আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ২০

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ২০
__________________________

নাদের মিয়া নিপাকে নিয়ে ফিরলেন ৷ তবে নিপা একা ছিল না , নিপার সাথে এসেছে সুমাইয়া ৷ লাকী অবাক হয়ে দেখলো সুমাইয়ার মধ্যে কোন জড়তা নাই , মনে হচ্ছে যেন নিজের বাড়িতেই এসেছে ৷ একা একাই বাড়ির এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে আবার নিপার কাছে এসে গুটগুট করে কী কী যেন বলে হেসে ঢলে পড়ছে ৷ মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর চেয়ে সুখী এ জগতে আর কেউ নাই ৷ জটিল সম্পর্কের এমন সরল রূপ দেখে অভ্যস্ত নয় এ বাড়ির মানুষজন ৷ মেহমানকে অনাদরও করা যাচ্ছে না , আবার নিজের ননদের সতীনকে আদরও করা যাচ্ছে না ৷

ঘরে স্বামীকে একা পেয়ে গর্জে উঠে লাকী ৷ নাদের মিয়া সারাদিন থাকে বাইরে , সংসার পুরো লাকীর কাঁধে ৷ আজকাল গাজী মিয়ার শরীরও ভালো যাচ্ছে না ৷ সংসারের কোন সিদ্ধান্তে তিনি আর থাকেন না ৷ নিজের ঘরেই থাকেন দিনের বেশিরভাগ সময় ৷ এতবড় সংসারটা এখন একা সামলায় লাকী ৷ এই অবস্থায় এমন একজন অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি সৎকার কিভাবে করবে তা বলবারও কেউ নাই ৷ ভেতরের টেনশন কখন যে গর্জন হয়ে বের হয় লাকী নিজেও বোঝে না ৷

—কোন আক্কেলে আপনে নিপার সতীনরে বাড়ি আনলেন ? আগার পিছার সব চুলেই তো পাকন ধরছে এখনও বোধ বুদ্ধি হয় নাই আপনের ? জীবনে কুনোদিন দেখছেন যে কেউ বইনের সতীনরে ঘরে আইনা তোলে ? মেমানগিরি আপনে কইরেন ৷ আমি পারুম না ৷

—আহ বউ ! চিল্লাইও না তো ! এমনেই মাথাব্যথা করতাছে আমার ৷

—দুনিয়ার যন্ত্রনা আমার মাথাত ফালায়া আপনের মাথা করে ব্যথা ? ঢংয়ের আলাপ করেন আপনে আমার সাথে ?

—দেখো বউ , ওরে আমি আনি নাই ৷ নিপা নিজে আনছে ৷ গাড়িত উঠির টাইমে ওর হাত এমন খামচি দিয়া ধরছে , ওর শাউরী পর্যন্ত ছাড়াইতে পারে নাই ৷

—তোমার বইনের মাথার সমেস্যা হইছে ! সতীনরে বানাইছে বোন ৷ কথায় আছে ,আন সতীনে নাড়ে চাড়ে, বোন সতীনে পুড়ায়ে মারে… তোমার বইনের শেষকালে সেই দশা হইবো ৷

—যা হইবো সে পরেরটা পরে দেখা যাইবো ৷ তুমার বাড়ি মেমান হইয়া আইছে তুমি সমাদর করো ৷ বাকী মেমান যেমন সমাদর পায় তেমনই সমাদর করো ৷ যার সতীন তার যদি অসুবিধা না থাকে , তোমার আমার অসুবিধা হওনের কথা না ৷ যাও তো , এক গ্লাস লেবুর শরবত আনো তো ৷

লাকী নিজের মনে গজগজ করতে করতে লেবুর শরবত করতে যায় ৷ গিয়ে অবাক হয়ে দেখে সেখানে সুমাইয়া কী যেন খুঁজছে ৷ নিজেকে সামলে নিয়ে কোনমতে জিজ্ঞেস করে

—আপনে এইখানে যে ? কিছু লাগলে আমারে বুলাইতেন ৷

—নিপারে একটু শরবত দিতাম ৷ বাড়িতে তো আমিই দেই , অভ্যাসবসেই চইলা আসছি ভাবি ৷ আর আপনে আমারে তুমি কইরা কন ৷ আপনে আপনে শুনতে ভালো লাগে না ৷

—নিপার ভাইয়ের জন্য শরবত বানাইতেই আসছি , যাও নিপারেও দিতেছি ৷

—চিনি একটু কম দিয়েন ভাবি , বেশি চিনি খাওন ভালা না এই সময় ৷

—হ , ঠিক আছে ৷

—আপনের যেকোন সাহায্য লাগলে আমারে ডাইকেন ভাবি ৷

—আইচ্ছা

লাকী ইচ্ছে করেই সংক্ষেপে উত্তর দেয় ৷ কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না তার ৷ নিজের মনেই বিড়বিড় করে
“নিম তিত, নিশিন্দে তিত, তিত মাকাল ফল,
তার চেয়ে তিত কন্যে বোন সতীনের ঘর”… সতীনরে বানাইছে বোন , ঢং দেখে মরে যাই

