়বড় করে বললো,

” কি হয়েছে আদ্র?”

আদ্র মোবাইলটা সাগরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এলোমেলো পায়ে দৌড়ে গাড়ির কাছে এলো। সাগরের ডাক উপেক্ষা করে গেল সম্পূর্ণ। দ্রুত ড্রাইভ করে কোচিং সেন্টারে এলো। কিন্তু তুলির কোনো হদিস পেল না। সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করে দেখল ইতির সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে তুলি। কিন্তু কোথায় গেল? কিভাবে খুঁজবে আদ্র! হৃদয়ে তোলপাড় হচ্ছে। নিজের প্রাণনাশিনী কে হারানোর ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে বার বার। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। ড্রাইভ করতে করতে ঝাঁঝালো গলায় আওড়ালো,

” প্রত্যেক মানুষের দু’টো দিক থাকে ভালো এবং খারাপ। আমার মাঝেও দু’টো আছে- গভীর চাওয়া এবং শ্যামবতীর জন্য হিংস্র হয়ে উঠা।”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

পিক ক্রেডিট ঃরুবি❤️❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here