# আরশিযুগল প্রেম❤
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤
# পর্ব- ৩২
________________
মন মোর মেঘের সঙ্গী
উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে,
শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম।।
ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে রবিবাবুর গানটাই গুনগুন করছিল শুভ্রতা। এক হাতে ছাতা তো অন্যহাতে জামার এক কোণা খামচে ধরে পা টিপে টিপে হাঁটছে সে। একবার পা পিছলে পড়লেই ক্যালেঙ্কারি হবে। সাদা জামায় কাঁদার দাগটাও বড় নাছোড়বান্দা। আরও কয়েক পা এগিয়ে গেইট পেরুতেই ফোন বেজে উঠল তার। শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে একবার ব্যাগের দিকে তাকাল। ফোন তুলবে কি তুলবে না তা নিয়ে তুমুলযুদ্ধ বেঁধে গেল মনে। শেষ পর্যন্ত ফোন না তোলার সিদ্ধান্তটাই দৃঢ় হল। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই ঝট করে মন পরিবর্তন করে ফেলল শুভ্রতা। সাদাফ ফোন করেছে ভেবে কাঁধ আর মাথা দিয়ে ছাতাটা চেপে ধরে, ব্যাগ থেকে ফোন বের করল শুভ্রতা। ছাতাটা উল্টে গিয়ে ডানপাশের খানিকটা ভিজেও গেল। শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে ছাতাটা সোজা করে ফোনের দিকে তাকাল। নাহ, সাদাফ নয় পৃথা ফোন করেছে। শুভ্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠল পৃথা,
—-” ছোট ভাবি? ছোট ভাবি?”
শুভ্রতা নির্মল হেসে বলল,
—-” শুনছি পৃথা। বল।”
—-” বলব কি গো? আমার তো রীতিমতো নাচতে ইচ্ছে করছে।”
শুভ্রতা হেসে ফেলল। মেয়েটা ভারি চঞ্চল। আর এই চঞ্চল মেয়েটার প্রতিই ধীরে ধীরে প্রগাঢ় এক মায়ায় জড়িয়ে পড়ছে শুভ্রতা। সাদাফ ফোন না দিলেও দিনে দু-তিনবার তার ফোন আসাটা যেন চাই-ই চাই। শুভ্রতা স্নেহভরা গলায় বলল,
—-” তাই নাকি? তা পৃথার নাচতে ইচ্ছে করছে কেন শুনি?”
পৃথা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-” ওমা! ভাইয়া তোমাকে বলে নি?”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকাল। চিন্তিত গলায় বলল,
—-” না তো। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা নাকি?”
পৃথা গম্ভীর হয়ে বলল,
—-“অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তুমি জান? আমাদের বাসায় রাজপুত্রের আগমন হয়ে গিয়েছে। ইয়াহু…কি যে আনন্দ লাগছে আমার।”
শুভ্রতা কপাল কুঁচকে বলল,
—-” মানে?”
—-” মানে হল, বড় ভাবির ছেলে হয়েছে। ভাবতে পারছ তুমি? এখন আমাদের বাসায়ও একটা বাচ্চা থাকবে। আমি সারাদিন কোলে নিয়ে থাকব। উফ! আমার তো ভাবতেই ভীষণ আনন্দ লাগছে।”
শুভ্রতা খুশি হয়ে বলল,
—-” তাই নাকি? দারুন খবর। বাবুর একটা পিক পাঠিও আমায়। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। খুব কিউট হয়েছে বুঝি?”
—-” খুব খুব খুব কিউট। ছবি কেন পাঠাতে হবে? তুমিই চলে আসো না ভাবি। এখন বাড়িতে সবাই আছে। মেজো ভাইয়া আর ভাবিও এসেছে। তোমার সাথে দেখাও হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি, সবাই মিলে অনেক অনেক মজা করব আমরা। এসো না প্লিজ, প্লিজ।”
শুভ্রতা হেসে বলল,
—-” কি যে বল না পৃথা!”
