আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৪৯

আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৪৯
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা

ঘড়ির কাটা অলস ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে। চারপাশ থেকে মৃদু ফিনাইলের গন্ধ আসছে নাকে। নিঃশব্দ পরিবেশে এয়ারকন্ডিশনের ভোঁতা ঝিমঝিম শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো কোলাহল নেই। চারপাশের দেয়াল, বাতাস, মানুষ সবকিছুতেই কেমন দুঃখ দুঃখ ভাব ছড়িয়ে আছে। সাদাফ নীল রঙা একটা চেয়ারে ঝিম ধরে বসে আছে। মাথা নুয়ানো, চোখ-মুখ থমথমে। হাতে থাকা ধবধবে কাগজটাতেই লাল চোখে তাকিয়ে আছে, সেই কখন থেকে। কাগজের মাঝ বরাবর তিন লাইনের লেখাটা পড়ে চলেছে অসংখ্যবার।

‘ আমি ভালো থাকতে পারছি না। তোমাকে হারানোর তীব্র ভয় আর অপরাধবোধে আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আচ্ছা? আমিই কি এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানবী? সবচেয়ে নিরূপায়? আমি শান্তিতে দু’দন্ড ঘুমোতে চাই। এই বিষাক্ত, শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই। তুমি আমায় খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে প্লিজ? সেদিনের মতো, খুব শক্ত করে?’

স্থবির হয়ে বসে থাকা সাদাফ প্রতিটি লাইনের ভাঁজে ভাঁজে চোখ বুলায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে প্রতিটি অক্ষর। তারপর নিরুত্তর, হতাশ ভঙ্গিতে বসে থাকে অনেকক্ষণ। চারপাশের উৎসাহী দৃষ্টিগুলোতে সে বিভ্রান্ত হয় না। এক বিন্দু টলে না, মাথা তুলে তাকায় না। নির্জীব বসে থাকে গত একঘন্টার মতোই। শুভ্রতার আত্মীয়াদের কৌতূহল বাড়ে। আড়চোখে তাকায়। ‘বাড়ির মেয়ের প্রেমিক’ নামক সুদর্শন যুবকটার মাঝে প্রেমিকার জন্য পাগলামো, অসংলগ্নতা দেখা যাচ্ছে না বলে হয়ত অবাক হয়। পরক্ষণেই, ছেলেটির থমথমে মুখ, লাল চোখ আর স্থির দৃষ্টি দেখে গুটিয়ে যায়। কাছে যাওয়ার বা ফিসফাস করারও সাহস জুটে না। সাদাফ থেকে দশ-বারো হাত দূরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রব। চোখ দুটো ফোলা তার। ফর্সা নাকের ডগা লাল টুকটুকে। কিছুক্ষণ আগেই বাবা-মার সাথে তুমুল ঝামেলা হয়েছে তার। জিনিসপত্র ভাঙচুর, মামলা করার ধমকি দেওয়ার মতো এতোসব কান্ড করার পরও বাবা-মা ‘টু’ শব্দটা পর্যন্ত করে নি। রাদিবা নিথর চোখে তাকিয়েই ছিলেন। ছেলের কোন কথা বা আশেপাশের কিছুই যেন তার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। শাহিনুজ্জামান সাহেবও স্থির ছিলেন। বুকের ব্যথাটা আগের থেকেও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। অর্পন, পুষ্পি এখনও ফুঁপিয়ে চলেছে। তাদের অদূরেই বিভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে শেফা। শুভ্রতাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে সে। একদম ছোট বোনের মতোই গভীরভাবে ভালোবাসে। সেই ছোটবোনের এমন পরিণতি, এমন সিদ্ধান্ত কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে।

—-” প্যাশেন্টের গার্ডিয়ান কে এখানে?”

