আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৫৭

আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৫৭
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা

হেমন্ত মাস। ভীষণ ঠান্ডা না পড়লেও বিকেলের শেষ ভাগটাই হালকা শীত শীত ভাব। সাদাফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অস্থির হাতে কলিং বেল চাপছে , কেউ দরজা খুলছে না। সাদাফের টেনশন বাড়তে লাগল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই পৃথা ফোন করে শুভ্রতার অসুস্থতার কথা জানিয়েছে। শুভ্রতা নাকি ভার্সিটিতে ক্লাস চলাকালীন সময়েই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যেই সেই অসুস্থ নয় সাংঘাতিক রকমের অসুস্থ। অন্য সময় হলে পৃথার কথাটা ঠিক পাত্তা দিত না সাদাফ। কিন্তু এখন চিন্তা হচ্ছে। পৃথা নিশ্চয় শুভ্রতার অসুস্থতা নিয়ে মিথ্যা বলবে না। সাদাফ কপাল কুঁচকে আবারও কলিং বেল চাপল। দু’বারের মাথায় দরজা খুলে দিলো প্রেমা। সাদাফ প্রেমাকে দেখে বিশেষ অবাক হলো না। চিন্তিত ভঙ্গিতে ভেতরের ঘরের দিকে যেতে যেতে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

—–” শুভ্রতা কোথায়?”

—–” রুমে। রেস্ট নিচ্ছে।”

সাদাফ জবাবে কিছু বলল না। বুকটা অল্প বিস্তর কাঁপছে। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে শুভ্রতা। বুক পর্যন্ত কাঁথা টানা। চোখে-মুখে একরাশ ক্লান্তি। শুভ্রতার ডানপাশে বসে আছে অর্পণ। চোখ দুটো স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। সাদাফ রক্তশূণ্য মুখে শুভ্রতার পাশে গিয়ে বসলো। শুভ্রতার বাম হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল,

—–” ঠিক আছ?”

সাদাফের স্পর্শে চোখ মেলে তাকাল শুভ্রতা। অর্পণ মুখস্ত বিদ্যার মতো গরগর করে বলতে লাগল,

—–” ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছে, ভাইয়া। যদিও শুভি বিষয়টাকে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমাদের সাথে তো আর চাপাচাপি চলে না। শুভি যদিও বলবে আপনাকে তবে আমি বললেও ক্ষতি নেই। আমরা খালামনি হতে চলেছি ভাইয়া! বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই দারুণ একটা নিউজ পেয়ে আমরা সবাই ভীষণভাবে চমকিত। খুব সুন্দর একটা সংবাদ দিয়েছি, এখন আমাদের ট্রিট দেন।”

সাদাফ পাত্তা না দিয়ে বলল,

—–” ভেরি ফানি! সত্যি করে বলো তো, কি হয়েছিল? ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলে? আমায় আগে জানাও নি কেন?”

সাদাফের ব্যস্ততা দেখে মুচকি হাসল শুভ্রতা। ততক্ষণে পৃথা আর পুষ্পিও দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাদাফ সবার হাসিমাখা মুখে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে হঠাৎই চমকে উঠলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,

—–” অর্পির কথাটা সত্যি?”

শুভ্রতা হাসল। টলমলে চোখদুটোও অদ্ভুত উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করে উঠল। চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখের কোণ বেয়ে। সাদাফ কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলো। এই স্বাভাবিক সত্যটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ছোট্ট একটা সংবাদ যে জীবনের এতোবড় সার্থকতা বহন করার শক্তি রাখে, ধারণায় ছিলো না তার। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রথম যে কথাটা বলল সাদাফ তা হলো,

—–” তুমি খেয়েছ?”

অর্পণ চোখ কপালে তুলে বলল,

—–” সেকি কথা ভাইয়া? মানুষ বাবা হবে শুনলে বউকে কোলে নিয়ে ধেই ধেই করে নাঁচে, মিষ্টি মুখ করায়, ভালোবাসা প্রকাশ করে আর আপনি তো দেখি তার আশেপাশেই যাচ্ছেন না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, বাবা হওয়াটা খুবই কমন একটা ব্যাপার। এই টাইপ খবরগুলো রোজই শুনেন আপনি। এতে অবাক বা আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই।”

সাদাফ হাসল। হাসিমুখেই উত্তর দিলো,

—–” ধেই ধেই করে নাচলে কি আরো তাড়াতাড়ি বাচ্চার বাবা হয়ে যাব আমি? হবো না তো। তাহলে লাফালাফি করে কি লাভ?”

