আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব- ২৮

0
1670

# আরশিযুগল প্রেম❤
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤
# পর্ব- ২৮

________________

দিনটা শনিবার, অফিস ছুটি। বিছানায় কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে সাদাফ। সকাল সকাল আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে আজ। বৈশাখের প্রথম দিনেই প্রকৃতির কালবৈশাখী রূপ। সিলিং ফ্যানটা দ্রুত ঘুরছে। চারপাশটায় চাপা ঠান্ডা ভাব। মাঝরাত পর্যন্ত ফোনে কথা বলায় ঘুমের রেশটা এখনও কাটে নি সাদাফের। শরীরটা কেমন ম্যাচম্যাচ করছে। তার সাথে মাথাটাও কেমন ভারি ভারি ঠেকছে। মাথার ভিতর দিকটাই একধরনের নীরব ব্যাথা ধপধপ করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছে সেই ভোররাত থেকে। সাদাফ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে পাশ ফিরে শুলো। প্রায় সাথে সাথেই কোকিলের মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো কানে। দু’বারের মাথায় কাঁথা সরিয়ে সচেতন চোখে তাকালো সাদাফ। নিজের অজান্তেই কপালটা খানিক কুঁচকে এলো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে বসলো সাদাফ। বালিশের পাশে থাকা ফোনটা তুলে নিয়ে সময় দেখলো —- ৭ঃ২০। বিছানা থেকে নেমে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার সময়টুকুতে একটা কথায় মনে করার চেষ্টা করলো সাদাফ, ‘এতো সকালে কারো কি আসার কথা ছিলো আজ?’ কুঞ্চিত কপালে দরজাটা খুলতেই বিস্মিত হলো সাদাফ। কুঁচকানো কপাল সিথিল হয়ে এলো মুহূর্তেই। বিরক্তিটা উবে গিয়ে চোখে-মুখে ফুটে উঠলো নিদারুন ভালো লাগা আর কৌতূহল। সাদাফকে এভাবে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে লাজুক হাসলো ওপাশের মানুষটি। হাস্যোজ্জল কন্ঠে বললো,

—-” শুভ নববর্ষ।”

শুভ্রতার হালকা কন্ঠে বলা কথায় আরো একদফা মোহগ্রস্ত হলো সাদাফ। শুভ্রতার গায়ের লাল টকটকে শাড়ি, লাল ঠোঁট, মুক্তোর মতো ছোট্ট নাকফুল, হাতভরা চুড়ি সব মিলিয়ে যেন সদ্য বিবাহিত রমনী। শুভ্রতার ওষ্ঠ জোড়া আরো একদফা নড়ে ওঠায় সচেতন হলো সাদাফ। বিমোহিত মানুষের মতো দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো সে। শুভ্রতা নিঃসংকোচ পদযুগলে ভেতরে প্রবেশ করতেই শুভ্রতার পায়ের দিকে নজর গেলো সাদাফের। কাঁচা হলুদ রঙা পায়ে টকটকে লাল আলতা লাগিয়েছে শুভ্রতা। হাঁটার তালে তালে বাজছে রূপোর ভারি নুপুর। শুভ্রতা কৌতূহলী মনে ঘরের এদিকে ওদিক ঘুরে বেড়ালেও, সাদাফ আগের জায়গাটাতেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। বিস্মিয়টা কিছুতেই কমছে না তার। তারওপর শুভ্রতার এমন নববধূ সাজ! সাদাফ এমন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেও শুভ্রতা দ্বিধাহীন। শুভ্রতার চালচলন দেখে মনে হচ্ছে, এই ঘরটা তার বহুকালের চেনা। দীর্ঘদিন বাপের বাড়িতে থেকে হুট করেই স্বামীর ঘরে আসায় ঘরদোরটা একটু অগোছালো হয়ে আছে মাত্র। বাকিসব তার হাতেই সাজানো…তার মায়াতেই গড়া। শুভ্রতা খাবার টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে সাদাফের দিকে তাকালো। বিজ্ঞ গৃহিণীর মতো বললো,

—-” বাসায় বাজার টাজার কিছু আছে? অনেক বেলা হলো, রাঁধতে হবে তো!”

শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে হালকা হাসলো সাদাফ। শুভ্রতা আজ দু’হাত ভরে মেহেদী পড়েছে। ফর্সা হাতে মেহেদীর রঙটা বাড়াবাড়ি রকম সুন্দর লাগছে। সেদিকে দৃষ্টি রেখেই ছোট্ট করে উত্তর দিলো সাদাফ,

—-” থাকার তো কথা।”

কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে সাদাফের দিকে তাকালো শুভ্রতা। খোলা চুলগুলো হাত খোপা করতে করতে এদিক ওদিক তাকালো। বড় বড় চোখদুটো মেলে বললো,

—-” রান্নাঘর?”

সাদাফ হাসলো। হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় রান্নাঘর দেখালো। শুভ্রতা মিষ্টি হেসে সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

—-” দরজার বাইরে একটা ব্যাগ রেখে এসেছি। নিয়ে আসো না প্লিজ।”

সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,

—-” ব্যাগ? ব্যাগ কেন? তুমি কি একেবারে চলে এসেছো শুভ্রা?”

শুভ্রতা উত্তর দিলো না। সাদাফ দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার সামনেই মাঝারি সাইজের পাটের ব্যাগ। শুভ্রতাকে খেয়াল করতে গিয়ে ব্যাগটার ওপর একদমই নজর পড়ে নি সাদাফের। সাদাফ দ্রুত হাতে ব্যাগটা তুলে নিলো। দরজাটা লাগিয়ে ব্যাগে উঁকি দিতে দিতে বললো,

—-” তুমি আসার পথে বাজার করেছো নাকি শুভ্রা? এসবের কি দরকার ছিলো? আমাকে বলে রাখলেই তো হতো।”

কথাটা শেষ করে রান্না ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো সাদাফ। বাজারের ব্যাগটা চুলোর পাশে কেবিনেটের ওপর রাখতেই মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলো শুভ্রতা,

—-” বলে রাখলে কি অবাক হতে? তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই এতোকিছু করলাম। কিন্তু তুমি তো দিব্যি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছো। তোমার জায়গায় আমি হলে তো ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাক করে ফেলতাম।”

সাদাফ হেসে ফেললো। অবাক সে যথার্থই হয়েছিলো৷ এমনকি তার বিস্ময়ভাবটা পুরোপুরি কাটে নি এখনও। শুভ্রতাকে এই রূপে দেখে বুকটা ঢুপঢাপ ঢোল পিটিয়ে চলেছে সেই কখন থেকে। হাত-পায়ে মৃদু কম্পনও টের পাচ্ছে সে। কিন্তু সবকিছুই হচ্ছে শুভ্রতার দৃষ্টির বাইরে। সাদাফের বাসায় শুভ্রতার প্রথম আগমনটা যে এমন নাটকীয় হতে পারে তা যেন কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি সাদাফ। কিন্তু সমস্যা হলো, সাদাফের বিস্ময় বা রাগ কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় না। অতিরিক্ত বিস্ময়ে শীতল হয়ে আসে তার দৃষ্টি। একদমই নীরব হয়ে যায় তার আচরণ। যেমনটা হয়েছিলো মুরংদের গ্রামে অর্পনের মেয়ে ঘটিত ব্যাপারটা শোনার পর। সেদিনও বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলো সে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। শুভ্রতা বাজারের ব্যাগ থেকে এটা ওটা বের করছে। কাজলটানা চোখ দুটোর দু’পাশে পড়ে আছে দুই গাছি স্নিগ্ধ চুল। সাদাফ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। শুভ্রতার স্নিগ্ধ কোমল গালদুটোকে ছোঁয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে জাগছে তার। অভিমানে ফুলিয়ে রাখা ওষ্ঠদ্বয়ও কি ভীষণ টানছে তাকে। নিজেকে হঠাৎ করেই কেমন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। সামনে দাঁড়ানো নববধূবেশী মেয়েটা সত্যিই তার বিবাহিত স্ত্রী ভাবতেই বুকে অদ্ভুত এক মায়া উপচে পড়ছে। পৃথিবীটাকে, এই জীবনটা এবং এই মেয়েটাকে নিদারুণ সুন্দর এবং প্রশান্তির বলে বোধ হচ্ছে। আপ্লুত গলায় বলতে ইচ্ছে করছে, “শুনো মেয়ে, আমার পৃথিবীটা আমি তোমার নামে লিখে দেবো। আমার সব সুখ আর হাসিগুলোকে তোমার নামেই উড়িয়ে দেবো। তার পরিবর্তে একগুচ্ছ প্রশান্তির অনলে আমায় জ্বালিয়ে দিও প্লিজ।”

—-” কতক্ষণ আছো?”

