#আকাশে_তারার_মেলা পর্ব -১১
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
নিজেকে শান্ত করে হাঁটু গেড়ে নিচে বসল আদ্র। সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুলির কান্ডে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। রাগ ঝেড়ে তুলির পায়ে হাত দিল আদ্র। সাথে সাথেই প্রচন্ড জোরে চিল্লিয়ে উঠল তুলি। ব্যাথায় চোখ খিঁচে পা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই গম্ভীর স্বরে ধমকে উঠল আদ্র। ভয়ে চুপসে গেল তুলির মুখ। কিন্তু চোখে মুখে ব্যাথার প্রভাব স্পষ্ট। আদ্র আঁড়চোখে এক নজর তাকিয়ে হাত টেনে কোলে তুলে নিল । চোখ বন্ধ রেখেই আদ্রর গলা জরিয়ে ধরল তুলি। ভাবতেই ভীষণ লজ্জা লাগছে তার কি কান্ড টাই না ঘটল একটু আগে। কেন যে শুনল না আদ্রর কথা? অতিরিক্ত বেপরোয়া হলে হয়তো এমনটাই হয়।
কিছুক্ষণ আগে,,
আদ্রর সাথে পাশাপাশি হাঁটছিল। হুট করেই তুলি সামনে একটা পাখি দেখে দৌড় লাগাল। পিছন থেকে আদ্র অনেক ডেকেছে একটু ও শুনে নি মেয়েটা। বার বার চিল্লিয়ে বলেছে আস্তে দৌড়াতে নয়তো শাড়িতে পা ভেজে পড়ে যাবে। কিন্তু কথাগুলো যেন উচ্ছ্বসিত তুলির কর্ণধার হয় নি। আরেকটু বেগ বাড়াতেই ধপাস করে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। নাকে ও পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেল। জড়তা, লজ্জায় বুকের ব্যাথা ও তীব্র হল। ব্যাথার দাপটের চেয়ে লজ্জায় কাঁদতে লাগল ক্রমশ। সবাই একটু আকটু হাসলেও আদ্রর হাসির বদলে রাগটাই তীব্র।
আদ্রর রাগী ফেইস দেখে তুলির সেই স্মরণীয় থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে গেল। কেন অবাধ্য হল আদ্রর কথার? এখন নিশ্চয়ই রিসোর্টে নিয়ে আরও একটা স্মরণ রাখার মতো ঠাটিয়ে চড় মারবে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তুলির পুরো শরীর। ভয় টা একটু কমানোর চেষ্টায় আদ্রর বুকে মাথা রেখে চুপ হয়ে রইল। বাকি সবাই এখনও থ মেরে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ অন্তু হেসে বলল,,,
–“যা হয় ভাই ভালোর জন্যই হয়। নইলে কি এমন রোমান্টিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পেতাম?”
কপাল কুঁচকে তাকাল পায়েল। অন্তু চুপসে যেতেই এক রাশ হেসে বলল,,
–“এই প্রথম তুমি ভালো একটা কথা বলেছো অন্তু। ”
অট্টহাসিতে মেতে উঠল সবাই। পা চালিয়ে ছুটল আদ্র ও তুলির পিছু পিছু।
রিসোর্টে এনে তুলি কে ধপ করে বিছানায় বসাল আদ্র। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল তুলি। তাতে যেন কোনো খেয়াল নেই আদ্রর। ব্যাগ থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে টুল টেনে বসল তুলির সামনে। সংশয় নিয়ে আঁড়চোখে চাইল তুলি। তার মন বলছে আদ্র বক্স টা দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে ফেলবে এখন। নিজের বাচ্চাসুলভ আচরণে এখন নিজেই প্রচন্ড বিরক্ত সে। নাক ও ফাটাল, পা টা হয়তো ভেঙেই গেছে আবার বিনা টিকেটে সবাই কে কমেডি শো দেখিয়ে দিল। সর্বশেষে এখন বোধহয় মাথা টা হারাতে যাচ্ছে। আদ্র হাত টা বাড়াতেই ভয়ে কেঁদে উঠল তুলি।
–“আমার মাথা ফাটাবেন না আদ্র। আমি আর কখনও আপনার কথার অবাধ্য হব না।”
তুলির ভাঙা গলায় অদ্ভুত এসব কথা শুনে রাগটা দ্বিগুণ হয়ে গেল আদ্রর। তুলো নিয়ে নাকের রক্ত টা ক্লিন করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,,
