#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৪৯
কাছ থেকে পাখির ডাক তুলির কর্ণে এসে বিঁধছে। চারদিকে নিজের সুমিষ্ট ধ্বনিতে প্রভাত কে যেন মুখরিত করে তোলার জন্য উদ্যেগী হয়ে উঠেছে অচেনা, অজানা, না দেখা পাখি টা। তুলির মন জুড়িয়ে আসছে ছোট্ট ছোট্ট আওয়াজে। শহরে পাখির ডাক হাতে চাঁদ পাওয়ার ন্যায় তুলির কাছে। কতকাল শুনে না এমন সুন্দর ডাক। শাড়ি টা সামলে তুলি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। পাখির আওয়াজ টা অনুসরণ করে গুটি গুটি পায়ে, নিঃশব্দে বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সামান্য একটু শব্দেই যেন পাখিটা টের পেয়ে যাবে,সাথে চুরমার হয়ে যাবে পাখি টা কে দেখার স্পৃহা, অভিলাষ। কেননা পদলির ধ্বনিতে উড়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে।
তুলি দরজার একপাশে আড়াল করে দাঁড়াল। মাথা বের করে একটুখানি উঁকি দিতেই দেখল একটা ঝুঁটিওয়ালা পাখি। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকাল তুলি। চক্ষুদ্বয় পাখিটার উপর নিবদ্ধ রেখে ভাবতে লাগল কিছুক্ষণ। আকস্মিক ভাবনার সুতোয় টান পড়ে মস্তিষ্কে কিছু একটা ধরা দিতেই। চক্ষু জোড়া চকচক করে উঠল। মনে পড়ল এটা তো বুলবুলি। বুলবুলি পাখি। গ্রামে হুটহাট দেখা মিললেও শহুরে পরিবেশে দেখতে পাওয়া দুষ্কর। পাখি টা বেলকনির রেলিং এর উপর বসে আছে। তুলি আরেকটু এগিয়ে নিল দেহ টা। হাতে উপর অন্য একটা হাত পেঁচিয়ে ধরতেই তুলির শান্তিপূর্ণ আঁখি যুগল ভীত হয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। ঘাড়ে শুষ্ক ওষ্ঠের অনবরত স্পর্শে বুক টা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ওষ্ঠ যুগল তো ছুঁয়ে দিচ্ছে বাহ্যিক অংশ কিন্তু! তুলির মনপাজরে অদ্ভুতভাবে বিচরণ করে চলেছে,বিস্তার লাভ করছে,প্রখর হয়ে উঠছে অনুভূতি।
আদ্র তুলির মাথার উপর দিয়ে উঁকি দিল। ঠোঁটের কার্ণিশে মৃদু হাসি নিয়ে বললো,
‘ পাখি দেখছিলে?’
তুলি তখনও এক নজরে চেয়ে আছে বেলকনিতে। আদ্রর কন্ঠে ঘুরে দাঁড়াল। সাথে সাথেই রিমঝিম আওয়াজ তুলল হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি গুলো। নিমিষেই ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করল পুরো শ্যামবর্ণ মুখশ্রী। করুন চাহনি ছুঁড়ে দিল আদ্রর দিকে মাথা তুলে। আদ্র মৃদু হাসি বজায় রেখে বলে উঠল,
‘ তোমার চুড়ির ঝংকার শব্দেই বেচারা অথবা বেচারী বুলবুলি ভয়ে পেয়ে পালিয়েছে তুলা।’
তুলি আলতো হেসে আদ্রর কাছ থেকে সরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। বাড়ানো পা টা থামিয়ে স্থির হলো সামনে। ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করল,
‘ রেডি হয়েছি তো। কোথাও কি যেতে হবে?’
‘ যেতে হবে। খুব স্পেশাল একটা দিন আজ আবার কারো কারো জন্য সবচেয়ে নিকৃষ্ট, কুফা দিনও বলা চলে।’
কথাটা বলে আদ্র দ্রুতবেগে প্রস্থান করল। তবে অধর কোণে প্রস্ফুটিত তির্যক হাসি টা তুলির চক্ষু এড়ালো না। কিছু টা চিন্তিত, শঙ্কিত দেখালো তুলি কে। আদ্রর কথার আগামাথা না পারল বুঝতে,না পারল অর্থ উদ্ধার করতে।
.
.
আমরিন গালে হাত দিয়ে তুলিকে দেখে চলেছে নিষ্পলক। তুলি আমরিনের দৃষ্টি বুঝতে পেরেও নির্জীব, নির্বিকার বসে আছে। তোয়াক্কা করলেই যেন আমরিন ঝেঁকে ধরবে। কিন্তু কেন ধরবে?আমরিনের হাবভাব কেমন যেন ঠেকছে!পুরোই অসবর্ণ রহস্যের মতো। এক পলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। সূক্ষ্ম নিঃশব্দ নিঃশ্বাস ছেড়ে আমরিন তুলির সাথে বসে পড়ল গুটিশুটি মেরে। ব্যাকুল কন্ঠে বললো,
‘ আমি ফুপি হবো বললে তোকে খেয়ে ফেলব আমি?বেস্টফ্রেন্ড ভাবী হলে এমন শত্রু হয়ে যায় জানতাম না তো।’
তুলি পাশ ফিরে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চাইল। বেশ বৃহৎ আকার ধারণ করেছে আঁখিদ্বয়। মনটা নুইয়ে পড়ছে লজ্জায়, সংকোচে। কন্ঠে চরম অবাকতার ছাপ।
‘ কে বলেছে?’
