# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব – ৬৪
শহরজুড়ে সন্ধ্যা নেমেছে। রাস্তায় গাড়ির হেড লাইটের অসংখ্য আলো। শুভ্রব ব্যস্ত ব্রিজটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বসন্তের মিষ্টি বাতাসে চুলগুলো অল্পবিস্তর উড়ছে। গায়ে অফিসের ফিটফাট পোশাক। চোখে-মুখে ক্লান্তি। ডানহাতের আঙ্গুলে আধপোড়া সিগারেট। উদাসী, অন্যমনস্ক চোখদুটো কোথাও স্থির থাকতে পারছে না। অনবরত এদিক,ওদিক ছুটছে। মাথায় অর্থহীন চিন্তাগুলো উলোটপালোট ছক আঁকছে। হঠাৎই মুখের ওপর তীব্র আলো এসে পড়ায় ভাবনা ছুটলো শুভ্রবের। ভ্রু, কপাল কুঁচকে বামহাতে চোখ আড়াল করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিভে গেল আলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টয়োটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সাদাফ। টাইয়ের নাটটা ঢিল করে ব্রিজের রেলিংয়ের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সে। হাতদুটো ভাঁজ করে অত্যন্ত নরম গলায় বলল,
—-‘ কেমন আছ শুভ্রব?’
শুভ্রব হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে হাসলো। গাড়ি ইশারা করে বলল,
—-‘ গাড়িটা ভালো হয়েছে সাদাফ ভাই। তবে, গাড়ি পালা ভীষণ খরচ। তারওপর লোন তো আছেই।’
সাদাফ হেসে বলল,
—-‘ এই অবস্থায় শুভ্রতাকে বাইকে বা সিএনজিতে ভার্সিটি নিয়ে যেতে ভরসা পাই না। তাই বাধ্য হয়েই কিনলাম। তাছাড়া, প্রমোশনটাও হয়ে গিয়েছে। আপাতত ততোটা চাপ হবে না।’
শুভ্রব হাসলো। সাদাফ আবারও প্রশ্ন করলো,
—-‘ কেমন আছো বললে না তো।’
শুভ্রব অমায়িক হেসে বলল,
—-‘ হঠাৎ এতো ঘটা করে জিগ্যেস করছেন, সাদাফ ভাই। শুভি নিশ্চয় বাড়িয়ে টাড়িয়ে বলেছে? ওমন কিছুই না। ভালো আছি।’
—-‘ আমার সামনে স্মোক করতে পারো, সমস্যা নেই। সম্পর্কে আমি তোমার ছোট।’
শুভ্রব হঠাৎই ভীষণ লজ্জা পেলো। মাথা নুইয়ে লাজুক হেসে বলল,
—-‘ কি যে বলেন ভাই। সেই বাচ্চাকাল থেকে আপনাকে বড় ভাই জেনে আসছি। আজ হঠাৎ… ‘
শুভ্রবের কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো সাদাফ। বলল,
—-‘ বাচ্চাকাল! ভালো বলেছ। তবে বাচ্চাকাল বলা যায় না। তুমি হয়ত ততোদিনে কারো প্রেমিক হয়ে গিয়েছিলে।’
শুভ্রব হেসে বলল,
—-‘ হতে পারে। তখন প্রেম নেহাৎ কম করি নি। নিব্বা- নিব্বি প্রেম।’
—-‘ তোমার পিঠ-পিছে তোমার বোনের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেছিলাম বলে কখনো ক্ষোভ জাগে নি তোমার?’
সাদাফের এমন কথাবার্তায় শুভ্রবের ভীষণ লজ্জা লাগছে। সে কখনোই লাজুক প্রকৃতির ছেলে নয় তবুও লাগছে। লজ্জায় চোখ তুলে তাকানো যাচ্ছে না। শুভ্রব জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদু হাসলো। বলল,
—-‘ সম্পর্কটা মানুষ গোপনেই গড়ে তোলে। আমি তো আমার বোনের বেস্ট ফ্রেন্ডকেই পটিয়ে ফেলেছিলাম। গোটা চার বছর লুকিয়ে জবরদস্ত প্রেমও করেছি। শেষ পর্যন্ত এই মাথামোটা মেয়েটা যে কিভাবে বুঝে গেল আল্লাহ মালুম।’
কথাটা বলে হাসলো শুভ্রব। হাসলো সাদাফও।
—-‘ আমার সামনে আমার বউকে মাথামোটা বলছ!’
