# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব – ৫৩
শুভ্রতা ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই দেয়াল ঘড়িতে ঘন্টা বাজলো। সেকেন্ডের কাটাটা একের ঘর অতিক্রম করে দ্রুত গতিতে নিচে নামতে লাগল। শরৎ- এর শেষ দিক, শেষ রাতটাতে হালকা হিম হিম ভাব। ঠান্ডায় শুভ্রতার শরীরটা মৃদু কাঁপছে। ভেজা চুল থেকে পানি ঝরে ব্লাউজের পেছনের দিকটা ভিজে গিয়েছে। শুভ্রতা শাড়ির আঁচল ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়াল। ওয়াশ রুমে শাড়ি পরাটা বড্ড ঝঞ্জাটময় কাজ। শাড়ির কোনো একদিক না ভিজিয়ে শাড়ি পরাটাই মুশকিল।
—-” গোসল শেষ?”
ভেজা ব্লাউজ আর ভেজা আঁচলের বিরক্তিটা ঠেলে দিয়ে চোখ তুলে তাকাল শুভ্রতা। সাদাফ সোফায় বসে আছে। শুভ্রতার ঠান্ডায় কেঁপে উঠা ঠোঁটজোড়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। শুভ্রতা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বলল,
—-” হুম। শেষ।”
সাদাফ এবার গভীর চোখদুটো তুলে শুভ্রতার চোখের দিকে তাকাল। চোখের ইশারায় টি-টেবিলটা দেখিয়ে দিয়ে বলল,
—-” খেতে এসো। ক্ষুধা পায় নি?”
সাদাফের মুখে ‘ক্ষুধা’ শব্দটা শুনতেই পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো শুভ্রতার। সারাদিন না খেয়ে থাকা পেটটা এবার ঘোর আন্দোলন জুড়ে দিলো। শুভ্রতা বড় বড় পা ফেলে সাদাফের পাশে গিয়ে বসলো। সাদাফ গাঢ় দৃষ্টিতে শুভ্রতাকে খেয়াল করছে। মোহময় দৃষ্টিতে শুভ্রতার আগাগোড়া নিরক্ষণ করে হালকা হাসল সাদাফ,
—-” চুল মুছো নি? তোয়ালে কোথায়? এখনই যে পরিমাণ ভিজেছ খেতে খেতে তো আরো ভিজে যাবে।”
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়াল সাদাফ। আলমারি থেকে নিজের তোয়ালেটা বের করে শুভ্রতার চুলে জড়ালো। তোয়ালেটা চুলের সাথে পেচিয়ে শুভ্রতার ডান কাঁধে তুলে দিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলল। বলল,
—-” এবার খাওয়া স্টার্ট করো। অলরেডি একটা বেজে গিয়েছে। রাতটা শেষ হয়ে যাচ্ছে শুভ্রা!”
সাদাফের শেষ কথাটা বেশ করুণ শুনালো শুভ্রতার কানে। শুভ্রতা দুষ্টু হেসে খাবারের প্লেটটা তুলে নিয়ে বলল,
—-” বাসর রাতে ভাতের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকেছে বর! মানুষ কি বলবে?”
সাদাফ শুভ্রতার পাশে গা এলিয়ে বসলো। ক্লান্ত গলায় বলল,
—-” মানুষকে বাকশক্তিটা দেওয়া হয়েছেই বলার জন্য। তাদের বলাটাই স্বাভাবিক বরং তাদের কিছু না বলাটাই অস্বাভাবিক। নতুন বউ সারাদিন না খেয়ে থেকে বাসর রাতে সেন্সলেস হয়ে গেলেও তারা বলবে। নিজের মতো করে হাজার কথা সাজাবে।তাই মানুষের বলাবলি নিয়ে বসে থাকাটা বোকামো।”
—-” তবুও… বাসর ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার আনাটা কেমন দেখায় না?”
—-” আমি আনি নি। পৃথাকে বলে রেখেছিলাম। ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই দিয়ে গিয়েছে ঘরে। কেউ সম্ভবত দেখে নি। আর দেখলেই বা কি?”
শুভ্রতা জবাব না দিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলো। খাবার চিবোতে চিবোতে বলল,
—-” তোমার বোনটা ভীষণ লক্ষ্মী।”
সাদাফ বাঁকা হেসে বলল,
—-” সেই সাথে পাজিও। দিন দিন এতো বেয়াদব হচ্ছে মেয়েটা! কথা বলার সময় বড় ছোট খেয়াল থাকে না তার। বড় ভাইয়া আর ওর বয়সের ডিফারেন্স হলো সতেরো বছর। এরপরও ভাইয়াকে বলে কি জানো? ‘দাদাভাই? তোমার আর বড় ভাবির মাঝে নাকি হেব্বি প্রেম চলছে? প্রেমের জোয়ারে অলমোস্ট ভেসে যাচ্ছো দু’জনে। এই খুশিতে আমাকে একটা ফোন কিনে দেওয়া যায় না?’ চিন্তা করতে পারছ, কি পরিমাণ নির্লজ্জ হচ্ছে মেয়েটা? বড় ভাইয়াকে কেউ এই কথা বলে? আমি বা ছোট ভাইয়া হলে তবু একটা কথা ছিলো। ”
শুভ্রতা বিষম খেলো। চোখ বড় বড় করে বলল,
—-” সতেরো বছর! এতো ডিফারেন্স? বড় ভাইয়া এতো বড়?”
