আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব- ২৬
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤
________________
সকাল আটটা। তেমন একটা বেলা হয় নি। তবুও শাহিনুজ্জামান সাহেবের বাড়িতে ব্যস্ত পদচারণ। এ বাড়িতে সকাল আটটাকে বলা যায় দিনের ব্যস্ততম সময়। এই সময়টাতে বাড়ির কাজহীন মানুষগুলোর মাঝেও একধরনের সূক্ষ্ম ব্যস্ততা জেগে ওঠে। হয়তো বা নিজেকে কর্মণ্য প্রমাণ করার জন্যই তাদের এই ব্যস্ততার বাড়াবাড়ি। নিশ্চুপ খাবার টেবিলে চামচের টুনটাং ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ নেই। আনিমুল সাহেব গম্ভীর মুখে খাবার চিবুচ্ছেন। উনার এই গাম্ভীর্যতা যেন বাড়ির প্রত্যেকের মাঝেই ছড়িয়ে পড়েছে। চারপাশে থমথমে ভাব। সবাই যেন গাম্ভীর্যতার উন্মাদনায় মত্ত হয়েছে। এমন এক গাম্ভীর্যপূর্ণ সময়ে হঠাৎই চঞ্চল হয়ে উঠলো শুভ্রতার মুঠোফোন। খাবার ঘরের শীতল পরিবেশটাতে ছেদ ঘটিয়ে ক্রমেই বিকট শব্দে বেয়ারা হয়ে উঠলো সেই ফোন। হঠাৎ ফোনের শব্দে চমকে উঠলো শুভ্রতা। পরমুহূর্তেই তুমুল অস্বস্তি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। টেবিলের সবার দৃষ্টিই এখন তার ওপর। শুভ্রতা ফোনটা নিয়ে ওঠে যাবে নাকি আগের মতোই বসে থাকবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। কিছুক্ষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে ফোনটা সাইলেন্ট করে অপরাধী দৃষ্টিতে আবারও খাবারে মনোযোগ দিলো। কিন্তু খাবারের একটা দানাও গলা ভেদ করে পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছালো না। সব খাবারই যেন আটকে আটকে যেতে লাগলো গলায়। দু’দিন যাবৎ শুভ্রতার ঘুমটা বেশ বেড়েছে। গত দু’মাসে যে নির্ঘুম রাতগুলো কাটিয়েছে তা যেন এবার সুদে-আসলে মিটিয়ে নিচ্ছে সে। এশার নামাযটা কোনোরকম শেষ করেই ঘুমে ঢুলু ঢুলু করে তার চোখ। সাদাফ সারাদিন ব্যস্ত থেকে শুভ্রতাকে ফোন দেয় রাত ন’টা দশটার দিকে। আর ততক্ষণে শুভ্রতা ঘুমের রাজ্যের ব্যস্ত পথিক। কাল রাতেও ঠিক তাই হয়েছে। এশার নামাজ শেষ করে, ঘুমের সাথে তুমুল যুদ্ধ করে জেগে থাকার চেষ্টা করেছিলো শুভ্রতা। কিন্তু শেষ রক্ষাটা হয় নি। সাদাফের ফোন আসার আগেই কখন যে ঘুমের সাগরে ডুবেছে বুঝতেই পারে নি। সকালে ঘুম থেকে ওঠে মোবাইলে ’10 missed calls’ দেখেই আৎকে উঠেছিলো শুভ্রতা। সাদাফ সাধারণত দু’বারের বেশি কল করে না। দু’বারে রিসিভ না হলে আগামী দু-তিন ঘন্টার মাঝে আর কল করে না সে। আর সেই সাদাফ আজ দশবার কল করেছে ? কিছুটা বিস্ময় আর কিছুটা মন খারাপ ভাব নিয়ে তাড়াহুড়ো করে সাদাফকে ফোন লাগিয়েও তেমন একটা লাভ হয় নি শুভ্রতার। সাদাফ ফোন তুলে নি। মা আর ভার্সিটি উভয়ের তাড়ায় পড়েই ফোনের অপেক্ষা না করে ঝটপট তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে বসেছিলো সে। আর ঠিক এই এখনই সাদাফের কল করার সময় হলো। শুভ্রতা অস্বস্তিতে কাঁচুমাচু করে আরেকবার স্ক্রিনের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ খাবার নাড়াচাড়া করে প্লেটটা ঠেলে দিয়ে বললো,
—” আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে মা। এখন আর খাবো না। ক্যাফিটেরিয়া থেকে ভাত খেয়ে নিবো, প্রমিস।”