শুভ্রব কৌতুকমাখা কন্ঠে বলল,
—-‘ আপনার বউকে কিছু বলার সাহস আছে নাকি আমার, সাদাফ ভাই? আমি তো আমার বোনকে মাথামোটা বলেছি। এখন, আমার বোন যদি কোনোভাবে আপনার বউ হয়ে থাকে তাহলে সেটা অন্য ব্যাপার।’
সাদাফ হাসল। বলল,
—-‘ চলো, কোথাও বসা যাক। কথা আছে তোমার সাথে।’
শুভ্রব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল,
—-‘ সিরিয়াস কিছু?’
—-‘ আরে না। তেমন কিছু নয়।’
—-‘ এই একবছরে, এই প্রথম ডেকে পাঠিয়েছেন আমায়। জটিল না হলেও খুব সিম্পল কিছু যে হবে না, তা বেশ বুঝতে পারছি। চলুন, যাওয়া যাক।’
কথাটা বলে গাড়ির দিকে এগোতে নিতেই পেছন থেকে বলে উঠলো সাদাফ,
—-‘ চলো এখানেই বসি। এই মুহূর্তে রেস্টুরেন্টের কৃত্রিম পরিবেশ ভালো লাগবে না ।’
শুভ্রব প্রত্যুত্তর না করে রাস্তার পাশে ফুটপাতে বেশ আয়েশ করে বসল। তার নিজেরও এই মুহুর্তে রেস্টুরেন্টের মতো অতি ভদ্র পরিবেশে যাওয়ার ইচ্ছে জাগছে না। অতিরিক্ত মেকি এই শহরে, এই যানবাহনে পূর্ণ এলোমেলো রাস্তাটাই যেন সত্য। ভীষণ সত্য। সাদাফও শুভ্রবের পাশে কিছুটা তফাতে বসলো। কিছুক্ষণ দু’জনই নীরবে শহরের কোলাহল শুনলো। তারপর হঠাৎ করেই বলল,
—-‘ তোমার বোন তোমায় খুব ভালোবাসে।’
শুভ্রব অপ্রস্তুত হাসল। মাথা দুলিয়ে বলল,
—-‘ জানি।’
—-‘ তুমিও ওকে খুব ভালোবাসো, তাই না?’
—-‘ একটা বোনই। ভালো না বেসে উপায় আছে?’
—-‘ আমারও একটাই বোন।’
সাদাফের কথায় চমকে উঠল শুভ্রব। মনের মধ্যে একটা শঙ্কা টনটন করে উঠলো। মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরতে লাগল বরংবার, পৃথার পাগলামোর জন্য শুভ্রতার সংসারে অশনি কিছু ঘটবে না তো? শুভ্রব শুকনো কন্ঠে বলল,
—-‘ জানি।’
সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—-‘ তনয়াকে খুব ভালোবাসো?’
শুভ্রব তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
—-‘ বাসি।’
—-‘ বাকি জীবনটা কি একাই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছ?’
শুভ্রব উত্তর দিল না। সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু’হাতে ভর দিয়ে পেছন দিকে হেলে বসল। শান্ত গলায় বলল,
—-‘ আমি তোমার অনুভূতি এবং সিদ্ধান্তকে সম্মান করি শুভ্রব। তুমি কতটা ভোগান্তির মধ্যে আছো তা আমার পক্ষে জানা বা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমি নিজে একজনকে প্রচন্ড ভালোবাসি। আমি যাকে হারিয়ে ফেলার কথা চিন্তাও করতে পারি না সেখানে তুমি তাকে হারিয়েছ। বুঝতে পারছি আমি। তোমার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো তোমার মতোই আচরণ করতাম। কিন্তু সমাজে কিছু থার্ড পার্সোন থাকে। আজ বাধ্য হয়ে সেই থার্ড পার্সোনের রোলটাই প্লে করতে হচ্ছে আমায়। সরি শুভ্রব।’
শুভ্রব নিশ্চুপ। চোখদুটো রাস্তার ওপর নিবদ্ধ। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মৃদু গলায় বলল,
—-‘ পৃথা কি এখনও?’
