আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
পর্ব:৩৪
~ শুনছো! ( অহনা )
~ বলো। ( সুরাজ জামান বই এর পাতা উল্টাতে উল্টাতে জবাব দিলেন )
~ আচ্ছা আরশি আর সূর্যের ব্যাপারে কিছু ভাবলে? আরিয়া আরশি কে নিয়ে অনেক চিন্তা করছিলো।
সেই ছোটবেলায় মেয়েটার বিয়ে হলো। কিন্তু সংসার করা আর হলো না। ( দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অহনা )
স্ত্রীর কথা শুনে বই টা পাশে রেখে সোজা হয়ে বসলেন সুরাজ জামান। সিরিয়াস হয়ে বললেন,,,
~এখানে সংসারের কথা কোত্থেকে আসছে?
অহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,,” সংসারের কথা আসবে না! তুমি কি ওদের বিয়ের কথাটা ভুলে গেছো নাকি?”
~ আমি সেটা বুঝাই নি আর আমি কিছু ভুলেও যায়নি। কিন্তু কথাটা হচ্ছে আরশি আর সূর্য তখন ছোট ছিলো। তাদের সংসার করার মত বয়স ছিল না। আর এখন এর কথা বলতে গেলে সূর্য এখনো নিজে কিছু করতে পারেনি আর আরশি তো এখনো ইন্টার শেষ করেনি, ওর এখন সংসার করার সময় নয়। তাহলে সংসারের কথা উঠছে কেনো ?
~ আমরা ওদের ছোট বানিয়ে রাখলে কি হবে ওরা কিন্তু যথেষ্ট বড় হয়েছে। সবটা স্বাভাবিক থাকলে সেই অনুযায়ী ওদের বিয়ে দেওয়ার মতো বয়স হয়ে গেছে। আর এখানে তো ওদের আগেই বিয়েটা হয়ে গেছে। সূর্য তো এই সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু শুনতেই নারাজ। এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না কিছু একটা বিহিত তো করতেই হবে।
~ কি করবো বলো? সূর্য কে এখন কিছু বলতে গেলে যদি একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে তখন কি হবে? আর এখন তো এখানে আরিয়া, আফিফ আর আরশিও আছে।
~ ভাই কিচ্ছু করবে না বাবা। আমার মনে হয় তোমার ভাইয়ের সাথে ওদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলা উচিত। ( সুজানা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো। ও বাবা মায়ের ঘরেই আসছিলো তখনই ওদের কথা শুনতে পায় )
~ তুই কি করে এতো সিওর হচ্ছিস? ( সুরাজ জামান )
~ বাবা এই কদিন আমি ভাইয়ের হাবভাব খেয়াল করেছি। ও আর আগের মতো নেই। এখন ও আরশি কে দেখে বা ওর কথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করে না। উল্টো আরশির জন্য চিন্তা করে। কেয়ার করে। আরশির প্রতি ওর কেয়ার গুলো আমি কাছ থেকে দেখেছি। তাই বলছি বাবা তোমার একবার ওর সাথে কথা বলা উচিত। আমার কেনো জানিনা মনে হচ্ছে ভাই কোনো কারনে এই বিয়েটাকে আপাতত মানতে চাইছে না। ইভেন আগেও ও কখনও কিন্তু ও এই বিয়েটাকে অস্বীকার করেনি। শুধু বলেছে এই ব্যাপারে কোন কথা শুনতে চায় না । এখন কেন বিয়েটা মানতে চাইছে না সেটা আমাদেরকে জানতে হবে।
~ কি করে জানবো আমরা? ও কি কখনো কোনো কথার সোজা উত্তর দিয়েছে? ( অহনা )
~ আচ্ছা মা শোনো আমি বলছি কি , তোমরা এখন এই ব্যাপারে কিছু বলো না। আমরা এখন বেড়াতে যাচ্ছি সেখান থেকে ফিরে এসে যা করার করবো।
~ ঠিক আছে যা ভালো বুঝিস কর। কিন্তু দেখিস কোন সমস্যা যাতে না হয়। ( সুরাজ জামান )
~ হুম। মা বলছি ওরা একটু পরেই এসে পড়বে। আমাদের তো বেরোতে হবে। তুমি এসো আমার সাথে আমাকে একটু প্যাকিংয়ে সাহায্য করো।
~ চল।।
~ আরশি!!
