আমি শুধুই তোমার পাঠ-১

#আমি_শুধুই_তোমার
#লেখনিতেঃ লামিয়া ইসলাম তন্নি
#প্রথম_পর্ব

✘কপি করা সম্পূর্ণ নি/ষিদ্ধ✘
ফুলে সাজানো বাসরে ১ হাত লম্বা ঘোমটা টেনে বসে আছি আমি। অপেক্ষা করছি আমার স্বামী নামের আ/সামির জন্য। আ/সামি বলার কারণটা সামনেই বোঝা যাবে। আপাতত, আমার কথা বলি। আমি লামিয়া। সবে অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছি৷ বাবা-মায়ের ৩ সন্তানের ভেতর আমি দুই মাত্র। আর, যাকে স্বামী ওরফে আ/সামি বলছি? সে তাহনান ইব্রাহিম তাহিন। আমার ভার্সিটিরই টিচার। এছাড়াও তার আরেকটা পরিচয় হলো সে আমার বাবার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে। আপাতত, আমি তার ক্লাস নেওয়ার জন্য বসে আছি। ব্যাটা আস্ত খচ্চর একটা। বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। নয়তো, ২ দিন আগে কেউ মেয়ে দেখতে এসে ৩দিনের মাথায় বিয়ে করে? শুধু কি তাই? সে জানে যে, মেয়েটা বিয়েতে রাজি নয়। এমনকি, বিয়ের পর যেকোনো মুহূর্তে তাকে রেখে পালাতে পারে, তারপরও নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিলো? আশ্চর্য না? আজকে তো এর একদিন কি আমার একদিন!

ফ্লাসব্যাক….
পাত্র পক্ষের সামনে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছি আমি। চুপচাপ বসে আছি বললে অবশ্য ভুল হবে। কারণ, আমি চুপচাপ নেই। মনে মনে এটে চলছি হাজারও ফন্দি। বিয়ে ভা/ঙার ফন্দি। পাত্র মোটেই খা/রাপ নয়। দেখতে বেশ ভালো। নম্র, ভদ্র, ব্রিলিয়ান্ট। এক কথায় বলতে গেলে মি.পার্ফেক্ট। আমি অবশ্য তাকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। শুধু আমি নই। আমার পুরো পরিবারই তাকে চেনে। তাই, এবারের বিয়েটা ভাঙা বেশ মুশকিল। অবাক হওয়ার বিষয়, তাই না? কারণ, সব ঠিক থাকার পরও আমি বিয়েটা ভাঙতে চাচ্ছি। আসলে, আমি বিয়ে করতে চাই না। আর আমার একমাত্র বাবা আর মা আমাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। এই নিয়ে আমাদের মাঝে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। কারণ, এই পর্যন্ত আমি ৯টা বিয়ে ভেঙেছি। এটা ১০ নম্বর। আপাতত, এটাকে নিয়ে কী করব, তাই ভাবছি।

আমার সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝে আন্টি অর্থাৎ পাত্রের মা আমায় ডাকলেন। তার ডাক অনুসরণ করে তাকাতেই তিনি বললেন,
‘লামু? তোরা ছাঁদে যা। দু’জনে একটু কথা বলে আয়।’

আন্টির কথা শুনে আমি আমার সামনে বসে থাকা সেই গম্ভীর পুরুষটির দিকে তাকালাম। তিনি কোনো প্রকার কথা না বলে একের পর এক পা ফেলে ড্রইং রুম ত্যাগ করলেন। ঘর থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে হাঁটা ধরলেন। তার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম আমিও। দু’জনে নীরবে ৩ তলা থেকে ৫ তলায় এলাম। পুরো সিঁড়িতে কেউ কোনো কথা বললাম না। ছাঁদে গিয়েই এসেই আমি দোলনায় বসে পরলাম। এরপর, মৃদু তালে দুলতে লাগলাম। উনি ধীর পায়ে এসে পাশে বসলেন। আরও কিছুটা সময় নীরবেই কে/টে গেল। উনি কিছুই বললেন না। কিন্তু, আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। কারণ, লোকে বলে- “যার পেটের খিদে সেই নাকি বোঝে।” এই মুহূর্তে আমার পেটে খিদে। আই মিন, বিয়েটা আমি করতে চাইনা। সো, আমাকেই প্রথমে কথা বলতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি ঘুরে উনার দিকে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো। আমি কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। বললাম,
“ইব্রাহিম ভাই? আপনাকে কিছু বলার ছিল।”