–“কান্না থামা। নয়তো আজ তোর কপালে শনি আছে। আমার ভালো-মন্দ দুই রূপ সম্পর্কেই তুই অবগত। এখনই কান্না থামা।”
আদ্রর কথা শুনে কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টায় লেগে পড়ল তুলি। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল আদ্রর বুকের কাছের অংশ। দু চোখ বুঁজে ফেলল। তুলির স্পর্শ পেতেই হৃদয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল আদ্রর। নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল রাগ টা। যত্ন করে তুলির নাকে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে ফু দিল তুলির বন্ধ দু চোখের পাতায়। শিউরে উঠল তুলির সারা শরীর। আরেকটু শক্ত করে খামচে ধরে রাখল আদ্র কে। ঘন ঘন দু চোখের পলক ঝাপটিয়ে চোখ মেলে তাকাল আদ্রর দিকে। আদ্রর নীল বর্ণের চোখ জোড়া নিজের উপর সীমাবদ্ধ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল তুলি। হৃদয় জুড়ে হতে লাগল ভয়াবহ ঝড়। আদ্রর বুক থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা পিছে হেলে গেল। মুচকি হেসে আদ্র নিজের ঠোঁট ছোঁয়াল তুলির নাকে। একটা কথা মনে পড়তেই দাঁত কেলিয়ে তুলি বলে উঠল,,,
__”বান্ধবীদের কাছে শুনতাম বয়ফ্রেন্ড চুমু খেলে নাকি জ্বর ও চলে যায়। আপনি কি আমার নাকের ব্যাথা কমানোর জন্য চুমু খেয়েছেন আদ্র?”
বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল আদ্র। তুলির মুখে এমন এক বাক্য শুনে অবাক হয়ে পড়ল। এই মেয়ে বয়সে মনের দিক সবদিক দিয়েই একদম বাচ্চা। নিজের ব্যাগ থেকে ইনজেকশন বের করতে করতে আদ্র ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে জবাব দিল,,,
–“যদি চুমু তেই ব্যাথা কমে যায় তাহলে ইনজেকশনের কি দরকার বলো? এজ অ্যা ডক্টর আমার মতে ইনজেকশন টা দিলেই ব্যাথা কমবে চুমু তে নয়।”
ইনজেকশন দেখে মাথা ঘুরে গেল তুলির। ভয়ে শুকিয়ে গেল গলা। আমতা আমতা করে বলল,,,
–“আমি ইনজেকশন দিব না। আমায় ইনজেকশন দিতে এলে খুব খারাপ হবে কিন্তু। ”
মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল আদ্রর। সাবলীলভাবে জিজ্ঞেস করল,,
–“কি হবে শুনি?”
–“আমি কামড়ে দিব আপনাকে। ছোট বেলায় আমি এক ডাক্তারের হাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ ওনিও আপনার মতো ইনজেকশন দিতে আসছিল।”
—“তা কোথায় কামড়াবে? গালে,ঠোঁটে? ”
কথা টা বলতে বলতে তুলির হাত টা চেপে ধরতেই সজোরে কামড় বসিয়ে দিল তুলি আদ্রর বুকে। বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল আদ্র। সে তো ভেবেছিল তুলি হয়তো মজা করছে কিন্তু সত্যি সত্যিই কামড় বসিয়ে দিল। হাত থেকে ইনজেকশন টা পড়ে গিয়ে হালকা শব্দ করল। তুলির দুই বাহুতে ধরে টেনে বুক থেকে সরিয়ে আনল। বুকে প্রচন্ড বেগে দ্রিমদ্রিম শব্দ হতে লাগল তুলির। নিজের আচরণের উপর এখন নিজেই বিস্মিত তুলি। এখন মনে হচ্ছে বয়স যতই হোক মনে ম্যাচুরিটি আনা টা বেশ জরুরি। নয়তো এই যে এসব অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করে বসে আদ্র হয়তো তাকে বেহায়া মেয়ের আখ্যায়িত দিতে পারে। নিজের মাথা তুলে তাকাতেও অস্বস্তি হচ্ছে তুলির। আদ্রর কথায় মাথা তুলতে বাধ্য হল। চোখে পড়ল আদ্রর রাগান্বিত দৃষ্টি। সাথে সাথেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল।
–“আমায় কামড় দিয়ে দেখিয়ে দিলে তোমার দাঁত কতো দারালো তাই না?”
নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল তুলি। আচমকা আদ্র কে শার্টের বোতাম খুলতে দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ ফিরিয়ে নিল লজ্জায়। কানে আসল আদ্রর রাগী কন্ঠের সুর,,
–“এই মেয়ে এদিকে তাকাও।”
এখনও নিশ্চুপ তুলি। লাল রাঙা মুখ নিয়ে ফিরে চাইল আদ্রর দিকে। প্রথমেই চোখ পড়ল আদ্রর ফর্সা উম্মুক্ত বুকে রক্তে কিছু টা লাল হয়ে যাওয়া স্থানে। বুক টা ধুক করে উঠল সাথে সাথেই। কি করল এটা? তুলির ছোট্ট মনে এক ফালি লজ্জা যেন উড়ে এসে জড়ো হয়ে বসল। বহু কষ্টে আদ্রর চোখের দিকে চাইতেই আঁতকে উঠল। আজ আর নিস্তার নেই। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারল তুলি। তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে আছে আদ্র।
–“আমার বুক রক্তাক্ত করার শাস্তি তোমায় পেতে হবে।”
শাস্তির কথা শুনেই ঢোক গিলল তুলি। আদ্রর দিকে করুন চোখে তাকাতেই বলে উঠল,,
–” গুণে গুণে দশ টা চুমু দিবে তুমি আমার বুকের ক্ষত জায়গা তে। নয়তো আমি গুণে গুণে ঠিক দশটা থাপ্পড় লাগাব তোমার গালে।”
অবলীলায় কথা গুলো বলে চোখের দৃষ্টি তুলির উপর স্থির রেখেই বসে রইল আদ্র। বেলুনের মতো চুপসে আছে তুলির মুখটা। মনে হল যেন জোর করে তাকে কেউ করলার জুস খাইয়ে দিয়েছে। মনে মনে ভীষণ হাসি পেল আদ্রের। মেয়ে টা কে জ্বালাতে এখন খুব ভালো লাগে তার। ছোট্ট তুলি যখন লজ্জায় মুখটা কে নিচু করে ফেলে তখন তার খুব ইচ্ছে হয় নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে। বুকের মাঝখানে লুকিয়ে ফেলতে। লুকাবে খুব শীগ্রই মেয়েটা কে আবদ্ধ করে ফেলবে নিজের বাহুদ্বয়ে। দরকার হলে সবকিছু ধ্বংস করে দিবে তবুও এই মেয়েটা কে চায় তার। তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তুলির কানে আদ্রের কথাটা এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। চোখ জোড়া বুঁজে আদ্রর বুকের কাছে মুখ নিয়ে বলল,,,
–“আপনি কিন্তু তাকাবেন না আদ্র। আপনি তাকালে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। প্লিজ চোখ দুটো বন্ধ করে রাখবেন। কোনো ক্রমেই অবলোকন করবেন না আমাকে।”
তুলির শ্রুতিমধুর লজ্জিত স্বর কর্ণকুহর হতেই আদ্রর চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এল আবেশে। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানেই অনুভব করল নরম ঠোঁটের স্পর্শ। ঠোঁটের কোণে প্রতীয়মান হল এক তৃপ্ততার মৃদু হাসি। পর পর দশ দশটা চুমু দিয়ে সরে এল তুলি। নিজের দু হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল শ্যামলা মুখশ্রী। আদ্র ও বসে থাকতে পারল না। মজা করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল ভালোবাসার স্নিগ্ধ সম্মোহনে। ঘোর কাটতেই বেরিয়ে এল রুম থেকে। নিজের ফোন বের করে স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদ্র। মেসেজ ও কলের ভিড়। সায়েরা বেগম ফোন দিয়েছেন অনেক গুলো। ফোন ব্যাক করতেই ওইপাশ থেকে সায়েরা বেগম বলে উঠলেন,,,
–” তোর সেমিনার কবে শেষ হবে আদ্র? এই মাসে দু দু’বার সেমিনার। ইনশিতার বিয়ের ডেট ঠিক করতে আসবে পরশু রনকের ফ্যামিলি। তুই আসলে ভালো হতো। তুই তো জানিস,,,
–” বুঝেছি আম্মু। আর বলতে হবে না। কাল রাতে বাসায় থাকব। রাখছি।”
ভারী গলায় শেষ কথাটা বলে ফোনটা রেখে দিল আদ্র। বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। চোখে মুখে পানি দিয়ে তুলির কাছে আসল ফের। তুলি এখনও লজ্জায় মুখ ঢেকে রেখেছে। মিনমিন করে আদ্র বলে উঠল,,–
“তুমি আমার প্রশান্তির আরেক নাম তুলা। যতদিন পর্যন্ত এ হৃদয়ে তোমার বিচরণ চলবে ততদিন পর্যন্ত সুস্থ থাকব আমি। শান্তি বিরাজ করবে আমার অস্তিত্ব জুড়ে।”
পায়ে কারো স্পর্শ অনুভব করল তুলি। অনুভূতি গুলো মনে নাড়া দিতে লাগল অনবরত। এক হাত সরিয়ে আদ্র কে দেখতেই কিছু টা আওয়াজ করে বলল,,
–“কি করছেন আদ্র? পায়ে হাত দিবেন না প্লিজ। ”
–” এতো ফর্মালিটি অথবা সংকোচ বোধের কিছুই নেই তুলা। আমি তোমার পায়ে হাত দিতেই পারি। কারণ ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ হলেই বিয়ে করছি আমরা।তখন তো তোমার আঠারো হয়ে যাবে। হবু স্বামী বউয়ের সেবা করতেই পারে তাই না?”
