#আমার_গল্পে_তুমি
//পর্ব-২//
#সাদিয়া
ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে “Time and tide wait for none”. সময় এবং স্রোত করো জন্য অপেক্ষা করে না। সত্যিই যেন তাই। জীবনের পাতা থেকে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন অনেক গুলো সপ্তাহ অনেক গুলো মাস অনেক গুলো বছর। শুধু রয়ে গেছে পুরোনো কিছু স্মৃতি আর কিছু ক্ষত। অনেক ক্ষত সময়ের সাথে সাথে সেরে গেলেও অনেক ক্ষত আজীবন রয়ে যায়। সেগুলো আমাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। চাইলেও আমরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে চলতে পারি না।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ বদলায়। বদলায় তাদের জীবনের গতিপথ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সাদিয়াও বদলে গেছে। আজকের সাদিয়া আর ছয় বছর আগের সাদিয়ার মধ্যে যেন আকাশ পাতাল তফাৎ। আগের সেই চঞ্চল দূরন্ত কিশোরীটি এখন দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। এখন আর তাকে হাসি মুখে দুষ্টুমি করতে দেখা যায় না। সে এখন গম্ভীর মুখে শাসন করতে শিখেছে। তার ব্যাবহারে এখন আর চঞ্চলতা নেই। আছে পরিপক্বতা।সে পরিপক্ব হয়েছে আরো অনেক আগেই! বয়স মানুষকে পরিপক্ব করে না,করে পরিস্থিতি!
আদিব দুনিয়াতে নেই প্রায় ছয় বছর। এই ছয় বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। এই ছয় বছরে সাদিয়ার আব্বু-আম্মু,আদিবের বাবা-মা তাকে বিয়ের কথা বহুবার বলেছে। কিন্তু সাদিয়ার এক কথা সে বিয়ে করবে না। সাদিয়ার ভাষ্যমতে,বিয়ে জীবনে এক বারই হয়। যা সাদিয়ার হয়ে গেছে। সাদিয়া দুবার আর বিয়ের পীড়িতে বসতে চায় না। সে নিজের জীবনটা নিজের মতো করে আদির কিছু আবছা স্মৃতির সাথে গুছিয়ে নিয়েছে। এই গুছানো জীবনে কারো জায়গা দিতে নারাজ সে। সে চায় না তার আর আদির আবছা স্মৃতির মাঝে কোনো তৃতীয় পক্ষ আসুক।
সাদিয়া এবার এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। লেখাপড়ার সুবাদে সে হোস্টেলেই থাকে। বাড়িতে আসা-যাওয়া কম তার। আগে কোনো অনুষ্ঠান বা ঈদে বাড়িতে বাড়িতে যাওয়া হলেও এখন শুধু ঈদেই যাওয়া হয়। সে কোনো অনুষ্ঠানে যেতে চায় না। তার ইচ্ছে হয় না। মানুষের সমাগম তার পছন্দ নয়। বিশেষ করে আদিবদের বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে যেতে তার একদমই ভালো লাগে ন। তাকে দেখলেই সবার এক প্রশ্ন “বিয়ে করছো কবে?” বিয়ে করছো না কেন?” এই সব প্রশ্নের বেড়াজালে সাদিয়া যেন ক্লান্ত।
🍁
আজকে সাদিয়ার হাফডে ছিলো। কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি। তাই সে ঠিক করলো একবার আদিবদের বাসায় যাওয়ার কথা। গত পরশু আদিবের আম্মু ফোন করে বলেছিলো আদিবের বাবার শরীরটা ভালো নেই। তাকে দেখতে চাচ্ছে বারবার। এমনিতে তো সাদিয়ার সময় হয় না আজকে যেহেতু সময় পেয়েছে তাই আদিবদের বাসার পথ ধরলো।