অর্পণ প্রত্যুত্তরে কিছু বলবে তার আগেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠল পৃথা,

—–” আমি কিন্তু বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছি ভাইয়া। মা তো ভীষণ খুশি। উফ্ আমার যে কি মজা লাগছে! ভাবি? তুমি এই নয়/দশ মাস শুধু আমাকেই দেখবে বুঝছ? আমার ভাতিজা অথবা ভাতিজী যায় হোক একদম আমার মতো হতে হবে। আমাদের বাসায় আরেকটা বাবু আসছে। আমি এবার দুই জনের সিনিয়র হয়ে যাচ্ছি। ইশ! ভাবতেই ভালো লাগছে।”

সাদাফ মজা করে বলল,

—–” তোর মতো হওয়া চলবে না। তোর মতো হলেই ঝামেলা। তুই যে ফাজিল!”

পৃথা অবাক চোখে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-” আমি ফাজিল!”

—-” কেন তুই ফাজিল না?”

—-” একদমই না। ভাবি তুমিই বলো, আমি ফাজিল?”

শুভ্রতা দুর্বল গলায় বলল,

—-” একদমই না। এই? আমার ননদিনীকে একদম ফাজিল বলবে না। নয়ত, বাসায় ভাত টাত বন্ধ। ঠিক না পৃথা?”

পৃথা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। শুভ্রতাকে দুই একটা উড়ন্ত চুমু দেখিয়ে সাদাফের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙালো। সাদাফের নিঃশব্দ হাসি আরো খানিকটা চওড়া হলো। হঠাৎ করেই খেয়াল করলো, তার হাত-পা ঝিমঝিম করছে। সে বাবা হবে, কথাটা ভাবতেই সারা শরীরে অদ্ভুত এক মাদকতা তৈরি হচ্ছে। আচ্ছা? বাবা হওয়াটা কি সত্যিই এতোটা খুশির? নাকি শুধু সাদাফের কাছে লাগছে? কিছুদিন পর তার ঘরে, তারই একটা অংশ চোখের সামনে বেড়ে উঠবে। ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে বুকে। উফ! সাদাফ আর ভাবতে পারছে না। যে কাজটা সে কখনো করে নি। আজ তাই করতে ইচ্ছে করছে, হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পৃথিবীর সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করছে যে সেও বাবা হতে চলেছে। বাবা! কি ভারী একটা শব্দ। হাতের মুঠোয় থাকা শুভ্রতার হাতটা আরও খানিকটা শক্তি করে ধরলো সাদাফ। ঘরে বিদ্যমান এতোগুলো মানুষের অগোচরে দু’জনের চোখাচোখি হলো। সাদাফের চোখ থেকে ঠিকরে পড়া আনন্দ আর কৃতজ্ঞতাটা উপলব্ধি করতে পেরে টলমল করে উঠলো শুভ্রতার চোখ। এই মুহুর্তে সদ্য মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া মেয়েটির কপালে উষ্ণ পরশ দিতে ইচ্ছে করছে সাদাফের। বুকের সাথে শক্ত করে ল্যাপ্টে রাখতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে। কিন্তু ঘরে থাকা বাকি মানুষগুলোর জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছেটাকে চেপে যেতে হচ্ছে। সাদাফের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শুভ্রতার মায়াময় মুখের দিকে নির্ণিমেষ তাকিয়ে থেকে বুকের তৃষ্ণাটাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলতে লাগল।

_____________________

শুভ্রতা বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। রাদিবা আহমেদ শুভ্রতার ডানহাতটা পরম আদরে নিজের কোলের ওপর রেখে মাঝে মাঝেই হাত বুলাচ্ছেন হাতে। খুশিতে চোখ দুটো চিকচিক করছে তার। শুভ্রতাকে এই মুহুর্তে কি বলা উচিত, শুভ্রতাকে নিজের খুশিটা কিভাবে বুঝানো যেতে পারে তা ঠিক ধরতে পারছেন না তিনি। শুভ্রব ঘরের এক কোণায় হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। এসেছে থেকে অবাক চোখে শুভ্রতাকে দেখে চলেছে, কোনো কথা বলছে না। পুরো ঘরে পিনপতন নীরবতা। এই নীরবতা কাটিয়ে প্রসঙ্গ টানলেন রাদিবা আহমেদ,

—-” সাদাফ? বাবা, কিছু ভেবেছ?”

