আমি তোমাকে ভালোবাসি পর্ব-১৯ শেষ পর্ব

0
1670

#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#শেষ_পর্ব

২৮.

সেদিন রাতে চন্দ্রা আর রাশেদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো। রাশেদ মেয়ে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো এই মেয়েকেই তো সে কল্পনায় দেখেছিলো। মিলে গেল কীভাবে? এতটা মিল কী সত্যিই হয় কল্পনার সাথে। সে তার মাকে বিস্ময়ে বললো, মা এতো ছোট কেন আমার মেয়ে? ওর কী কোন সমস্যা হয়েছে?

রিমা আহমেদ হাসলো। তারপর বললো, ছোটই তো থাকে সবাই। আর সমস্যা হলে তো তোর বোঝা উচিত। তুই তো ডাক্তার।

মা আমি আমার বেবিকে দেখে বুঝতে পারছি না। হাত কাঁপছে। এমন কেন হচ্ছে?

কিছু হবে না ঠিক হয়ে যাবে। তুই চন্দ্রার কাছে যা। বাবুকে দেখিয়ে নিয়ে আয়।

রাশেদ আস্তে আস্তে হাঁটছে তার মনে হচ্ছে বেবি তার হাত থেকে পড়ে যাবে। রিমা আহমেদ খেয়াল করলো রাশেদ হাত আলগা করে ধরে আছে তার মেয়েকে।

রিমা আহমেদ পেছন থেকে রাশেদকে বললেন, কীভাবে কোলে নিয়েছিস? বুকের সাথে জড়িয়ে ধর।

রাশেদ সেইভাবেই ধরলো। তারপর চন্দ্রার কাছে গেল।

চন্দ্রার কপালে চুমু খেয়ে বললো, বলেছিলাম না কিচ্ছু হবে না। এই দেখো সব ঠিক আছে।

চন্দ্রা চোখ খুলে চাইলো। তার এতে খুশি লাগছে ইচ্ছে করছে রাশেদকে ঝাপটে ধরতে। কিন্তু তার শরীরে একফোঁটা শক্তি পাচ্ছে না। সে কোন মতে হাত বাড়ালো। রাশেদ ভাবলো চন্দ্রা তাদের মেয়েকে চাইছে। তাই রাশেদ চন্দ্রার পাশে তাদের মেয়েকে শুইয়ে দিলো। চন্দ্রা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারপর রাশেদকে ইশারা করলো তার কাছে আসতে। রাশেদ এগুতেই সে অতিকষ্টে ভাঙা ভাঙা শব্দে ফিসফিস করে বললো, আমাকে আমাদের বাবুসহ একবার জড়িয়ে ধরো। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।

রাশেদ জড়িয়ে নিলো। তারপর বললো, এবার হয়েছে?

চন্দ্রা মাথা নাড়লো। তার চোখ ভর্তি জল।

রাশেদ চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, কাঁদছো কেন? কাঁদার কিছু হয়নি। এবার একটু ঘুমাও। ঘুম পেয়েছে না?

হুম।

তাহলে ঘুমাও। আমি পাশে বসে আছি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

চন্দ্রা চোখ বুজলো৷ সে জানে এবার তার আর কোন ভয় নেই। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল সে স্বপ্ন দেখছে।

২৯.

তন্দ্রা দরজায় দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার কারন একটাই সে তার পাপাকে আর মাম্মাকে যেতে দিবে না কোথাও। প্রতিদিন একই জিনিস করে। চন্দ্রা চোখ ফেটে জল চলে আসে। মেয়েটা সারাদিন একা থাকে যতই দাদা দাদি থাকুক। মা বাবাকেও সে পাশে চায় সবসময় তা খুব ভালো করে বুঝে চন্দ্রা। ছোট বেলায় এতোটা বুঝতো না কিন্তু দিনদিন বড় হচ্ছে তাই তাকে এখন ফাঁকি দিয়ে যাওয়া যায় না। ওদের ব্রেকফাস্টের পর থেকে তন্দ্রা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। আজও তাই।