সাদাফ হেসে মাথা নাড়ল। শুভ্রতা চোখ পিটপিট করে বলল,
—-” ভাইয়া তো তাহলে আমার থেকে অলমোস্ট তেরো বছরের বড় কিন্তু দেখে বুঝার উপায় নেই। কি সাংঘাতিক!”
—-” তুমি তো বাচ্চা মেয়েই। আমার থেকে কমপক্ষে আট/নয় বছরের ছোট হবে তুমি। আমাদের বিয়েটা এক্সিডেন্টলি না হয়ে গেলে বয়সের এতো ডিফারেন্স রেখে বিয়ে করতাম না কখনো। ওভাবে খেয়ালই করতাম না।”
সাদাফের কথায় শুভ্রতার মুখে কৃষ্ণাভ ছায়া খেলে গেল। সাদাফের কথার অর্থ কি? হুট করে বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো বলেই তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে সাদাফ? নয়তো বিয়ে করতো না? শুভ্রতার জন্য আলাদা কোনো অনুভূতি কাজ করে না তার? শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্লেটের বাকি খাবারগুলো মুখে অত্যন্ত তেঁতো ঠেকলো তার। শুভ্রতা কোনোরকম খাবারগুলো শেষ করেই ওঠে দাঁড়াল। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে তার। শুভ্রতা থমথমে মুখে ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্ট বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াল। সাদাফের এই বারান্দাটা বরাবরই ভীষণ ভালো লাগে শুভতার। বারান্দার বামপাশটায় ঝুলছে মিষ্টি দেখতে একটি বেতের ঝুলা। তারপাশে রাখা বেতের মোড়াটাতে বেশকিছু ইংলিশ ম্যাগাজিন পরিপাটিভাবে সাজানো। ডানপাশের দেয়ালটার তাকে তাকে অ্যাডেনিয়াম, অপরাজিতা, রেইনলিলি,ক্যাকটাস গাছের সারি। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে মেঝেতে রাখা জলভরা বিরাট পাত্রে গুটি কতক লাল পদ্ম ভাসছে। আজ এই বিশেষ দিনে লাল পদ্মের সাথে গোলাকার ক্ষুদে মোমবাতি ভাসাতেও ভুলে নি সাদাফ। অন্ধকার বারান্দায় মোমবাতির ছোট ছোট আলো অসহনীয় এক সুন্দর আবহ তৈরি করছে। গ্রিলগুলোর সাথে ল্যাপ্টে আছে মর্নিংগ্লোরি গাছের শাখা। চারপাশটাই শৌখিনতার ছোঁয়া। প্রকৃতির আবহে ঢাকা এই এক চিলতে বারান্দাটাতে পা রাখতেই মুগ্ধ হয়েছিল শুভ্রতা। মনে মনে সাদাফের গাঢ় রুচিশীলতার কি ভীষণ প্রসংশায় না করেছিল সে! শুভ্রতা মর্নিংগ্লোরির পাতায় হাত বুলিয়ে উদাসী চোখে আকাশের দিকে তাকাল। ঝকঝকে আকাশটায় অসংখ্য তারার মিটিমিটি আলো। সেই অপার্থিব তারার রাজ্যের গর্বিত রাণী হয়ে, আকাশের মাঝ বরাবর অধিষ্ঠিত হয়েছে বিশাল এক চাঁদ। শুভ্রতার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। সাদাফ তাকে ভালোবাসে, এই সত্যটা শুভ্রতারও জানা। কিন্তু, শুধু কি ভালোবাসলেই চলে? ভালোবাসাটা প্রকাশ করে বুকজোড়ে কোমল, স্নিগ্ধ অনুভূতির স্পর্শ কি প্রয়োজনীয় নয়? এই যে, আজ সারাটা দিন বউ সেজে বসে রইল শুভ্রতা। সবাই কত শত প্রসংশা করলো তার। কিন্তু সাদাফ নির্বিকার। আচ্ছা? বাসর রাতে নাকি স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের চাঁদের সাথে তুলনা করে? স্ত্রীর সৌন্দর্যের প্রসংশায় আত্মহারা হয়ে পড়ে? অথচ সাদাফ তার ধারে কাছে নেই। শুভ্রতা জানে সে চাঁদের মতো সুন্দর নয়, চাঁদের সাথে তুলনাও তার চায় না। কিন্তু, সাদাফ ছোট্ট করে, ‘সুন্দর লাগছে’ কথাটাও তো বলতে পারতো নাকি? গভীর অভিমানে শুভ্রতার চোখে-মুখে আষাঢ়ের মেঘ জমতে লাগল। সুন্দর চোখজোড়ায় জল চিকচিক করে উঠলো। শুভ্রতা করুণ গলায় গুনগুনিয়ে উঠলো,
“বল তো আরশি তুমি মুখটি দেখে
যদিও কাজল আমি পরিনি, যদিও কবরী আজ বাধিনি।
তবু, বলতো রূপসী কে তোমার চোখে?
আমি নই বিম্ববতী রাজার ঘরে,
হাসিতে পান্না তো নয় কান্না ঝরে।
কেতকী লজ্জা না পায় আমায় দেখে,
তবু বল, বল কে… রূপসী তোমার চোখে?