পৃথা কপট রাগ নিয়ে বলল,
—-” কেন? কি সমস্যা? ভাইয়া কালই চট্টগ্রাম আসছে। ভাইয়ার সাথে তুমিও চলে এসো না প্লিজ।”
—-” তা হয় না পৃথা। বাচ্চামো করো না।”
পৃথা আগ্রহ নিয়ে বলল,
—-” না হওয়ার কি আছে? ইচ্ছে থাকলে সব হয়। আমি এখনই ভাইয়াকে বলছি। বাই।”
পৃথার কথার পিঠে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কাটল পৃথা। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃষ্টির দিকে তাকাল। বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। তাড়াতাড়ি বাসায় না পৌঁছাতে পারলে ছাতাতে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। শুভ্রতা দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু রাস্তার প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদা পানিতে হাঁটার গতি স্বাভাবিকের থেকেও কমে এল। পৃথা কল কাটার পাঁচ/সাত মিনিটের মাথায় আবারও ফোন বাজল। শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে হাতা থাকা ফোনটির দিকে তাকাল। ঝটপট তুলে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে দুষ্টু গলায় বলে উঠল সাদাফ,
—-” তুমি নাকি শশুরবাড়ি যেতে চাও? সত্যি নাকি?”
শুভ্রতা অবাক হয়ে বলল,
—-” মানে?”
—-” সেটাই তো আমি জানতে চাইছি। মানেটা কি? সত্যিই যেতে চাও নাকি শশুরবাড়ি?”
শুভ্রতা কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলল,
—-” ধেৎ! ঢং কর না তো।”
সাদাফ হেসে বলল,
—-” ঢং কোথায় করলাম? সিরিয়াসলি জানতে চাইছি। পৃথা বলল, ভাবির বেবি দেখতে যেতে চাও। সত্যি যেতে চাও?”
শুভ্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” কি বলছ এসব? তা আবার সম্ভব নাকি? আমি আর তুমি ছাড়া কেউই জানে না যে আমি তোমার বউ। কি ভাববে ওরা?”
সাদাফ স্নিগ্ধ গলায় বলল,
—-” তারমানে তুমি যেতে চাইছ?”
—-” আরে আজব তো। আমি কখন বললাম যে যেতে চাইছি? তুমি আর পৃথা তো নিজেরাই আমার কথা বলে দিচ্ছ।”
সাদাফ শব্দ করে হাসল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
—-” সত্যিই যাবে শুভ্রা? আমার শহরে?”
শুভ্রতা অধৈর্য গলায় বলল,
—-” ভাই-বোন দু’জনেই এক। কিছু বলার সময় ভেবে বলে না। এটা কি আদৌ সম্ভব বল? ফ্যামিলিকে কিভাবে বুঝাবে?”
সাদাফ গাঢ় গলায় বলল,
—-” আমার শুভ্রাণী চাইলে সব সম্ভব।”
শুভ্রতা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-” তুমি সিরিয়াস?”
সাদাফ জবাব না দিয়ে হাসল। ঘোর লাগা গলায় বলল,
—-” পৃথার কথা শোনার পর থেকে অসভ্য ধরনের চিন্তা আসছে মাথায়। বারবার মনে হচ্ছে, ঢাকা-চট্রগ্রাম যেতে অনেকটা সময় পাশে পাব শুভ্রাকে। এর আগের বার তো জানতাম না যে এই শুভ্রাটাই আমার বউ হবে, তাই তেমন খেয়াল টেয়াল করি নি। কিন্তু এখন তো….”