আমার কথা শুনে উনি উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম,
“আমি শুরুতেই সরি বলছি। আসলে, আমি এই বিয়েটা করতে পারব না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। তাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আ’ম রিয়ালি সরি, ইব্রাহিম ভাই।”

আমার কথা শুনে উনি তৎক্ষনাৎ কোনো জবাব দিলেন না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর বললেন,
“ইট’স ওকে। তবে, এটা তোমার শুরুতেই আঙ্কেল-আন্টিকে বলা উচিৎ ছিল।”

ইব্রাহীম ভাইর কথায় আমি ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। মন খা/রাপ করে বললাম,
“বলেছিলাম তো। কিন্তু, তারা মেনে নিবেন না। কারণ, অভ্রর বাবা-মায়ের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। অভ্রর ৫ বছর সময় তার বাবা তার মাকে রেখে অন্য জায়গায় বিয়ে করেন। তখন থেকেই শুভর মা শুভকে নিয়ে আলাদা থাকে। আর, এজন্যই বাবা শুভর সাথে আমাকে বিয়ে দিবেন না। আর, যেখানে বাবার মত নেই। সেখানে আম্মুও মত দিবেন না। কত করে বোঝালাম। তারা বুঝতেই চাইলেন না। উল্টো বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছে। আপনার আগে বহু কষ্টে ৯টা বিয়ে ভে/ঙেছি। আপনি ১০ নাম্বার। যেহেতু, আপনি পরিচিত। তাই, আপনাকে সবটা বললাম। আর, আমার জানামতে কোনো ছেলেই এমন কাউকে বিয়ে করতে চাইবে না, যে অন্য কাউকে ভালোবাসে।”

আমার কথা শেষ হতেই তাহিন ভাই বললেন,
“কিন্তু, আমি চাই।”

তার কথা শুনে আমি চমকে তাকালাম। সে মুচকি হেসে বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।”

আমি বিস্মিত কন্ঠে শুধালাম,
“মানেহ্? কী বলছেন-টা কী? মাথা ঠিক আছে তো?”

উনি হাসলেন। ইশশ্, কি চমৎকার সেই হাসি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন সেই হাসিতে ডুবে গেলাম। পরক্ষণেই নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে চোখ ফেরালাম। ভাবলাম, তার এই হাসিতে যেকোনো মেয়েই চট করে প্রেমে পড়ে যাবে৷ কিছু সময়ের জন্য তার হাসিটা আমারও বেশ ভালো লাগলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আসলে, এত পার্ফেক্ট কাউকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। হয়তো, আমার ভাগ্যে এত ভালো কেউ নেই। তাই, এত চমৎকার একজন মানুষকে পেয়েও আমার তাকে ফেরাতে হচ্ছে। আমি যদি অভ্রকে ভালো না বাসতাম। তবে, আমি এই মানুষটাকে কখনোই ফেরাতাম না। তাকে ফেরানোর কারণ, একটাই। অভ্র! তবে, অভ্র যে খারাপ এমনটা নয়। সে-ও যথেষ্ট ভালো। কিন্তু, ইব্রাহীম ভাই’র মতো মি.পার্ফেক্ট না হয়তো!

