আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
পর্ব:৩৭
আরশি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুতেই ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করতেই সূর্যের মুখটা ভেসে উঠছে। পাশে সুজানা আর মিহি ঘুমাচ্ছে। মোবাইলে সময় দেখলো ৩ টা বেজে ২৫ মিনিট। ভোর হতে বেশিক্ষণ বাকি নেই। সানরাইজ দেখা যাবে। এই ভেবে বারান্দায় গেলো। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কটেজ থেকে বেড়িয়ে এলো। দরজা খোলার শব্দে নিধি মাথা তুলে তাকালো। আরশি কে এতো রাতে একা বাইরে যেতে দেখে অবাক হলো। ঘড়িতে সময় চেক করলো।
~ এই সময় আরশি বাইরে যাচ্ছে কেনো ? এভাবে একা বের হওয়াটা তো সেফ না।
রোজ আর ন্যান্সি ঘুম তাই আস্তে আস্তে উঠে বাইরে বেড়িয়ে এলো।
আরশি কাঠের ব্রিজের উপর দাড়িয়ে আছে। নিধি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আরশি ব্রিজের নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। নিধি ওর কাঁধে হাত রাখলো।
~আরশি!
আরশি চমকে নিধির দিকে তাকালো।
~ ও নিধি আপু তুমি! আমিতো ভয় ই পেয়ে গেছিলাম।
~ তুমি এখানে এতো রাতে কি করছো ? এই জায়গায় রাত করে একা বের হওয়া ঠিক না।
~ কি করবো ঘুম আসছিলো না। তাই ভাবলাম সানরাইজটা দেখেই নেই। তুমি ঘুমাও নি কেনো?
~ ঘুম আসছে না। আর নতুন জায়গায় আমি এমনিতেও ঠিক করে ঘুমোতে পারি না।
~ওহ আচ্ছা।
নিধি কিছু একটা ভেবে আরশি কে জিজ্ঞেস করলো,,
~ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড তোমাকে একটা কথা বলি?
~ হ্যাঁ বলোনা কি বলবে ।
~ আমি তোমার আর সূর্যের ব্যাপারে মিহির কাছে সবটাই শুনেছি। জানোতো আমার কেনো যেনো মনে হয় সূর্য ও তোমাকে ভালোবাসে।
আরশি কথাটা শুনে কেপে উঠলো। নিধির দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা কণ্ঠে বললো,,
~ তো.তোমার কেনো মনে হলো এটা ?
~ সূর্যকে দেখে। ওর তাকানো, তোমার কথা শুনে গান ও গাইলো, একসাথে ফানুস ও উড়ালো।
~ এগুলো তো নরমাল ব্যাপার এগুলো দেখে তোমার কেন মনে হল উনি আমাকে ভালোবাসবেন?
আরশি মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেললো। নিধি আরশি কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,,
~ হ্যাঁ মনে হলো। কারণ আমি ওর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। ভালো না বাসলে কেউ কারো দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারে না।( আরশি নিধির দিকে তাকালো ) বিলিভ মি। এখন শুধু ওর মুখে স্বীকার করা বাকি। আচ্ছা তুমি কি তোমার মনের কথা ওকে বলেছো?
~ না।
~ কেনো বলোনি? আমার মনে হয় তোমাদের মাঝে এই ব্যাপারে খোলাখুলি কথা হওয়া উচিত। না হলে মনের কথা মনেই থেকে যাবে। মুখ ফুটে আর বলা হবে না।
আরশি মাথা নাড়লো।
~ তোমরা এখানে কি করছো?
নিধি আর আরশি পিছনে ঘুরে তাকালো সূর্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে কটেজের সামনে দাড়িয়ে আছে।
~ ভাইয়া আপনি! ঐ আসলে আমাদের ঘুম আসছিলো না তাই একটু বাইরে এসেছিলাম।
সূর্য ওদের দিকে এগিয়ে এলো। আরশির দিকে তাকিয়ে, নিধির দিকে তাকালো।
~ একা এভাবে বাইরে চলে এলে? এভাবে একা বের হওয়া ঠিক হয় নি।
~ সরি ভাইয়া।
আরশি কিছু বলছে না। নিধি একবার আরশির দিকে আরেকবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললো,,,
~ উম আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।
~ হুম চলো আমিও যাচ্ছি। আরশি যেতে নিবে কিন্তু ওর হাতে টান পড়লো। পিছনে ঘুরে দেখলো সূর্য ওর এক হাত ধরে রেখেছে। আরশি অবাক হয়ে গেলো। নিধি ওদের দেখে মুচকি হেসে বললো,,
~ তোমার যেতে হবে না আরশি তোমার এখানে থাকাটা বেশি প্রয়োজন। আমি আসছি।
নিধি হাসতে হাসতে কটেজের ভিতরে ঢুকে গেলো।
আরশি হাত ছুটানোর চেষ্টা করছে। সূর্যকে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এলো।
~ এতো ছটফট করছো কেনো? চুপচাপ দাড়াও। ( আরশির কোমর জড়িয়ে ধরে ধমকে )
আরশি চুপ হয়ে গেলো। সূর্য আরশির গাল ছুঁয়ে যাওয়া চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে ওর কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আরশি মাথা নুইয়ে ফেললো।
~ তো সানরাইজ দেখবে বলে অপেক্ষা করছো?
