# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব – ৪৭
—-” ‘আমি বিয়ে করতে চাইছি না’ কারণ হিসেবে এটুকুই কি যথেষ্ট নয়?”
ফারদিন হেসে বলল,
—-” না। যথেষ্ট নয়।”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
—-” কেন নয়?”
—-” কারণ, আপনার কারণটার পেছনে আস্ত একটা ‘কেন’ থেকে যায়। আপনি যদি সেই ‘কেন’ এর উত্তরটা দেন তাহলে হয়ত যথেষ্ট হবে।”
শুভ্রতা জবাব না দিয়ে সরু চোখে তাকাল। ফারদিন একটু নড়েচড়ে বসল। টেবিলে দু’হাত রেখে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,
—-” আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন না কেন? সবকিছুর পেছনেই একটা রিজন থাকে। আপনার সিদ্ধান্তের পেছনেও নিশ্চয় আছে।”
শুভ্রতা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল। ফারদিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” আমি বিবাহিত। আর একজন বিবাহিত মেয়ের অন্যকারোর সাথে বিয়ে সম্ভব নয়। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় তো কখনোই নয়।”
ফারদিন হালকা গলায় বলল,
—-” ও আচ্ছা। ”
ফারদিনের দায়সারা উত্তরে খুশি হতে পারল না শুভ্রতা। বিরক্তি নিয়ে বলল,
—-” ও আচ্ছা, মানে?”
ফারদিন মুচকি হেসে বলল,
—-” ও আচ্ছা মানে আমি আপনার কথাটা বুঝতে পেরেছি।”
—-” কথাটা যেহেতু বুঝতে পেরেছেন সেহেতু আমার সমস্যাটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ফারদিন সাহেব?”
—-” হ্যাঁ পারছি।”
—-” তাহলে কি আমি ধরে নিব আপনি বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছেন?”
—-” এমন কিছু ধরে নেওয়াটা বোধ হয় ভুল হবে। কেননা, এমন কিছুই আমি করছি না।”
শুভ্রতার কপাল কুঁচকে এলো। বিরক্ত হয়ে বলল,
—-” আশ্চর্য! সবকিছু জেনেও বিয়েটা আপনি ভাঙছেন না?”
ফারদিন হেসে বলল,
—-” জি না। ভাঙছি না।”
—-” কেন?”
—-” বিয়ে ভাঙার মত ভয়ংকর কিছু ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে না বলেই বিয়েটা ভাঙছি না।”
শুভ্রতা রেগে উঠে বলল,
—-” আমি অলরেডি ম্যারেড, এটা আপনার কাছে ভয়ংকর কিছু মনে হচ্ছে না?”
—–” না হচ্ছে না।”
ফারদিনের ঠান্ডা মাথার উত্তরে রেগে গেল শুভ্রতা। সামনে বসে থাকা মানুষটিকে ভয়ানক থেকে ভয়ানক কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। শুভ্রতা নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণে আনতে দুই হাতে মাথা চেপে বসে রইল। অতিরিক্ত রাগ নিয়ে কারো সাথে বিয়ে ভাঙার মতো গম্ভীর আলোচনা করা চলে না। আর প্রতিপক্ষ যদি হয় ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ তাহলে তো কখনোই না। শুভ্রতা মাথা চেপে ধরে বসে থাকা অবস্থাতেই পাশের চেয়ারটা টেনে ধপ করে বসে পড়ল অর্পন। ফারদিনকে হকচকিয়ে দিয়ে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল,
—-” আপনাকে তো যথেষ্ট ইয়াং দেখাচ্ছে। আরও পাঁচ/ছয় বছর পর বিয়ে করলেও বুড়ো বরের খাতায় পড়বেন বলে মনে হয় না। তাহলে বিয়ে-শাদির জন্য এতো নাচানাচি করছেন কেন? শিক্ষক মানুষদের কি এমন নাচানাচি মানায়?”
অর্পনের কথায় ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফারদিন। শুভ্রতাও মাথা তুলে গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল। ফারদিন বিস্ময় নিয়ে বলল,
—-” আপনি কে?”