ইব্রাহীম ভাইকে আমি ছোটবেলার থেকে চিনলেও, বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের মাঝে দূরত্বও বেশ বেড়ে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই তাকে আমার ভালো লাগতো। বাট, ভালোবাসার সাহসটা হয়ে ওঠেনি৷ তার কারণ একটাই আমি যতবার তাকে দেখেছি রাগী অবস্থায় দেখেছি। একটা পর্যায় যা আমার মনের মধ্যে তার জন্য ভালো লাগা থেকে ভয়ের বেশি সঞ্চার করেছে। তারপর, ভার্সিটিতে ভর্তির পর অভ্র’র সাথে পরিচয়। সে তখন মাস্টার্সের স্টুডেন্ট। ভুল বোঝাবুঝি থেকে তাকে একদিন অনেক কথা শুনিয়েছিলাম। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরি বলতে গিয়েই বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্বের রেশ ধরেই আজ আমাদের সম্পর্ক। আমার ভাবনার মাঝেই সে বলে,
“আমার মাথা একদম ঠিক আছে। তুমি অভ্রকে ভালোবাসো। কিন্তু, তোমার কথা শুনে যা বুঝলাম, আঙ্কেল -আন্টি অভ্রকে কখনোই মেনে নিবে না। তার মানে, তুমি এখানে থাকলে কখনোই অভ্রকে পাবে না। আর, তুমিও পালিয়ে যাবে না। কারণ৷ সেটা করার হলে, অনেক আগেই করতে। তবে, আমার সাথে বিয়ের পর যদি তারা দেখেন, তুমি ভালো নেই। সেক্ষেত্রে তুমি চাইলে তাদের কাছে চলে যেতো পারবে। তারপর, আমাদের ডিভোর্সের পর তুমি তাদেরকে আবার অভ্রর কথা বলবে। তখন, তারা রাজি না হয়ে পারবে না। কারণ, প্রথমবার তাদের পছন্দের ছেলের সাথে মেয়ে ভালো ছিল না। পরেরবারও যদি না থাকে? তাই, তারা এক ভুল দু’বার করবে না। আর, দু’জন ভালোবাসার মানুষকে মেলানোর জন্য আমি এতটুকু করতেই পারি।”

একের পর এক কথাগুলো বলে থামলেন উনি। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। একটা মানুষ এতটা ভালো কীভাবে হয়? উনাকে না দেখলে হয়তো জানতামই না যে, মানুষ এতটাও ভালো হয়। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন,
“ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছো, পিচ্চি?”

উনার কথা শুনে আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। কিছুটা রেগে বললাম,
“আপনি ছোটবেলার মতো আবার আমায় পিচ্চি বলছেন? আমি মোটেও পিচ্চি নই। এখন আমি বেশ বড়।”

আমার কথা শুনে উনি শব্দ করে হেসে ফেললেন। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললেন,
“তুমি বড় হতে পারো। কিন্তু, আমার থেকে অনেক পিচ্চি। বুঝেছো, পিচ্চি?”

উনার কথা শুনে আমি চোখ গরম করে তাকাতেই উনি বললেন,
“থাক আর রাগতে হবে না। চলো, নিচে যাই।”

কথা শেষে উনি উঠে যেতে নিতেই আমি উনার হাত ধরে ফেললাম। উনি ফিরে তাকাতেই আমি হাত ছেড়ে দিলাম। বললাম,
“আপনি নিচে গিয়ে বলবেন, আমাকে আপনার পছন্দ নয়। আপনি এ বিয়ে করবেন না। প্লিজ…!”

উনি আমার কথার উত্তরে মৃদু হেসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। উনার পেছন পেছন আমিও নিচে নেমে গেলাম। নিচে নামতেই উনার আম্মু আমাকে টেনে নিয়ে উনার পাশে বসালেন। আমি আঁড়চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি মাথা নিচু করে বসে আছেন। আন্টি আমাদের উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞস করলেন,
“কথা বলেছিস তোরা? আমরা বিয়ের কথা আগাই?”

