#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব-[৩]
চৈত্রের সকাল। চারদিকে কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন আবার আকাশ টা মেঘে পরিপূর্ণ। ধরণীর বুকে বৃষ্টি হয়ে আছড়ে পড়বে পড়বে ভাব। গায়ের ওড়না টা ভালোভাবে জড়িয়ে রাস্তায় ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে তুলি। তার কাছে চৈত্রের সকালের রূপ টা বেশ লাগে। চৈত্র মাসের সকাল টায় যেন তুলি প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। সকালের প্রহর কেটে দুপুরে ভ্যাপসা গরমে,কাঠফাটা রোদের তেজে অবিশ্রান্ত হওয়া মানুষগুলোর নিকট তো সকালের এই নির্মল পরিবেশ টায় অমৃত ও মনোমুগ্ধকর। তুলির কাছে সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া বরাবরই পছন্দ। মনের প্রতিটি কোণায় একদম সতেজতা ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা এসেও প্রভাতে হাঁটার অভ্যেস বদলে নি তুলির। পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চুল গুলো বাতাসে হালকা উড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে আদ্রদের গেইটের সামনে এসে পা জোড়া থমকে গেল। নির্ঘুম চোখ জোড়া ছটফট করতে লাগল কাউকে এক পলক দেখার তৃষ্ণায়। সারাটা রাত নিকষ কালো আঁধারে ছটফট করছিল তুলির বিক্ষিপ্ত মনটা। কিছু সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতি তুলির ভিতরে প্রতিনিয়ত তোলপাড় করে চলেছে। তবে কি সতেরো বছরের কিশোরী জীবনে আবেগের প্রস্ফুটন ঘটছে নাকি অন্যরকম ভয়ংকর ভালো লাগার জন্ম নিচ্ছে?
”
”
তুলি কে দেখতে পেয়েই দারোয়ান মুখে হাসি ফুটিয়ে গেইট খুলে দিল। দু টানা মন নিয়ে ভিতরে পা বাড়াল তুলি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঠোঁটের কার্ণিশে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠল। মনে পড়ে গেল গতকাল হসপিটালের কথা। আদ্রর সেই উদ্বিগ্ন চেহারাটা। ইশ!কি মনোরম ছিল সেই দৃশ্যখানি। তুলি নিষ্পলক চেয়েছিল আদ্রর দিকে। এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা যায় ইহা ছিল মুগ্ধতার চাহনি।
সেদিন~
পিটপিট করে চক্ষুদ্বয় মেলে তুলি নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল। আঁতকে উঠল তুলি। মাথা টা প্রচন্ড ভারী অনুভব করতেই উঠে বসার বৃথা প্রয়াস চালাল। উঠতেই নিলে ব্যাথায় আহ্ করে চিল্লিয়ে উঠল। দু চোখ বুঁজে কপালে দু হাত ঠেকিয়ে বসেছিল আদ্র। মৃদু চিৎকারের আওয়াজ কানে আসতেই সোফা থেকে উঠে ছুটে এল দ্রুত গতিতে। তুলির দিকে না তাকিয়েই হাত টা আগলে ধরে অস্থির হয়ে পড়ল। তুলিও দ্বিকবিদিক ভুলে মগ্ন হয়ে পড়ল আদ্রর অস্থির চেহারা দেখতে। নিমিষেই তুলির মনে প্রশ্ন জাগল-” এত্তো সুন্দর মাদকতায় ভরপুর চোখ গুলো লাল কেন হল?সমস্ত শুভ্র চেহারা জুড়ে বিষন্নতার ছাপ কেন?উনি কি পাগল?