“বউ” শব্দ টা এতো মধুর হয়? নাকি আদ্রর মুখেই এতো মধুর শুনাচ্ছে? চোখের পলকেই যেন তুলি এক সংসার কল্পনা করে ফেলছে। তবুও ভয় লাগছে তার। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,,
–“খালা মণি, খালু সবাই মানবে তো?”
–“আমায় বিশ্বাস করো তো?”
পায়ে মালিশ করতে করতে প্রশ্ন টা তুলির দিকে ছুঁড়ে দিল আদ্র। তুলির ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলল,,
–“আপনাকে বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই আমার। যার প্রেমের মোহনায় হারিয়েছি আমি সেই তো আমার শেষ অবলম্বন। আপনি ঠকালে চিরতরে বিলীন হয়ে যাব। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি কখনও ঠকাবেন না আমায়। আপনার ভালোবাসার তুলনায় আমার কিছুদিনের ভালোবাসা অতি নগন্য। বছরের পর বছর আড়ালে সার্থহীন ভাবে যে আমায় ভালোবেসেছে সে কখনও ঠকাতেই পারে না।”
–” আমরা আজ ঢাকা চলে যাব তুলি। একটা অনুরোধ থাকবে তোমার কাছে কেউ যেন না জানে আমি ও তুমি সিলেট ছিলাম। ”
–“কখনও বলব না। সিলেট শহর টা কে ও ভুলতে পারব না। আমাদের দু জনকে ভালোবাসায় সিক্ত করার অবদান কিন্তু এই শহরের অনেক। এই শহরের চেয়ে ও বেশি আপনার।”
তুলির কপালে আলতো করে ভালোবাসার স্পর্শ একে দিল আদ্র। কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,,
–“ভালোবাসি তোমায় তুলি। খুব বেশি ভালোবাসি। ”
চোখের কার্ণিশে জমা হল জল। “ভালোবাসি” শব্দ টা তুলির তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিল শতগুণ। সুখের জমায়িত পানি কোনো বাঁধা না মেনে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। শুষে নিল আদ্র। গালে ও একে দিল ঠোঁটের গভীর ছোঁয়া। তুলির ইচ্ছে করছে সময় টা থমকে যাক। সারাজীবন আঁটকে থাকুক এই পরম শান্তির সময়টায়। ভালোবাসায় মেতে থাকুক সবটুকু প্রহর। থেমে গেলে কি খুব খারাপ হবে? থেমে যাক না সময়টা। লেপ্টে থাকুক তুলি সারাটা কাল এভাবেই আদ্রর বুকে।
—————–
রাতের আঁধারে ক্লান্ত তুলি ঘুমে মগ্ন আদ্রের বাহুতে। সিলেট থেকে ঢাকা এসে পৌঁছাল খানিকক্ষণ আগেই। লং জার্নি তে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তুলি। গাড়ি এসে থামল সাগর দের বাসার সামনে। তুলি কে ধীর কন্ঠ ডাকল আদ্র। একটু নড়েচড়ে তুলি আবারও ঝাপটে ধরল আদ্র কে। ঘুমের ঘোরে যে মেয়েটা কি করছে সে যদি বুঝত তাহলে লজ্জায় মরে যেত। মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও ডাকতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল তুলি। ঘুম ঘুম চোখে চারপাশে চোখ বুলাতেই গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সবাইকে। জায়গা টাও বেশ অপরিচিত তার নিকট। আদ্রর দিকে তাকাল জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে। আদ্রর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি বহমান। তুলির সচেতন মন বলে উঠল,,
–“তুলি তোর ডাক্তার সাহেব এতো হাসে কেন? ওনার তো গুমরো মুখো হওয়া উচিত ছিল। দেখিস এই হাসিতে ঘায়েল হয়ে কোন মেয়ে না জানি তোর কাছ থেকে কেঁড়ে নেই ওনাকে।”
ভাবান্তর হতেই তুলি হাত বাড়িয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরল আদ্র কে। ভ্রু কুঁচকাল আদ্র। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,,
–“কি করছো তুলা? বাহিরে সবাই ওয়েট করছে তো পরী। আমাকে ছেড়ে একটু বাহিরে চলো।”