‘ ভাইয়া বলেছে। শুধু আমাকে না এমনকি বাবা-মা,খালা-খালু সবাইকে জানিয়েছে। ‘
‘ কখন?’
‘ একটু আগে। জানিস ভাইয়া না খুশিতে বাবা কে জড়িয়ে বলেছে আমিও আপনার মতো বাবা ডাক শুনতে পাবো খুব শীগ্রই।’
প্রশান্তিতে ভরে গেল আমরিনের মুখ থেকে এসব শুনে। যতটুকু ভয় ছিল আদ্রর মনের অবস্থা নিয়ে তা নিঃশেষ হয়ে গেল। হ্যাঁ আদ্র খুশি। তার চেয়েও অনেক বেশি খুশি আদ্র। তুলির কাছে নিজের খুশি টা আদ্রর খুশির কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। খুবই নগন্য।
—————-
আজ বাহিরের পরিবেশ টা বেশ নির্মল। যেখানে অন্যান্য দিন বের হলেই কড়া রোদে,উত্তাপে মাথা ঘোরে,শরীর ঘেমে ভিজে উঠে আজ তার একটাও হচ্ছে না। বরং শান্তি শান্তি লাগছে সবকিছুতে। শেষ রাতের দিকে ঝড় হয়েছিল প্রচন্ড যার ফলে প্রকৃতিতে উত্তাপ নেই আছে কেবল ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। আদ্র হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। ১১টা বেজে ২০ মিনিট। শার্টের হাতা গুটিয়ে পাশ ফিরে তুলির দিকে তাকাল। নির্বিঘ্নে, নিভৃতে শাড়ি পড়ে ছোট ছোট পা ফেলে পাশাপাশি হেটে চলেছে মেয়েটা। ডান হাত টা বাড়িয়ে তুলির হাত মুঠোতে পুরে নিল নিমেষে। তুলি তীব্র অবাক হলো। চমকিত নয়নে চাইল সাথে সাথেই। কপোলে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল কিঞ্চিৎ। আদ্র কন্ঠে মুগ্ধতা এঁটে বলে উঠল,
‘ মনে হচ্ছিল দু’জন পথচারী কেবলমাত্র ফুটফাট ধরে হাঁটছি পাশাপাশি। এখন তোমার হাত টা মুষ্টিমেয় নিয়ে অনুভব করতে পারছি আমি কোনো অচেনা মেয়ের সান্নিধ্যে নয়,হাঁটছি আমার তুলার পাশাপাশি। তুমি কি অনুভব করতে পারছো তোমার আমার শুদ্ধ স্পর্শে এতক্ষণের শূন্যতা পূর্ণতায় রূপান্তর হয়েছে?’
তুলি জবাব দিল না। দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। সেই সাথে দাঁড়িয়ে পড়ল আদ্র। প্রশ্নসূচক দৃষ্টি ফেলতেই আদ্রর বাহুতে ধাক্কা দিতে লাগল তুলি। আদ্র হকচকালো। আচমকা এহেন কান্ড মোটেও বোধগম্য হচ্ছে না তার। বিচলিত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ কি হয়েছে?’
‘ নিচে নামুন আপনি ডাক্তার সাহেব। ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে হাঁটুন।’
পথচারী অনেকে চেয়ে আছে ওদের দিক। আদ্র তুলিকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখল। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ এগুলো কেমন কথা?আশপাশে সবাই দেখছে। ‘
‘ হুম। দেখছে তো সবাই। আপনি আইফেল টাওয়ার আর আমি লিলিপুট। রাস্তায় নামুন বলছি নয়তো আমি উল্টো ঘুরব এখন৷ তারপর সোজা হেঁটে বাসায় চলে যাব।’
এ মুহুর্তে গা কাপিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে আদ্রর। কিন্তু তা যে তার সাথে মানানসই নয়। তাই বোধহয় হাসল না। বাধ্য স্বামীর ন্যায় নেমে দাঁড়াল রাস্তায়। তুলি ফুটপাতের কিনারায় দাঁড়িয়ে আদ্রর দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে লজ্জালু হেসে বললো,
‘ এবার ধরুন। ‘
বলা মাত্র ধরল আদ্র। তুলি আদ্রর দিকে তাকাতেই নিজেকে একদম আদ্রর বরাবর আবিষ্কার করল। পার্থক্য এতটুকু সে এখন উঁচুতে এবং আদ্র রাস্তাতে। আবারও হাঁটছে দু’জন। গন্তব্য কোথায় জানা নেই তুলির। তবে আদ্র যখন বললো দু’জন আজ অনেকখানি হাঁটবে তুলি নাকচ করে নি। করবেই বা কেন?ঠিক কবে পাশাপাশি হেঁটেছে দু’জনে মনে পড়ছে না। তুলি মনে মনে বললো,’ হাঁটি নি কখনও এতোটা কাছাকাছি হয়ে,ভীরু ভীরু হয়ে পালিয়ে বেরিয়েছি সবসময়। ‘
বাড়ি থেকে খানিকদূরে চলে এসেছে দু’জন। রাস্তা জনমানবহীন। মাঝে মাঝে এক দু’জন লোক আসছে,যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে। আজ কি এই রাস্তায় মানুষের অভাব পড়ল নাকি!নানাবিধ কল্পনায় যখন মগ্ন তুলি তখনই আদ্র গাল ছুঁয়ে দিল অতি সন্তর্পণে। সর্বাঙ্গে কম্পন ধরে গেল তুলির। আদ্র ফের ছুঁয়ে দিল। সেকেন্ড বাদে ওষ্ঠ সরিয়ে এনে বললো,
‘ আমিই ছুঁয়েছি,দেখেছিও আমি। তবুও লজ্জা তোমার চিরসঙ্গী বুঝি?’