এটুকু বলে, রাদিবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ব্যাগ হাতে ছুটে বেরিয়ে গেলো শুভ্রতা। রাস্তায় রিক্সার সন্ধান করতে করতে সাদাফকে ফোন লাগালো সে। কিন্তু আবারও সেই একই সমস্যা, সাদাফ ফোন ধরলো না। শুভ্রতার এবার বেশ বিরক্ত লাগছে। সাদাফ কি ব্যস্ত বলে ফোন তুলছে না? নাকি ইচ্ছে করেই এমনটা করছে সে? শুভ্রতা কপাল কুঁচকে রিক্সায় চেপে বসলো। নিজের প্রতিই প্রচন্ড বিরক্ত সে। সেই সাথে সাদাফের প্রতিও। সবসময় অসময়ে কেন ফোন দেয় ছেলেটা? ভার্সিটি পৌঁছে গেইটের কাছেই পুষ্পিদের সাথে দেখা হলো শুভ্রতার। বান্ধবীদের দেখে হালকা হাসার চেষ্টা করতেই হঠাৎ থমকে গেলো সে। শুভ্রতাকে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ভ্রু কুঁচকালো অর্পন। শুভ্রতাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
—” কি রে? হ্যাং হয়ে গেলি নাকি? ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, জলদি চল।”
শুভ্রতা এক চুল পরিমাণও নড়লো না। শুভ্রতাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকালো পুষ্পি। ভার্সিটির মেইন গেইটের পাশে, ছোট্ট চা স্টলটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। নীল শার্ট, কালো প্যান্ট, সাদা-কালো চেইক টাই, চোখে সানগ্লাস….একদম ফর্মাল ড্রেসআপে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। ঠোঁটে হালকা-মৃদু হাসি। পুষ্পি ছেলেটি থেকে চোখ সরিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে বললো,
—” চিনিস ওই ছেলেকে?”
পুষ্পির ইশারায় অর্পন আর তনয়াও ফিরে তাকালো। অর্পন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করে নিয়ে বললো,
—” ওই ব্লু শার্টের কথা বলছিস? ভালোই তো দেখতে। এটা আমার ফোর্টি থ্রী নাম্বার ক্রাশ হতেই পা… ”
এটুকু বলেই থেমে গেলো অর্পন। চোখ বড় বড় করে আরেকবার সাদাফকে দেখে নিয়ে চট করেই শুভ্রতার দিকে তাকালো অর্পন। সন্দেহী গলায় বললো,
—” শুভ্রতা!!! এটাই কি ভাইয়া?”
পুষ্পি কুঁচকানো কপাল মুহূর্তেই সোজা হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” সাদাফ ভাই?”
শুভ্রতা কোনো জবাব দেওয়ার আগেই তাদের দিকে এগিয়ে এলো সাদাফ। শুভ্রতার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বললো,
—” ফোন দিচ্ছিলাম।”
শুভ্রতা মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বললো,
—” সরি!”
সাদাফ-শুভ্রতার এই নিচু স্বরের অল্প কথাগুলোই গিলে খাচ্ছিলো বাকি তিনজন। ওদের তিনজনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ্রতা অস্তিত্বতে পড়লেও সাদাফ মৃদু হাসলো। ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” হ্যালো?”
অর্পন উত্তেজিত হয়ে বললো,
—” হ্যাঁ হ্যাঁ হাই। কেমন আছেন ভাইয়া? আমার নাম অর্পি ফেরদৌসী। সবাই অর্পন বলেই ডাকে। আপনিও অর্পনই ডাকতে পারেন। ভাইয়া? আই মাস্ট ছে,আপনি কিন্তু দেখতে মাশাআল্লাহ। শুভির সাথে দারুণ মানিয়েছে।”
অর্পনের এতো কথার তোড়ে হেসে ফেললো সাদাফ। ছোট্ট করে বললো,
—” থেংকিউ অর্পি।”
পুষ্পি হাসিমুখে বললো,
—” আপনাকে এর আগেও কোথাও দেখেছি ভাইয়া। কিন্তু কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না।”
পাশ থেকে ফট করেই বলে উঠলো তনয়া,
—” রবীন্দ্র সরোবরে। তুই যে ঝগড়া করলি সেদিন…”
মুহূর্তেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো পুষ্পির। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বললো,
—” শুভি? তাহলে সেদিন ভাইয়ার কথা আমাদের বলিস নি কেন তুই?”