আজও রিমা আহমেদ তাকে দরজা থেকে সরিয়ে কোলে নিয়েছে। সে চন্দ্রার দিকে দুইহাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চন্দ্রা যেতেই নিলেই রাশেদ তাকে আটকে দিলো। তারপর রিমা আহমেদকে বললো, আম্মু দরজা লাগিয়ে দাও না হলে তন্দ্রা আবার কাছে আসতে বায়না করবে।

চন্দ্রা বললো, রাশেদ ছাড়ো। আমার বাবু কাঁদছে।

চন্দ্রা তুমি আজকে ওর কাছে গেলে ও প্রতিদিন এমন করবে। আম্মু সামলে নিবে। আমাদের দেরি হয়ে যাবে। চলো।

না আমি যাবো না।

আম্মু তুমি দরজা লাগাও। চন্দ্রাকে আমি দেখছি।

রাশেদ ও তোমারও মেয়ে। এতোটা পাষান তুমি!

হ্যাঁ। সময় বিশেষে হতে হয়।

রাশেদ চন্দ্রাকে টানতে টানতে নিয়ে গাড়িতে বসালো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো। চন্দ্রা একবারও রাশেদের দিকে তাকালো না। রাশেদ বুঝতে পারলো চন্দ্রার খুব কষ্ট হচ্ছে। তারপর গাড়ি একপাশে দাঁড় করিয়ে ভিডিও কল দিলো ওর মাকে।

আম্মু তন্দ্রা কী করছে?

চন্দ্রা রাশেদের কথা শুনে ফোনের দিকে তাকালো। দেখলো রিমা আহমেদের কোল থেকে তন্দ্রা জোর করে নেমে যাচ্ছে আর বলছে, দাদুন টুমি পঁতা। তোমাল কাত থেকে মা মা গন্ধ আসে না। ছাড়ো আমাকে।

টেনে ছিঁচড়ে তন্দ্রা নেমে পড়লো। তারপর ওদের ঘরে ছুটে গেল। বিছানার পাশে চন্দ্রার শাড়ি ছিল তা তন্দ্রা জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েছে। আর বলছে, এখন মা মা গন্ধ আসে।

ফোনের ওপাশ চন্দ্রা ফুঁপিয়ে উঠলো। রাশেদ ফোন রেখে দিল তারপর চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো।

চন্দ্রা রাশেদকে বললো, রাশেদ আমি চাকরিটা ছেড়ে দেই?

রাশেদ শক্ত গলায় বললো, না।

চন্দ্রা রেগে বললো, তোমার কাছে টাকা পয়সাই সব। আমার মেয়েটা আমাকে ছাড়া মানুষ হবে এটা কিছু না।

চন্দ্রা চাকরিটা তুমি তোমার নিজের যোগ্যতায় পেয়েছো।

এখন লাগবে না। আমাদের যা আছে তাই যথেষ্ট।

চন্দ্রা জীবনে টাকা পয়সাই সব না। আমি জানি আমাদের যা আছে তাই যথেষ্ট। কিন্তু এই চাকরিটা তোমার ড্রিম জব ছিল।

এখন নেই।

চন্দ্রা তুমি ছেলেমানুষী করছো। এতো বড় একটা চাকরি তুমি পরে চাইলেও পাবে না। এখন আবেগে বলছো ছেড়ে দিবে যখন আর তিন চারবছর পর তন্দ্রা স্কুলে যাবে তখন তুমি একা হয়ে পড়বে। তখন তোমার মনে হবে এখনের সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। তাই বলছি এসব মাথায় নিয়ে এসো না।

রাশেদ আমি কী করবো? তন্দ্রাকে এভাবে রেখে গেলে আমি কাজে মন দিতে পারি না।

মন দিতে হবে। তন্দ্রা বুঝবে কোন না কোন সময়। এখন চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।

না রাশেদ, বাসায় নিয়ে চলো। প্লিজ আজকেই লাষ্ট।

চন্দ্রা তুমি প্রতি সপ্তাহে তিন চারদিন এমন করো। এই রকম করলে তোমার চাকরিটা খুব বেশিদিন থাকবে না।

