আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ১০

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১০
__________________________
নিপার গায়ে হলুদ পর্ব হয়ে গেলো বেশ ঘটা করে ৷ একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোন কমতি রাখতে চান না গাজী মিয়া ৷ গ্রামের সব বউজিরা মিলে গীত গাইতে গাইতে হলুদ বাটাবাটি করে ফেললো ৷

“বালার কাই আছে দরদী
তায় বাটিবে হলদি
বালার ভাওজি আছে দরদী
তায় বাটিবে হলদী
বালার বোনজি আছে দরদী
তায় বাটিবে হলদী ”

সেই হলুদ ডলে ডলে লাগিয়ে দিলো সব ভাবীরা মিলে নিপার গায়ে ৷ বিকেলে হলো কাদা খেলা ৷ উঠানে পানি ঢেলে কাদা করে সেই কাদার মধ্যে বউজিরা একে অপরকে মাখিয়ে পুরো ভূত বানিয়ে দিলো ৷ রূপা পড়েছে বিপদে , ছোটদের সাথে সে মিশে মজা পায় না আবার বড়রা তাকে দলে নেয় না ৷ আবার নয়নের কাছ থেকে খবর এসেছে , আলেয়া চাচী যখন লতাভাবীকে বলছিল তখন সে শুনেছে ৷ নয়নের কোন একটা পরীক্ষা হবে , এজন্য বিয়েতে সে আসতে পারবে না ৷ রূপা কত আগ্রহ নিয়ে বসে ছিল অপেক্ষায় …. নয়ন আসবে না শুনে পুকুর পাড়ে বসে কতক্ষন কান্নাও করেছে সে ৷ এই যে কাদা খেলা হলো , বউজি খেলা শেষে সবাই পুকুরে নেমেছে ৷ এখন কাদায় গড়াগড়ি খাচ্ছে বাচ্চাকাচ্চার দল ৷ অথচ রূপা জুনিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় বসে শুধু দেখছে ৷ বাচ্চাদের সাথে কাদায় গড়াগড়ি খাবার কোন ইচ্ছেই তার হচ্ছে না ৷ অবশ্য জুনির বেশ আগ্রহ হচ্ছে , কিন্তু ওর মায়ের কড়া নিষেধ কাদায় নামা যাবে না ৷ অগত্যা জুনি মন খারাপ করে রূপার গলা জড়িয়ে বসে আছে ৷

সন্ধ্যায় ঘটক সাহেব আসলেন ৷ নাদের আর নাসির মিলে বেশ আপ্যায়ন করেই বসালেন ঘটককে ৷ সব খবর জানতে চাইলেন ওদিকের ৷ ঘটক সাহেব শুধু মাথা নাড়িয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় উত্তর দিলেন ৷ গাজী মিয়ার সাথে তার খুব জরুরি কথা আছে জানালেন ৷

গাজী মিয়া গিয়েছিলেন গঞ্জে ৷ বিয়ের যেসব টুকটাক কেনাকাটা বাকী সেসব শেষ করতে গিয়েছেন ৷ নাদের বেশ কবার ঘটককে বললো যা বলার তাকেই যেন বলে , কিন্তু ঘটক সাহেব কথা না বলে চুপ করে বসে রইলেন ৷

রাত বাড়ে , নিঝুম নিকষ গাঢ় রাত ৷ ভেতর বাড়ি থেকে মেয়েদের গুনগুনিয়ে গাওয়া গীত ভেসে আসছে ৷

” খোলার হাটের বালুর চরে সায়মোনা টাঙ্গাইছেরে
লাল ময়না তোর ই কারনে রে
সোন্দর ময়না তোর ই কারনে রে
তোমার বাবা জবান দিছে ভরা সভার মাঝেরে..”