নিরুত্তর থাকল তুলি। আদ্র হাত টেনে কাছে নিয়ে এলো। কোমর আঁকড়ে ধরে শূণ্যে তুলে এনে নামাল রাস্তাতে। একহাতে বাহু জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। লহু স্বরে বললো,
‘ আমার ভালোবাসার অস্তিত্ব তোমার গর্ভে অথচ আমার থেকেই দূরে থাকা? আমি মানছি না,কখনও মানব না,মানতে হবে এমন সিচুয়েশন জীবনে আসতে দিব না। ‘
তুলি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল আদ্রর হাসোজ্জল মুখের দিকে। আদ্রের দু চোখে ভাসছে তার শ্যামবর্ণা চেহারা টা। রাস্তায় আদ্রর অদ্ভুত অদ্ভুত বাক্য তুলির অন্তস্থল কাঁপিয়ে তুলছে। মুখে কিছু বলবে তার পূর্বেই একটা গাড়ি এসে থামল কাছ ঘেঁষে। গাড়িটা চেনা চেনা মনে হলো। জানালার কাঁচ খুলে গেল আস্তে আস্তে। চক্ষে ভাসল চেনা,প্রিয় মুখের মানুষ গুলোকে। পায়েল বসে আছে ব্যাক সিটে। সামনে অন্তু,নিবিড়।
গাড়ি দরজা মেলে পায়েল বেরিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। তুলি হতভম্ব হয়ে গেল। পরক্ষণেই ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললো,
‘ তোমরা এখানে আপু?’
‘ তোমার ডাক্তার সাহেবই আসতে বলল। সাথে কিন্তু মিষ্টিও এনেছি। কংগ্রাচুলেশন।’
তুলি নত মস্তকে মিহি স্বরে বলে উঠল,
‘ ধন্যবাদ। ‘
পায়েল তুলি কে নিয়ে গাড়িতে বসে পড়ল। আদ্রও বসল তুলির পাশে। অন্তু দাঁত কেলিয়ে বললো,
‘ পাঁচ কেজি মিষ্টি ওদের খাওয়াবি?তুই শিউর?’
‘ ইয়াহ!মিষ্টির সাথে আরও অনেক কিছু খাওয়াব। পারফেক্ট সময় হয়ে গেছে। এবার চল।’
তুলি একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘ কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
‘ গেলেই দেখতে পাবে। ‘
আদ্রর গম্ভীর কন্ঠে তুলি চুপ মেরে গেল। ঘন্টা দুয়েক অতিবাহিত হতেই দেখল গাড়ি একটা বাড়ির গেইট দিয়ে ঢুকছে। বাড়িটা তুলির জন্য সম্পূর্ণ অচেনা। আদ্র কে উপেক্ষা করে চারদিকে ব্যস্ত চোখ বুলালো। বিয়ে বাড়ির মতো সাজানো সমস্ত বাড়িটা। ওরা কি কোনো বিয়ের দাওয়াতে এসেছে? তাই বলে কি মিষ্টি নিয়ে এল?সকাল হতেই আদ্র রেডি করিয়ে রেখেছিল! তুলির ছোট্ট মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকছে না। আদ্রের পিছু পিছু হেঁটে সবার সাথে বাড়িতে ঢুকল। উদ্ভট লাগছে ভীষণ। তবে বধূবেশে ইতি কে দেখে মাথা ঘুরে গেল। চোখের ভুল ভেবে ভালো করে তাকাল। একই রকম দেখল সবকিছু। ইতির পাশে বর বেশে অভিক কে দেখে আরেকদফা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল তুলি। ইতির সাথে অভিকের বিয়ে? বাড়িটা ইতিদের নাকি অভিকের?ওদের হলেও আদ্রসহ সকলে এখানে কেন এল?তুলি চমকপ্রদ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। আজ বুঝি চরমভাবে চমকে যাওয়ার দিন!
#চলবে,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)