সাদাফ হেসে বলল,
—-‘ আমরা এতো বড় হয়েই অনুভূতি সামলাতে পারি না। আর ও তো বাচ্চা একটা মেয়ে। এই বয়সে মাথায় এসবই ঘুরে।’
শুভ্রব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
—-‘ আপনি কি বলতে চাইছেন তা বুঝতে পারছি।’
এটুকু বলে চুপ করল শুভ্রব। ঢোক গিলে নিয়ে বলল,
—-‘ আমি আপনাকে অনেক সম্মান করি সাদাফ ভাই। আপনি খুবই সুবিবেচক মানুষ। যা বলেন, ভেবেচিন্তেই বলেন। কিন্তু, সত্যিটা হলো পৃথা আমার সাথে ভালো থাকবে না। ওকে আমি ভালো রাখতে পারব না। ওকে ভালো রাখতে পারার ওয়ান পার্সেন্ট সম্ভবনাও যদি থাকতো তবুও আমি চেষ্টা করতাম। কিন্তু হবে না। আমি অনেক ভেবেছি সাদাফ ভাই। ওকে আমি বিয়ে করলে না আমি ভালো থাকার চেষ্টা করতে পারব না ওকে ভালো রাখার চেষ্টা করতে পারব। বাচ্চা একটা মেয়ে পৃথা। সুন্দর একটা জীবন আছে ওর। আমার থেকে অনেক ভালো কাউকে পাবে ও।’
—-‘ কারো প্রতি অনুভূতি কি ভালো-খারাপের মাত্রা বিবেচনা করে আসে শুভ্রব? আর সবার প্রতি কি সবার অনুভূতি আসে? যাকে বেস্ট মনে হয় অনুভূতিটা মূলত তার প্রতিই আসে। পৃথার হয়ত তোমাকেই বেস্ট মনে হয়েছে। তাই ওর উনিশ বছরের জীবনে অনুভূতিটা শুধু তোমার ওপরই এসেছে।’
শুভ্রব কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলে উঠলো সাদাফ,
—-‘ আমি তোমাকে কোনোভাবেই প্রেশার ক্রিয়েট করছি না শুভ্রব। তুমি যদি ভেবে থাকো তোমার বোনের কথা বলে তোমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করব, তাহলে ভুল ভাবছ। তোমার বোনটা আমার স্ত্রী শুভ্রব। দামাদামির বস্তু নয়। আমার বোনের সুখের সাথে আমার স্ত্রীর সুখের পাল্লা আমি দেব না। আমি পৃথার বড় ভাই হিসেবেও ডাকি নি তোমায়। এই সম্পর্কগুলোর বাইরে তোমার-আমার যে সম্পর্ক ছিল সেই হিসেবেই ডেকেছি। ভার্সিটি সিনিয়র হিসেবে আগেও অনেক উপদেশ দিয়েছি আজ নাহয় আরেকটু দিলাম। বিরক্ত হবে তাতে?’
শুভ্রব হাসলো। সাদাফ শুভ্রবের কাঁধে হাত রেখে বলল,
—-‘ আমাকে স্বাভাবিকভাবে নাও শুভ্রব। নিজের ভেতরের কথাগুলো বলো। খুব আপন কেউ নয়তো খুব অপরিচিত কেউ ভেবেই না’হয় নিজের কথাগুলো শেয়ার করো। বুকে আটকে থাকলেই ব্যথা। বিষফোঁড়ার বিষ বের না করলে কি বিষব্যথা কমবে?’
