আমি তোমাকে ভালোবাসি পর্ব-৩

0
837

#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#তৃতীয়_পর্ব

৬.

জানালা দিয়ে শীতের নরম আলো চন্দ্রার মুখে পড়লো। ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ পিটপিট করে তাকালো। হঠাৎ করে তার সব কথা মনে পড়লো। অনেক বেলা হয়ে গেছে বোধহয়। ফোনের দিকে তাকাতেই বারসাতের মিষ্টি চেহারা ওয়ালপেপারে দেখলো। সাথে সাথেই সময়টা চোখে পড়লো। সময় সকাল আটটা। চন্দ্রা পাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। বুঝতে পারলো রাশেদ বাথরুমে। চন্দ্রা খুবই খারাপ লাগছে তাকে বারবার রিমা আহমেদ বলে দিয়েছিলেন রাশেদ না আসা পর্যন্ত জেগে থাকতে কষ্ট করে। কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়লো। কোনদিন এরকম হয়না। নতুন জায়গায় তার ঘুম কখনোই আসে না। কাল কীভাবে ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারে নি। বাথরুমের দরজায় খট করে শব্দ হলো। রাশেদ বের হয়ে এলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে গোসল সেড়ে এসেছে।

চন্দ্রাকে বিছানায় বসে থাকতে দেখে কাছে এসে বললো,আরেকটু ঘুমাতে। শরীর তো খুব খারাপ হয়েছিল রাতে।

চন্দ্রা অবাক হয়ে গেল রাতের কথা তার মনে নেই। সে অবাক হয়ে বললো, কী হয়েছিলো?

জ্বর হয়েছিল। দেখি জ্বরটা কমেছে কিনা?

রাশেদ চন্দ্রার কপালে হাত দিতেই সে ছিটকে দূরে চলে গেল। রাশেদ হতভম্ব হয়ে গেল। চন্দ্রাও চমকে উঠলো। সে নিজেও বুঝতে পারেনি এমন করবে। রাশেদ দূরে সরে দাড়ালো।

তারপর চন্দ্রাকে বললো, যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।

চন্দ্রা কোন কথা বলে বলে বাথরুমে চলে গেল। তার খুবই খারাপ লাগছে। সে এমনটা করতে চায়নি। নিজের অজান্তেই হয়ে গেছে। রাশেদ রেগে আছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছে না। সে কী তাকে গিয়ে সরি বলে আসবে নাকি পরে বলবে। পরে বললেই হবে। তবে রাশেদ ভুল না বুঝলেই হবে। চন্দ্রা জানে রাশেদ এতোকিছু ভেবে তার কপালে হাত দেয়নি।

চন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই রাশেদ স্বাভাবিক গলায় বললো, চন্দ্রা তুমি কী আমার সাথে যাবে সবার সাথে বসে খেতে নাকি এখানে পাঠিয়ে দিব?

চন্দ্রা অবাক হলো রাশেদের কথা শুনে। তার কন্ঠে বোঝা যাচ্ছে না সে রাগ করেছে কিনা।

চন্দ্র ইতস্তত করে বললো, না এখানে আনতে হবে না। আমিই যাব।

আচ্ছা চলো।

চন্দ্রা ঘর থেকে বের হয়ে সবাইকে সালাম দিল। তার শাশুড়ী তাকে একহাতে জরিয়ে বললো, মা এখন কেমন লাগছে?

ভালো।

আরেকটু পরে উঠলেই পারতে।

ঘুম ভেঙে গেল তাই উঠে গেছি।

ঠিক আছে খেতে বসো তারপর ঘরে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ো নাহলে রেষ্ট নিয়ো।

আচ্ছা।

কালকে যা বলেছিলাম করেছিলে?