সাদাফ বিছানা থেকে খানিকটা দূরে একটা চেয়ার টেনে বসে ছিলো। শাশুড়ীর প্রশ্নে নম্র গলায় উত্তর দিলো,

—-” কি বিষয়ে মা?”

রাদিবা আহমেদ কোনরূপ ভূমিকা না করে বললেন,

—-” এখানে তো তুমি একা থাকো বাবা। তারওপর সারাদিন অফিসেই কাটাতে হয়, ব্যস্ত থাকো। শুভির দেখাশোনারও তো একটু প্রয়োজন আছে।”

সাদাফ আগের মতো করেই উত্তর দিলো,

—-” আমি একা কেন হব মা? আমাদের সাথে পৃথাও থাকে। এখানকার একটা ভার্সিটিতেই ভর্তি হয়েছে এ বছর।”

রাদিবা আহমেদ মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন,

—-” তা নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু শুভ্রতার ভার্সিটি তো ধানমন্ডিতে। এই অবস্থায় প্রতিদিন বনানী থেকে ধানমন্ডিতে যাওয়াটা রিস্ক হয়ে যায় না? তুমি বললে, এই ক’মাস নাহয় শুভি আমাদের সাথে ধানমন্ডিতেই থাকুক।”

রাদিবা আহমেদের প্রস্তাবে আৎকে উঠলো সাদাফ। এই কয়মাস মানে? শুভ্রতার এখন দু’মাস চলছে। আরো আট আটটা মাস শুভ্রতাকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবতেই তো দমবন্ধ লাগছে। তাছাড়া, সাদাফ তার প্রথম সন্তান পেতে চলেছে। সেই সন্তান রিলেটেড ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোও মিস করতে চায় না সে। শুভ্রতার ভেতরের অস্তিত্বটার ধীর গতিতে বেড়ে উঠাটা নিজের চোখে দেখতে চায় সাদাফ। দু’জনে মিলে সুখের জোয়ারে ভাসতে চায়। সাদাফকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলেন রাদিবা,

—-” না মানে। আমি বলছিলাম কি? তুমি, পৃথা, শুভি তিনজনেই নাহয় এই ক’মাস আমাদের সাথেই থাকো। আসলে শুভি আমাদের একমাত্র মেয়ে তো, ওকে নিয়ে খুব ভয় হয়।”

সাদাফ আগের মতোই নীরব বসে রইলো। ততক্ষণে শুভ্রবের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। কঠিন চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মায়ের এইসব অদ্ভুত কথাগুলোতে বরাবরই ভীষণ বিরক্ত হয় শুভ্রব। সাদাফ যে ধরনের মানুষ তাতে যে সে কখনোই শশুরবাড়ি গিয়ে পড়ে থাকবে না, তা তো জানা কথা। তারপরও রাদিবার এমন অযৌক্তিক প্রস্তাবের কোনো মানে হয়? সাদাফকে চুপ থাকতে দেখে আবারও একই কথা জিগ্যেস করলেন রাদিবা। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মৃদু হেসে উত্তর দিলো সাদাফ,

—-” আমার বাইকটা বাসায় অযথায় পড়ে আছে মা। শুভ্রতাকে এই কয়মাস নাহয় বাইকে করেই ভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে আসব আমি। তাছাড়া ওর থার্ড সেমিস্টার তো শেষ প্রায়।”

—-” তবুও….”

মায়ের প্রসঙ্গটাই এতোক্ষণ শুভ্রতাও খানিক শংকিত বোধ করছিলো। এবার আর চুপ থাকতে না পেরে মায়ের হাতটা চেপে ধরে বলল,

—-” ও তো ঠিকই বলেছে মা। সেমিস্টার তো প্রায় শেষই। ফাইনাল ইয়ারের পড়াশোনাও ঠিক ম্যানেজ করে নিবো আমি। তাছাড়া পুষ্পিরা সবাই আছেই তো। চিন্তা করো না।”

—-” চিন্তা করবো না মানে? এখন নাহয় ঠিক আছিস। কিন্তু কয়েকমাস পর ভারী শরীর নিয়ে কি করে অতোদূর আসা যাওয়া করবি তুই? এমনিতেই তো শরীরে কিছু নেই। বাচ্চা আর তোর দু’জনের জন্যই তো রিস্কি হয়ে যাবে ব্যাপারটা।”

সাদাফ মৃদু গলায় বলল,

—-” চিন্তা করবেন না মা। বেশি সমস্যা হলে কয়েক মাস পর নাহয় ধানমন্ডির দিকে বাসা ভাড়া নিয়ে নেব।”

রাদিবা বিস্ময় নিয়ে বললেন,

—-” সেকি! এখানে নিজস্ব ফ্ল্যাট রেখে ভাড়া বাসা….”

রাদিবাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠল শুভ্রব,

—-” মা, প্লিজ। থামো তো। সমস্যা নাই সাদাফ ভাই। আর আমিও তো আছিই। অলওয়েজ ফ্রি থাকি। মাঝে মাঝে নাহয় আমিও পৌঁছে দেব শুভিকে।”

সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে শাশুড়ীর দিকে তাকাল। চোখ নামিয়ে নম্র গলায় বলল,

—-” আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন, মা। আপনার মেয়ের এতোটুকুও অযত্ন হবে না। আমি বেঁচে থাকতে তো নয়ই।”

এটুকু বলে চোখ তুলে তাকাল সাদাফ। চোখে চোখ রেখে ভারী আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন,

—-” চিন্তা করবেন না, মা।”

রাদিবা আহমেদ সাদাফের ফর্সাটে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, জবাব দিলেন না। তার বুকে সাদাফের জন্য থাকা অন্যরকম স্নেহটা বুকে আরো একবার দোলা দিয়ে গেল। মনের মাঝে সুপ্ত মাতৃত্বটা গর্জে উঠে প্রার্থনা করতে লাগলেন, ‘বেঁচে থাকো, বাবা। দীর্ঘজীবী হও।’

____________________

আকাশে ঝাঁঝাঁ রোদ। কপালে হাত রেখে ফর্সা মুখটাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে পৃথা। সকালে ঠান্ডা পড়লেও এই ভরদুপুরের বিশ্রী গরমে শরীরটা কেমন আঠালো লাগছে পৃথার। পৃথা ওড়নার কোণা দিয়ে মুখ মুছে ডানদিকের রাস্তাটির দিকে তাকাল৷ জনাকীর্ণ রাস্তায় কাঙ্ক্ষিত যানটা দেখতে না পেয়ে কপাল কুঁচকে এলো। বক্র চোখে হাতে থাকা ফোনটাতে সময় দেখল, ১১ঃ৪৫। ঠিক এই সময়টাতেই ভার্সিটির বাসটা আসার কথা, কিন্তু আসছে না। বিরক্তিতে মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে এলো পৃথার। ডানহাতটা কপালের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে আশেপাশে তাকাতেই বিরক্ত চোখ জোড়াতে নেমে এলো শিথিলতা। ওইতো রাস্তার গোড়ার দিকেই ওই অসহ্যকর লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। দুই আঙ্গুলে ধরে রাখা সিগারেটে কি আয়েশ করেই না টান দিচ্ছে। এক ধলা সাদা ধোঁয়া শুষে নিয়ে আবারও এই খা খা রোদে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পৃথা অদ্ভুত এক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। এতোদিন সিগারেট পছন্দ না করা মেয়েটির হঠাৎই মনে হলো, সিগারেট না খেলে সত্যিকার অর্থে পুরুষ মানুষ হওয়া যায় না। পুরুষরা সিগারেট খাবে এটাই নিয়ম। তাদের সিগারেট না খেলে চলবে কেন? পৃথা কম্পিত পায়ে শুভ্রবের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। গলার সাথে যুদ্ধ করে কোনোরকম প্রশ্ন করল,

—-” আপনি এখানে? কেমন আছেন?”

কোনো মেয়েলি কন্ঠস্বরে ফিরে তাকাল শুভ্রব। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী মেয়েটির দিকে এক পলক তাকিয়েই আশেপাশে কিছু একটা খুঁজতে লাগল। খানিকক্ষণ পর অবাক হয়ে বলল,

—-” আমাকে বলছেন?”

—-” তো? এখানে কি আপনি ছাড়া অন্য কেউ আছে?”