অর্পন দাঁত বের করে হাসল। ডান কাঁধের চুলগুলো হাতদিয়ে উড়িয়ে দিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
—-” আমি অর্পন। পুরো নাম অর্পি ফেরদৌসী। ফেরদৌসী নামটা একটু ব্যাকডেটেট তাই না? নানাভাই রেখেছিলেন। আপনি আমায় অর্পন বলে ডাকতে পারেন। আই ডোন্ট মাইন্ড। কিন্তু এমন বিয়ে বিয়ে করে নাচানাচি করবেন তো আই রিয়েলি ডু।”
ফারদিনের বিস্ময় যেন এবার আকাশ ছুঁলো। ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-” জি?”
অর্পণ ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। সামনে রাখা গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে সম্পূর্ণটা শেষ করল। সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-” জি জি করার জন্য যথেষ্ট সময় আমাদের হাতে নেই ফারদিন সাহেব। দেখুন, বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা নয়। সারাটা জীবন একটা মানুষের সাথে কাটিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ানক চুক্তি হলো বিয়ে। এখানে জোরজবরদস্তি করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া চলে না। আর মেয়ে যদি অলরেডি ম্যারেড থাকে তাহলে তো কখনোই না। আপনি জেনেশুনে একজন ম্যারেড মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবেন কেন? শুভ্রতার ফোনে শুভ্রতা আর তার হাসবেন্ডের অনেক ক্লোজ পিকচার আছে। আই থিংক সেগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন, আপনি কতটা রং জায়গায় আছেন। দাঁড়ান দেখাচ্ছি।”
কথাটা বলে শুভ্রতার থেকে ফোন নেওয়ার জন্য পাশে ফিরতেই ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল ফারদিন,
—-” আমি দেখতে চাইছি না মিস.অর্পি ফেরদৌসী। এই মুহুর্তে আমার হাতে ছবি দেখার মতো ততটা সময় নেই। ছবিগুলো বরং বিয়ের পর সময় নিয়ে দেখা যাবে, কেমন?”
অর্পন চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাল। টেবিলে থাবা দিয়ে বলল,
—-” আজব মানুষ আপনি! আমরা কখন থেকে একটা কথা বুঝানোর চেষ্টা করছি আর আপনি বুঝতেই চাচ্ছেন না। মাথায় কি বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু নেই? আপনাকে আমার চরম বোকা বলে মনে হচ্ছে। আপনি টিচার কি করে হলেন বলুন তো? যে গর্দভে আপনাকে বিসিএস পরীক্ষায় পাস মার্ক দিয়েছে তাকে ধরে গুলি করা উচিত। একটা মেয়েকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি বিয়ে করার পর ছাত্রদের কি নৈতিকতা শেখাবেন, শুনি?”
অর্পণের কথার মাঝেই পিঠে চিমটি কেটে চুপ হওয়ার জন্য সতর্ক করে দিল পুষ্পি। অর্পণ পুষ্পির কথার তোয়াক্কা না করে গুলির বেগে কথা ছুঁড়তে লাগল। পুষ্পি আবারও চিমটি লাগাতেই, পুষ্পির হাত ধরে টেনে পেছন থেকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল অর্পন। নিজেকে শান্ত করে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে খানিকটা হাসার চেষ্টা করল। চোখ পিটপিট করে বলল,
—-” আচ্ছা, মাস্টার মশাই? তিনদিনের মাঝে বিয়ে করাটা কি খুব জরুরি আপনার জন্য? মানে জীবন-মরণ সমস্যা টাইপ কিছু?”
ফারদিন কপাল কুঁচকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। অর্পন উৎসাহ নিয়ে বলল,
—-” এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আই উইল গিভ ইউ আ গ্রেট এডভাইস। আর সেই এডভাইসটা হলো, আপনি শুভিকে রেখে পুষিকে বিয়ে করে নিন। বিয়ে যখন করবেনই তখনই সেকেন্ড হ্যান্ড কেন করবেন? পুষি একদম পিউর সিঙ্গেল। জিন্দেগিতে কোনো ছেলেকে পাত্তা দেয় নি। যদিও ছেলেরা ওকে দেখে একটু ভয়ই পায়। কিন্তু আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া, মেয়ে দেখতেও মাশাআল্লাহ। তো, কি বলেন? কবুল?”
অর্পণের কথা শেষ হতেই অর্পণের পায়ে লাথি মারল পুষ্পি। চোখ রাঙিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—-” বলদ কোথাকার। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হ তারপর তোকে দেখছি।”
পুষ্পির কথাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে দাঁত বের করে প্রশ্ন করল অর্পন,
—-” কবুল?”
