আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৪৮
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
ফাইলে থাকা কাগজগুলো মনোযোগী দৃষ্টিতে নিরক্ষণ করল ফারদিন। সবগুলো কাগজ উল্টেপাল্টে দেখার পর মুখ তুলে সাদাফের চোখের দিকে তাকাল। সাদাফ মৃদু হেসে বলল,
—-” আপনি কিছু নিবেন? কফি দিতে বলি?”
—-” ইট’স ওকে। আমি কিছু নিব না।”
সাদাফ ওয়েটারকে ইশারা করে দুই কাপ কফির অর্ডার দিল। অর্ডার দেওয়ার পর চেয়ারে ঠেস দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসল সাদাফ। ফারদিনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে নিয়ে বলল,
—-” কফি খেতে খেতে কথা বলাটা বোধ হয় বেশি ভালো হবে। নয়ত, কথার মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।”
ফারদিন হালকা মাথা ঝাঁকাল। চোখে-মুখে হাজারও প্রশ্ন আর দ্বিধা নিয়ে বলল,
—-” আপনাদের গল্পটা শুনতে চাইছি।”
সাদাফ টেবিলে দু’হাত রেখে খানিকটা এগিয়ে বসে বলল,
—-” অবশ্যই। গল্পটা বলতেই এসেছি। আজ থেকে প্রায় একবছর তিন মাস আগে শুভ্রতার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই আমি। ব্যাপারটা খানিকটা সিনেম্যাটিক হলেও আমাদের দু’জনের জন্য সুন্দর একটি সত্য। কিছু কমপ্লিকেশনের জন্য ফ্যামিলিকে বিষয়টা জানানো হয় নি তখন। আমাদের দু’জনেরই বিশ্বাস ছিল ফ্যামিলি থেকে তেমন কোনো বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে না আমাদের। প্ল্যান ছিল নিজেদের একটু গুছিয়ে নিয়ে পারিবারিকভাবে আবারও বিবাহ বন্ধনে জড়াব আমরা। বাট ইউ নৌ.. টাইমিং ইজ আ বিগ ফ্যাক্ট। দুর্ভাগ্যবশত, এই সময়টাই আমাদের সাথে ছিল না। যার ফলে, শুভ্রতার দাদুর হজ্জে যাওয়া এবং উনার হঠাৎ মৃত্যুতে আমরা দু’জনেই থমকে গিয়েছিলাম। শুভ্রতার দাদুর মৃত্যুর ফলে সিম্পল বিষয়টা ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে গিয়ে ঠেকেছে। শুভ্রতা আইনত এবং ধর্মীয় দু’দিক থেকেই আমার স্ত্রী। তার পরিবার মেনে নেওয়া বা না নেওয়া দিয়ে আমি আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দেব না। আর না শুভ্রতা আমায় ছাড়বে। মাঝ থেকে সুন্দর একটা পরিবার ভেঙে যাবে। সেইসাথে ভাঙবে বাবা-মার মন। তাছাড়া, শুভ্রতার বাবা- চাচাদের মধ্যে একটা আক্ষেপও থেকে যাবে। আর সেই আক্ষেপটা কোনো না কোনো সময় শুভ্রতাকেও ঝাপটে ধরবে। আমি কোনো কিছুর বিনিময়েই আমার স্ত্রীকে ডিপ্রেসড বা দোষী হিসেবে দেখতে চাই না। আপনি বিয়ে ভাঙলে শুভ্রতাকে পাব নয়ত নয় এমনটা ভেবে আপনার কাছে আসি নি। কারণ, শুভ্রতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমারই। আমি এসেছি শুভ্রতার বাবা-মার জন্য। আমি চাই না উনারা কোনোভাবে শুভ্রতাকে ব্লেইম করুক বা একটা অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকুক। আর তাদের এই অপরাধবোধ থেকে মুক্ত দিতে পারেন শুধুই আপনি। আমার মনে হয় আপনি খুবই বুদ্ধিমান একজন মানুষ। আর আপনার ডিসিশনটাতেও বুদ্ধিদীপ্ত কিছু নিশ্চয় থাকবে।”
এটুকু বলে দম নিল সাদাফ। ফারদিন এতোক্ষণ মনোযোগী শ্রোতার মতো সাদাফের কথাগুলো শুনছিল। সাদাফ থামতেই চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল ফারদিন,
—-” আপনার কি মনে হয়? আমি কি ডিসিশন নেব?”
