আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-১৪

0
2891

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১৪

আকস্মিক বজ্রপাতের আওয়াজে যেমন করে মানুষ কেঁপে উঠে ঠিক তেমনই কম্পনের মৃদু ছাপ দেখা দিয়েছিল ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত থাকা সবার মাঝে। আদ্রের শান্তশিষ্ট নির্লিপ্ত জবাবে অবাক হওয়ার বদলে স্তম্ভিত সকলে। তুলি জড়তায় আড়ষ্ট হয়ে চেয়ার সেঁটে মাথা নিচু করে ফেলল। ক্রমশই হৃদপিণ্ডের কম্পন বেড়ে চলেছে তার। আদ্রের মতিগতি সে একদম বুঝে না। এই ছেলে কখন কি করে কারোই বুঝার সাধ্যি নেই। দু’দিন আগেও অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের পর সেটা গোপন রাখার কথা নিজেই ব্যক্ত করেছিল। এখন আবার নিজেই সেটা সবার সামনে প্রকাশ করছে। তুলির কাছে মনে হচ্ছে আদ্র কে বুঝতে হলে আরো একবার জন্ম নিতে হবে। কিন্তু সেটা কখনও সম্ভব নয়। মানুষ একবারই পৃথিবীতে আসার সুযোগ পায়। মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। হতে পারে এই মুহুর্তেই তুলির শ্বাস চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে অথবা বহু বছর আদ্রর হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দিতে পারে। সূক্ষ্ম একটা শ্বাস ছাড়ল তুলি। মনে মনে আওড়াল-” আপনার বুড়ো হওয়া রূপ দেখার জন্য হলেও আমি বহু বছর বাঁচতে চাই আদ্র।”

মুমতাহিনা খানম থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন। আদ্রের কথাটা শ্রবণ হতেই উনার মাথা টা ব্যাথায় ঝিম ঝিমিয়ে উঠল। এই বুঝি মাথার চুল ভেদ করে মস্তিষ্ক হতে গরম ধোঁয়া বের হবে। রূপসা, আমরিন,নিবিড়, পায়েল,অন্তু সবার চোখ প্রায় কোটর থেকে বেরিয়ে আসার অবস্থা। আদ্র তুলি কে পছন্দ করে এটা সবাই আন্দাজ করতে পেরেছিল,তাই বলে বিয়ে! এটা যেন অবিশ্বাস্য। কথাটা সবার কাছে এমন ঠেকছে যেন আম গাছে জাম ধরেছে। তবুও বিশ্বাস করিতে হইবে। কেননা আদ্র মিথ্যা বলার ছেলে না। সে যা বলবে একদম ক্লিয়ার কাট স্টাইলে। এক কথায় স্পষ্টভাষী!কারো ভালো না লাগলেও তাতে তার কিছু যায় আসে না। সুতরাং কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও বিশ্বাসযোগ্য। অতিশয় বিস্ময়ে নিজেদের আটকে রাখা শ্বাস কে মুক্ত করে রিলেক্স হয়ে চেয়ারে গা হেলিয়ে বসে পড়ল সবাই। শান্ত হতে পারলেন না একজন। মুমতাহিনা খানম তেজী কন্ঠে আদ্র কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

” তুমি মিথ্যে বলো তা তো জানতাম না আদ্র। আগেই বুঝতে পেরেছিলাম এই মেয়ে তোমায় ফাঁসাবে। রূপ নেই, যোগ্যতা নেই। গায়ের রং শ্যামলা যাকে কালো বললেও চলে। তোমার মতো এতো ফর্সা, লম্বা,সুদর্শন একটা মেধাবী, ডাক্তার ছেলেকে কীভাবে যে ফাঁসালো সেটাই বুঝতে পারছি না। তাই বলে তুমি বিয়ের বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলতে পারো না। আর যা-ই হোক এমন মেয়েকে বিয়ে করলে সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়বে আমাদের।”