এটুকু বলেই নিঃশব্দে হাসল সাদাফ। শুভ্রতা কিছুক্ষণের মাঝেই লজ্জায় রাঙা হল। দীর্ঘক্ষণ দু’জনেই চুপ থেকে নীরবতা ভাঙল শুভ্রতা। নিচু গলায় বলল,
—-” এটা সম্ভব নয়। বাসা থেকে কি বলে যাব? দিন গিয়ে তো দিন আসতে পারব না। তাছাড়া তুমিই বা বাড়িতে কি বলবে? গার্লফ্রেন্ড নিয়ে চলে এসেছ? কতটা বেহায়া ভাববে আমায়।”
সাদাফ সাথে সাথেই কোন উত্তর দিল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
—-” সেদিন তো চট্টগ্রাম থেকেই ফিরছিলে তাই না?চট্টগ্রামে কোথায় গিয়েছিলে?”
—-” মামুর বাসায়। আমার নানুবাড়ি চট্টগ্রাম।”
সাদাফ খুশি হয়ে বলল,
—-” তাহলে মামুর বাসাতেই চল। একসাথেই যাওয়া যাবে। স্টেশনে নেমে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব। পরশো রাতটা তোমার মামুর বাসায় থেকে সকালে উঠে আমাদের বাসায় চলে আসবে। ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বের হতে পারবে না? বা অন্যকোন ভাবে?”
শুভ্রতা খানিক ভাবল। মৃদু গলায় বলল,
—-” তুমি সিউর?”
—-” হঠাৎ খাপছাড়া হতে ভীষণ ইচ্ছে করছে শুভ্রাণী।”
শুভ্রতা হাসল। খুশিতে রাস্তাতেই লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে তার। সত্যিই সাদাফের সাথে এতোটা সময় কাটাবে সে? এতোটা? শুভ্রতা হঠাৎ করেই উপলব্ধি করল পৃথিবীটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে তার। এই বিরক্তকর কাঁদামাটি, ছ্যাতছ্যাতে দিন সবকিছুই কেমন প্রেমময় লাগছে, মাত্রাতিরিক্ত প্রেমময়!
___________________
খাবার টেবিলে বসে আছে সবাই। শফিক সাহেব দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করছেন। শাহিনুজ্জামান সাহেব কথার ফাঁকে হু হা করছেন। শুভ্রব বেশ আগ্রহ নিয়ে আলোচনায় যোগ দিয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, খাবারের থেকে শফিক সাহেবের কথাগুলোই বেশি গিলছে সে। এমন একটা জমজমাট পরিবেশে হুট করেই বলে উঠল শুভ্রতা,
—–” আমি চট্টগ্রাম মামুর কাছে যাব।”
শুভ্রতার এমন বাক্যে থেমে গেল সব শোরগোল। সবাই অবাক চোখে তাকাল। রাদিবা আহমেদ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—-” এমনিতে তো জোর করেও পাঠান যায় না। আজ হঠাৎ? ”
শুভ্রতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
—-” আগে যেতে ইচ্ছে করে নি বলে যে এখনও করবে না তেমন তো কোন কথা নেই মা। ঢাকার বাতাসটা ভীষণ ভারি ভারি লাগছে। তাছাড়া, এর আগের বারও এমন সময়েই চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম আমি। বর্ষায় চট্টগ্রামের পরিবেশটা দারুন লাগে।”
রাদিবা আহমেদ কিছু বললেন না। শুভ্রতা শখ করেই যদি যেতে চায় তাহলে বাঁধা দেওয়াটা সাজে না। তাছাড়া, উনি নিজেও কোন না কোনভাবে চট্টগ্রাম পাঠাতে চায়ছিল তাকে। দু’মাস পর যেহেতু বিয়ে সেহেতু ফারদিনের সাথে শুভ্রতার ঘনিষ্ঠ হওয়াটা জরুরি। রাদিবা আহমেদ নিজের মনোভাবটা চেপে রেখে বললেন,
—-” যেতে ইচ্ছে করলে যাবি। মানা করেছে কে?শুভ্রবকে নিয়ে রাতের ট্রেনে উঠে গেলে সকালের মাঝে ঠিক পৌঁছে যাবি।”
শুভ্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
—-” ভাইয়ার কথা কোথা থেকে আসছে? আমি একাই যাব।”
—-” একা একটা মেয়ে অতদূর যাবি? কক্ষনও না।”
—-” আশ্চর্য! আমি বাচ্চা নাকি? আমি যখন বলেছি একা যাব তো একাই যাব। নয়ত যাওয়া ক্যান্সেল। তোমার ছেলেকে সাথে নিলে ওর সাথে ঝগড়া করতে করতেই সময় কেটে যাবে আমার। বানর একটা।”
শুভ্রব মুখ ভেঙিয়ে বলল,
—-” তুই বললেই মনে হয় নেচে নেচে চলে যাচ্ছি আমি?”