নাহলে এমন পাগলামি করছেন কেন?” মনের প্রশ্নগুলো মনে চেপে রেখেই তুলি নিজের হাতের দিকে চেয়ে দেখল লাল তরল বর্ণ। ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখতে পেল তাকে স্যালাইন দেওয়া ছিল। হঠাৎ টান পড়ায় হাতের সুচ নড়ে গিয়ে গড়গড় করে রক্ত বেরোতে লাগল। কিন্তু রক্ত আর ব্যাথা বিন্দু মাত্র ছুঁতে সক্ষম হল না তুলির মন কে। তুলি তো স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যতিব্যস্ত আদ্র তে। তুলির মন বলছে-“দেখ তুলি তোর সামান্য ব্যাথা কেমন অস্থির করে তুলেছে ডাক্তার সাহেব কে!” সত্যিই কি তাই?ডাক্তার রা কি রোগীর জন্য এমনটাই করে?আদ্র তুলির হাতের স্যালাইন খুলে খুব যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিল। কোমল,নরম হাত টার দিকে অপলক চেয়ে দু চোখ বুঁজে নিল। তুলি কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল তুলি। আদ্রর অগ্রাহ্য টা মেনে নিতে পারল না তার ফুটন্ত অনুভূতি গুলো। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। অন্য হাতে দ্রুত মুছে ফেলল। আদ্র নামক মানুষ টা কে চিনতে তুলির হয়ত খুব বেগ পোহাতে হবে। মানুষ টা তুলির নিকট কখনও বৃষ্টি তো কখনও তেজী রৌদ্দুর।
দরজা ঠেলে আমরিন ও ইনশিতা কে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করতে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে ফেলল। ইনশিতা ও আমরিনের মলিন মুখে টা দেখে কিছু টা কষ্ট অনুভব করল। মলিন স্বরে প্রশ্ন করল-
“কি হয়েছে আপু? ”
” আমরা দুঃখিত তুলি। আমরা তোকে আগলে রাখতে পারি নি।”
“কেন কি হয়েছে ইনশিতা আপু?”
আমরিন একটা টুল টেনে তুলির পাশে বসে বলতে শুরু করল –
” তুই সকালে খেয়েছিস না তা জেনেই আমরা তোকে নিয়ে আসলাম। তোর শরীর খুব দুর্বল ছিল। হয়তো খাবারে খুব অনিয়মিত করিস তুই। ভাইয়া তোকে বেহুঁশ হতে দেখে তাড়াতাড়ি করে কেবিনে শিফট করে। আমরা তো ছুটে এসে দেখে অবাক। ভাইয়া কেমন পাগলামি করছিল। প্রচন্ড রেগে গিয়েছিল। ভাইয়া কখনও আমাকে ও ইনশিতা আপু কে বকে নি। আজ আমাদের দোষের জন্য আমাদের খুব বকেছে। একদম ঠিক করেছে আমাদেরই উচিত ছিল তোর খেয়াল রাখার। খালামণি কে বলে এসেছিলাম তোকে রাস্তায় কিছু খাইয়ে দিব কিন্তু আমরা ভুলে গেলাম। ভাইয়া কখনও কোনো কিছুতে অবহেলা পছন্দ করে না তাই হয়তো! ”
আমরিনের কথা শুনে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল তুলি। সামান্য ব্যাপারে এতো বকতে হয় নিজের বোনদের। তুলি ভ্রু কুঁচকে দুর্বল গলায় বলল,
” আমি খাই নি এটা আমার ব্যাপার। আদ্র ভাইয়া তাই বলে তোদের বকবে?উনি তো একটা গম্ভীর, রাগী স্বভাবের মানুষ।নিজের বোনদের ও ছাড় দেয় না।”
” নো তুলি। আমাদের ভাইয়া বেস্ট ভাইয়া। আমাদের ভাইয়ার মতো কেউ হতে পারবে না। ভাইয়ার মতো ভালোবাসা আমাদের কেউ দিতে পারে নি, আর না কখনও পারবে। ভাইয়াকে খুব বেশি ভালোবাসি আমরা। ভাইয়ার জন্য আমরা দু বোন জীবন দিতেও কুন্ঠাবোধ করব না। হি ইজ বেস্ট। ”
