আমি শুধু তোমার পাঠ-৪

#আমি_শুধু_তোমার
#লেখনিতেঃ লামিয়া ইসলাম তন্নি
#চুতর্থ_পর্ব

✘কপি করা সম্পূর্ণ নি/ষিদ্ধ✘
দেখতে দেখতে প্রায় ৩ মাস পেরিয়ে গেল। পরের সপ্তাহেই উকিলের ডিভোর্স পেপার রেডির কথা থাকলেও কিছু সমস্যার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। সেই সমস্যা সমাধান করতে করতেই ৩ মাস পেরিয়ে গেল অথচ, বুঝতেই পারলাম না। আজ মনে হয়, এইতো! কালই আমাদের বিয়ে হলো। আমি লাল টুকটুকে বউ সেজে এ-বাড়িতে পা দিলাম। তারপর, কিছু সময়ের ব্যবধানে এই বাড়ির মানুষগুলো আমার আপন হয়ে গেল।

মাত্র ৩ মাসে ওনার পরিবারের সবার প্রতি আমার মায়াটা আরও গাঢ় হলো। এমনকি, ইদানীং ওনার প্রতি কেমন এক আলাদা অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারি। এইযে, উনি বেশি সময় বাহিরে থাকলে টেনশন হয়। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারি না। উনি কোনো কথা বললে, মন দিয়ে তা শুনি। এমনকি, প্রথম প্রথম ক’দিন ওনার সাথে ঝগড়া বেশ চলতো আমার। দু’জনে চুটিয়ে কথা কাটাকাটি করতাম। কিন্তু, ইদানীং উনি একাই বকবক করেন। বেশ কিছুক্ষণ বকবক করে যখন আমার কোনো উত্তর পান না বা আমার দিক থেকে কোনো সাড়া পান না, তখন সে নিজেও চুপ করে যান। এমনকি, ঘরে এসে আমাকে এটা নিয়ে শাসায়। এইতো, গত পরশুর ঘটনা৷ সকালে নাস্তা করছিলেন। নাস্তা শেষে চা চাইলেন, কথামতো আমি চা দিলাম। একটুখানি চা মুখে নিয়েই নাক-মুখ কুঁচকে চায়ের কাপ ঠেলে ধমকে উঠলেন উনি। বললেন,
“এটা কী চা নাকি সরবত?”

সেদিন সত্যি বলতে তার ধমকে কেঁপে উঠেছিলাম। এতটা সাহসী আমি এতটুকুতে ভ/য় পাওয়ায়, বেশ অবাকও হয়েছিলাম। ভ/য়ে ভ/য়ে কাপ থেকে চামচ দিয়ে একটুখানি চা মুখে নিয়ে দেখেলাম, চিনি ঠিকই আছে। আমি বোকার মতো ওনার দিকে তাকাতেই উনি আরেকবার ধমকে উঠেছিলেন। আমি ভ/য়ে নিচে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম। কি জানি? কেন কিছু বললাম না! উনি একাই একের পর এক অনেক কথা শোনালেন আমাকে। মন না চাইলে যেন কাজ না করি। তবুও যেন এমন ভুল না হয়। এরপর থেকে কাজ করতে হলে যেন মন দিয়ে করি। এমন অনেক কথা বলেছিলেন। কিন্তু, আমি চুপ করে শুনছিলাম। যেন, উনি কোনো রূপকথার গল্প শোনাচ্ছেন। উনি বেশকিছু সময় বকবক করেও আমার সাড়া না পেয়ে ঘরে চলে গিয়েছিলেন। পরে যখন আমি আরেক কাপ চা নিয়ে ঘরে যাই, তখন তিনি আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে চুমুক দিয়েই চোখ বন্ধ করে চায়ের স্বাদটা অনুভব করেন৷ তারপর বলে ওঠেন,
“চা’টা চমৎকার বানিয়েছো। তখনকার চা’টাও দারুণ ছিল। তবে, কী নিয়ে ঝগড়া করব, খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই, চা নিয়েই শুরু করে দিলাম। কিন্তু, কী লাভ হলো? যার জন্য এতকিছু, সে নিজেই তো নিশ্চুপ।”

একের পর এক কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি। তারপর, আবার বললেন,
“হুট করে কী হলো তোমার? ক’দিন যাবৎ দেখছি আমার কথার জবাবে চুপ করে থাকছো। কিচ্ছু বলছো না। কেন?”