আন্টির কথায় আমি ফিরে তাকালাম। মনে মনে খুব করে চাইলাম যেন, উনি ‘না’ বলেন। কিন্তু, আশ্চর্যজনক ভাবে আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি বললেন,
“আগাও। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”

উনার কথা শুনে যেন আমি সাত আসমান থেকে টুপ করে জমিনে পরলাম। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। এই লোকটা এত ত্যাড়া কেন? শুধু শুধু নিজের জীবন কেন ন/ষ্ট করবেন? আমার ভাবনার মাঝেই আন্টির কথা কানে এলো। তিনি ইব্রাহিম ভাইকে বললেন,
‘আংটি-টা পরিয়ে দে ওকে।”

তার কথা অনুসরণ করে তাকাতেই দেখলাম, উনি পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করলেন। তারপর, তা খুলে তার ভেতর থেকে একটা আংটি বের করে আমার দিকে তাকা করে ঠিক আমার চোখের দিকে চাইলেন। তার চোখে চোখ পরতেই ভেতরটা কেন যেন কেঁপে উঠলো আমার। আমি চোখ সরিয়ে নিতেই আন্টি বললের,
‘কীরে? হাত বাড়া।’

আন্টির কথা শুনে আমি নিচে তাকিয়েই হাতটা এগিয়ে দিলাম। উনি আমায় কোনোভাবে টাচ না করেই আংটি-টা পরিয়ে দিলেন। আংটি পরানো শেষে বাবা আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ওকে ভেতরে নিয়ে যাও।”

দরজা খোলার শব্দে আমার ঘোর কা/টলো। সঙ্গে সঙ্গে আমি একটানে ঘোমটা সরিয়ে দরজার দিকে তাকালাম। চোখে পরলো আমার স্বামী নামক আ/সামিকে। আমি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি দরজার ছিটকিনি দিয়ে ফিরে চাইলের খাটের দিকে। সাথে সাথে দু’জনের চোখাচোখি হলো। আমি একটু কেমন যেন অন্যরকম অনুভূতি হলো। এই প্রথম কোনো ছেলের দৃষ্টিতে অস্বস্তি অনুভব করলাম। তৎক্ষনাৎ হাফসাফ করে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। আমার থেকে বেশ খানেকটা দূরত্ব রেখে বিছানায় বসলেন। আমি ফিরে তাকালাম। এক পলক উনাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। বললাম,
”সবটা জেনেও কেন করলেন এমনটা? নিজের সুখের কথা একবারও ভাবলেন না?”

আমার প্রশ্নে উনি আলতো হাসলেন। শান্ত স্বরে বললেন,
”প্রিয়জনের খুশিতেও সুখ থাকে। দূর থেকে প্রিয় মানুষটার হাসি মুখ দেখেও সুখী হওয়া যায়৷ যেই সুখ সবার কপালে থাকে না। পৃথিবীর খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই সেই সুখ পায়। আমিও তাদের-ই একজন।”

ওনার স্বরটা যেন কেমন ঠেকলো আমার কাছে। কথাটাও ঠিক বুঝতে পারলাম না। প্রিয়জন বলতে কী বোঝাতে চাইলেন উনি? আমি ওনার প্রিয়জন কীভাবে? উনি তো কখনোই তেমন কিছু বলেন নি আমায়। তবে?

আমার ভাবনার মাঝেই উনি বললেন,
“চেঞ্জ করে শুয়ে পড়ো। রাত হয়েছে অনেক। আমি ফ্লোরে শুচ্ছি।”

উনি কথা শেষ করতেই আমি বললাম,
“নিচে শুতে কবে না। বিছানাটা বড় আছে। ওপাশে শুয়ে পরুন। আমার সমস্যা নেই।”

আমার কথার উত্তরে উনি হয়তো কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু, সুযোগ পেলেন না। আমি আবারও বললাম,
“আর একটাও কথা না বলে। ঘুমান। আমার অনেক ঘুম পেয়েছে।”

কথা শেষ করে শুতে নিতেই উনি বললেন,
“চেঞ্জ করবে না? এই অবস্থায় ঘুমাতে পারবে?”