শুভ্রতা এবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। সাদাফের ঠোঁটে মৃদু হাসি। বান্ধবীদের মধ্যকার এই ঝামেলাতে বেশ মজাই পাচ্ছে সে। সাদাফকে এভাবে হাসতে দেখে আরো একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো শুভ্রতা। আমতা আমতা করে বললো,
—” না। মানে…আসলে…তখন..”
অর্পন ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” তখন কি? চিনতিস না ভাইয়াকে? কিন্তু তুই তো বলেছিলি শেফা আপুর বিয়ের পরদিন থেকেই উনার প্রেমে পড়ে গেছিস।”
অর্পন পরিষ্কার মনে কথাটা বললেও অর্পনের এই অতি স্বচ্ছ কথাটা শুভ্রতার তেমন একটা ভালো লাগলো না। ক্রমেই অর্পনকে কষে চড় মারার তীব্র ইচ্ছে জাগতে লাগলো তার। এই মেয়েটা মুখ খোলা মানেই শুভ্রতার মান-সম্মান শেষ। এক্কেবারে ধ্বংস। সেদিন যা একটু মানসম্মান বাকি ছিলো আজ তার তিল পরিমানও রাখতে দিলো না এই মেয়ে। শুভ্রতার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে, তাকে বাঁচাতেই বলে উঠলো পুষ্পি,
—” সেদিন জানলে এমন একটা বাজে পরিস্থিতি তৈরিই হতো না ভাইয়া। আপনিই যে শেফা আপুর দেবর জানতামই না আমরা।”
সাদাফ মৃদু হেসে বললো,
—” না জেনেই ভালো হয়েছে। নয়তো গালি বোধহয় আরেকটু বেশিই খেতে হতো।”
সাদাফের কথাটা ঠিক বুঝতে পারলো না পুষ্পি। কনফিউজড হয়ে বললো,
—” জ্বি ভাইয়া?”
সাদাফ হেসে ফেললো। উত্তর না দিয়ে বললো,
—” আপনাদের বান্ধবীকে দরকার। অনুমতি থাকলে তাকে কি নিয়ে যেতে পারি? ”
অর্পন মজার ছলে বললো,
—” শুধুই তাকে? শালিকা তিনজনকে কি চোখে পড়ে না? আমরা কি আপনার ‘তার’ থেকে কম সুন্দরী নাকি ভাইয়া?”
সাদাফ হেসে বললো,
—” কম সুন্দর কিনা বুঝতে পারছি না। তবে, আপাতত চোখে পড়ছে না। আপনাদের বান্ধবী যেদিকে আমার চোখও সেদিকে। একদম রিজার্ভ। অন্যকিছু দেখার সুযোগ নেই। এবার কি নিয়ে যেতে পারি? ”
অর্পন হেসে বললো,
—” ওহহো। আচ্ছা নিয়ে যান, নিয়ে যান। অনুমতি দেওয়া হলো। তবে আমাদের ট্রিটের কি হবে?”
—” অফিস টাইম। অন্য একদিন, অবশ্যই। আজ বরং আসছি। শুভ্রতা? চলো।”
কথাটা বলে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলো সাদাফ। শুভ্রতা ওর পিছু নিতেই ডান হাতটা টেনে ধরলো পুষ্পি। শুভ্রতা আৎকে উঠে বললো,
—” কি সমস্যা?”
—” এই? সাদাফ ভাই ওই কথাটা কেন বললো রে? বেশি গালি মানে?”
শুভ্রতা নিরুৎসাহিত দৃষ্টিতে তাকালো। মৃদু গলায় বললো,
—“সেদিন যে মহা সুন্দর সুন্দর কথাগুলো বলেছিলি দু’জনে। তার সবটাই ফোনের ওপাশ থেকে শুনেছেন তোদের সাদাফ ভাইয়া। মান-সম্মান শেষ করেছিস একদম। ছাড় এবার।”
এই কথাটা বলেই তাড়াতাড়ি হেঁটে সাদাফের পিছু নিলো শুভ্রতা। পুষ্পি কিছুক্ষণ ‘হা’ করে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
—“হোয়াটটট!”