শান্ত পরিবেশটা নার্সের এমন কথায় খানিকটা নড়েচড়ে উঠল। সাদাফ মাথা তুলে তাকিয়ে প্রথমবারের মতো বলল,

—-” আমি। আমি প্যাশেন্টের হাজবেন্ড।”

সাদাফের এমন কথায় সবার মুখেই বিস্ময় খেলে গেল। সাদাফের গম্ভীর মুখভঙ্গি দেখে কেউ কিছু বলার সাহস খুঁজে পেল না। শুভ্রব আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে বিস্ময় দেখা গেল না। নার্সটা দুলকি চালে সাদাফের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সাদাফ উঠে দাঁড়াতেই তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল,

—-” ফরমটা ফিল আপ করে দিন প্লিজ।”

সাদাফ বেশ শান্ত ভঙ্গিতে ফরমটা আগাগোড়া নিরক্ষণ করল। আরাফের এগিয়ে দেওয়া কলম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো পূরণ করল। পাশ থেকে শুভ্রতার বড় খালা বলে উঠলেন,

—-” শুভ্রতা তোমার কেউ হয় না সাদাফ। প্রেমের সম্পর্ক কখনই ল’ফুল সম্পর্ক হতে পারে না। শুভ্রতার আসল গার্ডিয়ান ওর বাবা-মা নয়ত শুভ্রব।”

সাদাফ ফরমটা পূরণ করে আবারও আগের জায়গায় বসে পড়ল। সায়িদা বেগমের কথার উত্তর দেওয়ার কোনো লক্ষণই তার মাঝে দেখা গেল না। শুভ্রব ক্ষীণ তবে শক্ত গলায় বলল,

—-” দয়া করে আমার বোনের ব্যাপারে খবরদারি করা বন্ধ করুন খালামনি। তাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করেছেন, আর চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। না আপনার আর না আপনার বোন এবং বোন জামাইয়ের। আমার বোন আমি বুঝব।”

সায়িদা বেগম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালেন। তপ্ত গলায় বললেন,

—-” শুভ্রব! ও শুধু তোমার বোন নয় আমাদের মেয়েও। আমরাও ওকে ভালোবাসি।”

শুভ্রব বিরস গলায় বলল,

—-” ভালোবাসুন শুনে ভালো লাগল। কিন্তু সেই ভালোবাসাটাকে নিজেদের মাঝেই আটকে রাখুন। আমার বোনের সামনে অযথা প্রকাশ করার চেষ্টাও করবেন না। আর একটা কথা, অটিতে যে মেয়েটা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে সে শুধু এবং শুধুই আমার বোন। অটিতে ঢুকার আগে আপনাদের মেয়ে হয়ে ঢুকলেও বেরুবে শুধু আমার বোন হয়ে। তাই, তাকে অযথা জ্ঞান দিতে যাবেন না, আই ওয়ার্ন ইউ অল। ”

—-” শুভ্রব তুমি…”

হাতের ইশারায় সায়িদা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

—-” আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চাইছি না খালামণি। এই মুহুর্তে মাথার ঠিক নেই আমার। চুপ থাকুন নয়ত বাসায় ফিরে যান।”

অপমানে সায়িদা বেগমের মুখটা লাল হয়ে এলো। বাধ্য হয়েই চুপচাপ জায়গা ত্যাগ করলেন তিনি। আরো ঘন্টাখানেক সময় এভাবেই কেটে গেল। হঠাৎ রিংটোনের শব্দে বিষাক্ত নীরবতায় ছন্দপতন ঘটল। অর্পন তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তনয়ার চিন্তিত কন্ঠ ভেসে এলো। অর্পন অসহায় গলায় বলল,

—-” ডক্টর এখনো কোনো আপডেট দেয় নি তনু।”

‘তনু’ নামটা শুনেই চমকে তাকাল শুভ্রব। বুকের মাঝে একটা তরল ভাবের সঞ্চার হলো। আবার সাথে সাথেই তীক্ষ্ণ ব্যথায় চোখ নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় অটির দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন মধ্যবয়স্ক ডাক্তার। ডাক্তারকে দেখেই তাড়াহুড়ো করে ফোন রাখল অর্পন।

—-” সব ঠিক আছে, ডক্টর?”