ইনশিতা ও আমরিন একসাথে কথাগুলো বলে উঠল। তীব্র থেকে তীব্রতর অবাক হয়েছিল তুলি সেদিন দু বোনের ভাইয়ের প্রতি অবিরাম ভালোবাসা দেখে। বড় ভাই বুঝি এমনই হয়। ইনশিতা ও আমরিন যখন ভাইয়ের কথা বলছিল কি উপচে পড়া খুশি ছিল দুই বোনের চোখে মুখে। অনাসয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিল তুলি আদ্র বোনদের অসম্ভব ভালো না বাসলে এতটা খুশি দেখা যেত না আমরিন ও ইনশিতার চেহারায়। সত্যিই হয়তো আদ্র ভাই হিসেবে পারফেক্ট! আমরিন ও ইনশিতা তুলি কে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল অনেকক্ষণ। যেন তুলি কে আগলে রাখাই ওদের মুখ্য কাজ। সেদিনের পর আর দেখা পায় নি তুলি আদ্রর। সারারাত নিদ্রাহীন প্রহর কাটিয়ে আজ হাজির হয়েছে চৌচির হয়ে থাকা মন নিয়ে। আশা একটাই হঠাৎ কোনো ঢেউয়ের দর্শনে তৃষ্ণা মিটানোর।
________
সদর দরজায় এসে দাঁড়াতেই হাতে অকস্মাৎ আলতো স্পর্শ অনুভব করতেই প্রখরভাবে কেঁপে উঠল তুলির পুরো শরীর। চকিতে তাকাল সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যক্তির দিকে। তাকাতেই পরম ভালো লাগা বিস্তার করতে লাগল চোখ মুখ জুড়ে। মৃদু হেসে সায়েরা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইল। সায়েরা বেগম পরম মমতায় তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে বাড়ির ভিতরে টেনে নিলেন। সোফায় পাশে বসিয়ে চিন্তিত স্বরে বলে উঠলেন,
” কি রে মা এতো সকালে বেরিয়ে এলি যে?কাল তো ইনশিতা ও আমরিনের মুখে শুনলাম তুই নাকি বেহুশ হয়ে গিয়েছিলি?শুনে আমার বুক টা কেঁপে উঠেছিল। ঠিকমতো খাবার খাবি এখন থেকে। আফসানা আসলে ঠিক মতো বকে দিব। সে কি জানেনা আমার তুলির কিছু হলে তার রক্ষে নেই। ”
অতিরিক্ত স্নেহে তুলির চোখে জলের সঞ্চার হল। ইচ্ছে করল কেঁদে ভাসিয়ে দিতে। ইনশিতা, আমরিন,আদ্রর মা সায়েরা বেগম। এই মানুষ টা তুলি কে একটু বেশিই স্নেহ করে। অথচ উনি কি জানে উনার রাগী, বদমেজাজী ছেলে কি পরিমাণ ভয় দেখায় তুলি কে?জানেন হয়ত!কিন্তু কি করার। আদ্র যা রাগী। বাড়ির প্রত্যেক টা মানুষ আদ্রর রাগে দমে থাকে তা নয় বরং মাত্রারিক্ত ভালোবাসে তাকে। তুলি সায়েরা বেগমের কাঁধে মাথা রেখে ঠোঁট উল্টে বলে উঠল-
“আম্মুর দোষ নেই খালা মণি। আমারই দোষ। আচ্ছা ইনশিতা আপু ও আমরিন কি ঘুমোচ্ছে?”
” সকাল ছয়টায় ওদের কাছে গভীর রাত বুঝছিস। আর ওদের সকাল হল নয়টার পর। যদি পারিস একটু মানুষ কর দুটো কে। একটার তো কয়েকদিন বাদে বিয়ে অথচ দশটা পর্যন্ত ঘুমের স্বভাব পরিহার করার নাম গন্ধ নেই। ”
কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সায়েরা বেগম। তুলি তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে পড়ে হাসি মুখে বলে উঠল-
” আমি ওদের রুমে যাই খালামণি?”
