আকাশে তারার মেলা সিজন2 পর্ব-৪

0
3516

#আকাশে_তারার_মেলা_২ ✨
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -[৪]

চোরকে কখনও অতি খাতির যত্ন করতে দেখেছেন?হয়ত দেখেছেন অত্যধিক সমাদরের নামে উত্তম মধ্যম দিতে। তুলি স্বয়ং অভিলাষ কে সমর্থন জানিয়ে, মন স্পৃহা পূর্ণ করার অতীব আকাঙ্ক্ষায় লজ্জা -সংকোচকে মাটি চাপা দিয়ে চোরের মতো উপস্থিত হয়েছিল এক যুবকের সুদর্শন চেহারা দেখতে। অথচ তুলি নামক চোর কে অত্যন্ত যত্নের সাথে খাওয়ানো হচ্ছে। চেয়ারে বসে একটু একটু করে স্যান্ডউইচে কামড় বসাচ্ছে তুলি। তার বড় বড় কাজলে অঙ্কিত চোখ দুটোর দৃষ্টি সূদুরে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রর দিকে। কিন্তু আদ্র এক পলকও ফিরে তাকাচ্ছে না,যা ভীষণ পীড়া দিচ্ছে তুলির নতুন নতুন জন্মানো সুপ্ত অনুভূতিগুলো কে। তবুও প্রসন্নতা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। তুলি এখনও প্রচন্ড চমকিত যে আদ্র তার রুমে আসা নিয়ে কিছুই বলে নি। বিন্দু মাত্র রাগের আভাও ফুটে উঠে নীলাভ চোখের মণিতে। ছিল শুধু মাদকত!আর এক চিলতে হাসির রেখা। অতঃপর হাসিতে বিভোর হওয়া তুলি কে পরম যত্নের সহিত চেয়ারে বসিয়ে আদ্র নিচ থেকে নাস্তা এনে খেতে দিল। তুলি হতবিহ্বলতার রেশ কাটিয়ে উঠার আগে আদ্র তাকে খাওয়ার ইশারা করে বারান্দায় চলে গেল।


বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চিন্তায় মগ্ন আদ্র। সূর্যের কিরণ এসে আদ্রর উজ্জ্বল ফর্সা চেহারায় ছুঁয়ে চলেছে অনবরত। হাতে ধোঁয়া উঠা সিগারেট। সিগারেটের দূষিত ধোঁয়া সকালের নির্মল বায়ু কে বিষাক্ত করে তুলছে। তুলি ধীর পায়ে হেঁটে এসে আদ্রর পাশে দাঁড়াল। কিছুটা সাহস জুগিয়ে আলতো স্বরে বলে উঠল-

” ডাক্তার হয়ে সিগারেট খেয়ে ভিতরটা বিষাক্ত করে চলেছেন। তাহলে অন্যের চিকিৎসা কিভাবে করবেন?অন্যকে সুস্থ করার জন্য নিজেকে সুস্থ রাখা অধিক জরুরি তা কি আপনি জানেন না আদ্র ভাইয়া?”

তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি হাসল আদ্র। সিগারেট টা ফেলে দিয়ে দ্রুত বেগে তুলির হাত টা আকড়ে ধরে একদম কাছে টেনে নিল। আকস্মিক হামলায় ঘাবড়ে গেল তুলি। ধুক করে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। প্রখর ভাবে ছুটতে লাগল হৃৎস্পন্দন।

” বিষাক্ততা অনুভব করার ক্ষমতা কি হয়েছে তোমার তুলি?আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে বিষাক্ত ফোঁড়ার ন্যায় বিষ ছড়িয়ে রয়েছে। এই বিষের উপশম পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করি আমি প্রতি রাত,বহু আঁধার কাটে আমার নিদ্রাহীন। সিগারেটের ধোঁয়ার বিষ সেই বিষের নিকট অতি নিছক।”

আদ্রর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন ঝংকার তুলে তুলির শ্রবণ গ্রন্থিতে প্রবেশ করল। প্রবল স্রোতের ন্যায় ভয়ংকর কিছু অনুভূতিরা হৃদয়পটে আছড় কেটে গেল। সমস্ত লজ্জা সংবরণ করে মুখ উঁচুতে তুলে আদ্রর দিকে করুন চাহনি নিক্ষেপ করল তুলি। আদ্রর কন্ঠে বিষাদের রেশ ছিল তা বেশ অনুভব করেছে সে। খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, ” সামান্য নিছক বিষটা নাহয় ত্যাগ করুন। ” তুলিকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে নিলেই গড়গড় করে মনের কথাটা ব্যক্ত করে ফেলল। মৃদু হাসল আদ্র। তুলির পা থেকে মাথা পর্যন্ত চক্ষু নিবেদন করল। মেয়েটা বেশ পিচ্চি। বয়স বলুক আর উচ্চতায়!দু’টো ক্ষেত্রেই বেশ পিচ্চি। তবুও কেন এতো তোলপাড় হয় তার হৃদপিণ্ডে?আদ্রর চাহনিতে দৃষ্টি পড়তেই দমে গেল তুলি। এমন চাহনি এর আগে দেখে নি সে। মাদকতাময় চাহনি যেন তুলির মন টা কেও তীব্র নেশার অতল গহ্বরে তলিয়ে দিচ্ছে। শ্যামবর্ণা তুলির আদ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,