শুভ্রবের প্রশ্নে ঠোঁটদুটো প্রসারিত করলেন ডাক্তার। বললেন,

—-” প্যাশেন্ট রাতে বেশ পেট ভরে খাবার খেয়েছিলেন মনে হয়। তাই এতোক্ষণ পরও ওয়াশ করতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। অবস্থা যতটা ক্রিটিক্যাল ধারণা করেছিলাম এটলিস্ট ততটা হয় নি। অক্সিজেন আর স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝে জ্ঞান না ফিরলে নলের মাধ্যমে গ্লুকোজ, দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আশাবাদী। ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবেন।”

শুভ্রবসহ সবার বুকে চিরেই একটা গাঢ় স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। সাদাফ বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করল। বিরবির করে বলল,

—-” আলহামদুলিল্লাহ।”

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। হাসপাতালে ভীড় অনেকটাই কমে এসেছে। জানালার কাঁচে দুপুরের তীব্র রোদের তান্ডবটাও কমে এসেছে। সাদাফ আগের জায়গাটাতে কাঠ হয়ে বসে আছে। দুপুরের দিকে শুভ্রতার জ্ঞান ফেরার পর প্রত্যেকেই দেখা করতে গেলেও সাদাফকে উঠতে দেখা যায় নি। দরজার বাইরে থেকে দু’তিনবার মুখদর্শন করলেও একটাবারের জন্যও ভেতরে যায় নি সে। সাদাফকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আসরের আযানের আগমুহুর্তে নিজ থেকেই এগিয়ে এলো শুভ্রব। সাদাফের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নরম গলায় ডাকল,

—-” সাদাফ ভাই?”

সাদাফ চোখ তুলে তাকাল। শুভ্রব প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

—-” শুভির সাথে দেখা করবেন না? ও মনে মনে আপনাকেই খুঁজছে। কিন্তু বলতে পারছে না।”

সাদাফ কাঠ কাঠ গলায় বলল,

—-” প্রয়োজন নেই।”

—-” জ্বি?”

—-” দেখা করার প্রয়োজন নেই। আমি এখানে আছি বলারও প্রয়োজন নেই।”

শুভ্রব বেশ অবাক হল। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল,

—-” কিন্তু কেন? আপনি ওর সাথে দেখা করলে ওর মনটা শান্ত হবে। যান, প্লিজ।”

সাদাফের মাঝে উঠার কোনো লক্ষণ না দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভ্রব। গোটা একটা বছর সাদাফকে কাছ থেকে দেখেছে সে। সাদাফের স্বভাব তার চেনা। শুভ্রব কথা না বাড়িয়ে জায়গা ত্যাগ করল। সারাদিন টানা বসে থেকে রাত আটটার দিকে উঠে দাঁড়াল সাদাফ। শুভ্রতার প্রতি ক্ষোভ, রাগ, অভিমান নিয়েই কেবিনের ভেতর উঁকি দিল। শুভ্রতার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না। দরজা ঠেলে ধীর পায়ে শুভ্রতার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আলতো হাতে শুভ্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। শুভ্রতার ফর্সা মুখটা তখনো রক্তশূণ্য, দুর্বল দেখাচ্ছে। বহু আকাঙ্খিত ঠোঁটজোড়া কেমন শুকনো লাগছে। সাদাফ ছোট্ট শ্বাস টেনে শুভ্রতার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। এই মেয়েটার জন্যই সকালে প্রায় উম্মাদ হয়ে গিয়েছিল সাদাফ। শ্বাস আটকে আসছিল। আচ্ছা? আজ যদি সত্যিই শুভ্রতার কিছু হয়ে যেত, তাহলে কি করত সাদাফ? বেঁচে থাকত নাকি মারা যেত? নাহ্ মারা যেত না। অবশ্যই বেঁচে থাকত। মৃত্যু অত সহজ নয়। কারো জন্য কেউ মরে যায় না। কিন্তু সেই বেঁচে থাকাটা হয়ত মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়েও অধিক পীড়াদায়ক হতো। সাদাফ আরো একবার কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে যেতে নিতেই পেছন থেকে হাত আঁকড়ে ধরল কেউ। সাদাফ কপাল কুঁচকে পেছনে তাকাতেই শুভ্রতার ছলছল চোখজোড়া চোখে পড়ল। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে শুভ্রতার দুর্বল হাতটার দিকে তাকাল। শুভ্রতা রুদ্ধস্বরে বলল,

—-” সরি!”

সাদাফ উত্তর দিল না। শুভ্রতার হাতটা খুব যত্নে বিছানার উপর রেখে মৃদু গলায় বলল,

—-” রেস্ট নাও। আসছি।”

শুভ্রতা আবারও খামচে ধরলো হাত। করুণ গলায় বলল,

—-” প্লিজ, সরি। তখন… তখন আমার মাথায় কি চলছিল আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। অনেক বড় বোকামি করে ফেলেছি, না? এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। আর কখনও করব না এমন।”

সাদাফ ছোট করে বলল,

—-” আচ্ছা।”

—-” তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন?”

