#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -[৬]
‘তুমি তুলা!আমি তোমাকে দেখেছি।’
একটা মিষ্টভাষী কন্ঠের কথা তুলির শ্রবণ হলেও তাঁর কোনো হেলদোল নেই। সে তো কাঁদতে ব্যস্ত। চোখের একেক ফোঁটা অশ্রু যেন অজস্র কষ্টের বোঁজা নিয়ে গড়িয়ে চলছে। সামনে দুই পা ভেঙে বসা মেয়েটা ছলছল নয়নে তুলির কান্না দেখে যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তুলির পিছনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে তাকাল মেয়েটা। করুন স্বরে প্রশ্ন করল,
‘ তোমার তুলা কাঁদছে কেন বয়পেন?’
স্মিত হাসল আদ্র। হাঁটু গেড়ে তুলির সামনে বসে পড়ল। তুলির কোনো দিকেই হুঁশ নেই। জলে টুইটুম্বুর চোখ নিয়ে আদ্রর দিকে তাকাতেই আদ্রর হৃদয় কেঁপে উঠল। বক্ষপিঞ্জরে কাল বৈশাখীর ন্যায় প্রবল ঝড় শুরু হল। তুলির হস্তে আলতো স্পর্শ করতেই প্রচন্ড জোরে আদ্রকে ঝাপটে ধরল তুলি। নীল পাঞ্জাবির কিছু অংশ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে আদ্রর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। তার চোখের পানি নাকের পানি আদ্রর বুকের বা পাশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। অথচ তাতে কোনো হেলদোল নেই তুলির। কিন্তুর আদ্রর ভিতরের সর্বাঙ্গ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভূত করছে। তুলি আদ্রর বুকে সৃষ্ট হওয়া ঝড়ের আভাস পেলে লজ্জায় নিজের মৃত্যু কামনা করতেও পিছুপা হতো না। আমরিন তুলি কে আটকাতে গিয়েও ধরল না। আদ্রর দিকে ভয়মিশ্রিত নয়নে চেয়ে বলে উঠল- ‘ সরি ভাইয়া’। চোখে কষ্টের ছাপ থাকলেও আদ্রর ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখে আমরিন মনের মধ্যে তীব্র প্রশান্তি অনুভব করল। আদ্র বুকে আরেকটু চাপ অনুভব করতেই বলিষ্ঠ দু হাতে শরীরের সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল তুলি কে।তুলির কিঞ্চিৎ ব্যাথা হলেও শান্তির মাত্রা যে তার চেয়েও বেশি। বিকেল থেকে হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা সবটুকু কষ্ট নিঃশেষ করে দিয়েছে আদ্রর প্রতিটি হদস্পন্দন।
তুলি কে কোলে তুলে নিল আদ্র। তাতেও যেন ঘোর কাটে নি তুলির। সে যেনো অতি আনন্দে, আর অতি দুঃখে ভুল-খারাপ বিবেচনা করতেই ভুলে গেছে। নিজের অশ্রুমাখা নয়ন যে আদ্রর উজ্জ্বল মুখশ্রী থেকে সরাতেই পারছে না। তুলি নিজেও জানে না সে কেন এমন করছে!তবে তার কিশোরী মন প্রখর ভাবে অনুভূতিতে মিশিয়ে নিয়েছে আদ্র কে। আলতোভাবে অতি সন্তর্পণে তুলি কে বিছানায় বসিয়ে দিল আদ্র। মেয়েটা এখনো হেঁচকি তুলছে থেমে থেমে। ‘এতোটা নরম প্রকৃতির হয় বুঝি মেয়েরা?নাকি এই মেয়েটাই এমন?’ প্রশ্নটার সূচনা হতেই অন্য এক প্রশ্নে তুলির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা আদ্র পাশ ফিরে চাইল।
‘ বয়পেন কাঁদছে কেন মেয়েটা?’