লজ্জায় এবার থেকে সাদাফের সামনেই যেতে পারবে না সে। ছি! ছি! কি লজ্জা.. কি লজ্জা। না জানি সাদাফ তাকে নিয়ে কত কি ভাবছে। উফফ! পুষ্পির এই টেনশনের মাঝেই উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো অর্পন,
—” এই পুষি? সাদাফ ভাই কি কথা মেপে মেপে বলে নাকি রে? কেমন নিরামিষ নিরামিষ লাগে। তবে, কথাবার্তা সুন্দর। শুভ্রতার চয়েজটা দারুন কিন্তু সমস্যা হলো ব্যাটা কথা কম বলে। শুভ্রতার বিয়ের পর ভাইয়ার সাথে আড্ডা দেওয়া হয়ে উঠবে না রে।”
পুষ্পি বিরক্ত চোখে তাকালো। রাগ নিয়ে বললো,
—” তুই আসলেই একটা গবেট। তোর মাঝে কি সত্যিই ‘সেল্ফ রেসপেক্ট” নামক কোনো সফটওয়্যার নেই? বিয়ের পর আড্ডা দিতে পারবি কি না সেই টেনশনে মরে যাচ্ছিস অথচ তোর দেওয়া সব গালি ভাইয়া শুনে ফেলেছে তাতে তোর কোনো টেনশন হচ্ছে না। অদ্ভুত! ”
পুষ্পির কথায় দুঃখী দুঃখী চোখে তাকিয়ে রইলো অর্পন। যা গালি দেওয়ার তা তো দিয়েই ফেলেছে, সেটা নিয়ে এতো টেনশন করার কি আছে বুঝতে পারছে না অর্পন। আর তাছাড়া, সাদাফ বুঝবে কিভাবে ওটা অর্পনই ছিলো? তনয়াও তো হতে পারে অথবা প্রেমা? এই পুষ্পিটা না বড্ড বোকা।
___________________
—” তুমি আমার প্রেমে পড়বে জানতাম কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি প্রেমে পড়ে যাবে তা একদমই বুঝতে পারি নি আমি। নট বেড।”
কথাটা বলে হাসলো সাদাফ। সাদাফের এই একটা কথাতেই লজ্জা যেন বহুগুণ বেড়ে গেলো শুভ্রতার। দু’জন দু’জনের অনুভূতি জানার পর আজই তাদের প্রথম দেখা। তারওপর এতোটা কাছাকাছি বসে আছে দু’জনে। রিক্সার প্রতিটি কম্পনেই সমান তালে কেঁপে উঠছে শুভ্রতা। সাদাফের গায়ের সাথে গা লাগতেই লজ্জায় মিঁইয়ে যাচ্ছে সে। এই এতো এতো লজ্জার মাঝে সাদাফের এই কথাটায় যেন দিশেহারা হয়ে পড়লো শুভ্রতা। এই লজ্জা থেকে বাঁচতে একবার রিক্সা থেকে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছে তো এবার অর্পনকে ধরে জবরদস্ত দোলায় দিতে ইচ্ছে করছে তার । শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও বলে উঠলো সাদাফ,
—” তোমার বান্ধবীগুলো আমায় কিন্তু বেশ সুবিধা করে দিলো। কত কত গোপন কথা জানিয়ে দিলো। আমার বউ যে আমার প্রেমে মত্ত হয়ে সুইসাইড করার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলো সেটা তো ওদের উপকারেই আমার জানা।”
শুভ্রতা এবার রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। রাগ আর লজ্জায় গাল আর নাকটা একদম টকটকে লাল হয়ে আছে তার। সাদাফ সামনের দিকে তাকিয়েই মিটমিট হাসতে লাগলো। শুভ্রতা সাদাফের ডানপাশের শার্ট খামচে ধরে বললো,
—” আবার এমন সব কথা বললে রিক্সা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো। বার বার ইচ্ছে ইচ্ছে করে লজ্জায় ফেলেন আমায়।”
সাদাফ নিঃশব্দে হাসলো। ডান হাতটা শুভ্রতার পিঠের পেছন দিয়ে নিয়ে ওড়নার আঁচলটা টেনে কোলে তুলে দিয়ে বললো,
—” এবার নিয়ে দু’বার। ওড়নাটা সামলে বসো শুভ্রা। কোনো একটা ইন্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।”