না থাকুক।

রাশেদ কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। চন্দ্রা রাশেদের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে আছে। সে ভাবছে মুখে বললেও সে জানে চাকরিটা তার জন্য কী। ব্যাংকে চাকরি পেতে মানুষ কত কষ্ট করে। সেও কত কষ্ট করলো। ছোট্ট তন্দ্রাকে রাতে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সে পড়তে বসতো৷ রাতে উঠে কান্না করলে আবার খাইয়ে সে আবার পড়তো।কত রাত রাশেদ হাসপাতাল থেকে এসে না ঘুমিয়ে তন্দ্রাকে সামলিয়েছে শুধুমাত্র চন্দ্রার যাতে পড়ায় অসুবিধা না হয়। রাশেদের মা বাবাও যথেষ্ট সার্পোট করেছে। অবশেষে চাকরিটা হয়। তখন তন্দ্রাও বেশ ছোট ছিল। ঘুম পাড়িয়ে না হয় লুকিয়ে বের হয়ে যেত। এখন সেটা করা যায় না। সে কীভাবে যেন বুঝে যায় তাকে রেখে তার মাম্মা চলে যাবে? প্রতিদিন এমন করে।

গাড়ি থামলো। রাশেদ চন্দ্রাকে ডেকে বললো, চন্দ্রা নামো চলে এসেছি।

এতো তাড়াতাড়ি?

হ্যাঁ।

চন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে নামতে গেল। রাশেদ টেনে ধরলো পেছন থেকে। তারপর বললো, তুমি কী আমার উপর রাগ করেছো?

হ্যাঁ।

ওইসময় ওভাবে টেনে এনেছি দেখে?

হ্যাঁ। এতোটুকুও সংকোচ না করে চন্দ্রা বললো।

চন্দ্রা তখন টেনে না আনলে তুৃমি আজও অফিস আসতে না। প্রফেশনাল লাইফ আর পার্সোনাল লাইফ এক করে ফেলো না। এতে ক্ষতিটা তোমারই।

জানি। কিন্তু পারছি না তো।

পারতে হবে।

রাশেদ চন্দ্রার কপালে চুমু দিয়ে বললো, আমি জানি তুমি পারবে। এখন এসো। সাবধানে ফিরবে ঠিক আছে?

আচ্ছা।

চন্দ্রা নেমে গেল। সারাদিনটা তার খুবই বাজে ভাবে কাটলো। কাজে বারবার ভুল করলো। ম্যানেজার বললো, মিসেস আহমেদ আপনি কী অসুস্থ? অসুস্থ হলে সিক লিভ নিয়ে নিন।

না না আমি ঠিক আছি।

ঠিক আছে আপনার যা ইচ্ছে।

চন্দ্রা জোর করে কাজে মনযোগ দিলো। মনে মনে একটু পর পর নিজেকে সান্ত্বনা দিলো আর মাত্র তিনঘণ্টা, আর মাত্র দু-ঘন্টা এভাবে করে সময়টা কাটালো। অফিস টাইম শেষ হতেই সে বাড়ি ছুটলো। বাড়ির দরজায় কলিং বেল চাপ দিয়েই রাখলো। রিমা আহমেদ দরজা খুললো।

চন্দ্রা ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বললো, মা তন্দ্রা কোথায়?

ঘুমাচ্ছে। গা টা একটু গরম লাগছে। জ্বর আসবে বোধহয়।

চন্দ্রা ছুটে ঘরে চলে গেল। দেখলো তন্দ্রা ওর শাড়ি জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। চন্দ্রা ঘুমন্ত তন্দ্রাকে কোলে নিয়ে অজস্র চুমু খাচ্ছে। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। যেন একটু ছাড়লেই চলে যাবে।

তন্দ্রা পিটপিট করে তাকালো। চন্দ্রা বললো, কী হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে?

হুম।

কেমন লাগছে মা?

ঠান্ডা লাগছে।

এ তো মা এসে গেছি শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছি আর ঠান্ডা লাগবে না।

মাম্মা তোমাকে তন্দা মিস করেছে।

আমিও করেছি। মা তুমি কিছু খেয়েছো?