” এভাবে তাকাবেন না আদ্র । আমার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন?হৃদয়ে উঠা ঝড় কি আপনাকে ছুঁতে পারছে?নিজেকে রক্ষা করতে আপনার ওই প্রশস্ত বুকে মুখ লুকালে তো উপাধি দিবেন আমি নির্লজ্জ,চরিত্রহীনা।”

কাঁপা কাঁপা পা দুটো সামনে বাড়াল তুলি। আদ্রর দিকে তাকানোর সাহস যে তার আর নেই। এখন তার পালিয়ে যাওয়ায় শ্রেয়। আদ্রর সাথে পরিচয় হয়তো চার থেকে পাঁচ দিনের তবে তার সম্পর্কে যতটুকু জানে আদ্রর রাগের শিকার যে হবে তার আর রক্ষে নেই। অন্যায় ও মুখের উপর কথা বলা এই লোকের মোটেও পছন্দ না তুলি আমরিনের কাছ থেকে জেনেছে। তুলি তো এতো ছোট হয়েও মুখের উপর কথা বলেছে আবার মেরে বসবে নাতো!তুলির ভাবনার জগতকে উচ্ছেদ করে একটা কোমল কন্ঠ কর্ণপাতে ভেসে আসল। নিমিষেই আঁটকে গেল তুলির দু’পা মেঝেতে।

“ছাড়িয়ে দাও।”

“কি?” (ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল)

” বিষাক্ততার ধোঁয়া ছাড়িয়ে মুক্ত করো আমায়।”

আদ্রর দিকে এক পলক চেয়ে তুলি কিছু একটা ভেবে বলে উঠল,

” সিগারেট? ”

” জ্বী”

অতিশয় বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল তুলি। সে কিভাবে ছাড়াবে সিগারেট? এমন আজব কথা বলছে কেন আদ্র নামের লোকটা?কিছুক্ষণ ভেবে প্রতিত্তোর করল,

“ছাড়িয়ে দিলে কি দিবেন?”

” তুমি যা চাও।”

” একটা বেগুনি রঙের শাড়ি দিবেন?”

ভ্রু কুঁচকে এল আদ্রর। দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেলকনিতে ঘেঁষে দাঁড়াল। রসাত্মক স্বরে বলে উঠল,

“তোমার শাড়ি পড়ার বয়স হয়েছে? ”

প্রশ্নটা তুলির ছোট্ট মনে এক ঝাঁক রাগের বাসা বেঁধে দিল। সতেরো বছর বয়স কি শাড়ি পড়ার জন্য যথেষ্ট না?তুলি যদি পারত তবে এ মুহুর্তে আদ্রর কানে চিৎকার করে বলত–” নীল বর্ণের নেশা মিশ্রিত চোখ দুটো কে একজন চক্ষু ডাক্তারের সাক্ষাৎ করিয়ে আনেন ডাক্তার সাহেব।” কিন্তু মেয়েটা বড্ড অসহায়। বলার অপরাধে না জানি গাল লাল হয়ে উঠে। সেই আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে থমথমে গলায় বলল,

” আমার শুধু শাড়ি না সংসার করার বয়স ও হয়েছে ডাক্তার সাহেব। ”

নিজের কথায় নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল তুলি। মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে আদ্রর দিকে তাকাল। কারণ আদ্র হুট করেই একদম মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে উঠেছে নিমিষেই। ভয়ে তুলির প্রাণ পাখি বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিছু বলতে নিবে তার আগেই আদ্র ডান হাত টা খপ করে ধরে কনিষ্ঠ আঙুলে কামড় বসিয়ে দিল। গাঢ় স্বরে বলে উঠল,

“সহ্য করার বয়স হয়েছে তো?”

শীতল হয়ে উঠল তুলির পুরো দেহ। লজ্জায় মরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগল। প্রথমবার! কিশোরী জীবনে প্রথমবার এমন স্পর্শের সম্মুখীন হয়েছে। কি করল এটা আদ্র!তুলির চোখে লজ্জার ছাপ। তাতে যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মানুষটার। কালো ওড়না টা আঁকড়ে ধরে একটা অংশ দিয়ে তুলির চোখের কাজল গুলো মুছে দিল অতি যত্নসহকারে। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,

” আমি দেখেছি,আর কারো দেখার প্রয়োজন নেই ।”

এক মুহুর্ত ও দাঁড়াল না আদ্র চলে গেল পাশ কাটিয়ে। কিন্তু রেখে গেল অজানা ঘোরে ডুবন্ত তুলি কে।
___________

উত্তপ্ত দুপুর। চৈত্র মাসের শেষ প্রহর তবুও কতটা উত্তাপ। রোদের প্রখরে ঘেমে একাকার তুলি। তার পাশেই সমান তালে হাঁটছে আমরিন। কলেজ ছুটি হয়েছে খানিক সময় আগেই। মৃদুস্বরে বলে উঠল-