সাদাফ হেসে বলল,
—-” আপনি বিয়েটা ভেঙে দেবেন।”
—-” আপনার এমনটা কেন মনে হল?”
—-” আপনার বিয়ে ভাঙার পেছনে তিনটা বেশ ভালো কারণ আছে। প্রথমত, আপনি জানেন, আপনি চাইলেও শুভ্রতাকে বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ, সে অলরেডি আমার স্ত্রী। দ্বিতীয়ত, এই বিয়ের সাথে আপনার আত্মসম্মান জড়িয়ে আছে। বিয়েটা আপনাদের পক্ষ থেকে ক্যান্সেল না হয়ে মেয়েপক্ষ থেকে ক্যান্সেল হলে আপনার আত্মসম্মানে আঘাত লাগার সুদৃঢ় সম্ভাবনা আছে। সেই সাথে আপনার ফ্যামিলির মানসম্মানের ব্যাপারটাও এই বিয়ের সাথে সূক্ষ্মভাবে জড়িয়ে আছে। তৃতীয়ত, আপনি একজন বিবেকবান এবং বিচক্ষণ মানুষ। মানবতার খাতিরে হলেও আমার সাথে সহমত জ্ঞাপন করবেন আপনি। আমি কি ঠিক বললাম?”
ফারদিন মুচকি হাসল।
—-” আপনি বেশ যুক্তিবাদী পুরুষ। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আসলে, কাল বিকেলে যখন শুভ্রতা আমার কাছে এসেছিল তখন আমি ভেবেছিলাম বিষয়টা সম্পূর্ণই বানোয়াট। শুভ্রতার মামু আমাকে বলেছিলেন, শুভ্রতার নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই। তবে বিয়ের ব্যাপারে খানিকটা ছেলেমানুষ বলে সব সময় বিয়ে ভাঙা বা বিয়ে বিষয়টা থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই শুভ্রতার কথাটায় গুরুত্ব দিই নি আমি। আপনার কথাটাও হয়ত বিশ্বাস করতাম না কিন্তু আপনার চোখ বলছে, আপনি মিথ্যা বলছেন না।”
ফারদিনের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকাল সাদাফ। অবাক হয়ে বলল,
—-” শুভ্রতা আপনার সাথে দেখা করেছিল?”
—-” হ্যাঁ। করেছিল। সাথে উনার দু’জন ফ্রেন্ডও ছিল। আমি ভাবতেও পারি নি এমন কিছু হতে পারে। সরি ফর দেট।”
সাদাফ ব্যস্ত হয়ে বলল,
—-” প্লিজ ডোন্ট ছে সরি। আই থিংক, সরি টা আমাদেরই বলা উচিত। আপনি অপেক্ষা করছিলেন…. ”
—-” ইট’স ওকে। আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা হয়ত শুভ্রতা নিজেও জানতেন না। উনাকে জানানো হয় নি। সম্পূর্ণটাই একটা এক্সিডেন্ট বা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। আমি আজ রাতেই বাবার সাথে কথা বলব।”
সাদাফের ঠোঁটে হাসির রেখা প্রসারিত হল। আনন্দিত গলায় বলল,
—-” থেংকিউ। থেংকিউ সো মাচ।”
—-” মাই প্লেজার মিষ্টার রাফাত।”
ফারদিনের সাথে টুকটাক কথা বলে আটটার দিকে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো সাদাফ। ফারদিনের কথা ঠিক থাকলে কাল সকালের মধ্যেই বিয়ে ভাঙার খবরটা পৌঁছে যাবে শুভ্রতার বাসায়। তবুও, সাদাফ যেন স্থির থাকতে পারছে না। বারবারই শুভ্রতাকে খবরটা দিয়ে চমকে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে সংযত করে বাসা পর্যন্ত পৌঁছাল সাদাফ। ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই অস্থিরতা বাড়তে লাগল তার। শুভ্রতার হাস্যোজ্জল মুখটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ রুমময় পায়চারী করে শুভ্রতার নাম্বারে ডায়াল করল সাদাফ। দু’বার, তিনবার, চারবারের মাথাতেও ফোন রিসিভ না হওয়ায় উত্তেজনায় উসখুস করতে লাগল সে। আরো ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর হঠাৎই টিনএজারদের মতো অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিল সাদাফ। শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে। এই মুহুর্তে মেয়েটাকে না দেখলে চলছে না সাদাফের। আচ্ছা? বিয়ে ভাঙার খবরটা শুনে কি শুভ্রতা খুশিতে ঝাপটে ধরবে তাকে? মাতাল করা হাসিতে পাগল করে দেবে তাকে? হয়ত দিবে। নিজের অদ্ভুত সব ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলল সাদাফ। শুভ্রতার জন্য করা মাঝরাতের এই পাগলামিতে নিজেই খানিকটা হকচকিয়ে গেল। মাথার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজতে লাগল লালনের সেই বিখ্যাত গান,
‘ যখন ও রূপ স্মরণ হয়
থাকে না লোক, লজ্জা, ভয়।
অধীন লালন বলে সদাই
ওই প্রেম যে করে সে জানে।।
আমার মনের মানুষেরি সনে
মিলন হবে কত দিনে।।’
_____________________
তারা ভরা বিশাল আকাশের নিচে চোখ বন্ধ করে বসে আছে শুভ্রতা। মাঝরাতের মৃদু হওয়ায় কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। এখানে সেখানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। রাস্তার পাশে থাকা কাঠগোলাপের গাছ থেকে অদ্ভুত এক সুগন্ধ ভেসে আসছে। শুভ্রতা দু’হাতে চুলগুলো মুঠো করে খোঁপায় জড়াল। আকাশের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় গেয়ে উঠল,
‘ আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ -দিবস,দীর্ঘ রজনি,দীর্ঘ বরস-মাস’
এটুকু গাইতেই ছাঁদের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেল শুভ্রতা। গান থামিয়ে কৌতূহলী চোখে সিঁড়ি ঘরের দিকে তাকাতেই হাস্যোজ্জল গলায় বলে উঠলেন শফিক সাহেব,
—-” কি রে? থামলি কেন? বেশ ভালো গাইছিলি।”
শুভ্রতা মৃদু হাসল। শফিক সাহেব ধীর পায়ে শুভ্রতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—-” এতো রাতে একা ছাঁদে বসে আছিস যে? মন খারাপ? ”
—-” উহুম।”
—-” এইতো মিথ্যা বলে ফেললি। মানুষ খুবই ভীতু প্রজাতির জীব। এরা সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। তাই সুযোগ পেলেই চট করে মিথ্যা বলে ফেলে। অন্যকোনো প্রাণী কিন্তু মিথ্যা বলে না।”
—-” মানুষ ছাড়া অন্যকোনো প্রাণী কথায় বলতে পারে না চাচ্চু। মিথ্যা কিভাবে বলবে?”
—-” তুই লজিকটা বুঝতে পারছিস না। আমি তোকে বুঝিয়ে বলছি।”
শুভ্রতা কপাল কুঁচকে বলল,
—-” প্লিজ চাচ্চু, তোমার এই লজিক ফজিক বুঝতে ইচ্ছে করছে না এখন।”
—-” ইচ্ছে না করলেও অনেক কিছুই করতে হয় মাই চাইল্ড। যেমন ধর আমার এখন সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। আমি ছাঁদে মূলত সিগারেট খেতেই এসেছি কিন্তু আমি খাচ্ছি না। এর মানে এই নয় যে আমার ইচ্ছেটা পাল্টে গিয়েছে।”
—-” তুমি চাইলে সিগারেট খেতে পারো চাচ্চু।”
শফিক চশমার গ্লাস পরিষ্কার করতে করতে বললেন,
—-” উহু। পারি না। মেয়ের সামনে বাবার সিগারেট খাওয়ার নিয়ম নেই।”
—-” কে বানিয়েছে এই নিয়ম।”
—-” দি শফিকুজ্জামান হক শফিক।”
শুভ্রতা হাসল। পরমুহূর্তেই মুখ কালো করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর উদাসী গলায় প্রশ্ন করল শুভ্রতা,
—-” তোমার কাছে তো সবকিছুর লজিক থাকে চাচ্চু। আমার এখন কি করা উচিত বলো তো?”
শফিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখের দৃষ্টিটাকে বিশাল আকাশে নিবদ্ধ করে চুপ করে রইলেন। শুভ্রতা এবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল। করুণ গলায় বলল,
—-” বললে না?”
শফিক হেসে বললেন,
—-” তুই ভাবছিস তোর বাবা-মা তোর সাথে অন্যায় করছে। তোর বাবা-মা তোর সুখ, তোর খুশিটার কথা ভাবছে না। তোর এমনটা ভাবা স্বাভাবিক। তোর জায়গায় আমি থাকলেও তাই ভাবতাম। আমি ছোটবেলায় মাকে দেখি নি। বাবা আমাদের তিনজনকে মানুষ করতে গিয়ে এতোটাই শক্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে তার মাঝে আমার ছোট্ট মনটা ভালোবাসা খুঁজে পেত না। আমি কাঁদতাম। ভাবতাম, বাবা আমার জন্য কিছুই করছে না। উনি আমাকে ভালোবাসেন না। তখন ভাইজান একটা কথা বলেছিলেন। কথাটা কি জানিস?”
শুভ্রতা কৌতূহলী চোখে তাকাল। বলল,
—-” কী?”
—-” Ask not what your parents can do for you, ask what you can do for your parents. সেদিন থেকেই নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করেছি আমি। আজ আমার বাবার মৃত্যুর পরও এই একই প্রশ্ন করছি, আমি আমার বাবা-মার জন্য কি করতে পারি? কতটুকু করতে পারি? আমি কি তাদের জন্য আদৌ কিছু করেছি? আমার বাবার বা মায়ের উপর কোনো অভিমান নেই। অভিমানটা নিজের ওপর। আমি সময় থাকতে তাদের জন্য কিছুই করতে পারি নি। কিছুই না।”
এটুকু বলে থামলেন শফিক সাহেব। ঘোলা হয়ে আসা চশমাটা পরিষ্কার করে নিয়ে মৃদু হাসলেন। শুভ্রতার মাথায় হাত রেখে বললেন,
—-” নিজেকে প্রশ্ন কর। হয়ত ডিসিশন নেওয়াটা সহজ হবে। তবে আমি চাই তুই সুখী হ। আমরা সবাই তোকে ভালো রাখতে চাই।”
কথাটা শেষ করেই নিচে নেমে গেলেন শফিক সাহেব। শুভ্রতা বেশ কিছুক্ষণ উদাস মনে বসে থাকার পর ঘরে ফিরে এলো। নিজের ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়েও ফিরে এসে বাবা-মায়ের দরজার পাশে দাঁড়াল। পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখল রাদিবা স্বামীর বুকে তেল মালিশ করছেন। শুভ্রতা ফিরে আসতে নিয়েও কি মনে করে ভেতরে প্রবেশ করল। মৃদু গলায় ডাকল,
—-” বাবা?”
শাহিনুজ্জামান সাহেব বুক ব্যথার তান্ডবে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন। মেয়ের ডাকে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। চোখ খুলে মেয়ের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। শুভ্রতা বাবার পাশে গিয়ে বসল। শাহিনুজ্জামান রাদিবার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বালিশে ঠেস দিয়ে বসলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
—-” কিছু বলবে?”
—-” আমি তোমার কোলে শুই? অনেকদিন গল্প করো না আমার সাথে। আমাকে কি আর ভালোবাসো না তুমি?”
শাহিনুজ্জামান সাহেবের বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল। মুখ থেকে কথা বেরুলো না। শুভ্রতা বাবার কোলে মাথা রেখে বাবার ডানহাতটা নিজের হাতে জড়িয়ে নিল। শাহিনুজ্জামান কিছুক্ষণ নিরুত্তর বসে থেকে বামহাতটা শুভ্রতার মাথায় রাখলেন। শুভ্রতা চোখ তুলে বাবার মুখের দিকে তাকাল,
—-” ছোটবেলার খেজুর রস চুরির গল্পটা বলো বাবা। দাদু যে তোমাকে সারা গ্রাম দৌঁড়িয়েছিল সেই গল্পটা।”
শাহিনুজ্জামান মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। আবেগাপ্লুত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তার টলমল চোখদুটো চিকচিক করে বলতে লাগল, ‘দেখো রাদিবা, আমার মেয়ে আমায় ঘৃণা করে না।” শাহিনুজ্জামান সাহেবের বুকের ব্যাথাটা যেন মিলিয়ে যেতে লাগল। ছোট্ট বেলায় শুভ্রতাকে যেভাবে ডাকত সেভাবেই ডেকে উঠল,
—-” আম্মা?”
