আমার পুতুল বর লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম) পর্ব:৩৬

আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
পর্ব:৩৬

রাতে ওরা সবাই তারাশার বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। সুজানা আর মিহি আরশি কে খুচিয়ে যাচ্ছে। সুজানা আরশি আর সূর্যের একসাথে ছবি তোলার ব্যাপারটা মিহি কে বলে দিয়েছে। তারপর থেকে দুজন মিলে ওকে চেপে ধরেছে। কি করে এই চমৎকার হলো তা জানতে চাইছে। আরশি কাকে কি বলবে ? ও তো নিজেই বুঝতে পারছে না সূর্যের হঠাৎ কি হলো যে এতোটা পাল্টে গেলো !
~ আচ্ছা আদৌ কি সূর্য পাল্টেছে? আমার কেনো যেনো না মনে হচ্ছে উনার এই রূপটাই আসল। আগে শুধু সত্যিটা লুকানোর জন্য মুখোশ পরে থাকতেন। উনি সবসময়ই এমন ছিলেন। শুধু ক্ষণিকের জন্য নিজের ভোল পাল্টেছিলেন।

আরশির এসব ভাবনার মাঝেই সূর্য আর রেহান এলো। হাতে অনেকগুলো খাবারের প্যাকেট। আসলে ওরা ডিনার করতে বাইরে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সূর্যই না করেছে। ও খাবার নিয়ে আসবে বলে ওদেরকে এখানে অপেক্ষা করতে বলে গেছিলো।

ওরা একে একে সব খাবার গুলো সাজিয়ে ফেললো।
অনেক গুলো আইটেম।
~ ওয়াও ভাই, বারবিকিউ চিকেন! তুই এটা কিনে আনতে গেলি কেনো? আমরা নিজেরাই তো করতে পারতাম।
~ এখানে পারমিশন দিবে না। তাই তো কিনে আনলাম। সবাই খাওয়া শুরু করো।

খাওয়া শেষে ওরা বাইরে বেড়িয়ে এলো। নাহিদ আর রিক মিলে অনেকগুলো ফানুস নিয়ে এলো। আজকে এগুলো উড়ানো হবে। ফানুস দেখে সবাই অনেক খুশি হয়ে গেলো। আরশি একটা ফানুস নিলো। আগুন জ্বালাতেই যাবে তার আগেই কোত্থেকে সূর্য এসে ছো মেরে ওর হাতের থেকে লাইটার টা নিয়ে নিলো। আরশি হা করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে বললো,,
~ আমি ফানুস উড়াবো তো , লাইটার টা দিন।
~ একা একা উড়াবে কেনো?
~ হ্যাঁ? আমি একা কোথায় সবাই তো নিজেদের টা উড়াচ্ছে।।
~ সবাইকে কেনো দেখছো, আমাকে চোখে পড়ছে না তোমার? আমি তো ফানুস ভাগেই পেলাম না। তাই এইটা আমার। তবে তুমি চাইলে আমরা এটাকে শেয়ার করতে পারি। হোয়াট সে??
~ শেয়ার করবো? কি করে?
~ দেখাচ্ছি। ফানুস টা ধরো।

আরশি ফানুসটাকে ধরলো। সূর্য বেশ যত্ন করে সেই ফানুসে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। আরশির মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। সূর্য ও মুচকি হেসে ওর দিকে তাকালো। তারপর এক সাথে ফানুসটাকে আকাশে উড়িয়ে দিলো। ফানুস গুলো দেখতে তারার মতো মনে হচ্ছে। আরশি হাসি মুখে সেদিকে তাকিয়ে আছে। আর সূর্য! সে তো আরশির ঐ মিষ্টি হাসিটা দেখতে ব্যস্ত। সুজানা আর মিহি রিক কে দায়িত্ব দিয়েছিলো আরশি আর সূর্যর বিশেষ মুহূর্তের পিক তুলে রাখতে। রিক তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে। ফানুস উড়ানো থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ওদের প্রত্যেকটা মোমেন্টের ছবি ও তুলে ফেলেছে। ছবিগুলো তুলে দাঁত কেলিয়ে হাসলো রিক। মনে মনে দোয়া করলো ওদের সম্পর্কটা যাতে খুব জলদিই স্বাভাবিক হয়ে যায়। ওরা যেন চিরকাল একসাথে থাকতে পারে। আর এভাবেই যেন একসাথে হাসতে পারে।

