পিয়াস ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে এনে খালাম্মার পায়ের কাছে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। খালাম্মা আমায় ধরে তুললো। আমি খালাম্মাকে দেখে আরো বেশি ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম।
— এটা কি ধরনের অসভ্যতা পিয়াস? সদ্য বিয়ে করে আনা মেয়ের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে না কি? তোমার বুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে?
— তুমি বউ চেয়েছিলে না? এই মেয়েকে তো বউ করে আনতে চেয়েছিলে এই বাড়ির। সেলিব্রেট করো তোমার আশা তো পূরণ হয়েছে।
— কি আবোল তাবোল বলছো তুমি? ও শুধু এই বাড়ির বউ না তোমার স্ত্রী। ঠিক ভাবে ব্যবহার করো?
— মা প্লিজ,, তুমি চেয়েছো এই মেয়েটা তোমার বাড়ির বউ হবে। তাই তোমার কথা রাখার জন্যই আমি এই বিয়ে করেছি। আর স্ত্রীর কথা বলছো! আমি তো ও কে স্ত্রী হিসেবে মানিই না। তাই এই নিয়ে তুমি আর একটা কথাও বলবে না।
খালাম্মা কিছু বলার আগেই পিয়াস ভাইয়া রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমি খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। খালাম্মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার মুখ দু হাতে তুলে ধরেন।
— ওসব কিছু না। তুই তো পিয়াসকে জানিস। ও রেগে গেলে ওর মাথার ঠিক থাকে না। কি বলতে কি বলে ফেলে। তুই কিছু ভাববিনা সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখি মেয়েটা আমার কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ একদম ফুলিয়ে ফেলেছে।
ওয়ার ড্রপ থেকে একটা গাঢ় সবুজ রং এর শাড়ি আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
— যা তো যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে তাড়াতাড়ি। অনেক রাত হয়েছে। আমি সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করি।
আমি আলো। কিছুক্ষন আগে আমার বিয়ে হয়। আজকে সকালেও আমি জানতে পারি নি আমার আজ বিয়ে। প্রতিদিনের মতো আজও আমি ভার্সিটি গিয়েছিলাম। সারাদিন ভালোই কেটেছিলো। তবে একটু অবাক হয়েছিলাম কারণ আজকে ভার্সিটি যাওয়ার পথে আর বাড়িতে ফেরার পথে পিয়াস ভাইয়া কে কোথাও আমি দেখিনি। বাড়িতে যখন আসলাম তখন আমাকে কিছু না জানিয়েই আমার ছোট আম্মু আমাকে শাড়ি গহনা পরিয়ে দিলেন। আমাকে হাত ধরে নিয়ে চলে গেলেন। যেখানে নিয়ে গেলেন সেখানে দেখলাম জায়গাটা কতো সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো চারিদিকে আলোর রোশনাই। আর এক কোণে আমার ছোট আব্বু এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে জানালো হলো আজ আমার বিয়ে হবে। খুব রাগ হলো আমাকে না জানিয়ে কেনো বিয়ে দিচ্ছে। ছোট আম্মু যখন জানালো আমার বিয়ে পিয়াস ভাইয়ার সাথে হচ্ছে তখন নিজেকে শান্ত করলাম। কারণ আমার আব্বু আম্মু বেঁচে থাকলে আমাকে এই পিয়াস ভাইয়ার সাথেই বিয়ে দিতো। পিয়াস ভাইয়ার আম্মু আর আমার আম্মু বন্ধু হলেও ওদের সম্পর্ক বোনের মতো ছিলো। ছোটবেলায় আমি তো পিয়াস ভাইয়ার বাড়িতেই থাকতাম। আমি জানি না আমি পিয়াস ভাইয়ার সাথে সংসার করতে পারবো কি না!!
আমি খালাম্মার দেওয়া শাড়িটা পড়ে নিলাম। চুল গুলো ছেড়ে মুখে হালকা মেকাপ দিয়ে গহনা গুলো পরে নিলাম। দরজায় তিনটে টোকা পড়তে দেখি ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ভাবী এসে আমার চুলগুলো খোঁপা করে দিয়ে বেলীফুলের মালা দিয়ে দিলো।
— বাহ.. আমাদের আলোকে তো আজ ভীষণ মিষ্টি লাগছে। পিয়াস তো মনে হয় তোমার দিক থেকে চোখ ফেরাতেই পারবে না।
ভাবী আমার মুখটা ধরে বললো। আমি ভাবীর থেকে সরে গেলাম।
— কি যে বলো না ভাবী।
— থাক হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। আসো খেতে হবে তো না কি।
আমি আর কিছু না বলে ভাবীর পিছু পিছু ডাইনিং টেবিলের কাছে গেলাম। পিয়াস ভাইয়াকে দেখলাম খেয়ে উঠে চলে গেলো। এই বাড়ির সব কিছুর সাথে আমার পরিচিত থাকলেও আজ কেমন জানি অচেনা অচেনা লাগছে। হয়তো আজ থেকে আমি এই বাড়ির বউ তাই।
— আলো,,, কি ভাবছিস মা? আয় বস?
খালাম্মা আমাকে চেয়ারে বসালেন এবং নিজেও বসলেন। আমার পাশেই ভাবী বসলো। খাওয়া শেষে ভাবী আমাকে পিয়াস ভাইয়ার রুমে দিয়ে গেলো। আগে যখন এই বাড়িতে আসতাম তখন পিয়াস ভাইয়ার রুমটাতেই সারাক্ষণ থাকতাম। এই রুমটাকে নিজের মনের মতো করে সাজাতাম। পিয়াস ভাইয়া মাঝে মাঝে রেগে যেতো কারণ তার অনেক দরকারী কাগজ পত্র আমি এলোমেলো করে দিতাম। তখন বকা দিলেও একটুও ভয় পেতাম না। কিন্তু আজ কেমন যেনো ভয় লাগছে, পিয়াস ভাইয়া কেও আর এই রুম টা কেও।— কি রে তুই? তুই এখানে কি করছিস?