ফারদিন হাসল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,
—-” আগে শুভ্রতার সাথে কবুল বলে নিই তারপর নাহয় আপনার ফ্রেন্ডের কথা ভাবব? আমি একটু বিজি আজ তাই উঠতে হচ্ছে। নাইস টু মিট ইউ অল।”
ফারদিনকে চলে যেতে দেখে তাড়াহুড়ো করে ওঠে দাঁড়াল শুভ্রতা। জোরালো গলায় বলল,
—-” আমার কথা শেষ হয় নি ফারদিন সাহেব। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না এবং আমি সিরিয়াস।”
ফারদিন একপলক শুভ্রতার দিকে তাকাল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” এই কথাটাই আপনার বাবাকে গিয়ে বলুন শুভ্রতা। হ্যাভ আ নাইস ডে।”
এটুকু বলেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল ফারদিন। শুভ্রতা পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকার পরও সাড়া পাওয়া গেল না। দু’হাতে মুখ চেপে চেয়ারে বসে পড়ল। অর্পন পুষ্পি শুভ্রতার দুই পাশে চেয়ার টেনে বসল। অর্পণ শুভ্রতার কাঁধে হাত রাখল। বলল,
—-” চিন্তা করিস না। আমরা নতুন কোনো রাস্তা ঠিক বের করব। এই মাস্টার তো তোর বিয়ের কোনো প্রমাণই দেখতে রাজি নয়। আ…”
অর্পণের কথার মাঝেই উঠে দাঁড়াল শুভ্রতা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বান্ধবীদের দিকে তাকাল। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
—-” তোদের কিছু করতে হবে না অর্পণ। ও ঠিকই বলে আমাকে আমার আবেগটা নিয়ন্ত্রণ করে বাবা-মাকে ফেইস করা উচিত। আমার কথাগুলো তাদেরকে বলা উচিত। মাকে সেদিন বলতে না পারা কথাগুলো এবার প্রকাশ করার সময় এসে গেছে অর্পণ। এবার সরাসরি বাবার সাথেই কথা বলব আমি। এসব লুকোচুরি আর ভালো লাগছে না আমার। একটুও না।”
পুষ্পি-অর্পণ শেষ খানিকটা সময় নিরুত্তর বসে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
______________________
ঘড়িতে দশটার ঘন্টা বাজছে। রুমময় পায়চারী করছে শুভ্রতা। দুশ্চিন্তায় সারা মুখ রক্তশূণ্য হয়ে আছে। বাবার সামনে বিয়ের কথাটা বলতে হবে ভাবতেই সারা শরীরে ঘাম ছুটছে। আচ্ছা? বিয়ের ব্যাপারটা শুনে বাবা কিভাবে রিয়েক্ট করবে? শুভ্রতাকে কি অকৃতঘ্ন, ধোঁকাবাজ ভাববে? বাবা কি খুব বেশি কষ্ট পাবে? শুভ্রতার গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। প্রতিবারের মত এবারও দরজা পর্যন্ত এসেও ফিরে গেল। কিছুক্ষণ বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে রইল। উলোটপালোট হাজারো চিন্তার পর সাহস নিয়ে শাহিনুজ্জামান সাহেবের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দু’বার বড় বড় দম নিয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখল শাহিনুজ্জামান সাহেব ফোনে কথা বলছেন। শুভ্রতা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শাহিনুজ্জামান সাহেবের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষারত অবস্থায় ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও শাহিনুজ্জামান সাহেবের কথাগুলো কানে এসে লাগল শুভ্রতার,
—-” ছেলেটা সারাদিন কোথায় থাকে, ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া করে কিনা একটু খবর নিস শফি। ছেলে-মেয়ে দুটোই তোকে খুব ভালোবাসে। সেদিন গায়ে হাত তোলায় নিশ্চয় খুব রেগে আছে ও? থাকারই কথা। তুই ওকে একটু চোখে চোখে রাখিস শফি।”
শুভ্রতার কান খাঁড়া হয়ে এলো। কপাল কুঁচকে দরজায় কান পাতল। ওপাশ থেকে রাদিবা আহমেদের কন্ঠ ভেসে এলো,
—-” কি বলল শফিক?”
—-” শুভ্রব শফির সাথেই আছে।”
শাহিনুজ্জামান সাহেব ভারি নিঃশ্বাস ফেললেন। আদ্র কন্ঠে বললেন,
—-” ছেলে-মেয়েরা আমায় ঘৃণা করে রাদিবা, তুমি কি বুঝো ?”