শুভ্রতা ওড়না কোলে তুলে নিয়ে চুপচাপ মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। সাদাফও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলো। চলন্ত রিক্সার হালকা বাতাসে শুভ্রতার খোলা চুলগুলোর কিছুটা ঝাপটে পড়তে লাগলো সাদাফের মুখে। সাদাফ গভীর শ্বাস টেনে শুভ্রতার চুলের ঘ্রান নিলো। আড়চোখে শুভ্রতার দিকে তাকালো সে। ফর্সা মুখের তুলতুলে গাল আর ফর্সা নাকটা এখনও কেমন গোলাপী আভা ছড়াচ্ছে। আচ্ছা? শুভ্রতা কি জানে? তার লাজুক- অভিমানী মুখটা কতটা ভয়ঙ্কর সুন্দর? হয়তো জানে। জানে বলেই হয়তো কথায় কথায় এতো লজ্জা আর এতো অভিমান তার। সাদাফ একদৃষ্টিতে শুভ্রতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বুঝতে পারে এই মুখ, এই ঠোঁট, এই নাক….. এই গোটা মেয়েটাতেই অসম্ভব মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে সাদাফ। আর এই অসম্ভব মায়াটা দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। সাদাফের দৃষ্টির মাঝেই বেখায়ালি মনে চুল গোছালো শুভ্রতা। হঠাৎই ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো। শুভ্রতার এই ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোতেও অজানা এক ভালোলাগার শিহরণ জেগে উঠলো সাদাফের মনে। শুভ্রতা চুলগুলো কানে গুঁজে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,
—” আচ্ছা? আজ তোমার অফিস নেই?”
সাদাফ জবাব দিলো না। হয়তো প্রশ্নটা তার কর্ণগোচর হলো না। তার দৃষ্টি, মন সবই আটকে গেলো শুভ্রতার চিকন ওষ্ঠদ্বয়ে। সাদাফের উত্তর না পেয়ে বড় বড় চোখদুটো মেলে তারদিকে তাকালো শুভ্রতা। আবারও একই প্রশ্ন করলো,
—” অফিস নেই আজ?”
সাদাফ হেসে ফেললো। শুভ্রতার দিকে এভাবে আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে ছিলো অথচ মেয়েটা বুঝতেই পারলো না, এটা ভেবেই প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে তার। সাদাফকে নিঃশব্দে হাসতে দেখে অবাক হলো শুভ্রতা,
—” আশ্চর্য! হাসছো কেন? আমি হাসির মতো কিছু বলেছি নাকি? অফিস নেই আজ?”
—” না নেই।”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
—” সত্যিই নেই? ড্রেস আপ দেখে তো মনে হচ্ছে অফিসের জন্য তৈরি হয়েছো। তাছাড়া আজ তো কোনো ছুটির দিনও নয়। তবে?”
সাদাফ হেসে বললো,
—” আজ পাগল হওয়ার দিন তাই অফিস নেই। পাগল হওয়ার দিনে কেউ অফিসে যায় না। যেতে নেই।”
শুভ্রতা বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” মানে? পাগল হওয়ার দিন মানে?”
—” পাগল হওয়ার দিন মানে পাগল হওয়ার দিন। এখানে এতো মানে টানে নেই শুভ্রা।”
শুভ্রতা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো খানিকক্ষণ। তার কৌতূহল আর বিস্ময়মাখা চমৎকার চোখদুটো সাদাফের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে নেশাময় মদক বলে বোধ হতে লাগলো। সেই সাথে একরাশ বিস্ময়ও চেপে ধরতে লাগলো তাকে। আজ হয়তো সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছে সাদাফ। নয়তো এমন একটা অদ্ভুত কাজ কখনোই করতো না সে। সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যই বাসা থেকে বেরিয়েছিলো সে। কিন্তু বাসা থেকে বের হয়েই কি হলো তার, কে জানে? হুট করেই শুভ্রতাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করতে লাগলো। একদম কাছ থেকে দেখার সেই অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছেটা অফিস যাওয়ার মতো দরকারি কাজটাকেও চট করেই হারিয়ে দিলো। দায়িত্ববান সাদাফ এই প্রথম ছুটি ছাড়া অফিস মিস দেওয়ার মতো মারাত্মক কাজটা করে ফেললো। সত্যিই কি মারাত্মক? সাদাফের ছুটন্ত ব্রেন চট করেই উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ সত্যিই মারাত্মক।’
#চলবে…