#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১১
লেখিকাঃমাহযাবীন
পরিবারের সবার সাথে প্রায় অনেকটা সময় কাটিয়ে রাত ১২ টায় নিজ কক্ষে ফেরে নাফিয়া।অনেক ভালো লাগছে তার নিজ পরিবারের সবার সাথে এতোটা দিন পর সময় কাটাতে পেরে।ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখজোড়া বুঝতেই নাফিয়ার চোখের সামনে ভেসে ওঠে গত রাতে ছাঁদে আফিমের সাথে একসাথে নাচার কিছু মুহূর্ত।বিনে কারণেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।সোজা হয়ে শোয়া থেকে ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে চোখজোড়া বুঝতেই আবারও নাফিয়ার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আজকের মুহূর্তগুলো।যেখানে হুট করেই আফিম তাকে নিজের কাছে টেনে এনেছিলো আর শেষে তার নাকে আফিমের ঠোঁট ছোঁয়ানোর মুহূর্ত টা!মনে পরতেই মনে একরাশ লজ্জা ও মুগ্ধতা এসে ভর করে।সাথে সাথেই সে পাশ ফিরে বাম দিকে কাত হয়ে শোয়।ঠোঁটে হাসি বজায়ে রেখেই আবারও চোখজোড়া বুজে নেয় সে।চোখ বুঝতেই তার চোখের সামনে সেই মুহূর্ত টা ভেসে আসে যখন আফিম প্রশ্ন করেছিলো,
“কোন অধিকারে আমাকে নিজের এতোটা কাছে আসার অনুমতি দেও?”
চটজলদি চোখজোড়া মেলে তাকায় নাফিয়া।আবারও এক অদ্ভুত অনুভূতি এসে জায়গা করছে তার মনে।এ অনুভূতিতে আছে লজ্জা,মুগ্ধতা সেই সাথে কিছুটা দ্বিধা।নাফিয়ার মনে হচ্ছে,সে হয়তো আফিমকে ভালোবাসতে শুরু করেছে কিন্তু তা কতটা ঠিক সেটি নিয়ে সে নিশ্চিত হতে পারছে না।হতেও তো পারে এসব শুধুই মুগ্ধতা বা আকর্ষণ।
বারান্দায় হাতে কফির মগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আফিম।আকাশটা আজ অন্ধকার।না আছে চাঁদ আর না দেখা যাচ্ছে তেমন তারার সমাবেশ।তাও অন্ধকার সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে।নাফিয়া তার জীবনে আসার পর হতে এখন অব্দি ঘটা সকল স্মৃতি একের পর এক স্মৃতিচারণ করছে।
প্রথম দিনে নাফিয়ার চেহারার সেই মায়ায় আকর্ষিত হয় আফিম।তারপর আফিমের করা প্রতিটি অন্যায় এর জবাব দেওয়ার যে সাহসটা নাফিয়া দেখিয়েছিলো তাতে আফিম বাধ্য হয় নাফিয়াকে নিয়ে ভাবতে।সেই সাথে নাফিয়ার আচার-আচরণ,স্বভাব,চরিত্রের বৈশিষ্ট্য যা এই তিন মাসে ফুটে উঠেছে তাতে আফিমের মনে নাফিয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে মুগ্ধতা।সেই সাথে নাফিয়াতে অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছে সে।
!!
বিকেলে নাফিয়া ও তার বাবা সোফায় বসে টিভি দেখছে।সেই সাথে বাবা ও মেয়ের একটু-আধটু গল্পও হচ্ছে।এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হন নয়না বেগম।নাফিয়ার পাশে বসে তিনি বলে ওঠেন,
-তোমায় কিছু বলতে চাইছি!
-বলো আম্মু।(গুরুত্ব না দিয়ে টিভিতে চোখ রেখেই বলে নাফিয়া)
-কথাটি গুরুত্বপূর্ণ।এই যে শুনছেন?(নাফিয়ার বাবাকে উদ্দেশ্য করে)টিভিটি অফ করুন তো!
এবার ঠিক হয়ে বসে নাফিয়া।হঠাৎ তার মায়ের কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বুঝতে না পারায় কিছুটা গম্ভীরভাব নিয়ে মায়ের দিকে তাকায় নাফিয়া।নাফিয়ার বাবা টিভিটি অফ করতেই নয়না বেগম বলে ওঠেন,
-নাফিয়া একটি বিষয় তুমি ভালো করেই জানো, আমাদের আর্থিক কোনো সমস্যা নেই।ঢাকায় এই এক তলা বাড়ি এবং গ্রামে তোমার দাদার দুতলা বাড়িটি আমাদের।সেই সাথে তোমার বাবার জায়গা-জমি খুব যে কম তা কিন্তু নয়।
ব্রু কুঁচকে নাফিয়া বলে ওঠে,
-হটাৎ এসব কথা?