সাদা ছোট্ট লেহেঙ্গা পরিহিতা জারিফা কে নিজের কাছে টেনে নিল আদ্র। মেয়েটা ভীষণ কিউট। বয়স আর কত হবে পাঁচ থেকে ছয় বছর!এতটুকু একটা মেয়ের কথা খুব পাকা পাকা। জারিফা আদ্রর ছোট ফুফু ইনায়ার মেয়ে। বিয়ের ১২ বছর পর তিনি মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছেন। মেয়েটা যখন উনাকে মাম্মাম বলে অভিহিত করে তখন শুধু ইনায়ার না প্রত্যেকটা মানুষেরই পরাণ জুড়িয়ে যায়। বহু আকাঙ্ক্ষার পর সবার জীবনে জারিফার আগমন বলে কথা। মেয়েটা আদ্র বলতে পাগল। সবাইকে বলে বেড়ায় আদ্র তার বয়পেন। জারিফার গালে আলতো একটা চুমু খেল আদ্র। নরম স্বরে বলে উঠল-
‘ তুলা কেমন হয় জানো তো গার্লফ্রেন্ড?’
‘ অনেক সফট।’
‘রাইট। তুলার মতো সফট এই ছিঁচকাদুনে মেয়েটা।’
‘ তাই বুঝি তুমি তুলা ডাকো?’
‘হুম গার্লফ্রেন্ড!তুলার মতোই খুব নরম ও কোমল এই মেয়েটার মনটা।’
‘ তুমি কিভাবে বুঝলে?’
‘ মনের কানেকশন গার্লফ্রেন্ড!’
তুলি হতভম্ব হয়ে জারিফা ও আদ্রর কথা শুনছে। কিন্তু কিছুই ঢুকছে না তার অধম মাথায়। শুধু এতটুকু বুঝতে সক্ষম হল আদ্র তার মনটাকে সফট হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সত্যিই কি তাই!ফ্যালফ্যাল চোখ দুটো জারিফাকেই পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। জারিফা আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমরিন ওকে কোলে তুলে নিল। ভাই যে তাকে বকবে না সেটা জানে তবে খুব রাগ করেছে হয়ত। কিন্তু আমরিন যে কিছু একটা ধরার জন্যই এমন করেছে।
জারিফা কে নিয়ে রুমের বাহিরে আসল আমরিন। তুলিকে সে কয়েকদিন ধরে বিশেষ খেয়াল করেছে। তার মনে হয় তুলির মনে অনুভূতি আছে। তাই সে তুলি কে পরীক্ষা করার জন্য এই কান্ডটা ঘটাল। মনে মনে খুব আনন্দ পাচ্ছে আমরিন। ‘আচ্ছা ভাইয়ার মনেও অনুভূতি আছে তো?না থাকলে ভাইয়ার চোখে কেন অস্থিরতা ছিল?কন্ঠে কেন এতটা বিষাদের রেশ ছিল?’ বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে রুমের দিকে যাচ্ছিল আমরিন।
হঠাৎ করে থমকে গেল সে। সামনে নিবিড় দাঁড়িয়ে। আমরিনের বুকে উতালপাতাল ঢেউ গর্জে উঠলো নিবিড় কে দেখে। কতকাল পড়ে দেখল। হবে বছর তিনেক। বছর তিনেক আগে সেই যে হুমকি দিয়ে প্রগাঢ়পাড় হল আর আজ সামনে এসে উপস্থিত হল মানুষটা। মানুষটা কি জানে একটা হুমকিতে আমরিনের মনের কতটা অংশ মানুষটার দখলে চলে গেছে?জানেনা,জানলে হয়তো ছুটে আসতো। ঢের অভিমান ঝেকে ধরল আমরিন কে। কিশোরী প্রণয়ের অনলে সে যদি জ্বলতে পারে তবে মানুষ টা কেন জ্বলে নি!জ্বললে তো এতোটা বছর এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে থাকতে পারত না। অভিমানে নিবিড় কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল আমরিন। তার আগেই নিবিড় চট করে জারিফা কে নিজের কাছে নিয়ে নিল। হালকা কেশে বলে উঠল-
‘তুই যেতে পারিস আমরিন। আমি আদ্রর গার্লফ্রেন্ডের খেয়াল রাখব। তাই না গার্লফ্রেন্ড?’