দেখো না আরশি তুমি দুচোখ চেয়ে,
ভুবনে কে রূপসী, কে সবার চেয়ে?
আমি নই কলস্বরা নদীর মত,
চরনে ব্যাকুল বকুল ঝরে না তো
কোকিলা মরে না তো আমায় ডেকে,
তবু বল, বল কে… রূপসী তোমার চোখে?”
হঠাৎই কোমরে উত্তপ্ত ছোঁয়ায় চমকে উঠলো শুভ্রতা। সুর থেমে গেলো। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাতেই সাদাফের নিঃশব্দ হাসি চোখে পড়ল। এই নির্মল, পবিত্র হাসিটা দেখেই সব রাগ ,অভিমান হাওয়া হয়ে গেলো শুভ্রতার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটির প্রতি কয়েক সেকেন্ডের অভিমানেও যে শান্তি মেলে না শুভ্রতার। শুভ্রতার চোখে এই গভীর দৃষ্টিজোড়া পড়লেই দমবন্ধ ভালো লাগায় পাগল হয়ে যায় শুভ্রতা।
—-” গরম গরম কফি। এক সিপ খাওয়ার সাথে সাথেই শীত পালাবে। খুব বেশি ঠান্ডা লাগছে তোমার?”
কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো সাদাফ। শুভ্রতা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়লো। তার অর্থ, হ্যাঁ নাকি না, বোধগম্য হলো না সাদাফের। নিজের কফি কাপটা বামহাতে নিয়ে পেছনে থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সাদাফ। শুভ্রতার ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে রাশভারী কন্ঠে আবৃত্তি করে উঠলো,
‘ তুমি আরশি নগর চেয়েছিলে,
আমি চেয়েছিলাম আমার আয়নায় তোমাকে।
আমার ঘুম ভাঙা চোখে চলন্তিকা অজস্র স্বপ্নের ধারা……
তোমার লাল পেড়ে শাড়ি ,স্লিভলেস অন্ধকারে নিঃশব্দ আমার ছবি,
আজও আয়নায় ধরা…..
স্মৃতির মুখে লেগে আছে মাতন এই নীরবতা (সংগ্রহীত)
আমার আরশিতে তুমিই অনন্ত কালের রূপবতী।
বহু আকাঙ্খিত এক স্বপ্ন! আমার শুভ্রা!’
শুভ্রতা ঘাড় ফিরিয়ে বিস্মিত চোখে তাকালো। চোখ দুটো মুহূর্তেই জলে পরিপূর্ণ হলো তার। কেন এতো ভালো লাগে এই মানুষটাকে? প্রতিটা মুহূর্তে এমন দমবন্ধ অনুভূতি কেন জাগে? এই অসহনীয় বিমুগ্ধতায় মাঝে মাঝেই কান্না পায় শুভ্রতার। সামনে দাঁড়ানো লম্বা চওড়া মানুষটা শুধু তার ভাবতেই হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। শুভ্রতার ছলছল চোখজোড়ার দিকে খানিক নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইলো সাদাফ। তারপর হঠাৎই শুভ্রতার ডান বাহুটা টেনে ধরে ঠোঁট ডুবালো ঠোঁটে। সাদাফের আকস্মিক স্পর্শে থমকে গেলো শুভ্রতা। সারা শরীরে তীব্র শিহরণ বয়ে গেলো, সেই প্রথম দিনটার মতো। হাতে থাকা গরম কফি কাপটা হেলে পড়ে খানিক কফি ছিটকে পড়লো সাদাফের হাতে। উত্তপ্ত কফির ছোঁয়ায় ছিটকে সরে দাঁড়ালো সাদাফ। শুভ্রতা অপরাধী গলায় বলল,
—-” সরি! আমি… আমি আসলে…”
সাদাফ জবাবে মৃদু হাসলো। হাত ঝেড়ে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে শুভ্রতার মুখোমুখি দাঁড়ালো। গাঢ় গলায় বলল,
—-” তোমার মতো করে, এতোটা গভীরভাবে কেউ আমার প্রেমে পড়তে পারে নি শুভ্রা, পারবেও না। তুমি আমার প্রেমে ভীষণভাবে আহত।”
শুভ্রতা চোখ নামাল। অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাল। সাদাফ আরো একটু এগিয়ে এসে শুভ্রতার হাতের কাপটা নিয়ে বেতের মোড়ার উপর রাখলো। নিজের কাপটাও পাশাপাশি রেখে আবারও শুভ্রতার মুখোমুখি দাঁড়ালো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
—-” আর আমি তোমাতে আহাত, শুভ্রা! এই আহাত প্রাণ নিয়ে আর বাঁচা যাচ্ছে না।”
সাদাফের গরম নিঃশ্বাস শুভ্রতার মুখের ওপর ঝাপটে পড়তেই কেঁপে উঠলো শুভ্রতা। হিম ধরা রাতেও মৃদু ঘামতে লাগলো। সাদাফ ঠোঁটের কোণায় অদ্ভুত এক হাসি ফুটিয়ে ডানহাতে শুভ্রতাকে আরো একটু কাছে টেনে নিলো। সাথে সাথেই দমবন্ধ ভালো লাগায় কম্পনটা আরো খানিকটা বেড়ে গেলো তার। সাদাফ আলতো স্পর্শে শুভ্রতার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে ফিচেল গলায় বলল,
—-” তুমি কি শীতে কাঁপছো শুভ্রা? আজ একটু বেশিই ঠান্ডা, তাই না?”