*************

আলেয়া বেগম রূপার অবাধ্য চুলগুলোকে বেঁধে দেবার জন্য কাছে নিয়ে বসেছেন ৷ রূপার মাথায় ঘন কালো চুল , ওর মায়েরও এমন চুল ছিল … আজকে রূপাকে ঘটক দেখতে আসবে ছেলের মামাকে সাথে নিয়ে ৷ নিপার এমন সময়ে মেয়ে দেখানোর মত বড় আয়োজনে যেতে চায়নি আলেয়া বেগম ৷ মেয়েটার পেট নেমে গেছে , নয়মাসে পড়ছে কিন্তু মনে হয় নয়মাস শেষ হবে না , আগেই বাচ্চা হবে ৷ তারা অভিজ্ঞ মানুষ , পেট দেখেই বুঝতে পারেন ৷ তিনি খেয়াল করেছেন নিপা হাঁটার সময় বাম পা টেনে টেনে হাঁটে ৷ তার নয়ন যখন পেটে ছিল বাম পায়ে এমন ব্যথা হয়েছিল যে পা টেনে টেনে হাঁটতো , দেখে তার শাশুড়ি বলেছিল “মনে হয় তোমার পোলাই হইবো , পোলার মায়ের বাম পা ভারি ” … আলেয়া বেগমের মন খারাপ হয়ে যায় ৷ চোখের সামনে কতগুলো মানুষ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো ৷ আজকাল তার নিজেরও শরীর ভালো থাকে না ৷ হয়তো সময় চলে এসেছে ৷

পাত্রপক্ষের সামনে শাড়ি পড়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বসে আছে রূপা ৷ পাত্রের মামা প্রশ্ন করছেন একের পর এক … সুরা ফালাকের অর্থ বলো .. ইলিশ মাছ কাটতে কতটুকু ছাই লাগে … এসব নানান প্রশ্ন ৷ রূপা সব ঠিকঠাক উত্তর দিচ্ছে আর দরজার দিকে দেখছে … নয়ন বাড়িতে নেই , কোথায় গেছে কখন আসবে রূপা জানে না ৷ সে শুধু মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছে “ইয়া মাবুদ নয়ন ভাইরে পাঠায়ে দেও …”

রূপার প্রার্থনা স্রস্টা কবুল করলেন ৷ রূপা যখন একরাশ অর্থহীন প্রশ্নে জর্জরিত তখনই ঘরে ফিরলো নয়ন ৷ ফিরেই ঘটকের সামনে রূপাকে মাথায় কাপড় দিয়ে বসে থাকতে দেখে একদম মুহূর্তের মধ্যে মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেলো তার ৷ রাগ নিয়ন্ত্রন করার অনেক চেষ্টা করেও না পেরে সে গিয়ে ঘটকের কলার ধরে তাকে উঠালো ৷ তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলতে লাগলো “মানা করছি না ! মানা করছি না এই বাড়িত আসতে … এক্ষন বাইর হন নিজের মান সম্মান লইয়া ! এক্ষন বাইর হন ! ” ঘটকের কলার ছেড়ে তাদের সামনে রাখা খাবার পানি সব এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ৷ মাটির মেঝেতে এক জগ পানি পড়ে গড়াতে থাকে … ছেলের এমন ভয়ঙ্কর রাগ দেখে আলেয়া বেগম , মানিক মিয়া দুজনেই ভয় পেয়ে যায় ৷ তাড়াতাড়ি ঘটক বিদায় করতে পারলে তারা বাঁচে …

ঘটক চলে যাবার পর বাবা মাকে সামনে বসিয়ে দৃঢ় গলায় নয়ন বলে ” রূপার পড়ালেখা শেষ হবার আগে বিয়ের কথা কেউ মুখে আনবা না ৷ এত ভালো রেজাল্ট করছে একটা মাইয়্যা আর ওরে পড়ার সুযোগটা দিবা না ! ক্যান দিবা না ? অয় মাইয়্যা তাই ! অয় পড়বো , দেখি কে ঠেকায় ….”

রাত গভীর হয় ৷ পুরো গ্রামটা ঘুমের অতলে ৷ শুধু জেগে আছে রূপা … তার বুকের খাঁচায় আটকে থাকা হৃদয়টা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে ৷ আজকে নয়ন যেভাবে তাকে ঘটকের সামনে থেকে উদ্ধার করেছে সেই কথাগুলোই বারবার মনে পড়ছে ৷ বারবার ইচ্ছে করছে মানুষটাকে একটাবার একটু দেখতে ৷ সাহস করে নিজের ঘর থেকে নয়নের ঘরের দিকে পা বাড়ায় রূপা …

ভাগ্য সুপ্রসন্ন , ঘরের জানালা খোলা ৷ মানুষটা এখনও জেগে আছে ৷ ঘরের মধ্যে হাঁটাহাটি করছে ৷ ঘরের মধ্যে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না , তবুও রূপা যেন নয়নের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুভব করছে ৷ ইচ্ছে করছে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে মানুষটাকে এভাবেই হাঁটতে দেখে ৷ একটুও বিরক্ত করবে না তাকে , শুধু নয়ন জুড়িয়ে তার নয়নকে দেখবে সে ….

মানুষটাকে ছুঁতে না পারার কষ্টে মরমে মরে যায় রূপা ৷ শুধু একটাবার , একটাবার একটু ছুঁয়ে দেখতে পারলে জনম জনম সেই স্পর্শে বিভোর হয়ে কাটিয়ে দেওয়া যেতো ! একটু হাতটা ধরে দু’মিনিট বসে থাকতে পারলে , সেই দু’মিনিটের বিনিময়ে জীবন দিতেও দ্বিধা থাকতো না তার …

ভাবনার জগতে রূপা যখন ভাসছে তখনই নয়নের গলা ভেসে আসে …. জানালার গ্রীল ধরে থাকা রূপার হাত দুটো ধরে নয়ন বলে “রূপা , ঘরে যা ..”

সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে দিতে নিজের ঘরে ছুটে পালায় সে ৷ নিজের হাত দুটো বুকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে ৷

এই হাত দুটোতে নয়নের ছোঁয়া লেগে আছে , এদের জায়গা তাই আজ বুকের মধ্যেখানে…

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here