—-” ছি! কি বলছ এসব? ঘৃণা কেন করবে? ওরা তোমায় ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে।”
শাহিনুজ্জামান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। ছাঁদের দিকে চোখ রেখে বললেন,
—-” সান্ত্বনা বাণী শুনতে ভালো লাগছে না রাদিবা। মিথ্যা সান্ত্বনা দিও না।”
রাদিবা জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শাহিনুজ্জামান সাহেব মৃদু গলায় বললেন,
—-” শুভির গায়ে হাত তোলা তোমার উচিত হয় নি রাদিবা। মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে আর মেয়েরা ঘরের নূর। তাদের গায়ে হাত তুলতে নেই। রাদিবা? একটা বাবার জন্য সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত কখন হয় জানো? যখন সে নিজেই তার সন্তানের কষ্টের কারণ হয় আর সন্তানের চোখে নিজের জন্য…. ”
এটুকু বলে থামলেন শাহিনুজ্জামান সাহেব। রাদিবা ব্যস্ত হয়ে বললেন,
—-” তুমি এমনটা কেন ভাবছ বল তো? তুমি শুধু শুধু… ”
—-” রাদিবা তুমি নিজেও জানো যে, আমার মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যেখানে বাবা আর সন্তান দুজনের মাঝে একজনকে বেছে নিতে হচ্ছে। আমার বাবাকে আমি রাতদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে দেখেছি। আমাদের তিন ভাইয়ের জন্য কি অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন নিজ চোখে দেখেছি। আজ যদি বাবার ওয়াদাটা পূরণ না করি তাহলে হাশরের ময়দানে আমি বাবার সামনে কিভাবে দাঁড়াব রাদিবা? আমি তার কষ্টগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েও যদি বাবা মৃত মানুষ…. মৃত মানুষের আবার ওয়াদা কিসের বলে মুখ ফিরিয়ে নিই তাহলে আমি কেমন সন্তান? এটা শুধু আবেগ হলেও প্রশ্রয় দিতাম না রাদিবা। কিন্তু এটা শুধুই আবেগ নয়। সূরা বনী ইসরাঈল এ স্পষ্ট বলা হয়েছে ওয়াদা করলে তার পালন করো। আমি মসজিদের ইমামের সাথেও কথা বলেছি রাদিবা। যদি একটা পথ পাওয়া যায়, যদি একটা পথ পাওয়া যায় কিন্তু কোনো পথ মিলল না। সবার এক কথা, জীবদ্দশায় কেউ কোনো ওয়াদা করলে মৃত্যুর পর সেই ওয়াদার পালন করতে হয়। বাবার কথা না রাখলে হাশরের ময়দানে আমি কুলাঙ্গার সন্তান হিসেবে পরিচিত হব। বাবাকে অসম্মান করা হবে। আমি বেঁচে থাকতেও মরে যাব। আর বাবার কথা রাখলে আমার মেয়ে কষ্ট পাবে। আল্লাহ আমার খুব কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছে রাদিবা। খুব কঠিন পরীক্ষা। ”
রাদিবা নিরুত্তর বসে রইল। শাহিনুজ্জামান আবারও বললেন,
—-” আমি তোমাকে বলেছিলাম মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ো না। আমার মেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু তুমি….”