হুম। দাদুন পঁতা জোল করে খাই করেছে।

ছিঃ মা এভাবে বলে না।

না বববো।

চন্দ্রা মেয়ের কথায় হাসলো। তারপর বিছানায় নিয়ে আধশোয়া হয়ে তন্দ্রাকে বুকে জড়িয়ে রাখলো। তন্দ্রা মুখে আঙুল দিয়ে আছে। একটু পর বললো, মাম্মা শীত শীত।

চন্দ্রা পায়ের কাছ থেকে পাতলা কম্বল নিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে শুয়ে থাকলো। রিমা আহমেদ এসে দেখলেন চন্দ্রা জামা কাপড় কিছু না পাল্টেই তন্দ্রাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। তিনি কাছে এসে বললেন, চন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর কিছু মুখে দাও। তন্দ্রাকে আমার কাছে দাও।

চন্দ্রার নিজেরও ইচ্ছে করছে সব পাল্টে আসতে। কিন্তু তন্দ্রা নাছোড়বান্দা সে কিছুতেই মাকে ছাড়বে না। অগত্যা তাকে বসে থাকতে হলো।

রাতে বেশ দেরি করে ফিরলো রাশেদ। ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। সে লাইট জ্বালিয়ে চন্দ্রার পাশে দাঁড়ালো। চন্দ্রা তন্দ্রাকে বুকে জড়িয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। রাশেদ তন্দ্রার কপালে হাত দিলো। ফোনেই শুনেছিলো জ্বর এসেছে। আসার ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারে নি। চন্দ্রা চোখ মেলে তাকালো তারপর বললো, কখন এলে?

মাত্র এলাম। তন্দ্রার জ্বর কখন থেকে?

আসার পর থেকে গা গরম ছিলো।

ঔষধ খাইয়েছিলে?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। আমি একটু পর দেখবো। ফ্রেশ হয়ে আসি। এক সাথে খাবো।

আচ্ছা।

খাবার টেবিলে বসে রাশেদ চন্দ্রাকে বললো, চন্দ্রা কাল ঘুরতে যাবে?

এখন ঘুরাঘুরির কথা তন্দ্রার সামনে বলবে না। ও অসুস্থ। শুনলেই বায়না ধরবে।

কিছু হবে না। কোলে কোলে রাখবো।

না যাওয়া যাবে না।

তোমার কথায় তো হবে না। আমার মেয়ে যেতে চাইলে অবশ্যই নিয়ে যাবো।

যা খুশি করো।

তুমি কী আমার উপর রাগ করেছো?

তুমি কী রাগের কিছু করেছো?

হ্যাঁ।

তাহলে জিজ্ঞেস করছো কেন?

এখানে আর কথা না। আমার খাওয়া শেষ। চা নিয়ে এসো। বারান্দায় আছি।

বলেই রাশেদ উঠে গেল। চন্দ্রা টেবিল পরিষ্কার করে চা নিয়ে গেল। রাশেদকে চা দিয়ে সে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই রাশেদ বললো, এখানে দাঁড়াও। চা খেয়ে তোমার রাগ ভাঙ্গাচ্ছি।

লাগবে না।

চন্দ্রা তুমি এতো রাগ করো কেন? আচ্ছা কিছু করবো না। একটু দাঁড়ালে কী হয়?

চন্দ্রা দাঁড়ালো। রাশেদ চা খেয়ে বললো, চন্দ্রা সকালের ব্যাপারটায় তুমি এখনো আপসেট জানি। কিন্তু তুমি নিজেও ভালো করে জানো কথা গুলো আমি ভুল কিছু বলি নি।

তোমাকে সকালের কথা নিয়ে আমি তো কিছু বলিনি।

বলনি তা ঠিক। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি ভালো করে। তুমি তন্দ্রার কথা ভেবে চাকরি ছাড়তে চাইছো একবারও ভেবেছো আর কয়েক বছর পর কী হবে? বিয়ের পর তুমি কখনোই আমার কাছ থেকে কিছু চাইতে না। আমি নিজে যা এনে দিতাম তাই ব্যবহার করতে। মুখ ফুটে কিছুই চাইতে না। কিন্তু এখন আমি দেখি চাকরি পাওয়ার পর তুমি কী পরিমান খরচ করতে পছন্দ করো। তোমার কী মনে হয় আমি এগুলো খেয়াল করিনি।

চন্দ্রা নিশ্চুপ। রাশেদের কথা একটুও মিথ্যে নয়। সে কখনোই রাশেদের কাছ থেকে কিছু চাইতো না। তার ভালো লাগতো না চাইতে।

চন্দ্রা বললো, তাহলে তোমার মতে আমার টাকার জন্য হলেও চাকরিটা করা দরকার। তাই না?