~ মিহি ! তোরা এসে গেছিস এ মা আমিতো এখনো ব্যাগই গোছাতে পারলাম না।
~ এতক্ষণ কি করছিলি?
~ আরে ইয়ার তুই তো জানিস আমি এই ব্যাপারে অনেক কনফিউজড থাকি। কি নিব কি নিবোনা তা ঠিক করতে পারিনা। আর লাস্ট মোমেন্টে মাহির ভাইয়া জানালেন আমাদের নাকি সাজেক ট্যুরে এ নিয়ে যাবেন।
আরশি হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পরলো । মিহি আরশির পাশে বসে ভাবুক হয়ে বললো,,
~ দোস্ত বিশ্বাস কর! আমি আমার ভাইকে আগে কখনো এরকম দেখিনি। প্রথমে তো আমাদের কলেজের অনুষ্ঠানে এলো। তারপর লং ড্রাইভে যেতে রাজি হলো। রাজি কি নিজ থেকে বললো ও নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন কি বলছে, সাজেক ট্যুরে নিয়ে যাবে তাও কিনা চার থেকে পাঁচ দিনের জন্য। ভাবা যায় বল? আমার ভাইটা এমন বদলালো কি করে বলতো?
আরশি মিহির দিকে তাকিয়ে বললো,,
~ হয়তো জাদু আপ্পির জন্য। আই মিন আপ্পি তো ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই হয়তো ।
~ হুম হতে পারে । কিন্তু কেন যেন এই হতে পারাটা আমার ঠিক হজম হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছুতো আছে। ভাইয়া তো কখনো আমাদের ফ্যামিলি ফাংশন ও ঠিকমতো এটেন্ড করতো না। তাই এই পরিবর্তনটা মানতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
~ এখন তো হচ্ছে ওটা নিয়ে খুশি থাক। আর এত কথা না বলে আমাকে এগুলো গুছাতে হেল্প কর।
~ হ্যালো গার্লস কি গল্প করছো? এ মা আরশি তুমি এখনো ব্যাগ গোছাও নি ?
~ ( ঠোঁট উলটে ) কি কি নিবো বুঝতে পারছি না।
নিধি মুচকি হেসে বললো,, “দাও আমি হেল্প করছি।”
নিধি আর মিহি মিলে আরশি কে হেল্প করলো। দ্রুত ওর ব্যাগ গোছানো শেষ হয়ে গেলো।
~ আরশি তুমি চেঞ্জ করে এসো আমরা নিচে অপেক্ষা করছি।
~ ঠিক আছে।
~ তোমাদের কাছে জায়গাটার বিবরণ শুনে আমার তো অনেক এক্সসাইটেড লাগছে। ইশ কখন যে যাবো!! ( রোজ )
~ হ্যাঁ এক্ষুনি রওনা হবো। সুজি! আরশি, সূর্য ওরা কোথায় ? ( মাহির )
~ নিধি আর মিহি তো আরশির ঘরে গেলো ওকে আনতে। ভাই মনে হয় রেডি হচ্ছে। এসে যাবে। ( সুজানা )
~ ঐতো নিধি আর মিহি। আরশি কই ? ( নাহিদ )
~ আসছে। ( নিধি ) নিধি আড়চোখে অভ্রর দিকে তাকালো। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আজব এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো উনি?