—-” আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলাম ওর পছন্দ আছে কিনা। কিন্তু তখন ওর উত্তর ছিল ‘না’। আমি…”
রাদিবার কথার মাঝেই ককিয়ে উঠলেন শাহিনুজ্জামান সাহেব। বেদনার্ত গলায় বললেন,
—-” একটু তেল গরম করে আনো তো রাদিবা। বুকে ভীষণ ব্যথা করছে।”
শাহিনুজ্জামান সাহেবের ভারি নিঃশ্বাসের সাথে রাদিবার ফুঁপানোর শব্দও ভেসে এলো। রাদিবা আদ্র গলায় বলল,
—-” সারাদিন এত দুশ্চিন্তা করলে বুক ব্যথা করবে না? তু…”
শুভ্রতা আর দাঁড়াল না। খরগোশের মত ধীর পায়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। যে বাবা নিজেই সবটা বুঝতে পারছে তাকে নতুন করে কি বুঝাবে শুভ্রতা? এতো বুঝদার বাবাকে কিভাবে তার বিয়ের কথাটা বলবে? শুভ্রতার আত্মা কেঁপে ওঠে। দুটানা নামক ভয়ঙ্কর জিনিসটা ওর মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুরতে থাকে। শুভ্রতা ওয়াশ রুমে গিয়ে ফুল স্পিডে শাওয়ার ছাড়ে। এলোমেলো হয়ে বসে থেকে এলোমেলো সব চিন্তা করতে থাকে। বাবা নাকি সাদাফ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বুঝার চেষ্টা করল শুভ্রতা। মাথাটা খানিকটা উঠাতেই তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। শরীরের ভেজা কাপড়টা শুকিয়ে এসেছে। আধভেজা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল, কাল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল শুভ্রতা। শুভ্রতা বেশ কিছুক্ষণ দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে রইল। দুর্বল শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সারা শরীরের তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠল। ভেজা কাপড় ছেড়ে রুমে আসতেই ম্যাসেজ টুন কানে এল। শুভ্রতা আলসেমি ভরা হাতে ফোনটা তুলতেই অর্পনের ছোট্ট ম্যাসেজ চোখে পড়ল, ‘ কই তুই? ভার্সিটি আয় জলদি। আমরা অপেক্ষা করছি।’ শুভ্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইল। সারা শরীর জ্বরের তাপে পুড়ে যাচ্ছে তার। হাতে-পায়ে বিন্দুমাত্র শক্তিও পাওয়া যাচ্ছে না। শুভ্রতা আলমারি থেকে ভারী শাল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল। বাসায় কিছু না বলেই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। ভার্সিটি গেইটে রিক্সা থেকে নেমেই শুভ্রতার মনে হল, ‘ভার্সিটিতে আসাটা ঠিক হয় নি তার। যেকোনো সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার তীব্র সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছে সে।’ শুভ্রতা টলমলে পা দু’এক পা এগুতেই কেউ একজন হাত চেপে ধরল তার। শুভ্রতা ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকাতেই সাদাফের চিন্তিত মুখটি চোখে পড়ল। শুভ্রতা অবাক হয়ে বলল,
—-” তুমি? তুমি এখানে কি করছ? অফিস নেই?”
—-” তার আগে বলো, এতো জ্বর বাঁধালে কিভাবে?”
শুভ্রতা হাসার চেষ্টা করে বলল,
—-” ও কিছু নয়। একটু ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। দু’দিন ধরে ঘুমোতে পারছি না। একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে?”
সাদাফ রাগ নিয়ে বলল,
—-” গায়ের টেম্পারেচার দেখেছ তুমি? এতো জ্বর ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে? এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যাবে চলো।”
—-” ডাক্তার লাগবে না তো…”
—-” সেটা আমি বুঝব।”
কথাটা বলে একহাতে শুভ্রতাকে বুকে চেপে ধরল সাদাফ। রিক্সায় ওঠে শুভ্রতাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
—-” তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল বলে এসেছিলাম। এভাবে দেখতে হবে ভাবতেও পারি নি।”
সাদাফের বুকে মুখ ঘষে হাসল শুভ্রতা। মৃদু গলায় বলল,
—-” ঘুমাব।”
—-” হুম ঘুমাবে কিন্তু ডাক্তার দেখানোর পর।”
—–” আমি কিন্তু এখন বাসায় ফিরব না। ওই বাসায় শুধু দুশ্চিন্তা আর দীর্ঘশ্বাস। তোমার বাসায় যাব। তুমি মানা করতে পারবে না।”
সাদাফ মৃদু হেসে বলল,
—-” আচ্ছা।”
সাদাফের কথার উত্তরে সাদাফের বুকের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল শুভ্রতা। সাদাফও একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁয়াল। ফিসফিস করে বলল,
—-” তোমার জন্য দারুণ একটা সারপ্রাইজ আছে শুভ্রা। শুধু আজকের রাতটা অপেক্ষা করো।”
শুভ্রতা জ্বরের ঘোরে বলল,
—-“হু।”
রিক্সার হালকা গতিতেও শুভ্রতার খোলা চুলগুলো ঝাপটে পড়তে লাগল সাদাফের মুখে। চুলের মাদকীয় সুগন্ধের সাথে শুভ্রতার গায়ের অদ্ভুত গন্ধে সময়ে সময়ে শিহরিত হতে লাগল সে।
_____________________
বিছানায় মুখ কালো করে বসে আছে শুভ্রতা। মাঝে মাঝে আড়চোখে সাদাফকে দেখার চেষ্টাও চালাচ্ছে। সাদাফ বিছানার সামনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখদুটো রাগে জ্বলজ্বল করছে। শুভ্রতা আরো একবার কোণা চোখে তাকাতেই শক্ত কন্ঠে বলে উঠল সাদাফ,
—-” তোমাকে আমার কি করতে ইচ্ছে করছে জানো?”