‘ হু।’–মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল জারিফা।
অভিমানী আমরিনের অতিশয় মাত্রায় রাগ হল। ভেবেছিল নিবিড় হয়তো অন্য কিছু বলবে। কিন্তু! একটা সূক্ষ নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে এল সেখান থেকে। দলা মুচড়ে যাচ্ছে ভিতরটা। তিনটে বছর আগে মিছে মিছে একটা হুমকি কে মন পাঁজরে আকড়ে ধরে ভুল করে ফেলেছে সে। হতে পারে বন্ধুর বোন বলেই শাসন করেছিল যেন বিপথগামী না হয় অল্প বয়সে।
________________
গায়ে বেগুনি রঙের একটা সিল্কের শাড়ি জড়িয়ে নিয়েছে তুলি। পিছনের খোঁপায় বেলীফুলের মালা গাঁথা। সামনে কিছু চুল মৃদু হাওয়ার তালে কপালে উপচে পড়ছে। দু’হাতে বেগুনি রঙের মেটাল চুড়ি রিমঝিম আওয়াজ তুলে চলেছে প্রতিটি পদক্ষেপে। চিকন গোলাপি রাঙা ঠোঁটে লজ্জালু রেখার ছড়াছড়ি। হৃদয়ে হওয়া ক্ষতগুলো ভরাট করে দিয়েছে আদ্র। তুলি আমরিনের কাছ থেকে জেনেছিল আদ্র একজন হার্ট সার্জন। তুলির হার্টের চিকিৎসা করতে আদ্রর কোনো মেডিসিন দিতে হয় নি বরং দিতে হয়েছে এক আকাশসম সুখ। সুখ!এ মুহুর্তে তুলির নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে মনে হচ্ছে। সুখের আস্বাদনেই তো আজ হাউমাউ করে কেঁদেছে। জারিফা কে দেখে এক পলকের জন্য স্তব্ধ হলেও খানিকটা সময় পর খুশিতে নিজেকে সামলাতে পারল না। চরম লজ্জা পেলেও পাগলের মতো কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে নি আদ্র তাতেই খানিক সময় বিস্মিত ছিল। উল্টো নিজের কাবার্ড থেকে একটা শপিং ব্যাগ এনে তুলির কোলে রেখেছিল। খোলার জন্য ইশারা করতেই তুলি শপিং ব্যাগ খুলে কয়েক পল নিস্তব্ধতায় কাটিয়ে দিল। আদ্র যে তার কথানুযায়ী তাকে একটা শাড়ি সাথে চুড়ি,কাজল,বেলি ফুলের মালা দিবে কল্পনাতীত ছিল তার কাছে। কাঁদতে চাইলেও কাঁদল না তুলি। একটা হাত আঁকড়ে ধরে হাতের মুঠোয় পুরে নিল আদ্র। নিমিষেই অজানা এক শিহরণ বয়ে গেল অন্তস্থলে। কর্ণপাত হল আদ্রর বিষন্ন কন্ঠস্বর।
‘ জারিফা ছোট ফুপির মেয়ে। ওর কাছে আমি খুবই বিশেষ। ঠিক জারিফাও আমার জীবনে বিশেষ। তুমি এতোটাও দুর্বল প্রকৃতির রূপ ধারণ করো না তুলি যা অন্যের হৃদয় দুর্বল করে দেয়।’
হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল তুলি। আদ্রের কথার পিঠে কি জবাব দিবে গুছিয়ে নিতে পারছে না। তন্মধ্যে এটাও ঠাওর করতে পারছে না আদ্র কেন এসব বলছে। কিন্তু আদ্রর কোমল আদরেমাখা স্বর তার মনে অসম্ভব ভালোলাগার সঞ্চার ঘটাল। শাড়িটার জন্য ধন্যবাদ জানাতে গিয়েও আঁটকে পড়ল আদ্রর শ্রুতিমধুর কথার মাঝে। বাক্যটা এখনো তুলির কানে বারংবার বেজে উঠছে।