” তুই আমার আরকেটা মেয়ে। এই বাড়িতে আসতে অথবা বাড়ির কোথাও যেতে তোর কোনো পারমিশনের প্রয়োজন নেই তুলি।”
তুলি অতি আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে সায়েরা বেগম কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। খানিক সেকেন্ড বাদে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল ইনশিতা ও আমরিনের রুমে যাওয়ার জন্য। যাওয়ার পথে তার নজর গিয়ে আটকালো কর্ণারের রুমটার দিকে। মন কে হাজার টা গালি দিয়ে তুলি পা বাড়াতে নিলে বাঁধা পড়ল মনের কাছে। পা টিপে টিপে অতি সাবধানে রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা টা হালকা ভেজানো দেখে কীয়ৎক্ষণ বিস্মিত হলেও দুরুদুরু বুক নিয়ে একটা বার শুধু একটা বার তৃপ্ততার ছোঁয়া পেতে শব্দহীন পায়ে রুমে ঢুকে পড়ল। ঘোর অন্ধকারে ঢাকা রুমটা। সকালের হালকা আলোও বরাবর ব্যর্থ হচ্ছে সাদা পর্দা সরিয়ে রুমে প্রবেশ করতে। তুলি একটা বার ভাবল পর্দা গুলো সরিয়ে দিবে পরক্ষণেই মনে পড়ল সে তো চোর। চুরি করে কাউকে এক পলক দেখার টানে ছুটে এসেছে। বিছানার কিছুটা কাছে এসে দাঁড়াল ভীতি,শঙ্কা নিয়ে।
”
”
আকস্মিক ঘাড়ে উষ্ম গরম নিশ্বাস অনুভব করতেই শরীরের প্রত্যেক টা পশম শিউরে উঠল। শ্বাস ভারী হয়ে আসতে লাগল ক্রমাগত। ধরা পরে গেলে যেমন অনুভত হয় ঠিক তেমনভাবে হাসফাস করতে লাগল। তুলি উপলব্ধি করতে পারছে তার অতি সন্নিকটে দাঁড়িয়ে কেউ । বেহায়া মনের আকুতি কে প্রশয় দিয়ে মোটেও এই রুমে পদার্পণ করা উচিত হয় নি তার। আদ্র যদি লাজলজ্জাহীন মেয়ে বলে আখ্যায়িত করে?ভেঙে পড়বে সে। পিছন ফিরে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই সামনে উপস্থিত ব্যক্তির সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে কোমরে দু’টো বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন পেল। হাত দিয়ে খামচে ধরল আদ্রর কালো টি শার্টের বুকের কাছের কিছু অংশ। কোমরে হাতের আলতো চাপ দিয়ে তুলি কে নিজের অতি নিকটে টেনে নিল আদ্র। ভয়মিশ্রিত সারা মুখশ্রী তে চোখ বুলিয়ে এক হাত দিয়ে লাইটের সুইচ অন করল। ভয়,সংকোচে তুলির গাল দুটো রাঙা হয়ে উঠেছে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে যা বেসামাল করে তুলছে আদ্র কে। আদ্রর ঘুম ঘুম মুখ টা দেখে এক মুঠো শান্তি ছুঁয়ে গেল তুলির হৃদপিণ্ডে। অতিশয় মুগ্ধতা নিয়ে পলকহীন তাকিয়ে রইল লজ্জা -শরম উচ্ছন্নে দিয়ে। সূক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদ্র। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। মোলায়েম স্বরে বলে উঠল,
” আপনার রুমে আপনাকে স্বাগতম স্নিগ্ধময়ী তুলা।”
#চলবে,,,,
{ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। }