আমি শুতে গিয়েও বসে পরলাম। ঘুমে লেগে আসা চোখজোড়াকে জোর করে খুলে তার দিকে তাকালাম। মুখটা ছোট করে বললাম,
“আমার অনেক ঘুম পেয়েছে, ইব্রাহীম ভাই। এসব খুলতে গেলে ঘুম চলে যাবে। আর, না খুললে আরামে ঘুম হবে না। কী করি, বলুন তো?”

আমার কথার উত্তরে উনি মুচকি হাসলেন। বললেন,
“আচ্ছা ড্রেস থাকুক। গয়নাগুলো খুলে শোও।”

আমি ওনার কথায় চোখ বন্ধ করেই মাথা দুলালাম। তারপর, সেভাবেই দুলতে দুলতে কানে থাকা ঝুমকো জোড়া খুলে ফেললাম। কিন্তু, কোথায় ফেললাম নিজেও জানিনা। আসলে, আমার ঘুম পেলে দিন দুনিয়া সব ভুলে যাই। এখনও হলো তাই! ঝুমকো খুলে গলার হাড় খুলতে নিতেই ঝিমাতে ঝিমাতে পরতে নিতেই কেউ ধরে ফেলল। আচমকা ঝাঁকুনিতে ঘুমও দৌড়ে পালালো। মেজাজটাই চটে গেল। চিৎকার করার জন্য প্রস্তুত হতেই স্থান, কাল, সময় সব মনে পড়ে গেল। চোখের সামনে পড়লো পরিচিত সেই মুখখানা! ইশশ্, কি স্নিগ্ধ! আমার চিৎকার করা হলো না। তবে, মনটা খারাপ হলো। এত সাধের ঘুমটা আমার।

আমাকে মুখ কুঁচকে থাকতে দেখে উনি আবারও হাসলেন। যেই হাসি আমার চোখ এড়ালো না। এবার আমার একটু রাগ হলো। রেগে বললাম,
“আমার অবস্থা দেখে আপনার হাসি পাচ্ছে?”

উনি মুহূর্তেই মুখটা গম্ভীর করে ফেললেন। বললেন,
“কই? না তো! এই দেখো, হাসছি না।”

আমি জবাব দিলাম না। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে বাকী গয়নাগুলো খুলতে লাগলাম। উনি হালকা করে গলা ঝাড়লেন। বললেন,
“আমি কী কোনোভাবে হেল্প করতে পারি? আই মিন, যদি কিছু মনে না করো তো গয়না খুলতে তোমাকে হেল্প করি?”

ওনার কথা শুনে আমি বিস্মিত চোখে উনার দিকে তাকালাম। চেঁচিয়ে বললাম,
“কিহ্?”

উনি হয়তো আমার আচরণে ভরকে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অপ্রস্তুত হয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
“আ..আম সরি! আসলে, তোমার ঘুম পাচ্ছে। এতগুলো গয়না খুলতে সময় লাগবে। তাছাড়া, তুমি বিরক্তও হচ্ছো। তাই, ভাবলাম তোমাকে হেল্প করি। আমার খারাপ কোনো ইন্টেনশন ছিল না। নেইও। ট্রাস্ট মি!”