আমি সেটা বুঝাতে চাইনি। চন্দ্রা, এতোটা অবুঝ তো তুমি ছিলে না। টাকার থেকেও বড়ো কথা হচ্ছে তোমার খুব ইচ্ছে ছিলো এই চাকরিটা করার। আর আমি বলতে চাইছি তুমি যেমন মেয়ে কখনোই আমার থেকে টাকা চেয়ে নিবে না। আর টাকা সবারই প্রয়োজন হয় এখন না হয় পরে। এখন যেমন একটা নির্দিষ্ট সময় তোমার জন্য থাকে তখন সপটা পাবে না। তুমি সবদিক ভাবছো না। সবদিক ভাবা উচিত তোমার। টাকা, সময় সবদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তুমি ভুলে যাচ্ছো আমার একটা মেয়ে আছে।

না ভুলে যাচ্ছি না। সে আমারও মেয়ে।

না তোমার মেয়ে না।

চন্দ্রা তুমি শুধুমাত্র চাকরি ছাড়বে তন্দ্রার জন্য। কারন সে প্রতিদিন তোমার যাওয়ার সময় রাস্তা আটকায় তাই? এই ছোট একটা কারনে।

রাস্তা আটকায় এটা দেখছো আর ও যে কাঁদতে কাঁদতে জ্বর বাঁধালো সেটা চোখে পড়লে না।

না চোখে পড়েনি। ওকে আমি দেখেছি এই সময়ে সবারই এমন হচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে ওর জ্বর আসেনি।

তোমার সাথে কথা বলাই বৃথা।

বলেই চন্দ্রা বেরিয়ে যেতে নিলেই রাশেদ হাত টেনে ধরলো।

তোমার সমস্যা তন্দ্রা প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকে আর কাঁদে। তাই তো? ঠিক আছে কাল তো শুক্রবার পরশু থেকে তন্দ্রা আর এমন করবে না। আমি কথা দিলাম। তন্দ্রা যদি আর কান্নাকাটি না করে তাহলে তুমি পরশুদিন অফিসে যাবে। ঠিক আছে?

সেটা পরশু দেখা যাবে।

না তুমি কথা দাও।

রাশেদ রাত-বিরেতে ঝামেলা কেন করছো?

ঝামেলার কী দেখলে?

ছাড়ো মেয়ে ডাকছে।

ভেতর থেকে তন্দ্রার ক্ষীণ গলা শোনা গেল। মাম্মা মাম্মা বলে ব্যাকুলে হয়ে ডাকছে। চন্দ্রা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রাশেদ ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর হুট করে তন্দ্রাকে বুকের উপর শুইয়ে দিলো। এই মেয়ে তার খুব আদরের। ফুলের টোকাও লাগতে দেয় না। সেই মেয়ের আজ জ্বর। রাশেদ তন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চন্দ্রা একমনে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

৩০.

সকালে বেশ বেলা করে চন্দ্রার ঘুম ভাঙলো। চন্দ্রা ঘুম থেকে উঠে দেখলো রাশেদ আর তন্দ্রা মিলে আলমারির সব কাপড় নামিয়ে মাটিতে রেখেছে আর কী যেন একমনে খুঁজছে। চন্দ্রার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে দাঁত কিড়মিড় করে বললো, এগুলো কে করেছে?

তন্দ্রা আনন্দের সাথে বললো, আমলা মাম্মা।

কেন করেছো?

রাশেদ বললো, আমরা শাড়ি খুঁজছি চন্দ্রা। তন্দ্রার জন্য যে শাড়িটা এনেছিলাম সেটা কোথায়?

সেটা কেন খুঁজছো?

আমলা বাইরে যাব তাই।

না তুমি কোথাও যাবে না। তোমার শরীর ভালো না।

পাপা বলেছে নিয়ে যাবে।

তোমার পাপার কথায় হবে না। কোথাও যাবে না। তুমি কোন সময় উঠলে? খেয়েছো কিছু?