শুভ্রতা জবাব দিলো না। একবার চোখ তুলে তাকিয়েই চোখ নামাল। সাদাফ খুব ভালো করেই জানে শুভ্রতার এই কম্পন ইচ্ছেকৃত নয়। এখানে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার আছে। কিন্তু, তবুও সে মজা নেবেই নেবে। শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো সাদাফ। ইনোসেন্ট গলায় বলল,
—-” তোমার এই ঠান্ডা গরম কফিতে কমবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি হেল্প করব?”
শুভ্রতার মুখ লাল হলো। সাদাফের ছোঁড়া লজ্জা বাণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হাসফাস করতে লাগলো সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে অবশেষে সাদাফের বুকেই মুখ লুকালো শুভ্রতা। সাদাফের ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো। দুই হাতে পরম আবেশে প্রিয়তমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো সে। বারান্দায় ছড়িয়ে পড়া অ্যাডেনিয়াম ফুলের সুবাস আর শুভ্রতার ভেজা চুলের সুবাসে গাঢ় হয়ে এলো সাদাফের নিঃশ্বাস। ধুকপুক করতে থাকা হৃদপিণ্ডটাও আরো খানিকটা বেপরোয়া হয়ে নিজের উত্তেজনা প্রকাশে মত্ত হলো।
______________________
সকাল সাতটা। সাদাফের বনানীর ফ্ল্যাটটাতে তুমুল হৈচৈ চলছে। খাবার টেবিলে ছেলেপক্ষ মেয়েপক্ষের ভয়ানক বাকবিতন্ডা চলছে। রাকিব পুষ্পির পাশের চেয়ারে বসে আছে। খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছে করেই পুষ্পির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাচ্ছে সে।
—-” কি সমস্যা? বার বার এভাবে কি দেখছেন আপনি?”
পুষ্পির প্রশ্নে দাঁত বের করে হাসলো রাকিব।
—-” বেয়াইনরা আপ্যায়নের প্রিপারেশন নিয়ে এসেছে কিনা সেটাই দেখছিলাম। আজ আমাদের আপ্যায়ন করার পালা কি না?”
পুষ্পি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। প্লেটে থাকা খাবারগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। রাফাত বাঁকা হেসে বলল,
—-” লাভ নেই। প্লেটে অভিযান চালিয়ে লাভ নেই। আমরা হলাম ছেলেপক্ষ। আমাদের বুক ভরা আতিথেয়তা। অমন বৃহদাকার আতিথেয়তা কি আর ভাতের প্লেটে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? বড় বড় জিনিসে খুঁজতে হবে।”
পুষ্পির কুঞ্চিত ভ্রু আরো একটু কুঁচকে এলো। রাফাতের পাশে বসে গোগ্রাসে খাবার গিলছিলো আরাফ। তার দিকে তাকিয়েই দাঁত বের করে হাসলো অর্পণ। গদগদ কন্ঠে বলল,
—-” আরাফ ভাইয়া?”
আরাফ চোখ তুলে তাকাল। অসহায় কন্ঠে বলল,
—-” প্লিজ বইন, এভাবে ডেকো না। তোমাদের এতো আদরমাখা ডাক শুনলেই আত্মা ধক করে উঠে আমার। হুটহাট এভাবে ডাকলে হার্টফেলও হয়ে যেতে পারে, অসম্ভব কিছু না।”
প্রেমা আগলা গলায় বলল,
—-” সেটা আপনার এমনিতেও হবে। এইযে, আপনার বন্ধুরা আমাদের বিশেষ আপ্যায়নের চিন্তায় নিন্দাহীন রাত পাড় করছে। তার দাম তো দিতে হবে নাকি? সেই দামটা আমরা আপনাকে আপ্যায়ন করে সুদ বুদ করব। শুধু আমরা না…দরকার হলে আপনার বউও করবে। মোড়াল অফ দ্যা স্টোরি হলো, ভবিষ্যতে এর থেকেও আদরমাখা ডাক শুনতে হবে আপনাকে। আপনার হার্টফেল তো কনফার্ম।”
আরাফ ঢোক গিলে বন্ধুদের দিকে তাকালো। রাকিব সন্দিহান গলায় বলল,
—-” ওই? তোরে তো আমার সন্দেহ লাগতাছে। তুই কি মেয়েপক্ষ সাজার চেষ্টা করছিস নাকি?”
আরাফ অসহায় কন্ঠে বলল,
—-” দোস্ত! আমার সংসার!”
আরাফের কথাটা শেষ হতেই পিঠে ধুম করে কিল বসালো রাফাত। চোখ রাঙিয়ে বলল,
—-” শালা! বন্ধু আগে না বউ আগে? সেই স্কুল লাইফ থাইক্যা তোর জন্য মাইয়ার বাপের দৌঁড়ানী খাইয়া আসতাছি আমরা। আর আজ বউ পাইয়া বন্ধু পর? শালা, বিভীষণ!”