আমি তৎক্ষনাৎ বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। উত্তর না দিয়ে চলে আসছিলাম। তখনই উনি আমার হাত টেনে ধরলেন। বললেন,
“কোনো সমস্যা?”

উত্তরে আমি ‘না-বোধক’ মাথা নেড়েছিলাম। উনি আমার হাত ছেড়ে ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন,
“আমার পুরো লাইফে আমি এত বকবক কখনো করিনি৷ যতটা এ’কদিন করছি।”

তারপর, আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“কিন্তু, চব্বিশ ঘন্টার ভেতর ১৬ ঘন্টাই বকবক করা বকবক কন্যা হুট করেই এমন চুপ করে গেল কেন? কাহিনী কি, ম্যাডাম? প্রেমে টেমে পড়ে গেলেন নাকি? আপনি তো দেখছি, আমার মায়ের কাছে আমাকে কালপ্রিট বানিয়ে দিচ্ছেন। না জানি, আম্মু কোনদিন বলে বসে ‘ইদানীং তুই খুব বেশি করছিস, তাহি। খালি খালি রোজ মেয়েটার সাথে ঝগড়া করছিস। আমার বাসায় এসব চলবে না। আজকে পর যদি আবার আমার মেয়েটাকে কিছু বলতে দেখি? তাহলে, তোকে বাসা থেকে বের করে দিব।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন উনি। ওনার সাথে চোখাচোখি হতেই কেঁপে উঠেছিলাম আমি। তার থেকেও বেশি ভ/য় পেয়েছিলাম ওনার মুখে প্রেমে পড়ার কথাটা শুনে। সত্যি-ই কি তা সম্ভব? আমি যখন ভাবনার সাগরে ডুবে ছিলাম? অনাকাঙ্ক্ষিত ভ/য়ে আতঙ্কিত হয়েছিলাম? তখনই উনি ভরসার হাত রেখেছিলেন আমার হাতে। বলেছিলেন,
“আরে, বাবা! মজা করেছি। তুমি দেখি সিরিয়াস হয়ে গিয়েছো।”

ওনার কথার উত্তরে সেদিন জোরপূর্বক হাসলেও মন থেকে ভ/য়টা দূর করতে পারিনি। বরং, সেই ভ/য়টা বেড়েই চলেছে। কারণ, তার প্রতি এত এত মুগ্ধতা, তার প্রতিটা কাজে আনন্দ পাওয়া এসব অন্য রকম এক লক্ষ্মণ!

এইযে, গত সপ্তাহের আরেক ঘটনা। সেদিন আমার জন্ম তারিখ অর্থাৎ ১২ তারিখ ছিল। যদিও আমার জন্মদিনটা ১২ই ডিসেম্বর। কিন্তু, আমাদের বিয়ের পর থেকে প্রতি মাসের ১২ তারিখেই সে আমাকে সারপ্রাইজ দিচ্ছে। কোনো না কোনোভাবে আমাকে চমকে দিচ্ছে। সেই দিনটাকে বিশেষ করে দিচ্ছে। সেদিনও ব্যতিক্রম কিছুই হয়নি। বরং, প্রথম দুই ১২ তারিখের থেকেও বেশ বিশেষ কিছু করেছিলেন। আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। বিস্ময়ে দু’হাতে মুখ চেপে ধরেছিলাম। আমার চোখ টলমল করছিল, পানিতে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দেখছিলাম তার পাগলামো!

ফ্লাশব্যাক…
বাবা, মা আর তাইয়্যেবাহ্ বাসাতে নেই। ছোট মামার বাসাতে গিয়েছেন। আজ ফিরবেন না। আমিও যেতে চেয়েছিলাম তাদের সাথে। কিন্তু, আমার আ/সামি মহাশয় রাজি ছিলেন না বিধায় যাওয়া হয়নি। কী আর করার! তাই, বসে বসে ফেইসবুক স্ক্রোল করছিলাম। সে সময় বাসার বেল বাজলো। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই আমার আ/সামি মহাশয় আমার দিকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“দ্রুত যাও। তৈরি হয়ে এসো।”

তার কথা শুনে আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আমরা ছোট মামার বাসাতে যাব। তাই পাশের দেয়ালে থাকা ঘড়িতে চোখ বোলালাম। এমা! সাড়ে ৯টা বাজে! এত রাতে কেউ কারো বাসায় যায় নাকি? আমি সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“এত রাতে কেউ কারো বাসায় যায় নাকি? কী ভাববেন মামা, মামি?”