~ নিধি কি আমার উপর এখনো রেগে আছে? জানাই তো হলো না। ওখানে গিয়ে ওর সাথে কথা বলতে হবে। আজতো কিছু একটা বলতে ও চাইছিলো। ( মনে মনে )
~ দেখ তোরা কিন্তু সাবধানে যাবি। প্রথমবার বাস জার্নি করছিস, না জানি একেকটার কি অবস্থা হবে। শোন, সবসময় একসাথে থাকবি আলাদা আলাদা ঘুড়ার দরকার নেই। আর সুজানা তুই কিন্তু আরশির সাথেই থাকিস ও তো একদমই বাস জার্নি করতে পারে না। অসুস্থ না হয়ে যায়। ( চিন্তিত হয়ে বললো অহনা )
~ মা তুমি চিন্তা করো না। আমরা সবাই তো আছি ঠিক সামলে নিবো সবটা।
~ এই নে এই খাবার গুলো রাখ। ওখানে তো ফাইভ স্টার হোটেল নেই। এমনি হোটেল। সেখানের খাবার কেমন হবে কে জানে। সূর্য আর তুই তো ওসব হোটেলের খাবার খেতে পারবি না। তাই এগুলো সকলে মিলে খাবি। ( তিনটা টিফিন বক্স ওদের দিকে এগিয়ে দিলো আরিয়া )
~ মা, খালামনি তোমরা এতো চিন্তা কেনো করছো বলোতো? আমরা ঠিক ম্যানেজ করতে পারবো। তাইনা মাহির? (মাহির শুধু হাসলো ) । ওরা সবাই মুগ্ধ হয়ে দুই মায়ের তাদের সন্তানদের জন্য চিন্তা করাটা দেখছে।
~ চিন্তা করবোনা? প্রথমবার এতো দূরে যাচ্ছিস। তাও একা একা। ( আরিয়া )
~ মাহির বাবা, তুমি একটু এদের খেয়াল রেখো। ( অহনা )
~ অবশ্যই আন্টি। আপনি চিন্তা করবেন না।
~ ঐতো ভাই নামছে। (সুজানা )
~ আরশি ও। ( মাহির )
সূর্য আর আরশি দুজনেই নিজেদের ঘর থেকে বের হয়ে একসাথে সিড়ির কাছে এলো। ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। সূর্য কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতো পড়েছে। আরশি ও একটা কালো থ্রি পিস পড়েছে। দুজনের ড্রেস এর মিল দেখে ওরা অবাক হয়ে গেছে।
~ বাহ বাহ এখন মিয়া বিবি ম্যাচিং ম্যাচিং ড্রেস পড়া হচ্ছে ?? তলে তলে এতো কিছু। ( সুজানা দুষ্টু হেসে বললো )
সূর্য চোখ গরম করে রাগি লুক নিয়ে তাকালো। সুজানা এমন একটা ভাব করলো যেনো ও কিছু বলেই নি। অভ্র সুজানার কথায় চমকে গেলো। “কি বলছে এসব সুজানা আপু? মিয়া বিবি মানে? আর আন্টিরাই বা মুচকি মুচকি হাসছেন কেনো ? ” ( মনে মনে )
নিধি অভ্রর দিকে তাকিয়ে ভাবছে,,
~ আমি জানি অভ্র আপনি কি ভাবছেন । যে করেই হোক আপনাকে সত্যিটা দ্রুত বলতে হবে।।
আরশি তড়িৎ গতিতে নিচে নেমে এলো। এমনিতেই সূর্যের সামনে লজ্জা লাগছে। তার উপর জাদু আপ্পি সকলের সামনে কি সব বলছে। ও এসে নিধির পাশে দাড়িয়ে গেলো। সূর্য আস্তে আস্তে নেমে এলো।
~ ওকে চলো সবাই দেরী হয়ে যাচ্ছে। ( রেহান )
আরিয়া আর অহনা বের হবার আগে সূর্যকে আর আরশি কে বেশ করে বুঝিয়ে দিলেন কি কি করতে হবে। ওরা সবাই সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
এক এক করে সকলে বাসে উঠলো। সূর্য আর অভ্র কাউন্টারে আছে । আরশি জানলার কাছের সিটে গিয়ে বসলো। মিহি টুপ করে নিধির পাশে গিয়ে বসে পড়লো। সুজানা গিয়ে মাহিরের সাথে বসলো। রোজ আর ন্যান্সি এক সাথে বসেছে। আরশি হা হয়ে ওদের দেখছে।
~ আপ্পি , মিহি, তোমরা আমাকে ছাড়া এভাবে আলাদা আলাদা বসেছো কেন?