কলেজের সামনে গাড়ির জন্য পনেরো মিনিট যাবত দাঁড়িয়ে আছে সাদিয়া। একটা গাড়িও নেই আজকে। সে রীতিমত বিরক্ত হচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
—উফফফ আজকেই সব গাড়ির মরতে হলো? একটা গাড়িও পাচ্ছি না। যেতে দেরি হলে আন্টি আসতেও দিবে দেরি করে ।আমার আবার কালকে প্রফ আছে। ইইইই কি যে করি। ধুরর ভালো লাগে না।
নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে সামনের দিকে পা চালালো সে। সে আনমনে হাঁটছে আর গাড়ি চালকদের গুষ্টি উদ্ধার করছে। আচমকা তার সামনে একটা মার্সিডিজের লেটেস্ট মডেলের প্রাইভেট কার ফুল স্পিডে এসে থামলো। ভয়ে সাদিয়া চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো।
কিছু সময় পরে কারো রাম ধমক খেয়ে সাদিয়া চোখ তুলে তাকালো। সামনে তাকাতেই সাদিয়া দেখতে পেলো একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। সাদিয়া তার চোখের দিকে তাকাতেই যেন অন্য জগতে চলে গেলো। সে সামনের মানুষটির চোখের অতল সমুদ্রে তলিয়ে যেতে লাগলো। এতো গভীরতা কেন ওই দু’চোখে?
—এই যে হ্যালো ম্যাম আপনাকে বলছি শুনছেন কিছু?
—আব জ্…জ্বী বলুন।
—আজব মানুষ তো আপনি এই খানে রাস্তার মাঝে কি করছেন আপনি? মরতে এসছিলেন? এই সব পাগল লোকজন বাহিরে কেন বের হয় বুঝি না আমি। যত্তসব ফাউল ষ্টুপিড লোকজন সব।
সামনের মানুষের কথা সাদিয়া কিছুই বুঝতে পারলো না। সে তো এটাই বুঝতে পারছে না কে ষ্টুপিড আর কে মরতে এসছিলো। সাদিয়া কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো সামনের জনের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে সামনের ব্যক্তিটি বিরক্ত হলো যা তার চেহারাতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
—আপনার মতো ডাফারকে কিছু বলা মানে নিজের মূল্যবান শক্তি আর সময় দুটোই নষ্ট করে।
এতোটুকু বলেই সে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। সাদিয়া তখন বোঝার চেষ্টা করছে এখানে এতক্ষণ আসলে কি হলো। বেচারি গাড়িতে থাকা মানুষটিকে দেখে এমন চমকে গিয়েছিলো যে সে আউট ওফ মাইন্ড হয়ে গেছে। সে আর ভাবলো না লোকটাকে কেন যেন তার পাগল বলেই মনে হলো। আসলেই কি লোকটা পাগল ছিলো?
কিছু দূর যেতেই সাদিয়া গাড়ি পেয়ে যায়। আধঘন্টার মধ্যে সে আদিবদের বাসায় পৌঁছে যায়। গাড়ি থেকে নেমে সাদিয়া এগিয়ে যায় দশ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংয়ে। এই বিল্ডিংয়ের অষ্টম তলায় থাকে আদিবের পরিবার।আদিবের পরিবারে আছে আদিবের বাবা-মা, দাদী,আদিবের কাকা-কাকী আর আদিবের কাকার দুইজন ছেলে। তারা দুজন জমজ।একজনের নাম আবির আরেক জনের নাম অয়ন। তাদের চেহারার কোনো মিল না থাকলেও তারা দুজনেই সমান দুষ্টু। তাদের দুষ্টুমিতে সবার নাজেহাল অবস্থা। তাই তাদেরকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে যত পারে করুক দুষ্টুমি। এবার তারা কলেজে পড়ে। পড়াশোনায় তারা দুজনেই গোল্লা!