-আমার কথা শেষ হয়নি।তুমি এও জানো যে,তোমার চাচা বাটপারি করে তোমার বাবাকে তোমার দাদার বাড়ির কোনো অংশ না দিয়ে সে বাড়িটি বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন।আর নিজের পৈতৃক ভিটা বাঁচাতেই তোমার বাবা নিজের আপন ভাইয়ের থেকে নিজের বাবার বাড়ি ক্রয় করেন।আর এই বাড়ি কিনতেই তিনি এক বড় লোন নিজের কাঁধে তুলেছিলেন যার বোঝা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন।লোন না নিয়ে তিনি নিজের জমিও বিক্রি করতে পারতেন কিন্তু তা সে কোনোভাবেই করতে চায় নি।
-হ্যা মা,সব টাই জানি।হটাৎ আজ এগুলো নতুন করে বলার কি হলো?
-দেখো নাফিয়া,আমি জানি তুমি চাইছো দ্রুতই তোমার বাবাকে এ ঋণ দিয়ে মুক্ত করতে।যা সন্তান হিসেবে তোমার কর্তব্যও।কিন্তু তার আর প্রয়োজন নেই।ঋণ আর বেশি নেই।মাত্র ২ লাখের মতো আছে যা সামনের কিছু মাসের মধ্যে শোধ হয়ে যাবে।
-আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু এটিও তো আমি জানিই মা।
-এখন মূল কথাটি বলছি!আমাদের সমাজে এক প্রচলিত বাণী আছে,”মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি”।সেথায় তোমার বয়স ২৮ বছর হয়ে গিয়েছে যা অতিরিক্ত।আমি এবং তোমার বাবা তোমার বিয়েটায় আর দেরি করতে চাইছি না।তাই তোমার আর চাকরি করতে হবে না সামনের মাস থেকে।এ মাসে তাদের জানিয়ে দিও।
মায়ের কথায় একদম চুপ হয়ে যায় নাফিয়া।মুহূর্তেই চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে যায় তার।এক তীব্র ভয় নিজের মাঝে অনুভব করছে সে।এ ভয়টি শুধুই আফিমকে হারানোর ভয়।টুপ করে নাফিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতেই নয়না বেগম বলে ওঠেন,
-এভাবে কাঁদার কিচ্ছুটি নেই।পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই বিয়ে করে।তুমি প্রথম নও।তাই এতো ভয় না পেয়ে বিষয়টি সহজভাবে নেও।তোমার বাবার পরিচিত এক মুখে ডাকা ভাইয়ের ছেলেকে আমরা তোমার জন্যে পছন্দ করেছি।সে আগামী ১০/১৫ দিনের মাঝেই তোমার সাথে দেখা করবে।
-মা,এখনই কেনো বিয়ে করতে হবে?
-২৮ বছর বয়স কম নয় নাফিয়া।
-বাবা,তুমি কিছু বলো?
পত্রিকা হতে চোখ উঠিয়ে নিজের মেয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠেন,
-তোমার মায়ের সাথে সহমত।আর দেরি করা ঠিক হবে না তবে একটি বিষয় বলতে চাইছি।তোমার কোনো পছন্দ থেকে থাকলে বলতে পারো!
-ওর আবার কিসের পছন্দ।আমরা যা সিদ্ধান্ত নিবো তাই ই ওর জন্য সঠিক।(নয়না বেগম)
-ভুল বললে নয়না।জীবন সঙ্গী ওর,সংসার করবে ও তাই ওর জন্য কোন মানুষটি উপযুক্ত হবে তা ও ই ভালো বুঝতে পারবে।
-আমাদের সময় তো বাবা-মাই বিয়ে ঠিক করছিলো আর সেই কালে বিয়ে টিকতো,এখনকার বাচ্চারা নিজের পছন্দে বিয়ে করে তারপরে তো হয় তালাক।
-আবারও ভুল বললে নয়না।আগের যুগে নারীরা ছিলো এমন যে মরে যাবো কিন্তু স্বামীর বাড়ি ছাড়বো না।তারা হাজারো অত্যাচার বা কষ্ট সহ্য করে সংসার করে গিয়েছিলেন দেখে বিবাহ বিচ্ছেদ তেমন হতো না।আর এখনকার নারীরা স্বাধীন।তারা এখন মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে স্বামীর সংসারে পরে থাকে না।সেই সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ তখন মানুষ যেমন ভয় পেতো এখনকার সময়ে এটি তেমন কোনো ব্যাপারই না।আগের কালের থেকে এখনকার সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে কারণ যুগ পাল্টেছে। এর সাথে বড়রা বিয়ে ঠিক করা বা ছোটরা নিজেরা পছন্দ করা টা কোনোভাবে জড়িত নয়।
উত্তরে কিছু বলেন না নয়না বেগম।স্বামীর কথায় যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন তিনি।
নয়না বেগম নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে ওঠেন,
-পছন্দ আছে কেউ?
উত্তরে বলার মতো কিছুই পায় না নাফিয়া।কিই বা বলবে সে?আফিম তাকে পছন্দ করে কিনা, ভালোবাসে কিনা,বিয়ে করবে কিনা কিছুই তো জানে না সে।উত্তরে কিছু না বলে সোফা থেকে উঠে নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় নাফিয়া।নয়না বেগম নাফিয়াকে থামাতে চাইলে নাফিয়ার বাবা ইশারায় নিষেধ করেন নিজ স্ত্রীকে।
!!