রাশেদ বললো, আমি খাইয়ে দিয়েছি চন্দ্রা। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি খাইনি এখনও।

চন্দ্রা তড়িঘড়ি করে উঠলো। এতোটা বেলা হয়ে গেল রাশেদ এখনো খায়নি তার জন্য৷ আর যত ঝামেলাই হোক রাশেদ না খেয়ে থাকবে সেটা চন্দ্রা কিছুতেই মানতে পারে না। খেয়ে উঠতেই রাশেদ তন্দ্রাকে কানে কানে বললো, তোমার মাম্মাকে রাজি করাও।

মাম্মা পঁতা। বকা দিয়েছে।

ঘুরতে যেতে হলে এটুকু সহ্য করতে হবে রে মা।

টুমি বলো। তন্দা বববে না।

না মা, পাপার কথা মাম্মা শুনবে না।

আততা বববো।

নাছোড়বান্দা তন্দ্রা শেষ পর্যন্ত চন্দ্রাকে রাজি করাতে পারলো। তারপর চন্দ্রাকে বললো শাড়ি পরিয়ে দিয়ে সাজিয়ে দিতে। চন্দ্রাকে তাই করতে হলো। রাশেদ ঘরে এসে তন্দ্রাকে কোলে নিলো। তন্দ্রা হেসে রাশেদের গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা দিয়ে রাখলো। তন্দ্রাকে রাশেদ বললো, মাম্মা তুমি পাপার গান শুনবে?

চন্দ্রা পাশ থেকে আঁতকে উঠে বললো, না এখন কোন গান হবে না। রাশেদ প্লিজ।

না পাপা বববে।

দেখলে তোমরা আমার প্রতিভার মূল্য না দিলেও আমার মেয়ে ঠিকই দিয়েছে। আমি এখন আমার মাকে গান শোনাবো।

দয়া করে বারান্দায় যাও। সেখানে গিয়ে যা খুশি করো বাপ বেটি মিলে।

রাশেদ তন্দ্রাকে নিয়ে হেলে দুলে বারান্দায় চলে গেল। চন্দ্রা তৈরি হতে বসলো। ছোটবেলা থেকে তন্দ্রা রাশেদের গান খুব পছন্দ করে। তার বাবা তাকে বললেই হলো, মা গান শুনবে? সে আনন্দের সাথে রাশেদকে অনুমতি দিতো। এখনো তা করে। বারান্দা থেকে রাশেদের হেঁড়ে গলার গান শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তন্দ্রারও গলা শোনা যাচ্ছে। চন্দ্রার মন ভালো হয়ে গেল। কী চমৎকার গাইছে তার মেয়ে আধো আধো বুলিতে! এটাই কী সেই ছোট্ট তন্দ্রা যাকে হাসপাতালে থেকে তোয়ালে মুড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছিলো। হাত পা ছোড়াছুড়ি করে খেলতো। এতো তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাচ্ছে কীভাবে? নিজের বাচ্চাকে বেড়ে উঠতে দেখার মতো আনন্দ বোধহয় আর কিছু হয় না। চন্দ্রা, রাশেদ আর তন্দ্রা সেদিন সারাদিন ঘুরলো। বাসায় ফিরলো রাত করে। এসেই তন্দ্রা কাহিল হয়ে পড়লো। চন্দ্রা চট করে তন্দ্রার সব জামা কাপড় পাল্টে দিয়ে ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। রাশেদ তা দেখে বললো, আগে শাড়িটা পাল্টে নিতে।

শাড়ি পাল্টাতে গেলে তোমার মেয়ে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়তো না খেয়ে। তাই খাইয়ে দিলাম। এখন পাল্টাবো শাড়ি।

আচ্ছা। কাল কিন্তু তুমি অফিসে যাবে।

রাশেদ প্রতিদিন এককথা বলবে না। তুমি জানো এতে ঝামেলা হয় আমাদের মধ্যে।

তুমি অফিসে গেলেই আর ঝামেলা হয় না।

সকালে দেখা যাবে।

তুমি কথা দিয়েছিলে তন্দ্রা কান্না না করলে তুমি যাবে।

কিন্তু তোমার মেয়ে যে কান্না করবে না সেটার কী নিশ্চয়তা?