আমার কথা শুনে উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বললেন,
“মামা, মামি মানে? তোমাকে কে বলল আমরা মামাদের বাসাতে যাচ্ছি?”

ওনার কথা শুনে আমি ভরকে গেলাম। বোকার মতো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে বললাম,
“যাচ্ছি না? তাহলে, রেডি হতে বলেছেন কেন? কোথায় যাব এত রাতে?”

উনি এবার চোখ গরম করে চাইলেন। ওনার সেই চাহনির কাছে আমার সব প্রশ্ন উড়ে গেল। আমি মুখটা ছোট করে ফেলতেই উনি বললেন,
“এত প্রশ্ন করো কেন, তুমি? যখন কথা বলতে বলি, তখন তো মুখে সুপার গ্লু লাগিয়ে রাখো। আর, যখন কথা না বলে কাজ করতে বলি, তখন প্রশ্ন করে মাথার সাথে সময়ও নষ্ট করো। যাও গিয়ে রেডি হও।”

বলতে গেলে, শেষের বাক্যটা এক প্রকার ছোটখাটো ধমক ছিল। তার রাগ সম্পর্কে যত বর্ণনা শুনেছি? আপাতত, তার রাগ দেখার ইচ্ছে নেই। তাই, তার ছোটখাটো ধমকেই দমে গেলাম আমি। চুপচাপ রুমে গিয়ে শপিং ব্যাগটা বিছানার উপর উপুড় করে ধরলাম। সাথে সাথে বেরিয়ে এলো একটা বক্স। লাল রঙের রেশমি চুড়ি, এক জোড়া বড় ঝুমকো, এক জোড়া পায়েল, এক পাতা টিপ আর একটা আলতার বোতল। বাহিরের জিনিসগুলো দেখে আমি বেশ চমকালাম। আমার বুঝতে বাকী রইলো না, বক্সে কী আছে! আমার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটলো। আমি চট জলদি বক্সটা নিয়ে খুললাম। তার থেকে বেড়িয়ে এলো লাল টুকটুকে একটা শাড়ি। আমি বক্স থেকে শাড়িটা হাতে তুলে নিলাম। তারপর, আস্তে আস্তে শাড়িটা খুললাম। এমনভাবে, যেন এই বুঝি ব্যথা পেল! শাড়িটা খুলে আমি বেশ মুগ্ধ হলাম। পুরো শাড়িতে কোনো কাজ নেই। কেবল, দুই পাড়ে চিকন করে গোল্ডেন কাজ। শাড়ির সাথে বক্সে একটা ব্লাউজ আর পেটিকোটও দেখতে পেলাম। ব্লাউজ ও পেটিকোটটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আমি আরও অবাক হলাম। আশ্চর্য! এই লোক এত পার্ফেক্ট সাইজ কীভাবে আনলো? পেটিকোট বা ব্লাউজ কোনোটাই ছোট বা বড় হয়নি। কীভাবে! আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে হলো। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, “এই লোক? আপনি এত পার্ফেক্ট পেটিকোট ব্লাউজ আনলেন কী করে?” কিন্তু, তা হলো না। কেন যেন ল/জ্জা লাগলো! তবে, শাড়ির মতো ব্লাউজটাও অনেক সুন্দর। মোটামুটি রকমের কাজ আছে সোনালি রঙের। সত্যি বলতে লোকটার চয়েজ আছে।

আমি যখন এগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম? তখন-ই দরজায় টোকা পরল। আমি ভেতরে আসার অনুমতি দিতেই উনি দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন। আমাকে তখনও একইভাবে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“এখনও রেডি হওনি যে? পছন্দ হয়নি?”