আমি জবাব দিলাম না। কতক্ষণ সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের কাজে মন দিলাম। একে একে ঝুমকো, টিকলি, নথ, হাড় সব খুললেও একটা হাড় খুলতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধলো। হুকটা কোনোভাবে আটকে গেল চুলের সাথে। অনেকক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করেও খুলতে তো পারলামই না। বরং, উল্টো আরও পেঁচিয়ে ফেললাম। এবার রাগে-দুঃখে আমার কান্না পেল। কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। যদি এখন এই লোককে বলি, কী ভাববে? তাছাড়া, যে চেয়ে বলতেও কেমন লাগে। আমি মুখ কাচুমাচু করে আড়ঁচোখে তার দিকে তাকালাম। সে আমার দিকেই তাকিয়ে আমার কান্ড দেখছিল। আমাকে তাকাতে দেখে মুচকি হাসলো। আমি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট কুঁচকে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে রইলাম। উনি কোনোপ্রকার কথা না বলে নীরবে এগিয়ে এলেন। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে চুল থেকে হুকটা ছাড়িয়ে দিলেন। একটিবারের জন্য আমায় স্পর্শও করলেন না। আর না, হুক ছাড়াতে গিয়ে ব্যথা দিলেন। সে আমাকে শরীরকে স্পর্শ না করলেও, তার এই ছোট্ট কাজটা আমার মনকে ঠিক স্পর্শ করলো। ভালো লাগার মতো না হওয়ার পরও খুব অদ্ভুতভাবে তা আমার ভীষণ ভালো লাগলো। আমি কিছু বললাম না। উনি আমার কাছ থেকে সবগুলো গয়না নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিলেন। আমি এক পলক উনাকে দেখে নিয়ে শুয়ে পরলাম। উনি বললেন,
“লাইট অন থাকবে?”

আমি ছোট্ট করে বললাম,
“উঁহু। নিভিয়ে দিন।”

উনি কথা বাড়ালো না। আলো নিভিয়ে এসে চুপ করে আমার পাশে শুয়ে পরলেন। আমি উনার দিকেই মুখ করে শুয়ে আছি। আর, উনি চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। বা হাত কপালের উপর। আর ডান হাত বুকে। বাহির থেকে আসা আবছা আলোয় স্পষ্ট তা দেখা যাচ্ছে। কি আশ্চর্য না? কাল এ সময়েও এই মানুষটা আমার কেউ ছিল না। আমার পাশে কেউ ছিল না৷ অথচ, আজ এই সময়ে এই মানুষটা আমার স্বামী। আমার স্বামীর পাশে আমি শুয়ে আছি। সব থেকে আশ্চর্যজনক হলো, শুনেছি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার সম্পর্ক। কিন্তু, আমাদের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। আমাদের মাঝে সীমাহীন দূরত্ব। এইযে, পাশাপাশি দু’জনই শুয়ে আছি। কিন্তু, দু’জনের মাঝে বেশ দূরত্ব। তেমনটাই আমাদের সম্পর্কেও। আমি তপ্তশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলাম। তখনই উনি বললেন,
“কোনো সমস্যা?”

আমি ছোট্ট করে বললাম,
“উঁহু।”

“ক্ষুধা পেয়েছে? যতটুকু জানি, রাতে মনে হয় খাওনি।”

“আমার অভ্যাস আছে।”

“কিছু আনি? খেয়ে নাও।”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। বললাম,
“না। এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না।”

“রাতে একদম খালি পেটে থাকা উচিত না।”

আমি এবার মাথা তুলে সরু চোখে তার দিকো তাকালাম। বললাম,
“টিচারগিরি করছেন? আমি কি এখন আপনার স্টুডেন্ট?”

উনি হাসলেন। আবছা আলোয় তা আমার চোখ এড়ালো না। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কি সুন্দর সেই হাসি!

হাসি থামিয়ে বললেন,
“যদি সম্পর্কের হিসেব করো, তাহলে তুমি এখন আমার সহধর্মিণী। সেই দিক থেকে তোমার ভালোমন্দ, সুস্থতা সকল দিকে খেয়াল রাখাটা আমার দায়িত্ব। যেমন দায়িত্ব তোমাকে খুশি রাখা? ঠিক তেমন।”

তারপর, বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
“কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি কিছু আনছি। খেয়ে ঘুমাবে। যাস্ট ৫ মিনিটস!”

কথাটা শেষ করে উনি এক মিনিটও অপেক্ষা না করেই আলো জ্বালিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তার যাওয়া! কতটা দায়িত্ববোধ! কতটা মায়া! আমার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটলো। যার কারণ আমারও অজানা!

~চলবে…?

(ছোটগল্প! ৫-৬ পর্বেই শেষ করে দিব। ধন্যবাদ )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here