চন্দ্রা আমতা আমতা করে বললো, না। আমি ভুলে ঘুমিয়ে গেছিলাম।

রিমা আহমেদ হেসে বললো, ঠিক আছে ব্যাপার না। রাশেদ আমাকে বলেছে তোমার জ্বর এসেছিল। আচ্ছা খেতে বসো।

চন্দ্রা ভেবেছিল সে বড়সড় ধমক খাবে কিন্তু কিছুই হয়নি। এতোটুকু বুঝতে পারছে মানুষ হিসেবে রিমা আহমেদ খুবই অমায়িক। খাবার টেবিলে রাশেদের বাবা রাশেদকে বললো, তুই কী আজ হসপিটালের যাবি?

না বাবা। তবে যদি ইমারজেন্সি হয় তবে যেতে পারি।

ওহ আচ্ছা।

তারপর চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললো, মা তুমি কেমন আছো?

চন্দ্রার চোখে জল চলে আসলো মা ডাক শুনে। তার বাবাও তাকে এভাবে ডাকতো।

সে ঝটপট নিজেকে সামলে বললো, ভালো। আপনি?

আমিও ভালো। এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে?

চন্দ্রা মিষ্টি করে হেসে বললো, না।

হলে আমাকে বলবে।

আচ্ছা।

বাসায় কথা বলেছো?

না এখনো হয়নি।

ও আচ্ছা। তোমার বাড়ির সবাই আজকে আসবে তুমি জানো?

চন্দ্রা অবাক হলো। সে এসবের কিছুই জানতো না। তার চোখমুখ চকচক করে উঠলো খুশিতে।

সে বললো, কখন?

বিকেলের মধ্যে চলে আসার কথা। আসলে তোমাদের বৌভাতটা কালকে তো তাই ভাবলাম আজই চলে আসুক। কালকে আসবে আবার চলে যাবে বেশি ধকল হয়ে যাবে।

থ্যাংক ইউ।

রাশেদের বাবা হাসলেন।

তিনি আবার বললো, তুমি বোধহয় ভাবছো বিয়ে বাড়িতে অথচ আত্মীয় স্বজনরা নেই কেন?

চন্দ্রা আসলেই তাই ভাবছিল। বাড়ি পুরোই খালি। শুধু ওরা পাঁচজন।

আসলে কী হয়েছে বলো তো আমাদের সব আত্মীয় স্বজন ঢাকাতেই থাকে কালকে আসার সময় সবাই তাদের বাসায় চলে গেছে। বিয়ে বাড়িতে এম্নিতেও ঘুম হতো না। জায়গা কম তার উপর এতোটা জার্নি তাই সবাই আজকের দিনটা রেষ্ট করে কালকে চলে আসবে।

ও আচ্ছা।

আচ্ছা তুমি খাও। আজকের দিনটা রেষ্ট নাও। কালকে আবার ধকল যাবে। ওদের বাসায় তো কালকেই যাবে। তাই না রিমা?

হ্যাঁ। কালকেই যেতে হবে।

চন্দ্রা খাবার খেয়ে উপরে চলে এলো। সে তার বাবাকে কল করে কথা বললো। তারা রওনা হয়ে গেছে। বিকালে না হলে সন্ধ্যায় চলে আসবে। চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি এখানে এসেছে কিন্তু মনে হচ্ছে কতদিন দেখা হয়না। এমন না সে তাদের ছেড়ে থাকে নি। সে আগে ঢাকাতেই থাকতো পড়াশোনার জন্য। তখন এমন লাগেনি কিন্তু এখন লাগছে। চন্দ্রা কথা বলে বারান্দা থেকে ঘরে এলো। এসে দেখলো রাশেদ বসে আছে হাতে বই নিয়ে। চন্দ্রা মনে মনে ঠিক করলো তাকে সরি বলবে। সে বিছানার পাশে গিয়ে বসলো রাশেদের সরাসরি।

তারপর বললো, সরি।

রাশেদ ভ্রু কুঁচকে বললো, কীসের জন্য?