” আজ সব মেহমান চলে আসবে তুলি। তুইও কিন্তু আজ থেকে আপুর বিয়ে অব্দি আমাদের বাসায় থাকবি।”

তুলি খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠল,

” আমি তো এখনই চলে যাব।”

তুলির হাসি দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল আমরিনের। মেয়েটা কে তার ভীষণ ভালো লাগে। কারো সাথে সহজে মিশতে পারে না আমরিন। বিশ্বাস করার অযোগ্য হলেও এটাই সত্য সতেরো বছরের জীবনে একটাও ফ্রেন্ড নেই তার। তবে এখন আছে। তুলি এখন তার শুধু বেস্ট ফ্রেন্ড না তার চেয়েও বেশি। অন্যদিকে তুলির পুরো অন্তর জুড়ে প্রফুল্লতা বিরাজমান। কয়েকটা দিন আদ্রর একদম সান্নিধ্যে থাকতে পারবে ভাবতেই মন চাইছে খুশিতে নাচতে। তুলি জানে না অনুভূতি গুলোর সঠিক ব্যাখা। কিন্তু তার কিশোরী মন টা আসক্ত হয়ে পড়েছে আদ্র তে। “আদ্র” নামটা শুনলেই প্রশান্তির নির্মল বাতাস বয়ে যায় মনের প্রতিটি কোণায় কোণায়। তেজস্বী রোদ অবিরাম বিরক্ত করলেও তুলির ঠোঁটে ভালোলাগার হাসি। হাসিটাও হয়তো তুলির চিকন দুটো ওষ্ঠদ্বয়কে আলিঙ্গন করে বলছে “তোর কিশোরী জীবনে গভীর প্রণয়ের আগমন তুলি।”


গেইটের সামনে আসতেই দেখল ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির। আমরিন ও তুলি গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইভার কে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলল। সাথে সাথেই কেউ গাড়ির দরজা মেলে তুলির পাশে বসে পড়ল। ক্লান্ত কন্ঠে ড্রাইভার কে গাড়ি চালানোর অনুমতি দিল। চমকে তাকাল আমরিন ও তুলি দু’জনেই। কিন্তু অপর পাশের মানুষ টার যেন তাতে কোনো খেয়ালই নেই। আমরিনের দৃষ্টির আড়ালে তুলির এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল। আতঙ্কিত চোখে আমরিনের দিক চাইল তুলি। আমরিন বিস্মিত গলায় বলে উঠল,

” তুমি কখন এলে ভাইয়া?”

” আগেই এসেছি। তোদের জন্য ওয়েট করছিলাম। একটা কল এটেন্ড করার জন্য কিছু টা দূরে ছিলাম।”

“ওহ্। আজ তুমি এদিকে?”

” হসপিটাল থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম।আজ গাড়িটা আমি নিয়েছি। শরীরটা ভালো লাগছিল না তাই ড্রাইভার কে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তোদের নিয়েই ফিরি।”

কথাটা বলেই আমরিনের অগোচরে তুলি কে কাছে টেনে নিল আদ্র। তুলি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই আদ্রর অগ্নিদৃষ্টি দেখে নিভে গেল। আজকাল মানুষ টা কাছে আসলেই তুলির হৃদপিণ্ডটা ব্যাথা অনুভব করে। অসহনশীল ব্যাথা! কানের কাছে গরম নিশ্বাস পড়তেই নখ দাবিয়ে দিল আদ্রর ফর্সা হাতে প্রখরভাবে। কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো,

” প্রতিশোধ নিলে তুলা?”


সারা রাস্তা নিরব ভূমিকা পালন করেছে তুলি। তুলিদের বাসার সামনে দিয়েই আদ্রদের বাসায় যেতে হয়। সেই সুবাদে আগে আমরিন নিজে নেমে তুলি কে নামার সুযোগ করে দিল। আদ্রর দিকে এক পলক চাইল তুলি। মোবাইল টিপতে ব্যস্ত তার ডাক্তার সাহেব। তুলি কে জড়িয়ে ধরল আমরিন। মোলায়েম স্বরে বলল,

” একটু পরেই ব্যাগ প্যাক গুছিয়ে চলে আসবি কিন্তু। আজকে তোকে ভাইয়ার জীবনের স্পেশাল একজনের সাথে পরিচয় করাব।”

তমসার ঘোর অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল তুলির অনুভূতিরা। প্রচন্ড জোরে ধারালো একটা ছুরির নেই কিছু একটা ঠিক বুকের বা পাশে গিয়ে বিঁধল। রক্তক্ষরণ হতে লাগল অনবরত। কম্পনরত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

” ক,ককক কে?”

আমরিন ফিসফিস করে হাসিমুখে জবাব দিল,

” ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড!”

#চলবে,,,

( বিকেল থেকে মাইগ্রেনের প্রবলেম। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। যতটুকু পেরেছি লিখেছি। রি-চেইক করি নি। ভুল-ত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here