তুলির দু চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এল। নত মস্তকে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কোনোমতে শব্দবিহীন কান্না আঁটকে রাখার চেষ্টায়। মুমতাহিনা খানমের অপমানজনক বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব তার কোমল মন মেনে নিতে অক্ষম। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তৌফিক সাহেব ও আফসানা দু’জনেই মেয়েকে করা অপমানে কষ্ট পেয়েছেন। মেয়ের জন্য বুকটা চিনচিন করছে দু’জনের। চোখ জলে ভরে এসেছে আফসানার। মেয়ের গায়ের রং নিয়ে কখনো কোনো আফসোস নেই তাদের। আফসানার গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা হলেও তিনি সবসময় আল্লাহর নিকট একটা শ্যামবর্ণা কন্যা চেয়েছেন। কিন্তু উনি যদি জানতেন শ্যামলা রঙের জন্য মেয়ে কে কিছু মানুষ অপমান করার সুযোগ পাবে তাহলে কখনো তিনি এমনটা চাইতেন না। মেয়ের কষ্ট সহ্য হয় না উনাদের।

এতোক্ষণ অব্দি আদ্র সটান হয়ে বসে মুমতাহিনা খানমের কথাগুলো হজম করেছে। সবার আপাত দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। তুলি কে কষ্ট দিয়ে কথা বলাতে আমরিন,রাদিফ সাহেব,সায়েরা বেগম,ঝুমু,অন্তু সবার মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। বুঝাই যাচ্ছে সবাই ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছে মেয়েটার জন্য। আহান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সংবরণের চেষ্টায় লেগে আছে। চোখ তুলে আদ্র ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবার পানে একবার চাইল। সবার নজর আদ্রর ইতিমধ্যে লাল বর্ণ ধারণ করা চক্ষুদ্বয়ে। তুলি নীরবে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। আদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তুলি কে দাঁড় করিয়ে নিজের কাছে টেনে হাতে হাত মুষ্টিমেয় করে শুধু এক পলক! এক নজর চাইল তুলির কান্নারত চেহারাতে। তাচ্ছিল্য হেসে শান্ত কন্ঠে মুমতাহিনা খানমের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

” শি ইজ মাই ওয়াইফ । এখন কি তা আমার ঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে হবে?আপনি তুলির যোগ্যতা নিয়ে বলেছেন। এতটুকু একটা মেয়ের এই বয়সে কিসের যোগ্যতা বিচার করেন আপনি? আজ আপনাকে ফুপু আম্মু বলতে আমার বিবেকে বাঁধছে, তাই আপনি আমার কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান পেলেও কখনো ডাক টা শুনতে পাবেন না। কারণ সেই যোগ্যতা আপনার নেই। যাদের মন মানসিকতা এতো নিচু এখনো মেয়েদের রূপ নিয়ে তাদের মনোভাব এমন, আর যাই হোক তারা সম্মানের যোগ্য না। তবুও আপনি পেয়ে যাবেন। কারণ আপনি আমাদের বড়। তুলির রূপ,গুণ না থাকলেও আমি আদ্র আহনাফ তাকে ছাড়া অচল। এই মেয়েটা আমার অস্তিত্ব। একটা মানুষের অস্তিত্ব না থাকলে কি তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়? তুলি আমার অস্তিত্ব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে যা অন্য কেউ পারে নি। তাহলে তো তুলির যোগ্যতার তুলনায় অন্য সবার যোগ্যতা নিছক। কি হবে সৌন্দর্য, রূপ,ডাক্তারি,সমাজ দিয়ে যদি আমার দেহে প্রাণ না থাকে!”

মুমতাহিনা খানমের তেজী রূপ নিমিষেই নিভে গেল প্রদীপের শিখার ন্যায়। থমথমে একটা পরিবেশ বিরাজমান। আদ্রর কথা শুনে তুলি কান্না থামিয়ে অপলক চেয়ে রইল সাদা মেঝেতে। একেকটা শব্দ মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হয়ে ঠিক তুলির হৃদপিণ্ডে বিঁধেছে। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল হৃদয়। অপর হাতে আদ্রর একটা হাত খামচে ধরে কিছু বলতে চেয়েও বলতে ব্যর্থ হলো। তাচ্ছিল্যের স্বরে আদ্র প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল মুমতাহিনা খানমের দিকে,

” আপনি আমার বউয়ের চোখের পানি ঝরিয়েছেন আপনার কথার মাধ্যমে। এখন কি আপনার যোগ্যতা আছে সেই চোখের পানি ওর চোখে ফিরিয়ে দেবার?”