নিশ্চুপ শুভ্রব দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশটা তারায় তারায় ভরা। ছোটবেলায় শুভ্রব তারাকে বলত আকাশফুল। শিউলি ফুলের মতো রাতেই এদের ফোটার উপযুক্ত সময়। শেষ রাতে এগুলো ঝরে পড়বে ভেবে রাত জাগার কত চেষ্টায় না করত শুভ্রব। কিন্তু রাত জাগাটা আর হয়ে উঠত না। সকালে ওঠে তারাবিহীন আকাশ দেখে তার সেকী কান্না! কে নিলো অতোগুলো আকাশফুল? শুভ্রব কে কি একটাও দেওয়া যেত না? ছোট বেলার কথা ভেবে নিজের মনেই হাসল শুভ্রব। খুব ধীরে কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল,
—-‘ আমার আসলে বলার মতো কোনো কথা নেই সাদাফ ভাই। সব মানুষকে হয়তো নির্দিষ্ট পরিমাণ ভালোবাসা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠানো হয়। আমার ভাগের ভালোবাসাটুকু আমি তনুজাকে উপুড় করে দিয়েছিলাম। এখন সেই ঘট শূন্য। আমি অন্যকোনো মেয়েকে আমার খুব কাছাকাছি কল্পনা করতে পারি না। আমি অন্যকোনো মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না। আমার মধ্যে কোনোরকম থ্রিল কাজ করে না। নারী মন, নারী দেহ কোনোকিছুর প্রতিই না। সবকিছু আবেগশূন্য মনে হয়।’
সাদাফ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। শুভ্রবকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে চুপ করে রইলো। শুভ্রব কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
—-‘ আমার জীবনে অন্যকোনো মেয়ের আসার সম্ভবনাতেও ভয় হয়। মনে হয়, আমি তনুজাকে ঠকাচ্ছি। আমার ওপর তনুজা ব্যতীত অন্যকারো অধিকার থাকতে পারে না।’
সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—-‘ তোমার সবটায় যার অধিকার, তার সবটায় এখন অন্যকারো অধিকার শুভ্রব। সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় অনুভূতি, সম্পর্কের সুতো। তনয়া এখন বিবাহিত। অন্যকারো ঘরে তার সাজানো গোছানো নিজস্ব একটা সংসার। সে এখন মা। পৃথিবীতে ওর বেঁচে থাকার জন্য এবং ভালো থাকার জন্য অনেক কারণ আছে। কিন্তু তোমার নেই। তুমি ভাবছ, তনয়া তোমার জন্য অসুখী। সে ভালো নেই। আমিও মানি তনয়া ভালো নেই। কিন্তু তা তোমাকে না পাওয়ার দুঃখের জন্য যতটা নয় তার থেকে বেশি অপরাধবোধের জন্য। তুমি যেমন ভাবছ, তোমার জন্য ও অসুখী। তোমার ওপর শুধু ওর অধিকার ঠিক তেমনই হয়তো সেও ভাবছে। আর সেই অপরাধবোধের কারণেই সে চেয়েও ভালো থাকতে পারছে না। দিনশেষে একটা গ্লানি কাজ করছে। তোমাকে অসুখী দেখে সে সুখী হতে পারছে না।’
এটুকু বলে থামল সাদাফ। পকেট থেকে ফোন বের করে শুভ্রবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
—-‘ দেখো।’
শুভ্রব চোখ ফিরিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। স্ক্রিন আলো করে ভাসছে তনয়ার হাস্যোজ্জল মুখ। কোলে সাদা তোয়ালেতে পেঁচানো নিষ্পাপ ছোট্ট শিশু। তনয়া হাস্যোজ্জল মুখে কাঁধ চেপে দাঁড়িয়ে থাকা একটি যুবকের দিকে তাকিয়ে আছে। যুবকের চোখে-মুখে মুগ্ধতা যেন ঠিকরে পড়ছে। সাদাফ মৃদু গলায় বলল,
—-‘ ও তনয়ার হাজবেন্ড, আরহান। ভদ্রলোকের সাথে দু’একবার কথা হয়েছিল আমার। তোমার মতো অতো সুদর্শন না হলেও মানুষ হিসেবে চমৎকার। তনয়াকে তার প্রেমিকের মতো ভালো না বাসলেও স্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট সমাদর করে। তনয়ার চোখ-মুখ বলে, সে লোকটিকে ভালোবাসে বা ভালোবাসতে চায়। কিন্তু পিছুটানের জন্য পারছে না।’
শুভ্রব আবারও ছবিটির দিকে তাকাল। তনয়ার হাস্যোজ্জল মুখটাতে কোনো কৃত্রিমতা নেই। চোখে-মুখে অদ্ভুত সুখের আভা। শুভ্রবের ভেতরটা জ্বালা করে উঠলো। সে তো এমনটাই চেয়েছিল, তাহলে হঠাৎ এমন জ্বলন-পোড়ন কেন? সাদাফ ফোনটা পকেটে রেখে শান্ত গলায় বলল,