রাদিবা কঠিন গলায় বলল,
—-” একদম না। একা তোকে পাঠাব না আমি। কখন কি বিপদ হয়, কে জানে?”
শুভ্রতা মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল,
—-” প্লিজ মা! এখান থেকে ট্রেনে উঠিয়ে দিবে না’হয়। আর চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে মামুর বাসা তো মাত্র দশ মিনিটের পথ। প্লিজ!”
রাদিবা খানিক ভেবে বললেন,
—-” আচ্ছা। শুভ্রব? কাল-পরশু গিয়ে ট্রেনের টিকেট কিনে আনিস তো।”
শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে বলল,
—-” কাল-পরশু নয়। আমি কালই যেতে চাই। টিকেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। টিকেট নাহয় আমিই কাটব।”
রাদিবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। হুটহাট মেয়ের এমন পরিবর্তনের কারণটা ধরতে চেষ্টা করছেন উনি। হঠাৎ করেই চট্টগ্রাম যাওয়ার এত কিসের তাড়া তার?
রুমময় পায়চারী করে সাদাফের সাথে ফোনালাপ করছে শুভ্রতা। কন্ঠটা ভীষণ উদ্বেগী শোনাচ্ছে তার,
—-” আম্মু তো ভাইয়াকেও টিকেট কাটতে বলে দিল। এবার কি হবে? আমাদের দু’জনের সিট তো আলাদা আলাদা জায়গায় হবে। একা একা অতদূর গিয়ে লাভ কি হবে আমার?”
শুভ্রতার এত চিন্তা দেখে হাসল সাদাফ। হাসিমুখেই বলল,
—-” এত অল্পতে কেন যে এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড় তুমি শুভ্রা।”
শুভ্রতা রাগ নিয়ে বলল,
—-” এটা অল্প?”
—-” আরে বাবা, আমায় বলতে তো দাও।”
শুভ্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,
—-” আচ্ছা বল।”
—-” আমি গোটা একটা কবিন বুক করেছি শুভ্রা। তোমার ভাইয়া টিকিট বুক করলেই বা কি হল, বল তো? তোমার ভাই যদি তুলে দিতে আসে তাহলে সিটে গিয়ে বসবে। তারপর নাহয় আমার কাছে চলে আসবে। সিম্পল।”
সাদাফের কথায় একঝাঁক অনিশ্চয়তা নিয়েও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শুভ্রতা। সাদাফ যেহেতু আছেই তার আর চিন্তা কিসের? শুভ্রতা বুক ভরে শ্বাস টেনে বিছানায় গা এলালো। আরও কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে ফোন রাখল সাদাফ। ঘড়ির কাটাও একের পর এক ঘর বদল করতে লাগল। দশটার ঘর থেকে এগারোটা, এগারোটার ঘর থেকে বারোটা কিন্তু শুভ্রতার চোখে ঘুমের দেখা মিলল না। উত্তেজনা আর খুশিতে সারাঘর লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সে। বার বার মনে হচ্ছে, এই ঘড়ি নামক যন্ত্রটিতে সন্ধ্যা ৭ টা বাজবে কখন? কখন?কখন কাটাবে সেই স্বর্ণালী প্রহর?
#চলবে..
(রি-চেইক করা হয় নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।)