এহেন প্রশ্নে অপমান ফিল করলেন মুমতাহিনা খানম। রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালেন। আদ্র ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,

” রিলেক্স। হাই প্রেশারের পেশেন্টের ক্ষেত্রে রাগ সুফল নয়। আমি জাস্ট আপনাকে এটাই বুঝাতে চেয়েছি পৃথিবীতে সব মানুষ সব ধরনের যোগ্যতা নিয়ে পদার্পণ করে না। আপনি দিশেহারা হয়ে বলেছেন আমি মিথ্যে বলেছি। মোটেও মিথ্যে বলি নি। নিজের বাবা-মা,শশুর -শাশুড়ী কে সাক্ষী রেখে আমি তিন কবুলের মাধ্যমে তুলিকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী রূপে কবুল করেছি। আপনাদের জানানো হয় নি। সরি ফর দ্যাট। রেজিষ্ট্রেশনের সময় অবশ্যই জানাব।”

আদ্রর কথার পৃষ্ঠে কিছু না বলেই মুমতাহিনা খানম বেরিয়ে যেতে লাগলেন। ছেলেকে কিছু বলে লাভ নেই কারণ আদ্রর বলা প্রত্যেক টা কথা সঠিক,তাই উপায় না পেয়ে বোন কে বুঝাতে পিছু পিছু ছুটলেন রাদিফ সাহেব। সায়েরা বেগম ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। রূপসা তুলির কাছে এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বলল,

” হাই লিটল ভাবী। মায়ের কথায় কষ্ট পাবে না প্লিজ। ”

রূপসা চলে যেতেই সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আদ্র তুলির হাত ছেড়ে দিয়ে গটগট পায়ে উপরে চলে গেল। তুলি কে নিজের কাছে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরল আমরিন। আমরিনের উষ্ম স্পর্শ পেয়ে তুলি চেপে রাখা কান্না টা বাঁধ মানল না। শব্দ করে কেঁদে উঠল বাচ্চাদের মতো। পাশ থেকে রিমা মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠল,

” ফুপু খালি এমন করে। নিজেরে রূপসী ভাবে। এক্কেরে ঠিক হইছে আদ্র ভাই আজকা কথা শোনায় দিছে ভালা কইরা। তবে ভালাই সম্মান দিছে,আমি হইলে দো একটা চুলও রাখতাম না।আর,,,”

সায়েরা বেগমের চোখ রাঙানিতে দাঁত কেলিয়ে থেমে গেল রিমা। তার কথা শুনে বাকি সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। পায়েল তো ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এনে সবাইকে খাওয়াতে ব্যস্ত। প্রাণ প্রিয় বন্ধুর জীবনের একটা গতি হয়েছে বলে কথা। তুলির মুখের সামনে একটা মিষ্টি ধরে বলে উঠলো,

“চুপিচুপি বিয়ে শেষ তাতে কিন্তু আমরা রেগে আছি। তবে ভাবী আপনি যদি মিষ্টি টা খান আমাদের মুখে ফোঁটে উঠবে মিষ্টি হাসি।”

ফিক করে হেসে দিল তুলি। মূলত তাকে হাসানোর জন্যই পায়েলের সেই শ্রুতিমধুর সমৃদ্ধ বাক্য।
________