—-‘ এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একাভাবে বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন শুভ্রব। দিনশেষে ভালোবাসাটা না জুটুক, একটা বিশ্বস্ত হাতের খুব প্রয়োজন। যার হাতটা ধরে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাবে। সুখ-দুঃখগুলো শেয়ার করা যাবে। তনয়ার প্রতি ভালোবাসাটা থাকুক। তারসাথে অন্য একজনকেও আসতে দাও। ভালো না বাসতে পারো বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো সারাটা জীবন পাশে চলার স্বীকৃতিটা দাও। পৃথা বাচ্চা মেয়ে হলেও খুব শক্ত একটা মেয়ে। তুমি ওকে তোমার সমস্যাটা বুঝিয়ে বললে সে বুঝবে। তুমি যদি শুধু হাতটা ধরে সারাটা জীবন কাটাতে বলো তবুও সে পারবে। ছোট থেকে দেখে আসছি ওকে, এটুকু জানি। এসবের বাইরে যদি তোমার পৃথাকে ভালো না লাগে তাহলে পৃথার জায়গায় অন্যকাউকে সুযোগ দাও। আমার কোনো অভিযোগ নেই। পৃথারও থাকবে না। আমি ওকে বুঝাব। হয়তো, তনয়ার মতো ওর ও একটা দীর্ঘশ্বাস থেকে যাবে তবে ও বুঝবে। জীবনটাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া অন্যায় নয় শুভ্রব। আর এই দ্বিতীয় সুযোগ যদি চারটা জীবনে ভালো কিছু মুহূর্ত এনে দেয় তাহলে তো কখনোই নয়।’
এটুকু বলে থামলো সাদাফ। বাম হাতের কব্জিতে থাকা ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,
—-‘ আটটার বেশি বাজে। এখন না উঠলে বাসায় পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। তুমিও চলো আমার সাথে। আজকের ডিনারটা নাহয় ছোট বোনের বাসাতেই করলে।’
শুভ্রব মলিন মুখে বলল,
—-‘ আজ নয় সাদাফ ভাই। অন্য কোনোদিন।’
—-‘ আরে চলোই না। মানুষের হায়াত মউতের কোনো ঠিক আছে? অন্য কোনোদিন আমাদের জীবনে আসবে তারই তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
শুভ্রব হাসার চেষ্টা করে বলল,
—-‘ তা নেই জানি। তবুও আজ থাক সাদাফ ভাই।’
সাদাফ আর জোর করলো না। শুভ্রবের পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বলল,
—-‘ চলো, পৌঁছে দিচ্ছি।’
_______________________
সুন্দর ঝকঝকে একটি সকাল। বারান্দায় লাগানো গাছগুলো বাতাসে তরতর করে কাঁপছে। পাতায় পাতায় সোনালী রোদের খেলা, সকালটাকে আরো বেশি মোহনীয় করে তুলেছে। শুভ্রতা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা খুব ভালো আজ। এই মন ভালো হওয়ার পেছনে যেমন বিশেষ কোনো কারণ নেই আবারও আছেও। এইতো কিছুক্ষণ আগেও ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কাটতে গিয়ে মনে পড়েছে তুতুনের আসতে আর মাত্র বারো দিন বাকি। তারপরই এক আকাশ স্বপ্ন ঠিকরে পড়বে শুভ্রতার কোলে। সাদাফ আর তার ছোট্ট সংসারটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। ছোট ছোট হাত-পা মেলে কাছে ডাকবে। মা ডাকবে। কথাগুলো ভাবতেই সারা শরীর শিউরে উঠলো শুভ্রতার। রুমের ভেতর থেকে সাদাফের ডাকে ঘোর কাটলো শুভ্রতার। শুভ্রতা ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই তাড়াহুড়ো করে বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়াল সাদাফ। হাতের ঘড়িটা ঠিক করতে করতে বলল,
—-‘ মা কাল থেকে ফোন করছেন। কাল রাতে তোমায় নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখেছেন। তোমাকে নাকি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমার অফিসে কাজ আছে। গাড়ি রেখে যাচ্ছি। শুভ্রব এসে নিয়ে যাবে তোমাদের। আজ আর ফেরার দরকার নেই। একদিনে এতো জার্নি ঠিক না।’
শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে বলল,
—-‘ আর তুমি?’