হঠাৎ এমন গম্ভীর আওয়াজে আমি দরজার দিকে তাকাই। পিয়াস ভাইয়া দরজা লক করে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। দ্রুত বেড থেকে নেমে দাঁড়াই। পিয়াস ভাইয়া পুনরায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
— কি হল শুনতে পাচ্ছিস না তোকে কি জিজ্ঞাসা করছি আমি?
— জ্বী ভাইয়া.. আমাকে তো ভাবী দিয়ে গেলো। আর তাছাড়া আমি আপনার রুম ছাড়া কোথায় থাকবো!
— তুই জাহান্নামে থাক। আমার রুম ছাড়া বাড়িতে আর কোন রুম নেই হুম? আগে যেই রুমে থাকতিস সেখানে গিয়েই থাকবি বুঝেছিস।
— কিন্তু ভা.. ই.. ভাইয়া আমা.. দের তো বিয়ে হয়েছে। আমরা তো সা.. স্বামী.. স্ত্রী, এক রুমেই তো আমরা থাক.. বো।
মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে কথাগুলো বলে পিয়াস ভাইয়ার দিকে তাকালাম। পিয়াস ভাইয়া আমার হাত টা কে পেছনে মুচড়ে ধরলো।
— ও বুঝলাম, তুই অধিকার ফলাতে এসেছিস তাই তো! স্ত্রীর অধিকার। ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নে আমি তোকে কখনো স্ত্রীর অধিকার দেবো না।
আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পিয়াস ভাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দি। চিৎকার করে বললাম,,
— কি শুধু তখন থেকে বলে চলেছেন আমাকে স্ত্রীর অধিকার দেবেন না? আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানেন না? যদি স্ত্রীর অধিকার নাই দেবেন তাহলে বিয়ে করেছেন কেন? বলুন.. বলুন আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলেন আপনি?
পিয়াস ভাইয়া আমার গালে সজোরে থাপ্পড় মারলে আমি পড়ে যেতে গেলেই আমার হাতটা ধরে নেয়। পিছনে মুচড়ে ধরে আমার গাল দুটো চেপে ধরে।
— হুসসস,, আস্তে গলা নামিয়ে কথা বল আলো। জানিস না আমার সাথে আমার মা বাবা ছাড়া আর কেউ উঁচু গলায় কথা বলার সাহস পায়না। তোর এতো সাহস আসে কোত্থেকে হুম।
— আমাকে ছাড়ো পিয়াস ভাইয়া আমার ব্যাথা লাগছে।
— লাগুক ব্যাথা, তোর আমি বেশি ব্যাথা আমি পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। তুই কি করে ভাবলি শুধু মা বললো বলেই তোকে আমি বিয়ে করেছি! না রে আলো ,, তুই যদি ওটাই ভাবিস তাহলে খুব ভুল ভাবছিস।
— মা,, ন,, মানে…
— হা হা হা , তুই আমার কাছে একটা রাস্তার মেয়ে ছাড়া আর কিছুই না। তুই যা কিছু করেছিস সব কিছুর শাস্তি আমি তোকে দেবো। তুই ভাবতেও পারছিস না আলো তোর জীবনে কি ঘটতে চলেছে!পিয়াস ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিলে আমি ফ্লোরে বসে পড়ি। চোখের কোণ বেয়ে যে নোনা পানি গড়িয়ে পড়লো তার কয়েকটা ফোঁটা গুনে নিলাম। নিজের মুখে একবার বলে নিলাম।
— আমি রাস্তার মেয়ে পিয়াস ভাইয়া! তুমি আমাকে এই কথা বলতে পারলে?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে পিয়াস ভাইয়ার মুখোমুখি হলাম।
— আমি যদি রাস্তার মেয়ে হয়ে থাকি তাহলে তুমি আমাকে কেন বিয়ে করলে? শাস্তি দিতে চাও তো আমায় এমনিই শাস্তি দিতে পারতে। পরিবার এর সবাই ভাবছে আমরা সুখি দম্পতি হবো কিন্তু তারা তো জানে না তুমি আমার জীবন নষ্ট করতে চাও। কেনো পিয়াস ভাইয়া কেনো? সেদিন কি সব দোষ আমার ছিলো বলো?
— এই শোন আমি তার কৈফিয়ত তোকে দেবো না। আর জীবন কোথায় নষ্ট করলাম তোর! তুই তো নষ্ট হয়েই গেছিস।
— আমি নষ্টা তো,, হ্যা তাই আমি নষ্টা মেয়ে। আর আমার এই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কারণ তুমি।
পিয়াস ভাইয়া আমার গালে সজোরে থাপ্পড় মারলো। আমি ফ্লোরে পড়ে গেলাম। পিয়াস ভাইয়া আমাকে টপকেই চলে গেল। আমার চোখ বেয়ে পানি ঝাঁপাতে লাগলো। ইচ্ছা করছে নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে নি। পিয়াস ভাইয়া তাহলে এতোদিন ধরে আমার সম্পর্কে এইসব ভেবে এসেছে। আমাকে শাস্তি দিতে চায়!!!.
চলবে….
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)
আমার তুমি আছো
Susmita Jana
Part— 1