সবাই ফানুস উড়াচ্ছে কিন্তু নিধি একপাশে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র এতক্ষন যাবৎ আরশি আর সূর্যকে দেখছিলো। তখন ওর বাসে সূর্যের বলা কথাগুলো মনে পড়লো। চারপাশে তাকিয়ে নিধিকে খুজছিলো। কিন্তু ওকে এভাবে একা জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলো। পাশে থাকা রেহানকে জিজ্ঞেস করলো,,,
~ তোর বোনের কি হয়েছে রে! ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেনো?
রেহান দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিধির দিকে তাকালো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,,
~ ও উড়াবে না। বাদ দে ওর কথা।
অভ্রর ভ্রূ কুচকে গেলো। নিধির হাল্কা ভয় মিশ্রিত মূখের দিকে তাকিয়ে বললো,,
~ ঠিক কারনটা কি? বল তো!
রেহান একবার নিধির দিকে তাকিয়ে তারপর অভ্রর দিকে তাকালো। অসহায় ভাবে বললো,,
~ নিধি আতশবাজি, ফানুস উড়ানো এসবে ভয় পায়।
~ আতশবাজি মানা যায় কিন্তু ফানুসে কিসের ভয়?
~ ওইযে হাতে নিয়ে আগুন জ্বালাতে হবে যে। ওর ধারণা এতে বড়ো দুর্ঘটনা হতে পারে। হাত বা শরীরের কোনো অংশ পুড়ে যেতে পারে। ওকে আমি আর মা মিলে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু ও মানতে নারাজ। ও মুখে অস্বীকার করলেও আমি জানি ওর আতশবাজি, ফানুস এসব অনেক ভাল লাগে। কিন্তু ভয়ের কারনে বেচারি এসবের থেকে দূরে থাকে।
~ ওকে আজকে একবার ডাকতি।
~ গেছিলাম। মিহি আর আরশি ও গেছিলো কিন্তু ও মানা করে দিয়েছে। কি আর করার!
রেহান আবার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর অভ্র নিধির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। তারপর আস্তে আস্তে সেদিকে এগিয়ে গেলো। রেহান আড় চোখে অভ্রর যাওয়া দেখলো। কিন্তু কোনো রিয়েক্ট করলো না।

অভ্র চুপচাপ নিধির পাশে গিয়ে দাড়িয়ে রইলো। কিন্তু নিধির কোনো ভাবান্তর নেই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্র নিধির কানের কাছে ঝুঁকে বললো,,
~ ফানুস উড়াবে?
আচমকা কারো গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাবড়ে গেছিলো নিধি। পাশে তাকিয়ে অভ্রকে ওর দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখে নিজের মাথা টা পিছিয়ে নিলো।
~ আপনি? এখানে কি করছেন?
~ কি জিজ্ঞেস করলাম ফানুস উড়াবে ?
নিধি এক কদম সরে গিয়ে বললো,,
~ না।
~ কেনো? ভয় করে? কিন্তু একবার সাহস করে ভয় টা কি জয় করা যায় না?

নিধি চমকে গেলো।

~ কে বলেছে আপনাকে যে আমি ভয় পাই?
অভ্র কোনো উত্তর না দিয়ে নিধির পিছনের টেবিল থেকে একটা ফানুস হাতে নিলো। তারপর ফানুস টা নিধির হাতে ধরিয়ে দিলো। নিধি অবাক হয়ে অভ্রর কার্যকলাপ দেখছে। যেই না অভ্র লাইটার টা হাতে নিয়েছে আগুন জ্বালানোর জন্য ওমনি নিধি ওর হাত থেকে ফানুস টা ফেলে দিলো। ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,,
~ আমি এসব উড়াবো না। প্লিজ আপনার ইচ্ছে হলে অন্যদিকে গিয়ে উড়াতে থাকুন।
অভ্র ঝুঁকে ফানুস টা তুলে আবার নিধির কাছে গেলো।