আরশি অবাক হয়ে গেলো। সূর্য কি করে ওর মনের কথা জানলো!
~ আপনি কি করে..
~ জানলাম তাই তো? ( আরশি মাথা দুলালো ) তোমার কথা গেইস করাটা তেমন একটা কঠিন না।
আরশি সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললো,,
~ সত্যিই কি আমার মনের কথা বোঝা আপনার জন্য এতোটা সহজ?
~ আমার জন্যে তো সহজ ই।
~ কিন্তু আমার জন্য মোটেও সহজ নয় আপনার মনে কি আছে সেটা জানা।
~ ঠিক করে ট্রাই করে দেখো।
~ আমার,, আমার আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আছে।
~ জানি। তোমার মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে। বলো কি জানতে চাও।
আরশি সূর্যের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।
~ আপনি কি আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছেন?
~ কোন বিয়ে?
আরশি অবাক হয়ে বললো,
~মা. মানে? কোন বিয়ে মানেটা কি? আপনার কি আমাদের বিয়ের কথা মনে নেই? ( কান্নাজড়িত কন্ঠে)
~ কান্না করছো কেনো? ( আরশি কে ধরতে গেলে আরশি দূরে সরে গেলো ) আরে আমার কথাটা তো আগে শুনবে। লিসেন কাম হেয়ার।
~ আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না।
আরশি চলে যেতে নিলে সূর্য ওকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
~ ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি। ( নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে )
~ হুশ! শুনো। আচ্ছা আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিলো তখন বিয়ে জিনিসটা ঠিক কি তুমি জানতে?
~ হ্যাঁ জানতাম।
~ আচ্ছা? কি জানতে? তোমাকে আপু আর দিম্মা মিলে বিয়ে মানে কি বুঝিয়ে ছিলো? তোমার পুতুল বর বউয়ের মতো সবসময় একসাথে থাকা তাইতো?
আরশি মাথা দুলালো।
~ কিন্তু আরশি মানুষের বিয়ে আর পুতুলের বিয়ে কি কখনো এক হতে পারে? আমি জানি তখন তোমার জন্য এইসব বোঝা সম্ভব ছিলোনা। তোমার সবটা বুঝতে আরও সময় প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমিতো এইসব বুঝতাম তাই না? দেখো দিম্মা আমাদের বিয়েটা দিয়েছিলেন কারণ তার মনে হয়েছিলো আমরা একে অপরের জন্য পারফেক্ট। হয়তো তখন নয় ভবিষ্যতে পারফেক্ট কাপল হবো। কিন্তু তখন ঐ সময় এইসব ভাবার অবস্থায় আমি বা তুমি কেউই ছিলাম না। তাহলে এই বিয়ের মানেটা কি ছিলো বলো আমায়?
~ তিন কবুল পড়ে বিয়ে হয়েছিলো আমাদের। তারপরেও কেন বলছেন এই বিয়েটার কোনো মানে নেই।
~ হ্যাঁ বলছি। তুমি আমায় বলো এখন তোমার কাছে আমাদের বিয়েটা অসল বিয়ে মনে হচ্ছে। কেনো? কারণ তুমি এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছো। বিয়ে কি সেটা বুঝতে শিখেছো। কিন্তু তখন তোমার কাছে আমাদের বিয়েটা পুতুলের বিয়ে দেওয়ার মতো আর আমি তোমার কাছে তোমার পুতুল বর ছিলাম। কিন্তু এখন তো আমাকে তোমার সত্যিকারের বর মনে হচ্ছে তাই না ?