ঘটক সাহেব তাকিয়ে দেখলেন আসলেই উঠানে সামিয়ানা টাঙানো ৷ বর বসার জন্য ছোট করে একটা স্টেজও করা হয়ে গেছে ৷ এ বাড়ির বিয়ের আয়োজন শেষ …. অথচ তিনি একটা খারাপ খবর নিয়ে এসেছেন ৷ তার নিজের ঘরেও তিন তিনটা মেয়ে , মেয়ের বাবার হৃদয়ের অবস্থা তার জানা ৷ তারপরও এই বর্বর নিষ্ঠুর খবরটা তাকে দিতেই হবে ৷ হয়তো আল্লাহ তার কপালে এটাই রেখেছিলেন … পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালটা মুছে নেন তিনি ৷ আজ অকারণেই বড্ড বেশি ঘামছেন তিনি …

গাজী মিয়া এলেন রাত দশটায় ৷ ভেতরবাড়ির গুনগুন ততক্ষনে থেমে গেছে ৷ বাচ্চাগুলো হয়তো ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে , বউজিরাও সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত …

গাজী মিয়া সবটা শুনলেন চুপচাপ ৷ কিছুই বললেন না ৷ ঘটক সাহেব যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালে শুধু ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন “খানাদানা করছেন ঘটকসাব ? ” ঘটক সাহেব কিছুই খাননি ৷ বেশ কয়েকজন এসে সাধাসাধি করেছিল , কিন্তু খাবার মত মানসিক অবস্থা তার নাই ৷ বারবার শুধু নিজের মেয়েগুলোর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে ৷ খাননি তবুও মাথা নাড়িয়ে বললেন খেয়েছেন , যদিও গাজী মিয়া এখন কিছুই দেখছেন না …..

বাড়ি ভর্তি মেহমান ৷ যাদের সাথে যুগেও একবার দেখা হয় না , সেই আত্মীয়দেরও তিনি আনিয়েছেন ৷ পুরো গ্রামের মানুষ দাওয়াতী , আশেপাশের গ্রামের গন্যমান্য মানুষেরাও দাওয়াতী ৷ এবার তিনি কী করবেন ! উঠান থেকে উঠে ঘরে যাবেন , এই শক্তিটুকুও যেন তিনি পাচ্ছেন না …

কখন যে তার পাশে নিপা এসে বসেছে তিনি খেয়ালও করেননি ৷ বাবার পাশে বসে গভীর মায়ায় বাবার হাতের উপর হাত রাখে সে ৷ বাবার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে তার ৷ যার কথায় পুরো বাড়ি চলে সেই মানুষটা কেমন বাকশূন্য হয়ে বসে আছে ৷ যাকে দেখে আজীবন সবাই ভয়ই পেয়েছে , আজ তাকে দেখে কেমন যেন মায়া হচ্ছে … মানুষটাকে বড্ড বেশি নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে ৷

—বিয়া ভাইঙা গেছে আব্বা ?

—হুমম

—কী কারণে বিয়া ভাঙলো আব্বা ? আমার কী দোষ ?

—মারে , তোর কোনো দোষ নাই মা ৷ দোষ কপালের ….

—ঘটক চাচায় কী বলছে যে নিপার কপাল ভালা না , ওর বিয়া বন্ধ !

—তা ক্যান কইবো !

—তাইলে কী কইছে এটাই কন ৷

—মা রে ঐ ছেলের হাবভাবেই আমার মনে হইছিল কোন একটা সমস্যা আছে ৷ পোলা আগেও বিয়া করছিল ৷ সেই বউ থাকে গেরামে ৷ হ্যায় বিয়া করতাছে এই খবর ঐ বউ পাইয়া মামলা দিয়া তারে জেলে ঢুকাইছে ৷ আমরার ঘটক এক সপ্তাহ ধইরা তার খোঁজ করতাছিল ৷ না পাইয়া নিজে ঢাকা গিয়া খোঁজ খবর নিয়া আসছে ৷ জেলে গিয়া ঐ হারামজাদার লগে দেখাও কইরা আসছে ৷ হারামজাদা নিজ মুখে স্বীকার করছে হ্যায় আগেরথেই বিয়াইত্যা !

—তাও ভালো ৷ বিয়ার আগেই জানছি ৷ বিয়ার পর জানলে কী হইতো !

—মা রে , তুই গিয়া শুইয়া পর ৷ যা আল্লাহ কপালে লেইখা রাখছে তাই হইবো ৷ তুই ঘুমা ….

নিপা চলে যায় ৷ তার আরও কথা বলার ছিল , কিন্তু তার বাবা যে এখন একটু একা থাকতে চাচ্ছে এটা বুঝেই চলে এসেছে সে ৷

বিছানায় শোয়ামাত্র গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় নিপা ৷ গত এক সপ্তাহ তার ঘুম হয়নি যে দুঃশ্চিন্তায় , সে দুঃশ্চিন্তার আজ অবসান হয়ে গেছে ….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here