~ নিধি ! আমার দিকে তাকাও।

নিধি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। অভ্র আবার ডাকার পরেও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। নিধির তুথনি ধরে ওকে জোর করে নিজের দিকে ফেরালো অভ্র। নিধি না চাইতেও অভ্রর দিকে তাকালো। অভ্র ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিধি অভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। ওর চোখের গভীর মায়ায় তলিয়ে যাচ্ছে। পলক ফেলতে ও ভূলে গেছে নিধি। অভ্র ধীরে ধীরে নিধির পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। পিছন থেকে ফানুস ধরে থাকা নিজের দু হাত নিধির দু পাশ দিয়ে সামনে তুলে ধরলো। নিধি হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ইশারা করলো ফানুস টা ধরতে। নিধি অভ্রর দিকে অসহায় চোখে তাকালো। অভ্র চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো যার মানে, ” ভয় পেয়োনা আমি আছিতো ! ” নিধি কাপা কাপা হাতে ফানুস টা ধরলো। অভ্র লাইটার দিয়ে ফানুসে আগুন ধরিয়ে দিলো। নিধি চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। অভ্র ওর কাঁধে হাত রেখে চোখ খুলতে বললো। নিধি মাথা নাড়ালো মানে খুলবে না। অভ্র চাপা ধমক দিলো। পিট পিট করে চোখ খুললো নিধি। তারপর অভ্র ওর হাতের উপর হাত রেখে ফানুস টা আকাশে উড়িয়ে দিলো। হঠাৎ করেই নিধির এত বছরের থাকা ভয়টা কেটে গেলো। ফানুস উড়াতে পেরে অনেক খুশি সে। হাসি যেন মুখ থেকে সরছেই না। ওর হাসি দেখে অভ্র ও মৃদু হাসলো। কিন্তু হঠাৎ করে অভ্র নিজের জায়গায় স্থির হয়ে গেলো। কারণ অতি খুশিতে নিধি তাকে জড়িয়ে ধরেছে।
~ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ সো মাচ অভ্র। আজ তোমার জন্য আমি ফানুস উড়াতে পেরেছি। ( অভ্রর কাধে মুখ গুঁজে ) জানো যখনই কাওকে ফানুস উড়াতে দেখতাম আমার ও খুব ইচ্ছে করতো উড়াতে কিন্তু আগুন জ্বালাতে গেলেই ভয় লাগতো। কিন্তু আজ আমি পেরেছি।।।
অভ্র এতোদিন পর নিধিকে আগের মতো ওর সাথে কথা বলতে শুনে বেশ খুশী হলো। কিন্তু অসস্তি ও হচ্ছে। কারণ এখানে সবাই আছে। আর নিধি ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কেউ দেখলে ব্যপারটা নিয়ে ভূল বুঝতে পারে। তাই অভ্র আলতো করে নিধির মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। নিধির এতক্ষণে খেয়াল হলো অতিরিক্ত খুশিতে ও কি করে ফেলেছে।। একবার সবার দিকে তাকালো। নাহ কেউ ওদের দেখে নি। সস্তির নিশ্বাস ফেললো। আড়চোখে অভ্রর দিকে তাকালো। অভ্র হালকা হেসে ওর নাক টেনে দিয়ে বললো,,,
~ যাক ভয় কে জয় করতে পেরেছো। অভিনন্দন তোমাকে।
তারপর হেসে অন্যপাশে চলে গেলো। নিধি ওর যাওয়ার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।

রেহান ক্যামেরা অফ করে প্রশান্তির হাসি হাসলো। এতক্ষণ সবটাই রেকর্ড করেছে ও। বোনের মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখে ওর মন ও ভালো হয়ে গেলো। যাক অভ্র তাহলে নিধির ভালো লাগা খারাপ লাগার কেয়ার ও করে। ও শুধু এটাই চায় অভ্র যেনো খুব শীঘ্রই নিজের মনের কথা বুঝতে পারে। কারণ নিজের অজান্তেই ও নিধির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটা যত জলদি বুঝতে পারবে ততোই ওদের জন্য ভালো হবে।