সকালের ব্যাপারটার জন্য। আমি ইচ্ছে করে করিনি।

তুমি এখনো তা মনে নিয়ে আছো। বাদ দাও কিছু হয়নি। আমি কিছু মনে করিনি।

সত্যি?

রাশেদ হেসে ফেললো। তারপর বললো, হ্যাঁ।

চন্দ্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হঠাৎ করে মনে পড়লো রাশেদ কী তার গায়ে হাত দিয়েছিল? না হলে বুঝলো কীভাবে? সে কী জিজ্ঞেস করবে? করলে যদি রেগে যায়।

রাশেদ তা খেয়াল করে বললো কিছু বলবে তুমি?

হ্যাঁ।

বলো।

কিছু মনে করবেন না তো?

আগে প্রশ্ন শুনি।

আপনি বুঝলেন কী করে জ্বর এসেছে?

রাশেদ বুঝতে পারলো চন্দ্রার ঠিক কী বলতে চাইছে। সে বললো, তুমি জ্বরের ঘোরে কথা বলছিলে। আমি জেগে ছিলাম তখন কপালে হাত দিলে বুঝতে পারি। আসলে চাইল্ড স্পেশালিষ্ট তো বাচ্চাদের দেখি সবসময়। অনেক সময় হাত দিয়ে চেকআপ করি তাই তোমার ক্ষেত্রে এতো কিছু ভেবে করিনি।

না না ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি।

তাহলে তুমি এখন রেষ্ট নাও। আমিও একটু ঘুমাই।

আচ্ছা।

বলেই একপাশে শুয়ে পড়লো গুটিশুটি মেরে। রাশেদ পাশে আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। তার স্বভার ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ বই পড়া। কিছুক্ষণ পরই দরজায়,টোকা পড়লো।

রাশেদ গলা উচিয়ে বললো, দরজা খোলা আছে।

দরজা ঠেলে রাশেদের বোন নীলা ঢুকলো। বিছানায় উকি দিয়ে বললো, ভাইয়া ভাবী কী করছে?

ঘুমাচ্ছে বোধহয়। কিছু দরকার ছিলো? ডাক দিবো?

না না থাক ডেকে দিতে হবে না। আমি এম্নিতেই এসেছি গল্প করতে। ঘুমিয়ে থাকুক। শুনলাম কালকে গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

হ্যাঁ। যা বুঝলাম একদমই জার্নি করতে পারে না।

ও। আচ্ছা ভাইয়া আমি আসি। তুমিও ঘুমাও।

আচ্ছা।

নীলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাশেদ বই বন্ধ করে চন্দ্রার দিকে তাকালো। ইসস একদিনের অসুস্থতায় চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্লান্ত খুব। তবে একটা জিনিস মানতেই হবে এই মেয়ে খুবই পরিপাটি হয়ে ঘুমায়। শাড়ি পড়ে ঘুমিয়ে আছে। একটুও এলোমেলো হয়নি শাড়ি। কমলা রংয়ের শাড়ি তার শ্যামবর্ণে চমৎকার মানিয়েছে। যদিও রাশেদের ধারনা ছিল ধবধবে ফর্সা গায়ে কমলা রং ফোটে উঠে। কিন্তু চন্দ্রাকে তবুও মানাচ্ছে।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই চন্দ্রার বাড়ির সবাই রাশেদের বাড়িতে পৌঁছায়। চন্দ্রা দৌড়ে এসে তার বাবাকে ঝাপটে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। মনির হোসেন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মেয়ের অসুস্থতার খবর সে আগেই শুনেছে। তাই আজকে চলে এসেছে। তিনি মেয়েকে ধরে সোফায় বসালেন।

তারপর দুই হাত দিয়ে মুখ তুলে আদুরে গলায় বললেন, দেখি আমার মেয়েকে। এতো কাঁদতে হয় বুঝি? চোখমুখের এই অবস্থা করেছিস একদিনেই?