আমি শাড়ি থেকে চোখ তুলে এক পলক ওনার দিকে তাকালাম। মুচকি হেসে বললাম,
“১০ মিনিট দিন।”

উনি মাথা নেড়ে রিয়ে গেলেন। আমি লাইট অফ করে ব্লাউজ আর পেটিকোটটা পরে নিলাম। তারপর, লাইট অন করে ধীরে ধীরে শাড়ি পরলাম। একের পর এক কুঁচি করে সবগুলো কুঁচি এক করে কোমড়ে গুঁজে নিলাম। তখন-ই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। সেই ফোন দিতেই দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন উনি। এমন একটা পরিস্থিতিতে দু’জন মুখোমুখি হতেই কিছুটা ল/জ্জা পেলাম আমি। উনিও চোখ বন্ধ করে ফেললেন তৎক্ষনাৎ। কারণ, তখনও আমার শাড়ি পরা শেষ হয়নি। শ্যাম বর্ণের কোমড় উঁকি দিচ্ছিল শাড়ির ফাঁকা দিয়ে। আমি এক টানে বুকের উপর থেকে শাড়ির আঁচল নামিয়ে কোমড় ঢাকলাম। উনি ফোনটা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ভুল করে তখন ডাইনিং টেবিলের উপর ফোন রেখে এসেছিলাম। আমি ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে অভ্রের কন্ঠ ভেসে এলো। সে বলল,
“এতক্ষণ লাগলো যে ফোন তুলতে?”

আমি শাড়ি পরার কথাটা বলতে গিয়েও বললাম না। বললাম,
“খাচ্ছিলাম। ফোন রুমে ছিল।”

অভ্র আমার কথা বিশ্বাস করলো কিনা কে জানে? সে বলল,
“আচ্ছা। তো এখন কী করছো?”

আমি মিথ্যা বলতে গেলে বারবার আটকে যাই। যার ফলে, সহজেই ধরা পরে যাই। আমি কী বলব, তৎক্ষনাৎ খুঁজে পেলাম না। ভাবতে যতটা সময় লাগলো, এরই মাঝে সে বলল,
“কথা বলছো না কেন? পাশে কেউ আছে নাকি?”

আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম,
“কই? না তো। আমি তো এখন একটু পড়তে বসবো।”

প্রতিত্তোরে সে ছোট্ট করে বলল,
“আচ্ছা।”

তারপর, আবার জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার কই?”

“উনি তো ড্রইং রুমে। টিভি দেখছেন।”

অভ্র এবার প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বল উঠলো,
“তুমি সিওর স্যার তোমাকে ডিভোর্স দিবে? আমার মনে হয় না। কারণ, কেউ-ই নিজের বউকে অন্যকারো হাতে তুলে দিতে রাজি হবে না। আমি হলে কোনোদিনও দিতাম না।”

অভ্রর কথায় আমার মনটা খা/রাপ হয়ে গেল। কিন্তু, আমি অভ্রকে তা বুঝতে দিলাম না। মৃদু হেসে বললাম,
“উনি খুব ভালো মানুষ, অভ্র। তা না হলে, বিয়ের প্রথম রাতেই সে নিজের অধিকার দেখাতো। কিন্তু, উনি তা করেন নি।”

আমার কথার উত্তরে অভ্র ঠাট্টার স্বরে বলল,
“বাহ্! মাত্র এই ক’দিনেই এত তারিফ। বিয়ের সাইড ইফেক্ট নাকি? শোনো, সে যদি এতই ভালো স্বামী হতো? তবে, কখনোই নিজের বউকে অন্যের হতে দিতো না। কিন্তু, সে দিবে। কারণ, তার মহৎ হওয়ার সাধ!”

ওনার বিরুদ্ধে অভ্রর একের পর এক কথাগুলো আমার কাছে বি/ষের মতো ঠেকল। আমি চেঁতে গেলাম। রাগী স্বরে বললাম,
“এনাফ, অভ্র! অনেক বলেছো তুমি। শোনো, ওনার নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। কারণ, উনি মহৎ। আর, রইলো বাকী নিজের বউকে তার প্রেমিকের হাতে তুলে দেওয়ার কথা? সেটা উনি এজন্যই করছেন, বিকজ হী লভ্স মি! এন্ড, আই লভ্ ইউ। তোমার সাথে আমি সুখে থাকব। আর, আমার সুখে সে খুশি হবে। এটা ভেবেই সে আমাদের এক হতে সাহায্য করছে। ভুলে যেও না, তার জন্যই তুমি আমাকে পাচ্ছো। আর, যার জন্য তুমি আমি এক হতে যাচ্ছি, তুমি তাকে নিয়ে এসব বলছো? আমি এটা আশা করিনি কখনো। সব বাদ দিলেও, সে তো তোমার শিক্ষক ছিলেন একসময়। রাইট? তো, তার প্রতি এতটুকু সম্মান তোমার রাখা উচিত ছিল না, অভ্র? আমি সত্যিই বাকরুদ্ধ!”