রাফাতের কথার সাথে যোগ দিয়ে বলে উঠল রাকিব,
—-” হ দোস্ত। কলেজের ওই সোনিয়া মাইয়াটাকে প্রোপোজ করার লাইগা ত্রিশ টাকা করে চাঁদা তুলছিলাম আমরা। আর সেই টাকা দিয়া এই শালায় ফুল আর গিফ্ট কিনছে। তখনকার সময় ত্রিশ টাকা শুধু টাকা ছিলো না। আস্ত একটা কিডনী ছিলো। আমরা তোরে একটা করে কিডনী দিয়া দিছি। আর আজ….”
রাকিবের কথার ভঙ্গিতে ফিক করে হেসে ফেলল অর্পণ। পুষ্পি-প্রেমাও মুখ টিপে হাসল। অর্পণ ঠাট্টা করে বলল,
—-” তা আপনাদের বাকি কিডনী ডোনারগুলো কই?”
রাফাত ভ্রু নাচিয়ে বলল,
—-” কেন? আমাদের ডোনারদের দিয়ে আপনাদের কি কাজ?”
—-” আমাদের কি কাজ সেটা জেনে আপনার কি কাজ?”
রাফাত ফিচেল হেসে বলল,
—-” আপনিময় জীবন আমার বেয়াইন সাহেবা। আপনাকে না জানলে তো এই জীবনটাই বৃথা। আপ…”
রাফাতের কথার মাঝ পথেই চেঁচিয়ে উঠলো রাকিব। পানি দিয়ে মুখের খাবারগুলো কোনোরকম গিলে নিয়ে বলল,
—-” লবণ! এতো লবণ কোথা থেকে এলো আমার প্লেটে?”
রাকিবের কথাটা শেষ হতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো পুষ্পি, প্রেমা আর অর্পণ। রাফাত চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
—-” তুই আসলেই একটা বেকুব। তোরে তো পুরো লবণের বস্তা খাওয়ানো উচিত। চোখের নিচ দিয়ে শত্রুপক্ষ আক্রমণ চালালো আর তুই বুঝতেও পারলি না? তোর তো বেঁচে থাকারই অধিকার নাই।”
রাকিব অত্যন্ত দুঃখী দুঃখী দৃষ্টিতে তাকালো। গলায় অসহায়ত্ব ঢেলে কিছু বলবে তার আগেই সাদাফের মা প্লেটে মাংসের তরকারি তুলে দিতে দিতে বললেন,
—-” খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই তৈরি হয়ে নাও। শুভ্রতার বন্ধুরা? সরি মা, তোমাদের নামগুলো খেয়াল রাখতেই পারছি না। বারবার ভুলে যাচ্ছি।”
অর্পন উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল,
—-” সমস্যা নেই আন্টি। আমাদের বারবার নাম বলতে ভালোই লাগে। আমার নাম অর্পি ফেরদৌসী। আপনি অর্পন বলে ডাকতে পারেন।”
পুষ্পি মৃদু হেসে নম্র গলায় বলল,
—-” আমার নাম পুষ্পিতা জামান। ডাকনাম পুষ্পি। আর ওর নাম প্রেমা।”
সাদাফের মা হাসলেন। শুভ্রতার বন্ধুদের বেশ ভালো লেগেছে তার। অর্পণ মেয়েটা একটু উশৃংখল ধরনের হলেও খুব একটা খারাপ নয়। সহজ, সরল আর চঞ্চল। সেদিক বিবেচনা করলে তার মেয়েটাও তো কম নয়। সাদাফের মা আদুরে গলায় বললেন,
—-” তোমরাও রেডি হয়ে নাও। শুভ্রতার সাথে তোমরাও যাচ্ছো।”
পুষ্পি একবার রাকিবের দিকে তাকিয়ে সাদাফের দিকে দৃষ্টি ফেরালো। কৌতূহল নিয়ে বলল,
—-” কোথায় যাবো, আন্টি?”
—-” চট্টগ্রাম। আসলে, ঢাকায় তো আমাদের কোনো আত্মীয় থাকে না। সবাই থাকে চট্টগ্রামের আশেপাশে। সাদাফের বিয়েটা এতো দূরের শহরে হওয়ায় অনেকেই দাওয়াত রক্ষা করতে পারে নি। তাই ভাবছিলাম বউ ভাতটা আপাতত চট্টগ্রাম হোক। এই সুবাদে আমাদের আত্মীয়দেরও মন রক্ষা
হবে আর শুভ্রতার বাড়ির লোকদেরও শুভ্রতার শশুর বাড়ি দেখা হয়ে যাবে।”
—-” কিন্তু বউ ভাতের অনুষ্ঠান তো আজ। এখন চট্টগ্রামের জন্য রওনা দিলে অনুষ্ঠান কখন হবে?”
অর্পণের প্রশ্নে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন সাদাফের মা। পুষ্পির প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন,
—-” শুভ্রতার পরিবারের সাথে কথা বলে বউ ভাতের অনুষ্ঠান দুইদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা জলদি তৈরি হয়ে নাও।”
—-” কিন্তু আন্টি আমরা….”
প্রেমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চেঁচিয়ে পৃথাকে ডেকে উঠলেন সাদাফের মা,
—-” পৃথা? বাসায় এতো কাজ আর তুই বসে বসে নেইলপালিশ মাখছিস? এখন নেইলপালিশ মাখার সময়? বাড়ি ভরা মেহমানের মধ্যেও তোকে ধরে-বেঁধে খাওয়াতে হবে? ফাজিল মেয়ে। জলদি খেতে আয়। আর তোর ছোট ভাইয়াকে ডেকে তোল তো জলদি। দশটায় বাস, তৈরি হতে হবে না?”
