আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-৪৮

0
2267

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৪৮

তুলি জিহ্বা দিয়ে শুকনো অধর যুগল ভিজিয়ে নিল। আমতা আমতা করে বললো,

” আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।”

” বলো।”

” আমার,,!”

কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না তুলি। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। গা গুলিয়ে আসতে লাগল হঠাৎ । গরগর করে বমি করে দিল আদ্রর সামনে,যা ছিটকে আদ্রর গায়ে পড়ল। চোখ বুঁজে নিল আদ্র। কীয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়া মাত্র তড়িৎ গতিতে উঠে ওয়াশরুম থেকে বালতি করে পানি নিয়ে এল। তুলি দুর্বল হয়ে বসে পড়েছে ইতিমধ্যে মেঝেতে হাঁটু ভেঙে। আদ্রর মনে হলো কেউ হাজারো তীর ছুঁড়ছে তার বুকের মাঝে। তুলির এই অবস্থা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে হৃদপিণ্ড। ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছে তুলি। আদ্রর উপর বমি করে দিয়েছে কেমন রিয়েক্ট করবে আদ্র!ব্যাথাতুর চোখে আদ্রর দিকে তাকাল। আদ্রর ভাব নির্বিকার যেন তুলি কোনো ভুল করে নি। তাড়াতাড়ি করে তুলি কে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিল। টাওয়াল ভিজিয়ে তুলির গা মুছে, কাপড় নিয়ে এল কার্বাড থেকে। হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠল,

‘ চেঞ্জ করতে পারবে তো?’

মাথা নাড়ল তুলি। টলমলে চোখ নিয়ে দৃষ্টি তাক করল আদ্রর দিকে। আদ্রর নীলাভ নেত্রে অস্থিরতা স্পষ্ট। লাল হয়েও আছে কিঞ্চিৎ। আদ্রের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে কাপড় নিল। ললাটে অনুভব করল আদ্রর গাঢ় স্পর্শ। নিমিষেই তুলির চক্ষু ভেদ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। উঁহু কষ্টে নয়,অতি সুখে, জীবনে এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্যে। ব্যান্ড দিয়ে উন্মুক্ত, খোলা চুলগুলো বেঁধে দিল আদ্র। কপালে অবাধে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। ম্লান হেসে বললো,

‘ আমি নিচ থেকে আসছি। তুমি চেঞ্জ করে নাও।’

বিনা সময় বিলম্বিত আদ্র বেরিয়ে গেল। তুলি চেয়ে থাকল,চেয়ে রইল অপলক। একটু রাগ করতে পারত না আদ্র? অন্য কারো বমিতে কি ঘিন নেই তার?শার্ট টাও তো পাল্টায় নি,কোথায় গেল আবার। তুলি নানা চিন্তা ভাবনায় মগ্ন থেকে কাপড় পাল্টে ফেলল। পুরো শরীর কাঁপছে,দুর্বল অনুভূত হচ্ছে খুব। ফ্লোরের দিকে নজর যেতেই গা গুলিয়ে আসতে লাগল আবারও। খিঁচে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ! ফ্লোর তো সে ভরিয়েছে, তারই পরিষ্কার করা উচিত। এখানে যেহেতু একটা ঘিন ঘিন ভাব আছে,কাজের মেয়েকে বলাও ঠিক হবে না।

চোখ মেলে কিছুটা স্থির হলো। আদ্রর রেখে যাওয়া বালতি টা টেনে আনল সোফার কাছ পর্যন্ত। এতটুকুতেই যেন জান বের হয়ে যাচ্ছিল। কই বালতি তে তেমন পানি নেই, ওজনও নেই তবুও তুলির শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। হয়তো অবসাদ,দুর্বলতার জন্য এমতাবস্থা। তুলি ন্যাকড়া ভিজিয়ে নিচু হওয়া মাত্র শ্রবণ গ্রন্থিতে পৌঁছাল আদ্রর ভরাট কন্ঠ।

‘স্টপ তুলা!’