সাদাফ জবাব দিল না। শুভ্রতায় বলল,

—-” ক্ষমা করে দাও না, প্লিজ।”

—-” ঘুমাও শুভ্রতা। তোমার ঘুমের প্রয়োজন।”

সাদাফের মুখে ‘শুভ্রতা’ নামটা শুনে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল শুভ্রতা। সাদাফ তাকে কখনোই ‘শুভ্রতা’ বলে সম্বোধন করে না। শুভ্রতা মৃদু গলায় বলল,

—-” আমার তোমাকেও প্রয়োজন।”

সাদাফ মুখ তুলে তাকাল,

—-” কেন প্রয়োজন?”

—-” জানো না কেন?”

সাদাফ কাঠ কাঠ গলায় বলল,

—” না। জানি না।”

—-” ভালোবাসি তাই।”

সাদাফ ঠোঁট বাকিয়ে হাসল। মুখে বলল,

—-” ও আচ্ছা।”

—-” এভাবে কথা বলছ কেন? তোমার বিশ্বাস হয় না যে আমি তোমায় ভালোবাসি?”

সাদাফ মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। শক্ত গলায় বলল,

—-” আপাতত হচ্ছে না। যে ভালোবাসে সে কখনও বিশ্বাস হারায় না। আর তুমি তো আমায় বিশ্বাসই করতে পারো নি। কিন্তু আমি তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম। তুমি সেই বিশ্বাসটাও ধরে রাখতে দিলে না। একে ভালোবাসা বলে না। আমি হয়ত শুধুমাত্র তোমার চাওয়া ছিলাম। প্রগাঢ় অনুভূতিগুলোর কারণ ছিলাম না।”

শুভ্রতা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। বড় বড় চোখদুটো থেকে দু’ফোটা টসটসে জল গড়িয়ে পড়ল। শুভ্রতার চোখের জল দৃষ্টিগোচর হতেই কম্পিত নিঃশ্বাস ফেলল সাদাফ। শুভ্রতা দুর্বল গলায় বলল,

—-” আর যা বলার বলো। যত শাস্তিই দাও কিন্তু এতো বড় অপবাদ দিও না। আমি সহ্য করতে পারব না।”

সাদাফ তার অসম্ভব সুন্দর চোখদুটো মেলে শুভ্রতাকে দেখল। হাজার বছরের তৃষ্ণার্থ পুরুষের মতো নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই তার চোখে নেমে এলো বেদনার ছায়া। নরম গলায় বলল,

—-” তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো নি, তা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ শুভ্রা।”

সাদাফের হাতটা শক্ত করে খামচে ধরল শুভ্রতা। অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—-” শেষবারের মতো মাফ করা যায় না আমায়? বিশ্বাস করো, আমি কখনোই তোমার ওপর থেকে বিশ্বাস হারাইনি। আমি জানতাম যেভাবেই হোক তুমি আমাকে তোমার করেই রাখবে। সাথে এটাও জানতাম, বাবা কখনও মানবেন না। আর বাবাকে কষ্ট দিয়ে আমি তোমার হাত ধরে সুখী হতে পারতাম না। ওই মুহূর্তে আমি সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলাম। একদিকে বাবা অন্যদিকে তুমি, আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। ভালো খারাপ কিচ্ছু না।”

সাদাফ হতাশ চোখে তাকাল। কম্পিত কণ্ঠে বলল,

—-” আজ আমি অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলতে পারতাম শুভ্রা। আমার সংসার, আমার স্বপ্ন, আশা সব! আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করব না শুভ্রা। কখনোই না।”