সেটা আমি দেখবো। তোমার মেয়ের নিশ্চয়তা আমি।

তুমি কী চকলেটের লোভ দেখে মানিয়েছো?

আমার মেয়ে এমন না যে তাকে কোন কিছু দিয়ে মানাতে হবে। তাকে ভালো করে বোঝালেই হয়।

সেটা কালই দেখা যাবে।

প্রতিদিনের মতো চন্দ্রা আজও ভয়ে ভয়ে তৈরি হয়ে দরজার সামনে গেলো। গিয়ে দেখলো তন্দ্রা নেই। সে সোফার পাশে বসে খেলছে। চন্দ্রা একটু অবাক হলো। রাশেদ তাকে কী বোঝ দিয়েছে সে এতো শান্ত কেন? রাশেদ পেছন থেকে চন্দ্রার মাথায় টোকা দিলো। চন্দ্রা পেছন ফিরতেই বললো, কী অফিসে যাবে না নাকি? দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো।

কাছে গেলেই তো কাঁদবে।

কাছে গিয়ে দেখো আগে।

চন্দ্রা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল তন্দ্রার দিকে। তন্দ্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

তারপর বললো, মাম্মা টুমি অফিস যাচ্ছি?

হ্যাঁ। মা।

আততা।

বলেই সে খেলায় মন দিলো। চন্দ্রা বিস্মিত চোখে রাশেদের দিকে তাকালো। রাশেদ নিজের কলার টেনে চন্দ্রাকে চোখের ইশারায় বললো, দেখলে কেমন অসাধ্য সাধন করলাম।

চন্দ্রা মেয়ের কাছে গিয়ে বললো, মা তুমি কাঁদবে না তো?

না। কাঁদবো কেন?

রাগ করবে না তো?

না আমি কেন রাগ করবো আমি পাপার স্মার্ট গার্ল না?

রাশেদ বললো,তাই তো। ঠিকই তো বলেছে তন্দ্রা। এই চন্দ্রা তুমি আমার মেয়ের খেলায় ডিস্টার্ব করছো। তাই না তন্দ্রা?

হ্যাঁ। মাম্মা টুমি অফিস যাও। টাটা।

চন্দ্রা মেয়েকে কোলে নিয়ে তার পুরো মুখে চুমু দিলো। তারপর বললো, আসছি মা। তুমি দাদুনকে একদম বিরক্ত করবে না। সময়মতো খেয়ে নিবে। ঠিক আছে?

আততা।

চন্দ্রা রাশেদ বেরিয়ে গেল। গাড়িতে উঠেই চন্দ্রা বললো, কী বলেছো আমার মেয়েকে সে এতোটুকুও মন খারাপ করলো না?

সে আমাদের বাবা মেয়ের ব্যাপার তোমাকে বলবো কেন?

চন্দ্রা রাশেদের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। তারপর বললো, আজ আমি খুব নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবো রাশেদ। প্রতিদিন আমার মন খারাপ থাকতো। কাজে মন বসাতে পারতাম না।

এখন থেকে পারবে।

বলো না কী বলেছো?

সেটা বলা যাবে না।

আচ্ছা বলতে হবে না।

চন্দ্রা আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কী জানো? তন্দ্রা আর তোমাকে নিয়ে আমি কী যে সুখে আছি তা কী জানো? মাঝে মাঝে মনে হয় ভাগ্যিস তানিয়া আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। না হলে তোমাকে পেতাম কীভাবে?

তোমার জিএফ তানিয়ার কথা বলছো?

হ্যাঁ।

ছেড়ে গেছিলো কেন?

সময় দিতে পারতাম না। প্রতিরাতে ঘুমানোর সময় কথা বলতাম না। ঘুরতে নিয়ে যেতে পারতাম না। প্রেমের শর্ত হলো এগুলো। যার কোনটাই আমি পূরন করতে পারতাম না। সেজন্য ব্রেকআপ করেছে। অবশ্য এগুলো তার বাহানা ছিলো।

কেন বাহানা ছিলো?