~ তুই তো জানালার কাছে ছাড়া বসতে পারবি না। তোর সাফোকেশন হবে তেমনি আমারও সাফোকেশন হবে। এর জন্য আমি জানালার পাশের সিটে বসেছি। ( সুজানা )
~ আমার ও, আমার ও। ( মিহি )
আরশি চোখ ছোট ছোট করে বললো,,
~ এটা এসি বাস এখানে এমনিতেও তোমাদের জানালা খুলতে দিবে না। তোমাদের এত সমস্যা হলে আমার পাশে বসতে পারো আমি জানালার সিট ছেড়ে দিচ্ছি।
আরশির কথায় সুজানা আর মিহি থতমত খেয়ে গেলো। আসলেই তো এটা তো এসি বাস এখানে জানালার কি কাজ।
ওরা চুপ করে আছে। মাহির ওদের অবস্থা দেখে হেসে বললো,,,
~ আসলে আরশি তোমার আপ্পি এতোদিন পর তার বেস্ট ফ্রেন্ডকে পেয়েছে তো তাই এক সাথে বসতে চাচ্ছে। আর রইলো কথা মিহির। আমি সাজেস্ট করবো ওর সাথে বসোনা। ও তো কখনো বাস জার্নি করেনি তাই বমি টমি করে দিতে পারে । তাই বেটার হবে তুমি সূর্যের সাথে বসো।
মিহি তার ভাইয়ের কথায় রেগে গেলো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিধি ওকে থামিয়ে দিলো। মিহি ওদের প্ল্যানের কথা ভেবে কিছু বললো না। কিন্তু রেহান! শয়তানি করে বললো,,
~ কারোর কি পলিথিন লাগবে? কারণ এখানে তো অনেকে আছে তাই বমি করে পরিবেশ নষ্ট করলে ব্যাপারটা ভালো হবে না।
সবাই মিটিমিটি করে হাসছে। মিহি তেতে উঠলো,,
~ কি বললেন আপনি?
~ ও শুনতে পাও নি বুঝি আবার বলবো??
~ আমি সেটা বলিনি আপনি কি মিন করতে চাইছেন? আমি বমি করে পরিবেশ নষ্ট করবো?
~ আমি তো কিছু বলিনি বলেছে তো তোমার ভাই। আমিতো শুধু আমাদের সবার ভালোর চিন্তা করে তোমাকে পলিথিনের আইডিয়াটা দিলাম।
মিহি কটমট করে মাহিরের দিকে তাকিয়ে রেহানকে বললো,
~আমার কিচ্ছু লাগবে না।
~ ওকে।
এদিকে আরশির সূর্যের সাথে বসতে হবে ভেবেই কলিজা লাফাচ্ছে। যার কাছ থেকে পালাতে চাইছে বারবার তার মুখোমুখি কেন হতে হচ্ছে?? ও সুজানা আর মিহির দিকে অসহায় ভাবে তাকাচ্ছে কিন্তু ওরা ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অন্য দিকে ফিরে গেলো। আরশি গাল ফুলিয়ে রাখলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য আর অভ্র এসে গেলো। দুটো সিট খালি আছে। একটা আরশির পাশের অন্যটা রেহানের পাশের। নাহিদ রিকের পাশে বসেছে। সূর্য এক নজর সবার দিকে তাকালো। তারপর ভ্রু কুঁচকে আরশির দিকে তাকালো। ও বেশ বুঝতে পারছে এসব ওর বোনের কারসাজি। আগে থেকে প্ল্যান করে এসব করেছে । সূর্য কিছু না বলে আরশির পাশে বসে পড়লো। আরশি একদম জানালার সাথে লেগে বসে গেলো। ওর হার্ট লাফাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বেড়িয়ে আসবে। সূর্য ওর দিকে পাত্তা না দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আরশি সূর্যের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু সূর্যের এমন ভাব দেখে ভেংচি কাটলো। অভ্র ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে চুপ চাপ রেহানের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। ওর আর বুঝতে বাকি নেই যে ওর সন্দেহ টাই ঠিক। ওদের সম্পর্ক নরমাল কাজিন দের মতো নয়।
সুজানা আর মিহি ওদের প্ল্যান সাকসেসফুল হতে দেখে বিজয়ের হাসি হাসলো। নিধির অভ্রর জন্য চিন্তা হচ্ছে। এই ট্রিপের মাধ্যমে হয়তো অভ্র আরশি আর সূর্যের সম্পর্কের কথা জেনে যাবেন তখন কি করবেন উনি? উনি ও কি আমার মতো ভালোবাসার মানুষকে না-পাওয়ার যন্ত্রণায় ভুগবেন?
বাস চলতে শুরু করলো। সেই সাথে শুরু হলো নতুন এক যাত্রার। এখন দেখার পালা এই যাত্রায় ঠিক কোন কোন জোড়ার মনের মিলন ঘটবে। আদৌ ঘটবে কি? নাকি মনের মিলন ঘটার আগেই বিচ্ছেদের সুর বাজবে।
#চলবে