~’ ধন্যবাদ দিতে হবে না,শুধু এক টুকরো হাসি আমায় নিবেদন করো শ্যামাঙ্গিনী।’
___________
আমরিনদের বাড়ির বাগানের পাশের জায়গাটায় মেহেদী অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হয়েছে। চারদিকে স্টার আকৃতির ফেয়ারি লাইট দিয়ে সাজানো। আলোতে ঝলমল করছে পুরোটা জায়গা। বাগান থেকে ফুলের ঘ্রাণ মৌ মৌ করে নাকে এসে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা দূরেই সবাই মিলে বসে বসে কথা বলছে,আড্ডা দিচ্ছে। আমরিন সবুজ একটা লেহেঙ্গা পড়ে মেহেদীর ঢালা নিয়ে স্টেজে যাচ্ছে। কিন্তু যার জন্য তুলি রমণীর রূপ ধারণ করল তার হদিসও পেল না। তবুও তাকে খোঁজার উদ্দেশ্য এগিয়ে যেতে লাগল। কিছু একটা ভেবে থেমে গেল। তুলি মন প্রাণে চায় সেই মানুষটাই তাকে প্রথম দেখুক। তাই আড়ালে দাড়িয়ে রইল।
দূর থেকে পূর্ব মুগ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুলির দিকে। পূর্বর নজরকে লক্ষ্য করে তার সাথে আসা দুই বন্ধুও তুলি কে দেখে অপলক তাকিয়ে রইল। রিশাদ নামের ছেলেটা লোভাতুর কন্ঠে বলে উঠল-
‘ জোশ তো!দোস্ত আমরা কিন্তু মিলেমিশে ভাগ করলেও পারি।’
চড়চড় করে মাথায় রাগ চেপে বসল পূর্বর। চোয়াল শক্ত হয়ে এল সেকেন্ডেই। রিশাদের কলার চেপে ধরে কঠোর কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ লাশ হতে না চাইলে ওই মেয়ের দিকে নিজের বাজে নজর দেওয়া বন্ধ কর। খুন করে ফেলব একদম। ‘
কাছের বন্ধুর কাছ থেকে এমন বাচনভঙ্গিতে ভড়কে গেল রিশাদ। পরমুহূর্তে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে উঠল,
‘ তোর বেড পার্টনার কতজন হয়েছে তার হিসেব আমাদের অজানা নয় পূর্ব। এই মেয়েটাও নিশ্চয়ই তাই হবে। তবে আফসোস একা একাই,,,’
পুরোটা বলতে পারল না রিশাদ। তার আগেই কন্ঠনালি চেপে ধরল পূর্ব। কড়া গলায় বলে উঠল,
‘ মেয়েটা চিরকালের জন্যই আমার।’
কথাটা বলেই নিজের রাগ দমাতে দূরে চলে গেল। ভাইয়ের হবু শশুর বাড়িতে কোনো সিন ক্রিয়েট করতে চায় না সে। তার পিছু পিছু ছুটে চলে গেল অন্য ছেলেটাও। কিন্তু রিশাদ নামের ছেলেটা দমে নি। তুলির দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অপমানে, ক্রোধে তুলিকে পাওয়ার জেদ চাপলো মস্তিষ্কে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পিছনে থেকে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁয়াতে উদ্যত হলো তুলির ঘাড়ে।
#চলবে,,,,,!
( ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আচ্ছা কেউ কি তুলির মতো খুশিতে কাঁদেন?তুলি এতোটাই ইমোশনাল যে খুশিতেও পাগলের মতো কান্দে।😑🤧 আমারও মাঝে মাঝে খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছে করে। 🤐)