কেমন যেনো সব উলট-পালট লাগছে নাফিয়ার।আফিমকে ঘিরে তার এতো এতো অনুভূতিগুলোর কি নাম দেবে তা ই এখনো নিশ্চিত করে পারলো না সে।এরই মাঝে এতো গুলো চিন্তে এসে পরেছে তার উপর।একদিকে বাবা-মা বিয়ের কথা বলায় অদ্ভুত রকমের ভয় কাজ করছে নাফিয়ার।এই ভয়টাতে কেমন যেনো কষ্ট আছে,বিচ্ছেদ হবার আতংক আছে।সেই সাথে আফিমের মনে তার জন্য কিরূপ অনুভূতি কাজ করে তা নিয়েও ভীষণ চিন্তিত নাফিয়া।আফিম কি তাকে ভালোবাসে নাকি সাময়িক সময়ের মোহ এর জন্যেই কাছে আসা?
এসব চিন্তের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে নাফিয়া।তেমন করে আর কারো সাথে কথা বলছে না,রুম হতে দরকার ছাড়া বের হচ্ছে না।কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে সে।নয়না বেগম সহ বাড়ির সবাই বিষয়টি খেয়াল করে কিন্তু নাফিয়ার বাবা সবাইকে বলেছেন নাফিয়াকে কোনো প্রশ্ন না করে নিজের মতো করে কয়দিন থাকতে দিতে।কারণ সে উপলব্ধি করতে পারছেন তার মেয়ে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত।আর তাই হয়তো নাফিয়া একান্তে সময় কাটাতে পারলে নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
নাফিয়া নিজের বাসায় আসার পর আজ ২য় রাত!বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকাতেই নাফিয়ার আফিমের সাথে কাটানো বেশ কিছু মুহূর্ত মনে যায়।দুজনার বেশির ভাগ স্মৃতিই এই আকাশের সাথে।রাতের আকাশ,চাঁদ,তারা!নাফিয়া আপন মনেই ভাবে আজ যদি তাদের মাঝে প্রেম নামক সম্পর্কটি থাকতো তবে বলা যেতো,
“আমাদের প্রেমের সাক্ষী এই আকাশ,বাতাস,ঐ চাঁদ ও তারা।”
ভাবতেই হেসে ওঠে নাফিয়া।এই বাক্যগুলো খুবই হাস্যকর লাগে তার কাছে।বাংলা সিনেমাগুলোতে নায়ক-নায়িকাদের প্রেমের সাক্ষী তো এই আকাশ,বাতাস,চাঁদ,তারাই হয়।আর আজ কিনা তারও একই অবস্থা,ভাবা যায়!
হটাৎই নাফিয়ার মুঠোফোনটি বেজে ওঠে।এতো রাতে কে কল দেবে ভেবে পায় না সে।ফোনটি হাতে নিতেই দেখে আননোন নাম্বার।ব্রু কুঁচকে ফোনটি রিসিভ করে কানে ধরে নাফিয়া বলে ওঠে,
“আসসালামু আলাইকুম”
কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না।নাফিয়া চুপ করেই আছে ওপাশের মানুষটির কিছু বলার অপেক্ষায়।কেউ কল দিয়ে এভাবে চুপ করে থাকবে কেন তা বুঝে উঠতে পারছে না সে।হটাৎই তার মনে হয় কলটি কি কোনোভাবে আফিম দিয়েছে!মনে হতেই ধীরে ধীরে নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করে।নাফিয়া মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-আ আ আফিম?
আর কিছু বলতে পারে না নাফিয়া।এক তো সে সন্দিহান আফিমই কল দিয়েছে কিনা!দ্বিতীয়ত হয়তো আফিমই কল দিয়েছে ভেবেই নাফিয়ার ভীষণ খুশি খুশি অনুভব হচ্ছে সেই সাথে তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে চলছে।কিছুটা সময় উভয়ের নিরাবতার পর ফোনের ওপাশ হতে আলতো স্বরে একটি আওয়াজ আসে,
“মিস.শেখ”
শব্দটি শোনার সাথে সাথেই যেনো নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন কয়েকশো গুণ বেড়ে গিয়েছে,অতিরিক্ত খুশি তার ঠোঁটের আলতো হাসিকে অনেকটা বৃদ্ধি করে দিয়েছে।খুশিতে নাফিয়া যেনো কিছু বলতেই পারছে না।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নাফিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলে ওঠে,
“আফিম?”
-হু।
-এতো রাতে!দাদী ঠিক আছে?
-আছে।
-ওহ।
আবারও দুজনেই চুপ।কিছুটা সময় নিরাবতাই চলে তাদের মাঝে।আফিম বলে ওঠে,
-I wanna see you tomorrow at home.
কথাটি বলেই ফোন কেটে দেয় আফিম।
চলবে।