সাদাফ হাসলো। কয়েক পা এগিয়ে শুভ্রতার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত দুটো শুভ্রতার গালের ওপর রেখে পরম আবেশে চুমু খেলো কপালে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
—-‘ অফিস শেষে আমিও আজ শশুরবাড়ি রওনা হবো মহারাণী। ভয় নেই। বর ছাড়া থাকতে হবে না আপনাকে।’
শুভ্রতা লজ্জায় লাল হলো। দুইহাতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
—-‘ তোমার যত বাজে কথা। আমি ওভাবে বলি নি। বাসায় একা থাকবে। কি খাবে, কি না খাবে তাই বলছিলাম।’
সাদাফ ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
—-‘ আচ্ছা! তাই?’
—-‘ হু।’
মৃদুস্বরে জবাব দিয়েই সাদাফের মুখের দিকে তাকাল শুভ্রতা। সাদাফকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। সাদাফের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
—-‘ শুধু শুধু এমন বিশ্রী করে হাসবে না তো।’
—-‘ আমি বিশ্রী করে হাসি নাকি?’
—-‘ এখন হাসছ। আমাকে লজ্জা দেওয়ার জন্য জোরপূর্বক হাসছ।’
—-‘ তুমি অযথা লজ্জা পেলে তা আমার দোষ?’
শুভ্রতা উত্তর দিল না। সাদাফ শুভ্রতার কপালে আরো একটা উষ্ণ পরশ দিয়ে বলল,
—-‘ আচ্ছা, আমার দেরি হচ্ছে। সাবধানে থেকো কেমন? রাতে দেখা হবে।’
দশটা নাগাদ শুভ্রব এলো। বাসায় ঢুকেই হুলস্থুল বাঁধিয়ে দিয়ে বলল,
—-‘ এখনও রেডি হোস নি। ফাজিল মাইয়া। অফিসে হাফ টাইম ছুটি নিয়েছি আমি। সময় নাই, জলদি আয়।’
শুভ্রতা আর পৃথাকে দৌড়ের ওপর রেডি করিয়ে নিচে নামলো সে। লিফটে ওঠে স্থির হয়ে দাঁড়ানোর পর প্রথম পৃথাকে খেয়াল করল শুভ্রব। পৃথা তাকে চায় কথাটা মনে পড়তেই মনের মাঝে অদ্ভুত এক অস্বস্তি দানা বাঁধলো। গাড়িতে সামনের মিররে বার দুয়েক পৃথাকে লক্ষ্য করলো শুভ্রব। পাতলা গোলাপি ঠোঁট, কাটা কাটা নাক, কাঁধের নিচ পর্যন্ত কালো ঘন চুল। ছোট ছোট চোখগুলো ঘন পাপড়িতে ঢাকা। গোলাপি সালোয়ার কামিজে কাম্য এক যুবতী। কিন্তু শুভ্রবের অনুভূতিরা খেললো না। হাজার চেষ্টার পরও পৃথার রূপে সে আকৃষ্ট হতে পারছে না।
#চলবে…
[ অর্ধেক লিখেই পোস্ট করতে হলো। দুঃখিত!]