হাত থেকে আপনাআপনি পড়ে গেল ন্যাকড়া টা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তুলি। সম্মুখে চাইতেই দেখল আদ্রর হাতে শরবতের গ্লাস,চোখে রাগ। তুলি দু’কদম সরে গেল। আদ্র হেঁটে এল দ্রুত, শরবতের গ্লাস টা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

‘ বিছানায় বসে শরবত টা ফিনিশ করো। এতো পন্ডিতি করার প্রয়োজন নেই তোমার। জান চলে না, আসছে ফ্লোর পরিষ্কার করতে। ‘

আদ্রের রাগান্বিত কন্ঠে ভয়ে হিমশিম খাচ্ছে তুলি রীতিমতো। রাগল কেন আদ্র?তখনকার জন্য নাকি এখনকার জন্য?মুখে উচ্চারিত শেষ বাক্যটুকু জানান দিচ্ছে এখন করা কান্ডের জন্য। ধীর ধীর পায়ে তুলি বিছানায় এসে বসল। মুখের কাছে গ্লাস টা নিতেই সুন্দর একটা স্মেলে মন,প্রাণ মুহুর্তেই জুড়িয়ে গেল। লেবুর শরবত বানিয়ে এনেছে আদ্র। তুলির এ মুহুর্তে এটাই জরুরি ছিল। রুদ্ধশ্বাসে খেয়ে নিল সবটুকু। চোখের দৃষ্টি সামনে নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেল আদ্র মেঝে পরিষ্কার করে ফেলেছে প্রায়। বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই মুখশ্রী তে। তৎক্ষনাৎ তুলির আঁখিদ্বয়ে ফুটে উঠল অজস্র মুগ্ধতা।হৃদয়পটে বইতে লাগল শীতল হাওয়া।
.
.
কোমরে ঠান্ডা স্পর্শে তুলির দেহ একটু আকটু শিউরে উঠল। ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বললো,

‘ শাওয়ার নিয়ে এসেছেন?’

‘হু।’

‘ কাল হসপিটালে যাবেন?’

আদ্র জবাব দিল না। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলির মুখের দিকে। মুখটা শুকিয়ে গেছে অনেক। রোগা রোগা ভাব। আদ্র চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ তুমি তখন কি বলতে চাইছিলে?’

হুঁশ উড়ে গেল তুলির আদ্রর প্রশ্নে। কিছু সময় আগেও বলার জন্য যেই সাহসটুকু জুগিয়েছিল তা উবে গেল নিমেষে। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে!যদি সত্যি হয়ে যায় ভাবনা টা তবে কেমন হবে আদ্রর প্রতিক্রিয়া?না পারবে না তুলি বলতে৷ বহু বছর আগের কার মেয়েদের মতো স্বামী কে বলতে ভীষণ লজ্জা অনুভব হচ্ছে তুলির।বিষয়টা চাপা দেবার লক্ষ্যে চোখ খিঁচে ঘুমের ভান ধরল। তড়িঘড়ি করে বললো,

‘ অনেক ঘুম পাচ্ছে ডাক্তার সাহেব। কাল বলব।’

আদ্রর নিষ্পলক দৃষ্টি ভঙ্গ হলো না। তুলির মিছে মিছে ঘুমের ভান দেখে ভ্রুঁ উঁচিয়ে মৃদু হেসে কোমর জরিয়ে বুকে নিয়ে এল। বুকে তুলির মাথা চেপে ধরে গাঢ় স্বরে বলে উঠল,

‘ লজ্জায় তুমি আচরণ করছো ঠিক নব্বই দশকের নারীর ন্যায়।
মিছে মিছে তোমার অভিনয় ধরা পড়ে গেল আমার চক্ষে। কি কারণ এত লজ্জার তোমার লাজুকলতা?’

তুলি শুনল সবটা,ঠিক কর্ণগোচর হলো কানের অতি নিকটে আদ্রর ফিচেল,মুগ্ধময় স্বর। চোখ বুঁজেই গুটিসুটি মেরে গেল একটুখানি আদ্রর বুকে।
____________

‘ দরজা খুলে বেরিয়ে এসো তুলি। দেরি হচ্ছে কিন্তু!’

রুমের ভিতর থেকে কোনো সাড়া এল না। আদ্রর মাথায় রাগ চরে গেল। ধপ ধপ করে জ্বলে উঠল মস্তিষ্ক। সেই সাথে বিরক্তি যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রাগ সংবরণের চেষ্টায় নেমে পড়ল। তুলি রুমের দরজা মেলছে না। জোরে ধাক্কা দিতে গিয়েও থেমে গেল। গম্ভীর অথচ আদর মাখা স্বরে কিছুটা জোরেই বললো,

‘ ঠিক আছে আমাকে নাহয় ঢুকতে দিও না তবে দরজা একটুখানি মেলে কিট টা দেখাও বউ। কতক্ষণ অপেক্ষা করাবে বলো?এতক্ষণ অপেক্ষা করালে এর ফল কিন্তু সুমিষ্ট হবে না।’