চন্দ্রা কিছু বললো না।

কী হলো কথা বল? নাকি সেটাও বলবি না?

কেমন আছো বাবা?

মনির হোসেন হেসে ফেললেন। তিনি বললেন, আমার মেয়ের এই অবস্থা আমি ভালো থাকি কী করে?

চন্দ্রা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলো। তারপর বললো, এবার কেমন আছো?

ভালো। তুই কেমন আছিস?

ভালো না। তুমি জানো কালকে আমি কত অসুস্থ ছিলাম?

হ্যাঁ। জানি। তাই তো আজ সকাল না হতেই গাড়িতে উঠলাম। খেয়েছিস?

হুম।

যা মার কাছে যা। চন্দ্রা সবাইকে জড়িয়ে আরেক দফা কাঁদলো। পুরো ঘটনা মন দিয়ে দেখলো রাশেদ। সে নিজমনে বললো, এই মেয়েটা এতো কাঁদতে পারে কীভাবে? ক্লান্ত হয় না?

রাতে চন্দ্রা মায়ের হাতে খাবার খেল। রাতে মায়ের সাথে ঘুমাবে বলে বায়নাও করলো। কিন্তু তার মা তাকে বুঝিয়ে নিজের ঘরে পাঠিয়ে দিল। চন্দ্রা ঘরে এসে দেখলো আজও রাশেদ নেই ঘরে। চন্দ্রা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে রইলো। রাশেদ কিছুক্ষণ পর এলো। সে স্ফিগমোম্যানোমিটার প্রেসার মেপে দিচ্ছিল চন্দ্রার

প্রেসার মেপে আলমারিতে মেশিন রাখতে গিয়ে পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো, প্রেশার কতো?

কন্ঠে বোঝা যাচ্ছে গলার মালিক চন্দ্রা। রাশেদ একটুও চমকালো না। যেন সে এই প্রশ্নটার অপেক্ষায় ছিল।

রাশেদ বললো, প্রেসার এখন নরমাল। কাল লো ছিল তাই আজকে চেক করলাম আবার। অসুস্থ ছিলে মনে হচ্ছিল প্রেসার লো তাই সিউর হয়ে নিলাম। ব্যাপার কী এখন সকালের মতো চমকে উঠলে না কেন? বলেই রাশেদ হেসে ফেললো।

চন্দ্রা বুঝতে পারলো না রাশেদ সকালের ব্যাপারটা নিয়ে আপসেট কিনা? সে প্রশ্ন করলো, আপনি কী সকালের ব্যাপারটা নিয়ে এখনো আপসেট?

না তো এম্নি বললাম।

চন্দ্রা থম মেরে রইলো। রাশেদ খেয়াল করে বললো, চন্দ্রা এখানে আপসেট হবার কিছু নেই। তোমার গিল্টি ফিল করারও কোন দরকার নেই। ঘুমিয়ে পড়ো।

আপনি কোথায় ঘুমাবেন?

কেন? যেখানে কাল ঘুমিয়েছিলাম।

কালকে কোথায় ঘুমিয়েছিলেন?

বিছানায়।

ও আচ্ছা।

কেন? তোমার কোন সমস্যা?

না তা হবে কেন? আপনার ঘর, আপনার বিছানা, আপনার সবকিছু।

আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো। আমি ভেবেছিলাম তুমি টিভি সিরিয়ালের মতো বলবে নিচে ঘুমাবে।

আপনি বললে না হয় তাই করবো।

না না তার দরকার নেই।

বলেই রাশেদ শুয়ে পড়লো। অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকায় সে ঘুমিয়ে পড়লো। চন্দ্রাও কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়লো। যেখনে বিয়েটাই হয়ে গেছে সেখানে আলাদা করে ঘুমানো ন্যাকামি ছাড়া কিছুই নয়।

চলবে…….

পর্বটা কী একটু যাচ্ছেতাই হয়ে গেল?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here