আমার এতগুলো কথায় অভ্র নিজের ভুল বুঝলো কিনা কে জানে? বুঝলাম না আমি তা! তবে, সে মৃদু স্বরে বলল,
“আ’ম সরি। আমি আসলে এতসব ভেবে বলিনি৷ কিন্তু, তুমি একটা জিনিস চিন্তা করো। স্যারের জায়গায় তুমি হলে, কখনো নিজের জিনিস কাউকে দিতে?”

অভ্রর এই কথাগুলো আমার মন ও মস্তিষ্কে একত্রে আ/ঘাত হানলো৷ আচমকাই আমার মনে পড়লো প্রীতি ও তানহার কথা। আমি চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো, ইব্রাহীমের মুখ। মনটা চেঁচিয়ে বলল,
“নাহ্! কখনো দিতাম না। দিবও না। আমার জিনিস শুধুই আমার।”

আমি চোখ খুলে ফেললাম। লম্বা করে শ্বাস নিলাম। অভ্রকে মৃদু স্বরে বললাম,
“পরে কথা বলছি, অভ্র।”

উত্তরে অভ্র বলল,
“রাগ করেছো?”

আমি ছোট্ট করে বললাম,
“না।”

তারপরে, অভ্রকে প্রতিত্তোর করার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কে/টে দিলাম। আর, ফোনটাকে ছুঁড়ে মা/রলাম বিছানায়। তখনই দরজায় আবার টোকা পরলো। ওপাশ থেকে উনি শুধালেন,
“আসবো?”

আমি ছোট্ট করে বললাম,
“আসুন।”

উনি দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন। তারপর, এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরালেন। বিছানায় পরে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে শুধালেন,
“কোনো সমস্যা?”

আমি ওনার থেকে চোখ ফেরালাম। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম,
“না।”

কে জানে, উনি আমার সেই মিথ্যা হাসিটা বুঝলো কিনা! তবে, বেশ কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইলো আমার মুখপানে। নিচে তাকিয়ে থেকেও যা আমার চোখ এড়ালো না। কিছুটা সময় দু’জনের নীরবতায় পেরিয়ে গেল। তারপর, উনি আলমারির দিকে যেতে নিয়েও ফিরে এলেন। ফিরে এসে আমার ঠিক সামনে এক হাঁটু ভাজ করে বসে পরলেন। আমি চমকে পেছনে সরে যেতে নিতেই উনি আমার চোখের দিকে তাকালো। ইশশ্, কি সুন্দর, কি মায়াবী সেই দৃষ্টি! প্রতিবারের মতো এবার আমি কেঁপে উঠলাম না। তবে, থমকে গেলাম। স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি দৃষ্টি ফেরালেন। দু’হাতে একের পর এক কুঁচিগুলো ধরলেন। তারপর, এলোমেলো কুঁচিগুলোও সমান করে নিচে তাকিয়েই আমায় বললেন,
“কোমড় থেকে কুঁচিগুলো বের করে সবগুলো মাথা সমান করে ধরে তারপর গোঁজো।”

ওনার কথামতো কুঁচিগুলো বের করলাম। নিচ থেকে এলোমেলো থাকা কুঁচিগুলোকে উনি সমান করে দিতে সবগুলো কুঁচিকে একত্রে ধরে তারপর আবার কোমড়ে গুঁজে নিলাম। কুঁচিগুলো কোমড়ে গোঁজা হতেই উনি উঠে দাঁড়ালেন। আমিও তাকিয়ে দেখলাম, কুঁচিগুলো কি সুন্দর ভাজ করে পরে আছে। কয়েক মিনিটের জন্য কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা ভুলে গেলাম। উনি এগিয়ে গেলেন আলমারির দিকে। আলমারি খুলে কিছু একটা খুঁজছেন। যা দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কী খুঁজছেন?”