_____________________

সেদিনের ইন্সিডেন্টের পর আজ সাতদিন চলছে। শুভ্রতা এখন পুরোপুরি সুস্থ। বাড়িতে কারো কাছেই আত্মহত্যা বা সাদাফ সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় নি তাকে। তবে, অর্পনের কাছে বিয়ে ভাঙার ব্যাপারটা শুনে আফসোসের শেষ ছিল না শুভ্রতার। ভয়ও পেয়েছিল খুব। যদি সত্যি সত্যিই মরে যেত সে? তখন কি হত তার? সাদাফ ঠিকই বলেছিল, ‘ মানুষের জীবনটা যদি একটা উপন্যাস হয় তাহলে আমাদের উচিত উপন্যাসের শেষ বর্ণটা পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে উপভোগ করা। কারণ, লেখক জানেন কখন থামতে হবে। উপন্যাসের চরিত্ররা যদি নিজে নিজেই তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে তাহলে উপন্যাসের শেষটা কখনও পূর্ণ হবে না। নান্দনীয়, আকর্ষনীয় হবে না। কোনো উপন্যাসই অপূর্ণ থাকে না শুভ্রা। কিছু মানুষ ধৈর্য্য রাখতে পারে না বলেই চমৎকার কোনো সমাপ্তি, ভয়ানক দুঃখগুলোর পর প্রাপ্তির বর্ষণ তাদের ছুঁয়ে দিতে পারে না। চোখের পলকে দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে পারে শুভ্রা। প্রয়োজন শুধু অপেক্ষা। আমাদের উপন্যাসের শেষ বর্ণ পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেতে হবে। লেখককের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার জন্য হলেও এই অপেক্ষাটা চাইই চাই।’ শুভ্রতারও উচিত ছিল অপেক্ষা করার। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই পেত স্বর্গীয় এক সুখ। মানুষের উচিত বেঁচে থাকার তিক্ত,মিষ্টি স্বাদের প্রতিটা ফোঁটা অনুভব করা, উপভোগ করা। ভয়াবহ কষ্টের মাঝেও আকস্মিক সুখগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে খুঁজে বের করা। আত্মহত্যা মানেই সুন্দর একটি উপন্যাসের জোরজবরদস্তি সমাপ্তি। বাকি পৃষ্ঠাগুলোর শূন্যতা। কৌতূহলগুলোকে মেটানোর আগেই শ্বাসরুদ্ধকর মৃত্যু। কে জানে? উপন্যাসের সেই পাতাগুলোই হতে পারত সবচেয়ে তৃপ্তিকর, সবচেয়ে কোমল আর ভালোবাসাময়!

শুভ্রতা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পুরো বিছানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শাড়ি আর গহনাগাটির বাক্স। কিছুক্ষণের মাঝেই বান্ধবীরা এসে উঠবে বাসায়। চারদিকে ব্যস্ত পদশব্দগুলো উপলব্ধি করে বুক ভরে শ্বাস নিল শুভ্রতা। মনের গহীনে বেজে ওঠা আনন্দের ঢাক-ঢোলের শব্দে মুহূর্তেই কেঁপে কেঁপে উঠল। সাদাফের পরিবার আজ দেখতে আসছে তাকে। শাহিনুজ্জামান সাহেব নিজে থেকেই ঘটকের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাদের। সবকিছু পরিবারিকভাবেই হচ্ছে। শুধু সাদাফই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। শুভ্রতার প্রতি অভিমান তার এক তিল পরিমাণ কমে নি। শুভ্রতার ফোন সে প্রায় প্রায়ই রিসিভ করে না। তবে, সাথে সাথেই পৃথার কলের বাহার পড়ে। একদিন তো মুখ ফসকে বলেই ফেলল পৃথা, ‘ বিয়ের পর ভাইয়াকে একদম টাইট করে ফেলবে ভাবি। ও আমার টাকা মেরে দিয়েছে।”

শুভ্রতা কৌতূহল নিয়ে জিগ্যেস করেছে,

—-” কিসের টাকা?”

—-” কিসের আবার? ফোন কল আর কল রেকর্ডের। ভাইয়ার সাথে ডিল হয়েছিল প্রতি কলে একশ টাকা কিন্তু….”

—-” কিন্তু?”

শুভ্রতার প্রশ্নে থতমত খেয়ে বলেছিল,

—-” আমি ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছি ভাবি। ওসব বাদ দাও, আমার জন্য হ্যান্ডসাম পেলে কিনা বল?”

পৃথা কথা কাটিয়ে নিলেও শুভ্রতা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। আর সেটুকুতেই সুখের সাগরে ডুবে থেকেছে দিনভর, রাতভর।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here