পৃথা অলস ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,
—-” আমি কিভাবে তুলবো ওকে? আমি ভাইয়াকে বড়জোর ডাকতে পারি কিন্তু তুলতে পারি না। দরজা ভেতর থেকে লাগানো। তুমি সবসময় ভুল কথা বলো মা।”
—-” অযথা কথা বলবি তো ঠাস করে একটা চড় লাগাবো। যা বলেছি তাই কর। সবসময় ফাজলামো।”
মায়ের দৃষ্টির অগোচরে মুখ ভেঙালো পৃথা। তাদের এই বৃহৎ পরিবারে, সবার কাছে প্রশ্রয় পেলেও এই মা’টার কাছে প্রশ্রয় পাওয়ার উপায় নেই। এই এত্তো বড় হওয়ার পরও ঠুসঠাস চড়-থাপ্পড় বসিয়ে দেয় পিঠে। আর যায় হোক, এই মা’টাকে বিশ্বাস নেই পৃথার। তিল পরিমাণও না।
_____________________
সদ্য সকালের মৃদু আলোতে ঘরের অন্ধকার ভাবটা হালকা হয়ে এসেছে। মিইয়ে আসা ফুলের বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমোচ্ছে দু’জন মানুষ। এমন সময় দরজায় তীব্র আঘাত হেনে তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল কেউ,
—-” ছোট ভাইয়া? এই ছোট ভাইয়া? আম্মু উঠতে বলছে জলদি। ওঠো।”
পৃথার তীক্ষ্ণ চিৎকারে চোখ মেলে তাকালো সাদাফ। এতো সকালে, এমন তারস্বরে চিৎকারে ভীষণ বিরক্ত সে। পৃথার দমহীন ডাকাডাকিতে পাশ ফিরে শুলো শুভ্রতা। ঘুমের মাঝেই বিরবির করে বলল,
—-” মাত্রই তো ঘুমোলাম। ডাকছ কেন এখনই? আমি ঘুমে মারা যাচ্ছি। এখন উঠতে পারবো না।”
সাদাফ কপাল কুঁচকে শুভ্রতার দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে উঁচু গলায় বলে উঠল,
—” চেঁচাচ্ছিস কেন পৃথা? আমরা উঠেছি, তুই যা।”
পৃথা দাঁত কেলিয়ে হাসল। বলল,
—” সত্যি উঠেছ? তোমরা যে উঠেছ, মাকে তো তার প্রমাণ দিতে হবে নাকি? দরজা খোলো, দেখি সত্যি সত্যি উঠেছ কিনা!”
পৃথার কথায় বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো সাদাফের। গম্ভীর গলায় বলল,
—-” এই মুহুর্তে দরজার সামনে থেকে যাবি তুই। নয়তো ডিরেক্ট নদীর পাড়ে ফেলে আসব, ছোট বেলা যেখান কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। যা বলছি…”
—-” কিন্তু…”
—-” আরেকটা লাগামছাড়া কথা বললে সত্যি সত্যিই মাইর খাবি তুই। যা বলছি।”
পৃথা সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় দুই তিনটা ধাক্কা দিয়েই খাবার ঘরের দিকে দৌড় লাগালো। সাদাফ রাগী গলায় ডাকল,
—-” পৃথা!”
সাদাফের ডাকটা পৃথার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। ততক্ষণে করিডোর পেরিয়ে খাবার টেবিলের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে সে। চেয়ার টেনে খেতে বসার আগমুহূর্তেই হঠাৎই মন খারাপ হয়ে গেল পৃথার। অজানা এক কারণে মনটা গুম হয়ে রইলো। বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। কাউকে ভীষণ মিস করছে সে। সেই অতিরিক্ত মিস করা ব্যক্তিটির জন্য কষ্টে মনটা টনটন করছে তার। কান্না পাচ্ছে। কিন্তু, কি আশ্চর্য! সেই লোকটা যে কে? আদৌ কেউ আছে কিনা, তাই জানা নেই পৃথার।
—-” খেতে না বসে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
মায়ের অতিস্বাভাবিক প্রশ্নে মেজাজ চটে গেল পৃথার। থমথমে গলায় বলল,
—-” খাবো না আমি। আমার মন ভালো নেই।”
পৃথার কথায় বিরক্তি নিয়ে তাকালেন সাদাফের মা। ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
—-” মাত্রই তো লাফিয়ে লাফিয়ে খেতে এলি। দুই মিনিটেই মন পাল্টে গেল? দিন দিন ঢংগী হচ্ছিস। ঢং না করে খেতে বস।”
মায়ের কথায় আহত দৃষ্টিতে তাকাল পৃথা। রুদ্ধস্বরে বলল,
—-” তুমি সবসময় আমার সাথে এমন ব্যবহার করো মা। কখনোই বিশ্বাস করো না আমার কথা। ভাইয়ারা ঠিক বলে, আমাকে অবশ্যই নদীর পাড় থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলো বাবা। নয়তো নিজের মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার করে কোনো মা?”