অষ্টম তলায় এসে লিফটের দরজা খুলে যায়। সাদিয়া আদিবদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার বেল টিপলো। সাথে সাথেই দরজা খুলে গেলো। দরজা খুলতেই আদিবের মায়ের হাসি মুখটা দেখতে পেলো সে। তিনি যেন দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজা খুলবেন বলে। সাদিয়াকে দেখেই তিনি পরম মমতায় আগলে নিলেন সাদিয়াকে। সাদিয়াও ধরলো।
—কেমন আছিস মা?
—আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আন্টি। তোমরা কেমন আছো? আঙ্কেলের শরীরটা এখন কেমন আছে?
—আমরা ভালো আছি। আর তোর আঙ্কেলের শরীরটাও আগের তুলনায় কিছুটা বেটার।
—কই গো বড় বউ এলো আমার নাতনি?
—জ্বী মা এতোক্ষণে আপনার নাতনির আগমন হলো।
—কই দেখি দেখি আমার নাতনিটাকে। কতো দিন হলো দেখি না।
সাদিয়া দাদীর দিকে এগিয়ে গিয়ে জরিয়ে ধরে বললো,,
—কেমন আছো দাদী?
—আমি ভালো আছি আগে বল তুই কেমন আছিস?
—আমিও একদম ফাটাফাটি আছি।
একে একে সবাই এসে উপস্থিত হলো ড্রয়িংরুমের। সাদিয়ার আসার শব্দ পেয়ে আদিবের বাবাও এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। তাকে দেখেই সাদিয়া বসা থেকে উঠে তার কাছে গেলো।
—তুমি উঠে আসতে গেলে কেন? আমিই তো এখন যাচ্ছিলাম তোমার কাছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে এতো চলা ফিরা করা করার কি দরকার বলো তো।
—আমার মা এসেছে আর আমি কিনা শুয়ে থাকবো,তাই হয় নাকি।
—হয়েছে এখন এখানে বসো তো দেখি।
—তা মা কেমন আছিস তুই?
—আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু তুমি তো শরীর খারাপ করে বসে আছো।তোমাকে কত বার বলি একটু সাবধানে থাকতে। তুমি আমার কথা কানেই তুলো না।তার উপর ঔষুধের অনিয়ম তো তোমার পুরোনো অভ্যাস। তোমাকে নিয়ে আর পারি না আমি।
এবার আদিবের কাকী মুখ খুললেন,,,
—একটু ভালো করে বকে দে তো সাদু। ভাইজান একদম আমাদের কথা শুনতে চায় না। তুই আসবি শুনে এই শরীর নিয়ে বাজার করতে চলে গেলো। কতো করে বললাম আপনার যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু উনি তো আমাদের কথা কানে তুলেন না।
কাকীর কথা শুনে সাদিয়া রাগি দৃষ্টিতে আদিবের বাবার দিকে তাকাতেই তিনি কাচুমাচু করা শুরু করে দেন।
—আচ্ছা বলো তো তুমি কি বাচ্চা? কেন এমন করো? তুমি কি নিজের ভালোটা বুঝতে পারো না? তুমি নিজে একজন ডাক্তার হয়ে কি করে সবকিছুতে এতো অনিয়ম অবহেলা করো বলো তো?
একটু দম নিয়ে সাদিয়া আবার বললো,
— তোমার যা মন চায় তুমি তাই করো। আমি আর আসবো না তোমাকে কিছু বলতে।
—না মা এমন বলে না। আমি প্রমিজ করছি আর এমন করবো না।
—মনে থাকে যেন।
সাদিয়ার কথায় মাথা দুলিয়ে আদিবের মায়ের উদ্দেশ্য বললেন,,
— দাঁড়িয়ে আছো কেন, যাও আমার মেয়ে টা কলেজ থেকে সোজা এখানে এসেছে ওকে খেতে দাও। সারাদিন মনে হয় খাই নি মেয়েটা।
—সাদু তুই যা ফ্রেশ হয়ে আয় আমি তোর খাবার বাড়ছি।
চলবে…..ইনশাআল্লাহ❤️