আজ সারাটাদিন যেন বাড়িতে এক তুমুলযুদ্ধ লেগে ছিল। আর সেই যুদ্ধের ইতি টেনেছিল ডক্টর আদ্র আহনাফ,তুলির কাছে এটাই মনে হচ্ছে। আকাশের অনেকখানি জায়গা দখল করে থালার মতো বিশাল বড় এক চাঁদ প্রকৃতিকে নিজের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে চারদিক। দূরে অবস্থিত পাহাড় টা তুলির চোখে ঝাপসা ঝাপসা দৃশ্যমান। চোখ বুঁজে নিল তুলি। বন্ধ চোখে কল্পনায় ভেসে উঠল আদ্রর সুদর্শন চেহারা টা। সাথে সাথেই তুলির ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল। অযাচিত মনে বলল,

“ইশ!আকাশে তারার মেলার ভিড়ে যদি আপনি থাকতেন?তবে আকাশ টা আমি আমার নামে লিখে নিতাম। আর মনের সুপ্ত কোণে সঞ্চারিত অনুভূতি কে আপনার নামে উৎসর্গ করে শুধু একটা!একটা প্রশ্নই করতাম,’আমি নাহয় আকাশ হবো, আপনি কি আমার আকাশের তারা হবেন আদ্র?’

উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের স্পর্শে বন্ধ চক্ষুদ্বয় খুলে গেল তুলির। কেঁপে উঠল বুক টা। তড়িঘড়ি করে পিছন ফিরতেই চক্ষে ভাসল কল্পনার জগতে বিচরণ করা সেই সুঠাম দেহের অধিকারী যুবকের চেহারা। চাঁদের আলোয় তুলির নয়ন জোড়া আটকাল যুবকের প্রশস্ত উদোম বুকে। কি সুন্দর করে শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে রেখেছে ছেলে টা। একবারও ভাবল না তুলির মতো কতো মেয়ের বেহায়া আখিঁযুগল আঁটকে যেতে পারে ফর্সা বুকে। তুলির কপট রাগ হল মনে মনে। কেননা প্রকাশ করা তার নিকট কঠিন। এই ছেলের ভয়ে চুপসে থাকে সারাক্ষণ আর তার প্রতি রাগ দেখানো তো অসাধ্য। ইচ্ছে করল শার্টের দু’টো বোতাম লাগিয়ে দিতে। কিন্তু পারল না তুলি। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। হুট করেই তার মনে হলো আদ্র একটু আগের বলা কথাগুলো শুনে নি তো!তুলি আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,

” আপনি এখানে?”

” হৃদপিন্ডের উঠানামা এতো দ্রুত গতিতে হচ্ছে কেন?”

আদ্রর প্রশ্নে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলি। তৎক্ষনাৎ লজ্জায় শিউরে উঠল দেহের সর্বাঙ্গ। ভাবলেশহীন আদ্র। চাঁদের আলোয় তুলির লজ্জিত ভাবমূর্তি অবলোকন করে পুনরায় বলে উঠল,

” আমি কি বাঘ?তোমায় খেয়ে ফেলব?”

দ্রুত বেগে দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে না বুঝাল তুলি। স্মিত হাসল আদ্র। তুলির আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,

” তবে আমি কাছে আসলে বুকের উঠানামা কেন বেড়ে যায়?তুমি কি চাও আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলি?আমি কিন্তু এতো জলদি কন্ট্রোললেস হতে চাই না তুলা।”

তুলির ইচ্ছে হলো এখুনি এই বেলকনি থেকে লাফ দেওয়ার। কিন্তু সে বাঁচতে চায় বহু বছর এই ঠোঁট কাটা স্বভাবের বেপরোয়া, বেহায়া ছেলেটার সাথে। ধুরু ধুরু বুক নিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আদ্রের হাতের বাঁধনে বাধা পড়ল।

” রেডি হয়ে নাও। একটু পরেই ঢাকা ফিরে যাব আমরা।”

অবাক হল তুলি। আজকে তো ফিরে যাওয়ার কথা না। মা তো বলল আরো দু’দিন এখানে থাকবে সবাই। অবাক ভঙ্গিতে বোকার মতো প্রশ্ন করল,

” কেন?”

আকাশ পানে চেয়ে আদ্র শিষ বাজাতে বাজাতে উত্তর দিল,

“সংসার করার জন্য। ”

#চলবে,,,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here