শুভ্রতা চোখ তুলে তাকাল। মিনমিনিয়ে বলল,
—-” কি করতে ইচ্ছে করছে?”
সাদাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—-” ঠাডিয়ে চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, বেশিক্ষণ পানির সংস্পর্শে থেকে এমন ভয়াবহ জ্বর বাঁধিয়েছ তুমি। নিশ্চয় কাল সারা রাত শাওয়ারের নিচে বসেছিলে? তুমি কি বাচ্চা? দু’দিন পর নিজেই বাচ্চার মা হয়ে যাবে তবুও বাচ্চামো যায় না। তোমাকে তো….”
শুভ্রতা মুখ কালো করে বলল,
—-” আমি অসুস্থ আর তুমি আমায় বকছ? এক্ষুনি বাসায় চলে যাব আমি।”
সাদাফ কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। শুভ্রতার গা ঘেঁষে বসে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
—-” বকা দেওয়ার মতো কাজ কেন কর বল তো? তোমার প্রেশার কতটা লো জানো?”
শুভ্রতা বিরক্তি হয়ে বলল,
—-” ধুর! অর্পণ ঠিকই বলে প্রচন্ড নিরামিষ তুমি। এসব শুনতে একদমই ভালো লাগছে না আমার। আমি ঘুমাব।”
সাদাফ ভ্রু নাচিয়ে বলল,
—-“আমি নিরামিষ?”
—-” অবশ্যই।”
—-” অসুস্থ বলে বেঁচে গেলে। এনিওয়ে, তোমার সত্যিই ঘুমের প্রয়োজন তুমি ঘুমাও।”
কথাটা বলে উঠতে নিতেই সাদাফের হাত চেপে ধরল শুভ্রতা। সাদাফ ভ্রু নাচিয়ে জিগ্যেস করল,
—-” কি?”
—-” তুমিও ঘুমাবে আমার সাথে।”
—-” আমি ঘুমালে খাবারের ব্যবস্থা করবে কে? ম্যাডামের কি ঘুম ভেঙে ক্ষুধা লাগবে না?”
—-” উহু। তোমাকে পেলে ক্ষুধা লাগবে না।”
সাদাফ হাসল। আবারও বসে পড়ে বলল,
—-” তাই নাকি?”
—-” হু।”
সাদাফ কিছু না বলে বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল। প্রায় সাথে সাথেই তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শুভ্রতা। শুভ্রতার গায়ে ভালো করে কম্বল পেঁচিয়ে দিয়ে হাসল সাদাফ। আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
—-” আস্তে ম্যাডাম। আরেকটু হলে বুকের হাড় ভেঙে ফেলতেন আপনি।”
শুভ্রতা উত্তর না দিয়ে সাদাফের বুকে মুখ ঘষল। দু’হাতের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সাদাফকে জড়িয়ে রাখল। সাদাফ এবারও হেসে ফেলল। শুভ্রতার কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে বলল,
—–” পালিয়ে যাচ্ছি না। নিশ্চিন্তে ঘুমাও। যতক্ষণ না ঘুম ভাঙবে পাশেই থাকব, প্রমিস।”
কিন্তু শুভ্রতার মধ্যে ঘুমের লক্ষ্মণ দেখা গেল না। বাচ্চাদের মত উশখুশ করতে লাগল। ঘন্টাখানেক পরও শুভ্রতার মধ্যে ঘুমানোর সম্ভবনা না দেখে কপাল কুঁচকে তাকাল সাদাফ। হাত দিয়ে শুভ্রতার মুখটা উপরের দিকে তুলে বলল,
—-” এই মেয়ে? কি সমস্যা? মাথায় কি চলছে তোমার?”