পরে খবর পেয়েছিলাম খুব বড় শিল্পপতির বেকার ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তাই এমন করেছে।

ও আচ্ছা।

তুমি জানো ওর সাথে আমার ব্রেকআপ হবার পর আমি খুব ভেঙে গিয়েছিলাম। আমি সত্যিই ওকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু ও বুঝতে পারে নি। ওর কাছে আমি ছিলাম শুধুমাত্র সময় কাটানোর একটা মাধ্যম। প্রেম করতেই হবে তাই করেছিলো। সে বাদ দাও। ছেড়েছে ভালো করেছে না হলে এতো ভালো বউ পেতাম।

চন্দ্রা হেসে বললো, পাম দেওয়া হচ্ছে?

একদমই না। তুমি প্রশংসাও বুঝো না।

আচ্ছা বুঝলাম।

চন্দ্রা আমি তোমাকে ভালোবাসি।

আর কতবার বলবে?

সত্য কথা দিনের মধ্যে চৌদ্দবার বলা যায়। হুমায়ুন আহমেদের একটা নাটকের ডায়ালগ ছিলো।

চন্দ্রা হাসলো। এই মানুষটা তাকে খুব ভালোবাসে সে জানে। তার পছন্দ অপছন্দ সব জানে। তাকে সারাক্ষণ আগলে রাখে। এই মানুষকে ভালো না বেসে থাকা যায়? তাই তো চন্দ্রাও তাকে ভালোবাসে। তার সবটা জুড়ে সে রাশেদ আর তন্দ্রাকে ভালোবাসে। চন্দ্রা কখনো ভাবে নি বিয়ের পর তার জীবনটা এতো সুন্দর কাটবে। সে ভেবেছিল কোন মতে কাটিয়ে দিবে। কিন্তু রাশেদ তা হতে দেয়নি। রাশেদ তার চারপাশে ভালবাসার বলয় তৈরি করে দিয়েছে তাই তো সেই সাদামাটা জীবনটা অসাধারণ হয়ে গেল। ভালবাসায় মাখামাখি একটা সংসার হয়ে গেল তার। সেখানে আছে পুতুলের মতো মেয়ে আর রাশেদের মতো হাসবেন্ড। জীবনে এর থেকে বেশি আর কী লাগে?

সমাপ্ত……..

চন্দ্রা আর রাশেদের গল্পটা এতোটুকুই ছিলো। ইচ্ছে ছিলো ভালাবাসায় মাখানো একটা সংসার দেখাতে। কতটুকু পেরেছি জানি না।
যাই হোক দীর্ঘ একটা পর্ব ছিল এটা। এই গল্পটা নিয়ে আপনাদের কিছু অভিযোগ ছিলো। প্রথমত বিভিন্ন গ্রুপে,আমার পেজে বারসাত নামটা নিয়ে অনেক নেগেটিভ কমেন্ট পেয়েছি। তারপর চন্দ্রার ব্যাপারটা নিয়েও পেয়েছি যে সে খুব ন্যাকামী করছে। এছাড়াও একটা মজার ব্যাপার হলো আমি এই গল্পের যে পর্বগুলো থেকে বেশি রিয়েক্ট আশা করেছি ওইগুলোতেই কম রিয়েক্ট পড়েছে। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু মানুষের কমেন্ট আমার মন ভালো করে দিতো। কী পরিমান ভালোবাসা যে পেয়েছি ইনবক্স, কমেন্ট বক্সে এই আড়াইমাসের লেখালেখির জীবনে সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। সত্যি বলছি। আমি কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে।
সবাই আজকে রিয়েক্ট দিবেন ( যারা সাইলেন্ট রিডার তারাও)। আমি দেখতে চাই মোট কতজন আমার গল্প পড়েছেন। আর যারা নিয়মিত কমেন্ট করতেন সুন্দর করে আজ কয়েকটা কমেন্ট করুন তো। আর যারা কমেন্ট কোন সময় করেন না তারাও করেন যদি ইচ্ছে হয়।
এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটি গল্প। যদি কারো সাথে মিল পান তবে সেটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত।
ধন্যবাদ ১৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭শে মার্চ এতো দীর্ঘ সময় পাশে থাকার জন্য। আশাকরি পরবর্তী গল্পেও পাশে পাবো। সবাই অনেক অনেক ভালো থাকবেন আর আমার জন্য দোয়া করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here