তুলি চমকে উঠল, দ্রুত গতিতে বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে তাকাল হাতে থাকা প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট টার দিক। প্রচন্ড কাঁপছে বুক টা। বক্ষস্থলে চলছে তীব্র তোলপাড়। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যখন ওয়াশরুমে যেতে নিবে তখনই হতদন্ত হয়ে ছুটে এসে হাতে এটা ধরিয়ে দিল আদ্র। প্যাকেটে নাম পড়তেই তুলি লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। না বলতেই কিভাবে বুঝে গেল মানুষ টা?আগেই কি বুঝতে পেরেছিল?তাই বুঝি সবকিছু এতোটা স্বাভাবিক! আচ্ছা যদি নেগেটিভ হয় ভাবনা?তুলির বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। আদ্র প্যাকেট টা হাতে দিয়েই সাথে সাথে বেরিয়ে গেছে। হয়ত বুঝে গেছে এখন এক নজরও চাইল তুলির মরণ হবে লজ্জায়। তুলি দরজা বন্ধ করেছে আদ্র যাওয়ার পর পরই। এখনও মেলে নি। দরজায় দেহ ঠেকিয়ে কিট টার দিক তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ।

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। পুনরায় আদ্রর ডাকে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা টা খুলে দিল একটু। পুরোটা মেলল না। কিন্তু বোকা তুলি আদ্রর চাল টা-ই বুঝল না৷ কিট টা দরজার ফাঁক দিয়ে ধরতেই দরজা ঠেলে ভিতরে চলে আসল আদ্র। তুলি হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল কেবল। আদ্র এক হাতে তুলি কে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে অন্য হাতে দরজার ছিটকিনি আঁটকে দিল। কিট টার দিকে এক পলক তাকিয়ে তুলির দিকে তাকাল বিস্মিত চোখে। তুলির ভয় হচ্ছে। প্রবলভাবে বাড়ছে তা আদ্রর মুখভঙ্গি দেখে। কম্পিত গলায় বললো,

‘ ককক কিছু বলছেন না কেন?’

আচমকা ঠোঁটে কিছু মুহুর্তের স্পর্শে মাথা নত হয়ে গেল তুলির। আদ্র কোমরে হাত পেঁচিয়ে তুলির কপালে চুমু খেল গভীরভাবে। গালে তরল কিছুর অস্তিত্ব পেতেই তুলির হা পা অসাড় হতে শুরু করল। নত আখিপল্লব তুলে চকিতে চাইল আদ্রর পানে। আদ্র পকেট থেকে ফোন বের করল। তুলির কান্না পাচ্ছে, গাল স্পর্শ করা জল টুকু আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। আহা,কি সুখ মিশ্রিত এই জলে। সুখময় জল!
.
.
অন্তুর কাঁধে মাথা রেখে পায়েল সকালের আকাশ দেখছে। আজ আকাশ টা নীল নয় কেমন ধূসর রঙা। বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। পায়েলের চুলগুলো হালকা হালকা উড়ে বেড়াচ্ছে, ছুঁয়ে দিচ্ছে অন্তুর মুখ,ঘাড়,গাল। ফোনের শব্দে পায়েল নড়েচড়ে উঠল। প্রেমবিলাস ভঙ্গ হওয়ায় চোখ রাঙিয়ে তাকাল অন্তুর দিকে। অন্তু মিনমিন করে বললো,

‘ আমার কোনো দোষ নেই পায়েল,আমি তোকে একদম বিরক্ত করি নি। করেছে আমার ফোন।’

পায়েল পকেট থেকে ফোন টা বের করে হাতে নিয়ে আছাড় মারতে যাবে তার পূর্বে আবারও বেজে উঠল। স্ক্রিনে চাইতেই ঠোঁটের কোণ ঘেষে ফুটে উঠল হাসি। রিসিভ করলো সাথে সাথেই।

‘ জলদি দশ কেজি মিষ্টি নিয়ে আয়। পাঁচ কেজি বাসায় রাখবি এবং বাকি পাঁচ কেজি বিশেষ কারো জন্য। ‘

পায়েল আদ্রের কথা শুনে হতভম্ব। কন্ঠে অবাকতা নিয়ে বললো,

‘ কেন?’

‘ কারণ আমি বাবা হচ্ছি।’

আদ্রের নির্বিকার স্বীকারোক্তিতে পায়েল বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কিছু বলার আগেই কেটে গেল কলটা।
.
.
তুলির হাত টা ধরে কাবার্ডের সামনে আনল আদ্র। কালো রঙের একটা শাড়ি বের করে বললো,

‘ তৈরি হয়ে নাও।’

হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলি অল্পক্ষণ। অথচ আদ্র ভ্রুক্ষেপহীন। তাড়া দিচ্ছে বার বার তৈরি হওয়ার জন্য।

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here