মেয়ের কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন সাদাফের মা। শেষ বয়সের এই মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝে উঠেন না তিনি। সাদাফের বাবা, পলাশ সাহেব, সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। মেয়ের রুদ্ধকন্ঠস্বর শুনে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। নাকের ডগার চশমাটা ডানহাত দিয়ে উপরে ঠেলে দিয়ে বললেন,
—-” সাহেরা? তুমি আমার মেয়েকে অযথা বকাবকি করছো কেন? ”
পৃথা এতোক্ষণ থমথমে চোখ-মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাবার কন্ঠস্বর শুনেই আহ্লাদী হয়ে উঠলো। ঠোঁট উল্টে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলল,
—-” এই বাসায় কেউ আমাকে ভালোবাসে না। সবাই শুধু বকাবকি করে। আমি তো তোমাদের কেউ না। কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে।”
পলাশ সাহেব মৃদু হাসলেন। বুড়ো বয়সে এসে আল্লাহ প্রদত্ত এই উপহারটা পেয়ে একটু বেশিই খুশি হয়েছিলেন পলাশ সাহেব। তিন ছেলের পর পাওয়া এই মেয়েটির প্রতি প্রগাঢ় এক মমতা কাজ করে তার। সেই সুবাদেই, তিন ভাই আর বাবার আদরের একমাত্র উত্তরাধিকারী হয়েও মাঝে মাঝেই ভীষণ আহ্লাদী হয়ে উঠে পৃথা। পলাশ সাহেব আদরমাখা গলায় বললেন,
—-” কার এতোবড় সাহস যে আমার মাকে ভালোবাসে না? বাবার কাছে আসো তো মা। দেখি আমার মায়ের মনের কি হলো আজ। আসো, আসো।”
পৃথা মুখ ভার করে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। মুখ খারাপ করে বলল,
—-” আমি কাউকে খুব মিস করছি বাবা। অনেক বেশি মন কেমন করছে তার জন্য। সেই সাথে কান্নাও পাচ্ছে।”
পলাশ সাহেব পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন,
—-” কার জন্য মন কেমন করছে মা?”
পৃথা অসহায় চোখে তাকাল,
—-” সেটা তো বুঝতে পারছি না, বাবা।”
পলাশ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়ের এই সমস্যার সমাধান কি হতে পারে জানা নেই তার। কার জন্য মন কেমন করছে তাই যদি বুঝতে না পারা যায়, তাহলে কি-ই বা করতে পারেন তিনি?পৃথা বাবার গা ঘেঁষে বসে রইলো। হৃদয়ঘটিত মন খারাপটা খুব বেশিই ভুগাচ্ছে তাকে। অচেনা সেই মানুষটির জন্য কেঁদে কেটে চোখ ফোলাতে ইচ্ছে করছে। উফ, কি অশান্তি!
শরৎ এর স্বচ্ছ নীল আকাশে থালার মতো গোলাকার এক সূর্য। চারপাশটা সোনালী রোদে ঝলমল করছে। চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া বাসটি রাস্তা ধরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে। ডানপাশের সারির একটি সিটে বসে ঘুমে ঢুলছে শুভ্রতা। জানালা ভেদ করে আসা অবাধ্য হাওয়া মাঝে মাঝেই উড়িয়ে দিচ্ছে শুভ্রতার ঘোমটা দেওয়া আঁচলটা। সাদাফ নিবিড় চোখে তাকিয়ে আছে শুভ্রতার চোখে মুখে। ঘুমু ঘুমু মিষ্টি মেয়েটিকে বুকে টেনে নিয়ে ঘুমোনোর একটা সুযোগ করে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে। তাদের পাশের সারিতে এক সিট পেছনেই বসেছেন সাদাফের বাবা-মা। আর যায় হোক, বাবা-মার সামনে তো আর বউকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা যায় না। শুভ্রতা নিজের ঘুম নিয়ন্ত্রণের যথাসাধ্য চেষ্টা করার পরও লাভ বিশেষ হচ্ছে না। এর আগেও অনেক বারই রাগ জেগেছে শুভ্রতা। কখনো এতোটা ঘুম পায় নি! সাদাফ চোখ ঘুরিয়ে পাশের সারিতে তাকালো। বাসের প্রায় বিশটা সিটই সাদাফদের রিজার্ভ করা। সাদাফের বন্ধু, তাদের স্ত্রী এবং আত্মীয় স্বজন মিলে প্রায় বিশ জন। শুভ্রতা ঘুমে আবারও সামনের দিকে ঢুলে পড়ছে। শুভ্রতাকে এক হাতে সামলে নিয়ে ঠিকঠাকভাবে সিটে বসিয়ে দিতেই ম্যাসেজ টুন বাজলো। শুভ্রতা বারবার ঘুমিয়ে পড়ছিলো বলে তার ফোনটা নিজের হাতে রেখেছিলো সাদাফ। ম্যাসেজ টুন কানে যেতেই ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাল সাদাফ, অর্পনের ম্যাসেজ।
—-” ওই? বর পেয়ে আমাদের ভুলে গেলি? স্বার্থপর মাইয়া। এখনও নিশ্চয় মাখো মাখো প্রেম করছিস?”
