তিন বছর আগে ঠিক এই দিনটায় ভালাবাসার মানুষটার বিয়ের দিন পাড়ি দিয়েছিলাম সদূর আমেরিকায়। আজ আবার
দীর্ঘ তিন বছর পর পা রাখলাম সেই চিরচেনা শহরে। এই শহরে পা রাখতেই পুরোনো সেই অতীতটা আবার মনে পড়ে গেলে। ভালোবাসার মানুষ টাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা টা আরো প্রকোপ হলো।
একতরফা ভালোবাসা যে এতোটা পু*ড়ায় ক্ষনে ক্ষনে। একদম দম বন্ধকর পরিস্থিতি।
খুব ছোট থেকেই ভালো লাগতো রায়ান ভাইকে। সে সম্পর্কে আমার চাচাতো ভাই। আস্তে আস্তে এই ভালোলাগা টা যে কখন ভালোবাসায় পরিনত হলো বুঝতেই পারলাম না। তার আশে পাশে কোনো মেয়েকে সহ্য হতো না। কোনো মেয়ের সাথে তাকে কথা বলতে দেখলে খুব রাগ হয়। তার সাথে কথা বার্তা খুবই কম হতো আমার।
রায়ান ভাইয়ার আম্মু জানতো যে আমি রায়ান ভাইকে ভালোবাসি। আমার হাবভাব দেখেই কিছুটা বুঝে ফেলছিলো।
এভাবেই কাটতে থাকতো দিনগুলো।
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একটা ফ্রেন্ড হয়। তার নাম রিয়া বেস্ট ফ্রেন্ড ও বটে। প্রান উচ্ছাসি একটা মেয়ে।
যখন ইন্টারে উঠি তখন রিয়ার আমাদের বাসায় আসার মাত্রাটা বেড়ে গিয়েছিলো। তখন বুঝতে পারি নি তার আসার কারন ভেবেছি আমার সাথেই দেখা করতে আসতো।যেই রায়ান ভাই কি না আমার সাথে নিজে এসে কথা বলতো না সেই রায়ান ভাই কি না আমার কাছে রিয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতো, প্রথমে এসব নরমালি নিলেও পরে ব্যাপারটা খুব ভাবায় আমায়। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন কলেজ থেকে ফিরে শুনি রায়ান ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্রী আর কেও না আমারই ফ্রেন্ড রিয়া। সেদিন শুধু রায়ানের মা বড় আম্মুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। তিনি তো আমায় কথা দিয়েছেলেন আমায় রায়ান ভাইয়ের বউ বানাবে। তাহলে আজ কেন এমন করলো বড় আম্মু?
রাতে বড় আম্মুর সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বললে তিনি জানান,,
” দেখ চিত্রা আগে যেটা বলেছিলাম সেটা ভুলে যা। আমি রিয়াকেই আমার ছেলের বউ বানাতে চাই। তখন আবেগের ছলে বলে ফেলেছিলাম তোকে রায়ানের বউ বানাবো কিন্তু রায়ান রিয়াকে ভালোবাসে আর রিয়াকেই বিয়ে করতে চায়। আশা করি তুই বুজছিস।”
” কিন্তু বড় আম্মু আমার ভালোবাসার কি হবে তাহলে আমিও তো রায়ান ভাইকে ভালোবাসি। ”
“এক পাক্ষিক ভালোবাসা দিয়ে কিচ্ছু হয় না, রায়ান তোকে কখনো সে নজরে দেখে নি। তুই দেরি করে ফেলছিস তোর ভালোবাসা প্রকাশ করতে, এখন আর কিছু করার নেই।”
কথাটা শুনা মাত্র ই ছুটে চলে এসেছিলাম নিজের ঘরে।
সেদিন খুব কেঁদেছিলাম পা*গলের মতো। রুমের দরজা বন্ধ করে ছটফট করছিলাম গ*লা কা*টা মুরগীর মতো।
বলতে পারি নি কাউকে নিজের কথা। আর না ছিলো বলার মতো পরিস্থিতি।
একবার বলতেও চেয়েছিলাম রায়ান ভাইকে আমার এক পাক্ষিক ভালো বাসার কথা। কিন্তু অপমান লাজলজ্জার ভয়ে বলতে পারি নি।
দেখতে দেখতে তাদের বিয়ের দিনও চলে আসলো।
আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না বিয়েটা নিজের চোখে দেখার। যেখানে এতোদিন নিজেকে তার পাশে বসিয়ে এসেছি আর আজ তার পাশেই আমার বেস্টু রিয়া। মানতে কষ্ট হচ্ছিল, তাই সেদিন রাতেই আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হই ছোট চাচ্চুর সাথে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তার আমেরিকা যাওয়ার ডেট ছিলল। আমার ও যেহেতু ভিসা পাসপোর্ট ছিলো আগে থেকেই সে জন্য আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় নি। সবাই অবাকই হয়েছিলো আমার হঠাৎ চলে যাওয়াতে, তাদের বলেছিলাম ভালো পড়াশোনার জন্য আমায় ওখানে যেতেই হবে আর তার উর্ধে ভালো থাকার জন্য।
আমি চলে আসার এক বছর পরই রিয়া রায়ানের একটা মেয়ে হয়। সেদিন খবর টা শুনে কোনো অনুভূতিই পাই নি। এখানে আসার পর রায়ান ভাই আর রিয়া অনেক বার ফোন দিয়েছিলো বিভিন্ন ব্যাস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে গিয়েছি। এই তিনটা বছর ধরে নিজেকে তৈরি করেছি।
আজ আবার নিজ গৃহ নিজ মাতৃভূমি তে ফিরছি,চিরকাল তো আর ভীনদেশে থাকা যায় না। এবার নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলেছি যাতে আর নিজেকে ভেঙে যেতে না দেখি।