উনি আগের মতো খুঁজতে খুঁজতেই বললেন,
“কালো পাঞ্জাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না।”

আম কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম। এলোমেলো করা কাপড়গুলো সরিযে নিচ থেকে স্ত্রি করা পাঞ্জাবিটা নিয়ে তার হাতে দিলাম। বললাম,
“এভাবে কাপড় এলোমেলো করে খুঁজলে পাবেন? গোছানো অবস্থাতে দেখলে অল্পতে পেয়ে যেতেন।”

কথা শেষ করে আমি ফিরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুল টেনে বসলাম। ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে স্নো-টা নিয়ে মুখে দিয়ে কাজলটা তুলে নিলাম। চোখে কাজল টানতে গিয়ে খেয়াল করলাম, উনি তখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি আয়নার ভেতরই ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, “কী?” উত্তরে উনি মুচকি হেসে মাথা নাড়লেন। তারপর, সেখানে দাঁড়িয়েই গায়ে থাকা শার্টটা খুলে পাঞ্জাবিটা পরলেন। ওনাকে শার্ট খুলতে দেখেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিজ কাজে মনোযোগী হলাম। চোখে কাজল টেনো, ঠোঁটে লিপস্টিক দিলাম। তারপর, চুড়িগুলো নিয়ে একে একে হাতে পরে নিলাম। এরপর, ঝুমকো জোড়া তুলে কানে দিলাম। সব শেষে চুলে চিরুনি দিয়ে আয়নায় তাকাতেই দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলাম। উনি এগিয়ে এলেন। বিছানার ওপর থেকে টিপের পাতাটা নিয়ে ওখান থেকে একটা টিপ এনে আমাকে পরিয়ে দিলেন। বললেন,
“শূণ্যতা এবার পূর্ণ হলো।”

আমি ওনার দিকে চোখ তুলে তাকালাম। উনি আমাকে বসিয়ে রেখে আবার বিছানার কাছে গেলো। সেখানে থাকা আলতা আর নুপুর নিয়ে ফিরে এলো। তখনকার মতো আমার সামনে বসে পরলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উত্তরে হাত বাড়িয়ে আমার পা ছুঁলো। আমি চমকে উঠলাম। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল শীতল এক অনুভূতি। বুকটা বুঝি কেঁপে উঠলো? কাঁপলো হাত-পা’ও। কিন্তু, ওনার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। উনি গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার দু’পায়ে আলতা পরিয়ে দিলেন। তারপর, আলতায় রাখা পা জোড়ায় রিনঝিন শব্দ তোলা নুপুর জোড়া পরিয়ে দিলেন। সবশেষে আমার চোখের দিকে তাকালেন। যেই দৃষ্টি কোনো সাধারণ দৃষ্টি ছিল না। যা ছিল ইচ্ছে পূরণের আনন্দের দৃষ্টি। যেই দৃষ্টিতে খুশি ছিল। হাসি ছিল। মনে হচ্ছিল যেন তা কথা বলছে! দৃষ্টিও এভাবে কথা বলে বুঝি? কি জানি? উত্তর পেলাম না। তবে, ওনার এতটুকু কাজে আমি ভীষণ মুগ্ধ হলাম। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম তার আনন্দময় খুশির দৃষ্টিতে! ডুবে গেলাম অনন্ত এক মায়ায়!

~চলবে…?

(#বিঃদ্রঃ_১ কাহিনী আরেকটু আগাতে চেয়েছিলাম আজ। তবে, লিখতে লিখতে পর্বটা অলরেডি ২৩৩০ শব্দ হয়ে গিয়েছে। আরও বড় করলে যারা লাইট থেকে পড়ে, তাদের সমস্যা হতো। তাদের কথা ভেবে আজকের পর্বটা এখানেই শেষ করা। হ্যাপি রিডিং..

#বিঃদ্রঃ_২ পাঠকমহল কাদের একত্রে দেখতে চাচ্ছেন? ইব্রাহীম-লামিয়া নাকি অভ্র-লামিয়া। অবশ্যই জানাবেন। ধন্যবাদ.. 🖤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here