শুভ্রতা দাঁত বের করে হাসল। সাদাফ ভ্রু নাচাতেই মাথাটা একটু উপরে তুলে সাদাফের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। শুভ্রতার কান্ডে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেল সাদাফ। শুভ্রতা আবারও একই কাজ করায় শুভ্রতার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
—-” তুমি অসুস্থ শুভ্রা। ইউ নিড রেস্ট।”
—-” হু। আমি অসুস্থ। আমার টেইক কেয়ারের প্রয়োজন। আর অসুখটা যেহেতু তোমার জন্য হয়েছে সো অসুখ সারানোর দায়িত্বও তোমার।”
সাদাফ সরু চোখে তাকাল,
—-” আমার জন্য হয়েছে?”
শুভ্রতা দাঁত বের করে হাসল। বলল,
—-” অবশ্যই তোমার জন্য হয়েছে। আমি এখন ‘তোমাকে পাওয়ার অসুখ’ এ আক্রান্ত। আর অসুখের মেডিসিন হলে তুমি, সিম্পল।”
—-” জ্বরে মাথা পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তোমার শরীর অনেক বেশি দুর্বল। তুমি রেস্ট নাও আমি রান্না ঘরে….”
শুভ্রতা আগের থেকেও জোরে জড়িয়ে ধরে বলল,
—-” প্লিজ।”
—-” শুভ্রা!”
—-” প্লিজ প্লিজ।”
সাদাফ হেসে ফেলল। মুগ্ধ চোখে বিমুগ্ধ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো অন্যায় আহ্বানই ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় সাদাফের। সেখানে, এই আহ্বান তো সম্পূর্ণ পবিত্র। সাদাফ এবার হাতের বাঁধন শক্ত করল। শুভ্রতার উত্তাল ভালোবাসার সাগরে ধীরে ধীরেই পরাজিত নাবিকের মত মিলিয়ে যেতে লাগল।
______________________
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। দূর আকাশে অল্প বিস্তর তারার আলো চোখে পড়ছে। ফারদিন রেস্টুরেন্টের কাচ গেলে আকাশের দিকে তাকাল। বিশাল আকাশটির কোথাও চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তারা আছে অথচ চাঁদ নেই, বিষয়টি নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবল ফারদিন। অলস দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকাল। রাস্তার মোড়ের ল্যাম্পপোষ্ট আর যানবাহনের আলো গুলো ফারদিনের কাছে মস্ত আকাশের উজ্জ্বল তারাগুলোর মতোই লাগছে। ফারদিনের তারা বিষয়ক চিন্তার মাঝেই তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুড়ল পুরুষালী কন্ঠস্বর,
—-” এক্সকিউজ মি? আপনি ফারদিন হাসান?”
ফারদিন চোখ ফিরিয়ে সামনের মানুষটির দিকে তাকাল। সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে প্রথমেই যে কথাটা মাথায় এলো তা হল, ‘ লোকটি অত্যন্ত সুপুরুষ’। সামনের লোকটি আবারও একই প্রশ্ন জিগ্যেস করায় মাথা নেড়ে সাঁই জানাল ফারদিন। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—-” আপনিই কি রাফাত আল সাদাফ? যে ব্যক্তিটি ফোন করে আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলেন?”
সাদাফ মৃদু হেসে বলল,
—-” হ্যাঁ। আমিই সেই ব্যক্তি। বসে কথা বলি?”
ফারদিন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। চেয়ার টেনে বসে বলল,
—-” সরি, আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।”
—-” না চেনারই কথা। দু’দিন আগে আমিও আপনাকে চিনতাম না। এনিওয়ে, আমরা কিন্তু এখনও পরিচিত হতে পারি, পারি না?”
ফারদিন হেসে বলল,
—-” হ্যাঁ অবশ্যই। আমি ফারদিন হাসান।”
—-” জানি। আপনার সম্পর্কে সবটা খোঁজ নিয়েই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। আমি রাফাত আল সাদাফ। পরিচয়টা আরেকটু সহজ করে দিলে হয়ত আপনার বুঝতে সুবিধা হবে। আমার সহজ পরিচয়টা হলো, আমি শুভ্রতার হাজবেন্ড। শুভ্রতাকে চিনেন নিশ্চয়?”
ফারদিন কপাল কুঁচকে তাকাল। সাদাফ হালকা হেসে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,
—-” ফাইলটা একটু চেইক করুন, প্লিজ।”
#চলবে….
[ যথেষ্ট বড় পর্ব দিয়েছি আজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় রি-চেইক দেওয়া হয় নি। ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করা হচ্ছে। সেই সাথে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।]