বাড়িতে পা রাখতেই এক পিচ্চি এসে সামনে দাঁড়ালো সাথে ছিলো পুরো পরিবার। মা বাবা আমায় দেখার সাথে সাথে দৌড়ে কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো পরম আবেশে। মা অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিলো মুখ,তখন ও দেখি পিচ্চিটা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,আমার চিনতে খুব একটা কষ্ট হয় না এ বাচ্চাটা কাদের। আমি পিচ্চিটার কাছে গিয়ে খানিকটা ঝুঁকে হাত বাড়ালাম কোলে নেবার জন্য, পিচ্চি টা ও কোলে আসার জন্য হাত বাড়ায়,কোলে নিতেই পিচ্চি টা আদো আদো কন্ঠে ফুপি,আন্টি বলতে লাগলো।
এই টুকু পিচ্চির মুখে এমন ডাক শুনে অবাক হয়ে যাই। ব্যাগ থেকে চকোলেট বের করে পিচ্চি ছেলেটার হাতে দেয়, এর মধ্যেই রিয়া এসে আমায় জড়িয়ে ধরে।
-“ খুব মিস করছি ইয়ার তোকে,আর যাস না চলে ঐ সুদূর দেশে।
রিয়াকে কিছু বলতে নিবে এর মাঝেই চোখ যায় সোফায় বসে থাকা রায়ান ভাইয়ের দিকে,আগে থেকে আরো সুদর্শন হয়ে গেছে, নিজের দৃষ্টিকে সংবরণ করে শুধাই-
-“ না আর যাবো না তা কেমন চলছে তোদের দিনকাল। পিচ্চিটা দেখি একদম তোর মতো হয়েছে।
-“ এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই চলছো সব,আগে যা ফ্রেশ হয়ে আয় অনেক দূর থেকে এসেছিস,রেস্ট নে গিয়ে।
চিত্রার মা পাশ থেকে চিত্রা কে নিয়ে যায়, চিত্রা ঘরে এসে অবাক হয়, সেই আগের মতোই আছে তার এই রুম টা একটু ও পরিবর্তন হয় নি। মেয়েকে এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুধায়,,
” তোর রুমে কাউকে ঢুকতে দেই নি প্রতিদিন এসে সযত্নে পরিষ্কার করে গেছি,এদিক থেকে ওদিক হতে দেই নি। ”
চিত্রা মায়ের কথা শুনে ব্যাগ থেকে জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে খানিকটা সময় নিজের ঘরে বিশ্রাম নেয়, এর মধ্যে চিত্রার মায়ের ডাক আসে খাবার খাওয়ার জন্য, চিত্রা সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতেই দেখতে পায় রায়ান আর রিয়া মিলে পিচ্চি টাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে,পিচ্চি টা খেতে চাচ্ছে না তা দেখে রায়ান নানান অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে ছেলেকে হাসাচ্ছে আর রিয়া সেই সুযোগে পিচ্চির মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে।
চিত্রা মাথা নিচু করে এসে টেবিলে বসে নিশ্চুপে খাবার খেয়ে নিজ ঘরে চলে যায়। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে জানতে চায় তার অনুভূতির কাছে,কেনো সে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আবার, কেনো তাদের সুখী পরিবারকে দেখে বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হয়,
মুখ দিয়ে তো খুব সহজে বলাই যায় নিজেকে গড়ে তুলেছি শক্ত করে, কিন্তু মন গহীনে তো এখনো থেমে থেমে কড়া নাড়ে পুরোনো অতীত, তাকে তো চেয়েছি ভুলতে কিন্তু আদৌও কি সেটা সম্ভব হয়,আগে তো সুদূরে ছিলাম তাই একটু হলেও ভুলে থাকতে পেরেছি,কিন্তু এখন কি হবে, এখন থেকে তো একই ছাঁদের নিচে বসবাস,মনের অন্তঃস্থলে আর কতো দিন তাকে নিয়ে অসংখ্য ব্যাথা অনুভূত হবে, ভালোবাসলেই তো তার সাথে ঘর বাঁধা যায় না।
আকাশে জ্বল জ্বল করে থাকা চাঁদটার দিকে তাকায় চিত্রা। ছলছল নয়নে চেয়ে থেকে বলে উঠে,,
” ও চাঁদ তুমি ভুলিয়ে দিয়ো সব মোর গ্লানি, সঙ্গী হইয়ো মোর এমনি প্রতিটি রাতের, আমার সব ব্যাথাযুক্ত গল্প গুলো শুনাবো তোমায় অতি সন্তপর্ণে, তুমি না হয় নিরব পাঠক হয়ে শুনে যাবে আমার গল্পের প্রতিটি পর্ব”
—————–
-“ হ্যালো ভাইয়া তোমার প্রেয়সী দেশে এসেছে। এবার আর হারাতে দিয়ো না। নিজের অনুভূতি গুলো জানিয়ে দাও তাকে।
ফোনের ওপাশে থাকা ব্যাক্তিটি চোখ মেলে তাকালো। বিছানা ছেড়ে উঠে বেলকনিতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল-
-“ রেডি থাকতে বলিস তাকে। খুব পুড়িয়েছে আমায়। তার শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। শাস্তি স্বরূপ তাকে আমার শহরে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলে জানে মে’রে ফেলবো
( আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবার রেসপন্স আশা করছি।)
#চলবে?
#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ
#সূচনা_পর্ব
#Raiha_Zubair_Ripte