সাদাফ ম্যাসেজটা দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের সারির পেছনের দিকে তাকাল। তারপর ম্যাসেজ পাঠাল,
—-” তোমার বান্ধবী ঘুম পেয়ে তার বরকেও ভুলে গিয়েছে শ্যালিকা। কিন্তু, শশুর-শাশুড়ির সামনে ঘুমটাকেও আপন করে নিতে পারছে না বেচারী।”
অর্পণের জবাব এলো,
—-” ওহহো! কি এমন করেছেন রাতে যে বর রেখে ঘুমকে আপন করে নিল আমার বান্ধবী? আমাকে কিন্তু বলতেই পারেন ভাইয়া। আমি আবার মাইন্ড টাইন্ড করি না।”
সাদাফ হাসলো, জবাব দিলো না। প্রায় সাথে সাথেই পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো অর্পণ। অর্পণকে এভাবে চেঁচাতে দেখে হকচকিয়ে গেল সাদাফ। বাসের প্রতিটি চোখ ঘুরে এসে তার উপর নিবদ্ধ হলো। অর্পণ উঁচু গলায় বলল,
—-” সাদাফ ভাইয়া? আপনারা কি এই সিটটাই বসবেন প্লিজ? আমার এই সিটে সাফোকেশন হচ্ছে। সামনের সিট ছাড়া বসতে পারি না আমি।”
সাদাফ তাড়াহুড়ো করে বলল,
—-” সমস্যা নেই। চলে এসো।”
অর্পণের সাথের সিটটাতে বসেছিল সাদাফের বন্ধু রাফাত। অর্পণ তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
—-” চলুন জলদি।”
রাফাত অবাক হয়ে বলল,
—-” কোথায়?”
—-” কোথায় আবার? সামনে।”
—-” আপনার সমস্যা হচ্ছে আপনি যান। আমি গিয়ে কি করবো?”
অর্পণ বিরক্ত হয়ে বলল,
—-” আপনি গিয়ে গান গাইবেন। আশ্চর্য বেকুব তো আপনি! আমি সামনে গেলে সাদাফ ভাই পেছনে আসবেন। আর আপনি উঠলে শুভ্রতা। আপনি এখানে বসে থেকে তাদের দু’জনকে আলাদ করে দিতে চাইছেন? ঘরের শত্রু বিভীষণ।”
রাফাত কপাল কুঁচকে তাকাল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো। অর্পণ খুশি হয়ে বলল,
—-” গুড বয়। বাসে আপনি আমার পার্টনার। সো, বাস জার্নি চলাকালীন আমি যেখানে যেখানে যাবো আপনিও সেখানেই যাবেন। এটাই নিয়ম।”
রাফাত হাই তুলতে তুলতে বলল,
—-” আচ্ছা। যখন ওয়াশরুমে যাবেন আমাকে জানাবেন। আমি খুব উৎসাহের সহিত সঙ্গ দেব।”
অর্পণ নাক ফুলিয়ে বলল,
—-” কি বললেন?”
—-” যা শুনলেন।”
—-” আপনি তো দেখি খুবই অসভ্য একটা মানুষ।”
রাফাত হেসে বলল,
—-” জ্বি না। আমি খুবই সভ্য একটা মানুষ। তবে, আপনি খুব একটা ভদ্র মানুষ নন।”
অর্পণ ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-” আপনি কি আমায় অভদ্র বলতে চাইছেন? আমি কি অভদ্রতা করলাম আপনার সাথে?”
—-” এইযে, আপনার থেকে আট/নয় বছরের বড় ছেলের ওপর ইচ্ছেমতো হুকুমজারি করছেন। এটা অবশ্যই অভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে।”
অর্পণ অবাক হয়ে বলল,
—-” আশ্চর্য! আমার থেকে আট/নয় বছরের বড় ছেলের সাথে কখন কি করলাম? কার কথা বলছেন?”
—-” আমার কথা।”
—–” আপনি আমার থেকে আট বছরের বড়?”
রাফাত ক্লান্ত গলায় বলল,
—-” সাদাফ যেহেতু আপনার থেকে আট বছরের বড় সেহেতু আমিও বড়। আমি আর সাদাফ সমবয়সী কিনা! এখন প্লিজ এগোন।”
রাফাতের কথায় খানিকটা হোঁচট খেলো অর্পণ। বয়সের পার্থক্যটা গিলতে খানিক সময় লাগলো। সাদাফদের সিটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শুভ্রতাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাদাফ। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলল,
—-” থেংকিউ শালি সাহেবা।”
অর্পণ বিগলিত হেসে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলো,
—-” এনি টাইম!”
পেছনের দিকের সিটটাতে বসেই শুভ্রতার মাথাটা টেনে নিজের কাঁধে রাখলো সাদাফ। ডানহাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো,
—-” এবার নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন ম্যাডাম। আশেপাশে আর শশুর-শাশুড়ির ভয় নেই।”
শুভ্রতা ঘুমু ঘুমু চোখ তুলে তাকাল। মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে আবারও কাঁধে মাথা রাখলো। সাদাফের বামবাহুটা দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুজলো। আহ! কি শান্তি। আচ্ছা? এই মানুষটির স্পর্শে এতো শান্তি, এতো ভরসা কেন পায় শুভ্রতা? ভালোবাসে বলে? নাকি স্বামী মানেই শান্তিময়, স্নিগ্ধ এক সে!
#চলবে….
(রি-চেইক করা হয় নি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়]