তুলির অবাধ্য মন বলে উঠল,,
–“আপনি এতো সুন্দর অথচ পরী ডাকছেন আমায়? ”
–“শ্যামবতী হলেও আমার হৃদয়ের গহীনে আবদ্ধ হওয়া রূপবতী কন্যা তুমি। তোমার এই মায়ায় জরিয়েই তো ডেকে এনেছি নিজের সর্বনাশ। তোমায় ছাড়া নিশ্বাস টুকু নেওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। ”
লাজুক তুলি ছেড়ে দিল আদ্র কে। খুব করে বলতে ইচ্ছে করল,,–“এমন হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়া কথা কেন বলেন আদ্র? আপনি কি দেখতে পান না আমার মনটা দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে? কঠিন অসুখে ভুগছে।”
আদ্রর সাথে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তুলি। পায়েল ও রিমি তুলি কে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। মুচকি হেসে বলল,,
–“আবারও দেখা হবে কিউটি।”
আমরিন ইশারায় নিবিড় কে বিদায় জানাল। আদ্র আজ সাগর দের বাসায় থাকবে। ড্রাইভার কে ভালোভাবে পৌঁছে দিতে বলল ওদের।সবাই কে বিদায় জানিয়ে তুলি গাড়িতে উঠতে যেয়েও ফিরে তাকাল আদ্রর দিকে। কালই তো আদ্র বাসায় যাবে তবুও সামান্য একটু দূরত্ব যেন তুলি মেনে নিতে পারছে না। বার বার দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে মন। আশঙ্কা জাগছে প্রিয় মানুষ টা কে হারিয়ে ফেলার। করুন চোখে চেয়ে দিক বিদিক ভুলে দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরল আদ্র কে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অস্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠল,,,
–“আমি যাব না আদ্র। আপনিও চলুন প্লিজ। আপনাকে ফেলে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। এতটুকু দূরত্ব ও আমার মনে আঘাত করছে। ”
হতবুদ্ধি হয়ে গেল আদ্র।বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল তুলির মাথা টা। রিমি,অন্তু,নিবিড়, পায়েল,আমরিন,সাগর সবাই খুব বেশি বিস্মিত হল। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পিচ্চি মেয়েটা কত ভালোবেসে ফেলেছে আদ্র কে। ভালোবাসা আসলেই সময় বেঁধে হয় না। কখনও কখনও ক্ষণিকের দেখাতেও অচেনা,অজানা মানুষের জন্য ভালোবাসার উদয় হয় মনের পিঞ্জিরায়। আর সেই জায়গায় তুলি তো আদ্রের এতো বছরের জমানো ভালোবাসায় ডুব দিয়েছে যার ফলে আদ্রর প্রতি তার অনুভূতি, মায়া,ভালোবাসা আরও প্রখর হয়ে উঠেছে। মাথায় হাত রেখে মিহি সুরে আদ্র উচ্চারণ করল ভালোবাসাময় কিছু বাক্য।
“আমাকে কেঁড়ে নেওয়ার সাধ্য কারো নেই তুলি। একটা কথা কি জানো? তুমি ছাড়া তো আমিই জীবন্ত লাশ হয়ে যাব। তাই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকি না কেন আমি তোমার কাছেই ছুটে যাব। ছুটে যাব স্নিগ্ধ প্রণয়ের গভীর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে। নিজের ঠোঁটে একটু প্রাণোচ্ছল হাসি ফুটাতে। একটু তৃপ্ততার শ্বাস নিতে।”
আদ্র কে ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল তুলি। জানালা দিয়ে চেয়ে রইল অপলকভাবে। আদ্রের মুখে প্রশস্ত হাসি ও চোখে ফুটে আছে তুলির জন্য অসীম ভালোবাসা। আদ্র হাত দিয়ে ইশারা করল একটু হাসার। তুলিও ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলল অমায়িক মুগ্ধ হাসি।
চলবে,,,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)