শুভ্রতার চোখ ঘোলা হয়ে এলো। বাবার কোলে শুয়েই সাদাফের কথা মনে পড়ল তার। আবারও বাবার মুখের দিকে তাকাল শুভ্রতা। এই মানুষটিকেই বা কিভাবে ছেড়ে দিবে শুভ্রতা? আর সাদাফকে ছেড়েই বা বাঁচবে কিভাবে সে? এই দুটো মানুষের একজনকে বেছে নেওয়া কি আদৌ সম্ভব?
__________________
ঘড়িতে আটটা বাজে। ফোনের বাজখাঁই শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সাদাফের। কাল রাতে শুভ্রতার বাসার সামনে শেষ রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল সাদাফ। শুভ্রতাকে কোনভাবে না পেয়ে রাত তিনটার দিকে বাসায় ফিরেছে সে। বনানী পৌঁছে ঘুমোতে যেতে যেতে ফজরের ওয়াক্ত পেরিয়ে গিয়েছি। শুভ্রতার জ্বর, মেডিসিন খেয়ে ঘুমোচ্ছে এসব বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে কোনো রকম চোখ বোজেছে সাদাফ। এই অল্প সময়ের মধ্যেই আটটা কিভাবে বেজে গেল মাথায় আসছে না সাদাফের। এতোক্ষণে অফিসের জন্য তৈরি হওয়া সাদাফ পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে ভেবে নিজেই অবাক হল। মাথা ঝাঁকিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলাল। দক্ষিণের জানালা ভেদ করে সকালের রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছে কার্পেটে ঢাকা ফ্লোরে। চারদিকে কেমন থমথমে, ভ্যপ্সা গরম। সাদাফের হঠাৎ করেই ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল। আজকের সকালটাকে কেমন অগোছালো মনে হতে লাগল। সাদাফের ভাবনার মাঝে আবারও ফোন বাজল। ফোনে ‘শুভ্রা’ নামটা ভাসতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। নিশ্চয় এতোক্ষণে সবটা জেনে গিয়েছে শুভ্রতা? সাদাফ দ্রুত হাতে ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে রুদ্ধ গলায় ‘হ্যালো’ বলে উঠতেই কপাল কুঁচকালো সাদাফ। দ্বিধা নিয়ে বলল,
—-” এটা তো শুভ্রতার নাম্বার। আপনি কে?”
ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে উঠল কেউ। সাদাফের হঠাৎই ভীষণ ভয় করতে লাগল। গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। কাঁপা গলায় বলল,
—-” কে আপনি? কাঁদছেন কেন?”
ওপাশ থেকে কান্নারুদ্ধ গলায় উত্তর এলো,
—-” ভাইয়া আমি অর্পণ। শুভি…শুভি সুইসাইড করেছে।”
অর্পনের কথাটা কানে যেতেই থমকে গেল সাদাফ। মাথাটা ভো ভো করতে লাগল তার। পুরো পৃথিবীটা মুহূর্তেই বিবর্ণ রঙ ধারণ করল। সাদাফ ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল । বুকের কোথাও একটা ভয়ানক ব্যথা করতে লাগল। গলায় আটকে আসতে লাগল একঝাঁক অসহায়ত্ব। সাদাফ শ্বাস আটকে প্রশ্ন করল,
—-” তুমি কি মজা করছ অর্পি? এটা প্র্যাঙ্ক ছিল তাই না?”
অর্পন এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। অস্পষ্ট গলায় বলল,
—-” ভাইয়া কাল রাতেই…. ”
অর্পনের আর কোনো কথায় সাদাফের কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। থমকে থাকা মনটা চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘ তার শুভ্র এমন কিছু করতে পারে না। কিছুতেই না।’
#চলবে…..