সবাই সূর্য কে বলছে গান গাইতে। সুজানার মতে তার ভাই গিটার অনেক ভালো বাজায়। নিশ্চয় অনেক ভালো গান ও গাইতে পারে। তাই আজ তাকে গাইতেই হবে। কিন্তু সূর্যের এক কথা ও গাইবে না। মানে গাইবেই না। কারোর কথাই শুনছে না। সুজানা শেষে আরশি কে ইশারা করে বললো সূর্য কে গান গাইতে বলতে। আরশি দ্রুত মাথা নাড়ালো তার মানে ও বলতে পারবেনা। সুজানা চোখ রাঙালো। আরশি অসহায় ভাবে সুজানার দিকে তাকালো। এতগুলো মানুষের সামনে কি করে বলবে ও। আর সূর্য কি ওর কথা শুনবে নাকি? নিজের বোন আর ফ্রেন্ডদের কথাই তো শুনলো না। সুজানা ওকে খুঁচিয়েই যাচ্ছে বলার জন্য। শেষে আর না পেরে সাহস করে সূর্য কে উদ্দেশ্য করে বললো,,,
~সবাই যখন এতো করে বলছে তখন গাইলেই হয়।

সূর্য মাথা নিচু করে রেখেছিলো। আরশির কথায় ওর দিকে তাকালো। বাকিরাও আরশির দিকে তাকালো।
আরশি সবাইকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ঢোক গিললো। তারপর মাথা নিচু করে মিন মিন করে বললো,,,
~ না মানে বলছিলাম গানটা গাইলে সকলে বেশ খুশিই হতো। কিন্তু আপনি না চাইলে গাওয়ার দরকার নেই।

সূর্য আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর রিক কে ইশারা করে গিটার আনতে বললো। রিক এক প্রকার হতভম্ব হয়েই গিটার এনে সূর্যর হাতে দিলো। বাকি সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

গিটারের টুং টাং আওয়াজে আরশি মাথা তুলে সূর্যের দিকে তাকালো। ও আরশির দিকেই তাকিয়ে আছে।

Main bhi hoon tu bhi hain, amne samne
Dil ko behka diya ishq ke jaam ne (×2)
Musalsal nazar barasti rahi
taraste hain hum bheege barsaat main
ho ik mulaqaat
Ik mulaqaat mein baat hi baat mein
unka yun muskurana gazab ho gaya
kal talak woh jo mere
khayalon mein thhe
rubaru unka aana gazab ho gaya
Mohabbat ki pehli mulaqaat ka asar dekho
na jaane kab ho gaya……
Ik mulaqaat mein baat hi baat mein
unka yun muskurana gazab ho gaya
Humsafar har safar mein teri hi kami hai
Dil tera hi to hai mere hadd ki Zameen

Humdard tu dard se mere waakif nahi hai
kareeb aa dekh tu aankhon ki nami
kyun khayalon mein kuch barf si gir rahi
Rait ki khwahishon mein nami bhar rahi
Musalsal nazar barasti rahi
taraste hain hum bheege barsaat main
O Ik mulaqaat…..

ik mulaqaat mein baat hi baat mein
unka yun muskurana gazab ho gaya
kal talak woh jo mere khayalon mein thhe
Rubaru unka aana gazab ho gaya
mohabbat ki pehli mulaqaat ka asar dekho na jaane kab ho gaya
Ik mulaqaat Baat hi baat..
unka yun muskurana gazab ho gaya
______________

পুরোটা গান সূর্য আরশির দিকে তাকিয়েই গেয়েছে। আরশি ও সকল সংকোচ , লাজ-লজ্জা ভুলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলো গান গাওয়ার সময়। হাত তালির আওয়াজে আরশি দ্রুত সূর্যের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। সূর্য এখনও তাকিয়ে। সুজানা, মিহি, রোজ আর ন্যান্সি আরশি কে আর সূর্য কে টিজ করে যাচ্ছে এভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে। বাকিরা হাসছে। অভ্র সবটাই দেখছে, বুঝতে পারছে। মনে মনে ঠিক করলো আরশির সাথে খোলাখুলি ভাবে কথা বলবে ওর আর সূর্যের ব্যাপারে।।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here