~ আমি আপনাকে এখনো আমার পুতুল বর হিসেবেই জানি। আর জানবো।
~ তা তুমি জানতেই পারো। কিন্তু তোমার এখনের আমাকে পুতুল বর মানা আর তখনের পুতুল বর মানার মধ্যে পার্থক্য ছিলো। আমি তোমাকে বিয়েটা শুধুমাত্র দিম্মাকে দেওয়া প্রমিস এর জন্য করেছিলাম। আমার মধ্যে তোমার জন্য তখন কোনো ফিলিংস ছিলো না।
~ আর এখন ? ( ছলছল চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে )
~ এখনের টা নাহয় পরেই বললাম।
আরশি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সূর্য আরশি কে আবার নিজের দিকে ফেরালো। গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো,,
~ তোমার থেকে দূরে কেনো গেছিলাম জানো? তোমাকে আর নিজেকে সময় দিতে। আমি যদি তখন সবটা মেনে ও নিতাম তাহলে আজকে পরিস্থিতি এমন হতো না। আমার মাঝে শুধু তখন দায়িত্ববোধ টা থাকতো।কিন্তু আমি সেটা চাইনি। আমাদের বিয়ে শুধুমাত্র দুটো পরিবারের সম্মতিতেই হয়েছিল আমাদের নিজেদের কোনো ইচ্ছে ছিলোনা। আর শুধু দুটো পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয়না দুটো মানুষের সম্মতির ও প্রয়োজন আছে বিয়েতে। আমি আমাদের দুজনের ভালোর কথা ভেবেই দূরে থাকার ডিসিশনটা নিয়েছিলাম। দেখো এতে কিন্তু কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। হ্যাঁ আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু কষ্টের পরেইতো সুখ আসে আরশি। আমি তোমার থেকে দূরে থেকে তোমাকে অনুভব করেছি। হ্যাঁ আগে তোমার উপর রাগ দেখাতাম। বকা দিতাম। কিন্তু তারমানে এইনা যে আমি তোমাকে সহ্য করতে পারতাম না। তুমি সব সময় আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট ছিলে। ওই সময়ে বিয়েটা হওয়ার জন্য সব থেকে বেশি ইফেক্ট কিন্তু তোমার উপর পড়তো। তুমি বলতে পারো যে একসাথে থেকে কি সব ঠিক করা যেত না? তাহলে আমি বলবো না, যেতো না। আমরা বিয়েটাকে ভূলে যতই আগে বাড়ার চেষ্টা করতাম না কেনো পারতাম না। এক বাড়ীতে , সবসময় একে অপরের চোখের সামনে থেকে এই বিয়েটা ভূলে থাকা কখনোই সম্ভব হতো না। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। বাট অল থ্যাংকস টু আল্লাহ আপুর অপারেশনের জন্য আমাদেরকে কানাডা শিফট হতে হলো। আমিও একটা সুযোগ পেলাম। আমি সবাইকে না করেছিলাম আমাদের বিয়েটা নিয়ে কোনো কথা বলতে কিন্তু কখনও তাদেরকে তোমাকে ভুলে যেতে বলিনি না আমি নিজে কখনো তোমাকে ভুলেছি। আমি আরো পরে ব্যাক করতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবা এখনি ব্যাক করতে বললো।
~ তাহলে আমাদের বিয়েটার কি কোনো গুরুত্ব নেই ?
~ অবশ্যই আছে।
~ তাহলে এসব ?
~ ঐ বিয়েটা নামমাত্র বিয়ে ছিলো। আমাদের দুজনকে একটা সম্পর্কে বাধার ওয়ে ছিলো জাস্ট। কিন্তু পুরোটাই মিনিংলেস ।
আরশির চোখ থেকে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। সূর্য যত্ন সহকারে ওর চোখের পানি মুছে দিলো।
~ আরশি আমি পুরোনো কিছু মনে রাখতে চাই না। ঐ বিয়েটা আমি ভুলতে চাই। ( আরশি হতভম্ব হয়ে সূর্যের দিকে তাকালো ) হ্যাঁ আমি সবটা ভুলতে চাই। আবার নতুন করে সব শুরু করতে চাই।
~ মানে ?
সূর্য মুচকি হেসে বললো,,
~ আমি এই আরশি কে আবার আমার করতে চাই। তোমার পুতুল বর হতে চাই । সত্যিকারের পুতুল বউয়ের পুতুল বর। হবে তো আমার পুতুল বউ?
আরশি এখনো অবাক হয়ে সূর্যকে দেখছে।
~ কি হবে না ?
আরশি একই ভাবে তাকিয়ে আছে। সূর্য হঠাৎ করে আরশির নাকে আলতো করে কামড় দিলো। আরশির হুশ ফিরে এলো।
~ আপনি মানে আবার বিয়ে ,?
সূর্য মিষ্টি হেসে মাথা দুলালো। আরশি চোখে পানি নিয়েই মুচকি হাসলো। আচমকা সূর্য আরশি কে জড়িয়ে ধরলো। খুব শক্ত করে। আরশি প্রথমে চমকে গেলেও পরে হেসে নিজেও সূর্যকে জড়িয়ে ধরলো। দুজনেরই ঠোটে মেখে আছে প্রাপ্তির হাসি।
#চলবে