সাদাফের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো শুভ্রতা। অভিমানী গলায় বললো,

—-” এটা আমার বরের বাসা। আমি যতক্ষণ ইচ্ছে থাকতে পারি। আপনার কোনো সমস্যা?”

সাদাফ মৃদু হেসে বললো,

—-” জ্বী না। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

শুভ্রতা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

—-” সমস্যা না থাকলে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আজ আমি রান্না করবো।”

সাদাফ আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এখান থেকে একপাও নড়তে ইচ্ছে করছে না তার। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই শুভ্রতাকে দেখতে ইচ্ছে করছে ঘন্টার পর ঘন্টা। শুভ্রতার নাক,চোখ,ঠোঁট,গাল সবাই যেন লাজুক ভঙ্গিতে ফিসফিসিয়ে চলেছে। ফিসফিস করে জানাতে চাইছে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি তার স্ত্রী। উহুম, শুধু পৃথিবী নয়। শুধু পৃথিবীর তুলনা দিয়ে মন ভরছে না সাদাফের। তার চোখে শুভ্রতা আরো কয়েকগুণ বেশি সুন্দর। আরো কয়েকগুণ বেশি লাজুক, প্রাণোচ্ছল।

ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আবারও রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়েছে সাদাফ। খুব অদ্ভুত কারণেই রান্না ঘরের মতো জায়গাটাও ভীষণ প্রিয় লাগছে তার। শুভ্রতার ঘেমে নেয়ে যাওয়া মুখ, ল্যাপ্টে যাওয়া কাজল আর শুভ্রতার গন্ধমাখা তাপটাও ভীষণ মিষ্টি লাগছে আজ। শুভ্রতা রান্নায় খুব একটা দক্ষ নয়। বাড়িতে নিজ হাতে এক গ্লাস পানি ঢেলেও খেতে দেখা যায় না তাকে। গরম তেল ছিঁটকে উঠতেই শুভ্রতার চমকে পিছিয়ে যাওয়াটা তার অদক্ষতারই পরিচয়।তার সেই অপটু হাতে মাছ ভাজি করা দেখেই হেসে ফেললো সাদাফ। ধীর পায়ে শুভ্রতার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। শুভ্রতা ভয়মাখা চাহনী নিয়ে মাছ উল্টাতে উল্টাতে বললো,

—-” কি চাই?”

সাদাফ শীতল কন্ঠে বললো,

—-” রান্না দেখি। দূর থেকে ভালো দেখা যাচ্ছিলো না তাই কাছে এসে দাঁড়ালাম। একটু শেখাবে আমায়?”

শুভ্রতা সন্দেহী চোখে তাকালো। তার জানা মতে রান্নাবান্নায় বেশ ভালোই দক্ষ সাদাফ, তবে? শুভ্রতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বামহাতটা শুভ্রতার কোমরের ওপর রাখলো সাদাফ। ডানহাতটা শুভ্রতার ডানহাতের ওপর দিয়ে খুন্তির ওপর রাখলো। ফিসফিসিয়ে বললো,

—-” আমিও একটু শিখি মহারাণী।”

প্রেমে পাগল প্রেয়সীকে পাগল করার জন্য এতটুকু ছোঁয়ায় যে যথেষ্ট তা হয়তো জানা ছিলো না সাদাফের। যার ফলশ্রুতিতে পুরোটা সময় প্রেয়সীর মুগ্ধদৃষ্টির শিকার হতে হলো তাকে। শুভ্রতা নিজের সম্পূর্ণটা ভর সাদাফের বুকের ওপর ছেড়ে দিয়ে মুগ্ধ নয়নে শুধু তাকিয়েই ছিলো। শুভ্রতার এমন পাগলামোতে মিটিমিটি হাসলো সাদাফ। কিন্তু তাতেও কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া হলো না শুভ্রতার। মাছভাজা শেষ করে সাদাফ যখন কথা বললো তখনই কেবল মোহভঙ্গ ঘটলো শুভ্রতার। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। সাদাফ মাথা চুলকে বললো,

—-” আর কিছু রান্না করবেন মহারাণী?”

#চলবে….

[ ছোট হয়েছে না? আমিও বুঝতে পারছি। আসলে, অনেকদিন বাদ পড়ায় সুরকাটা সঙ্গিতের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। হাত চলছিলোই না….আশা করছি আবারও নিয়মিত লিখে ঠিক হয়ে যাবে ব্যাপারটা। লিখবো লিখবো করে লেখা হচ্ছিল না। তাই ছোট মোট যা হলো তাতেই সূচনাটা করলাম। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here