শুভ্রবের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। মনে করার চেষ্টা চালালো, মেয়েটাকে কি আদৌ চিনে সে? শুভ্রব কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

—-” ওহ্ আচ্ছা।”

শুভ্রবের দায়সারা জবাবে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে পৃথার। পৃথা ঝাঁঝ নিয়ে বলল,

—-” ও আচ্ছা মানে? ‘কেমন আছেন?’ এর উত্তর ‘ও আচ্ছা’ হয় জানতাম না তো।”

শুভ্রব নিষ্প্রভ গলায় বলল,

—-” জ্বি ভালো আছি।”

পৃথা ক্ষুণ্ণ হলো। কেউ কেমন আছেন জিগ্যেস করলে উত্তরে যে তাকেও জিগ্যেস করতে হয় এই সামান্য ভদ্রতা কি এই ছেলেটির জানা নেই? পৃথা শুভ্রবের হাতের ফাইল খেয়াল করে বলল,

—-” হাতে ফাইল? জবের জন্য ট্রাই করছেন নাকি?”

শুভ্রব ছোট্ট করে বলল,

—-” হু।”

তারপর প্রায় সাথে সাথেই বলল,

—-” আপনাকে কি রিক্সা দেখে দেব?”

পৃথা ফুঁসে ওঠে বলল,

—-” আপনাকে কি বলেছি রিক্সা দেখে দিতে? আপনার ধারণা, আমি নিজের জন্য একটা রিক্সাও ঠিক করতে পারব না? তাছাড়া আমি রিক্সা নয় বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।”

শুভ্রব মুখ গোল করে বলল,

—-” ও।”

শুভ্রবের কথার ধরন দেখে রাগে সারা শরীর শির শির করতে লাগল পৃথার। রাগে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। কি দরকার ছিলো এই অসভ্য লোকটির সাথে যেচে কথা বলতে আসার? পৃথা আসলে ভালো মেয়ে নয়। সে ভালো মেয়ে হলে নিশ্চয় এভাবে ছ্যাচড়ার মতো কথা বলতে আসতো না। রাতে ওমন বিশ্রী স্বপ্নও দেখতো না। সে ভালো মেয়ে হলে এই লোকটির করা অপমানে ক্ষণে ক্ষণে মরে যেতে ইচ্ছে করতো না। কাছাকাছি দাঁড়ালেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছেও করতো না। পৃথার মন খারাপ লাগছে। এই অসহ্য লোকটির জন্য আজকের রাতেও যে তার ঘুম হবে না তা সে বেশ বুঝতে পারছে। পৃথার ভাবনার মাঝেই প্রশ্ন ছুঁড়লো শুভ্রব,

—-” শুভি ভালো আছে?”

পৃথা কপাল কুঁচকে তাকাল। তাকে একবার জিগ্যেস করলো না অথচ বোনের কথা ঠিকই মনে আছে। অভিমানে থমথমে হয়ে উঠলো পৃথার ফর্সা মুখ। বাঁকা গলায় বলল,

—-” নিজে গিয়ে দেখে এলেও তো পারেন। সেই একমাস আগে খবর পেয়ে গিয়েছিলেন তারপর আর নেই।”

শুভ্রব জবাব দিলো না। একটা রিক্সা ডেকে উঠে বসতে বসতে বলল,

—-” আপনার বাস হয়তো চলে আসবে এখনই। আমার একটু তাড়া আছে, আসছি।”

পৃথা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো। একটা মানুষ এতোটা অভদ্র কি করে হতে পারে? পৃথার রাগে-দুঃখে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। এই অসহ্যকর লোকটিকে নিজের চিন্তাতে আর সহ্য করতে পারছে না সে। ভয়ানক বিতৃষ্ণায় মনটা ছেয়ে যাচ্ছে।

রাত বারোটা। চারপাশে ভয়ানক নিস্তব্ধতা। শীতের ফিনফিনে বাতাস উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে জানালার পর্দা। পৃথা সারা ঘর পায়চারী করছে। শুকিয়ে আসা ঠোঁটদুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। এই ঠান্ডায় তার পা খালি, গায়ে শীতের কাপড় নেই। কিন্তু সেদিকে পৃথার খেয়াল আছে বলে মনে হচ্ছে না। কপালে পড়া চামড়ার ভাঁজের পরতে পরতে গভীর কোনো চিন্তা। পৃথা আরো কিছুক্ষণ ঘরময় পায়চারী করে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সাদাফদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাদাফকে ডাকলো। সাদাফ তখন শুভ্রতাকে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত। সারাদিন বমি টমি করে মাঝরাতে ভীষণ মাথা ধরেছে শুভ্রতার। শরীর এতো দুর্বল তবু ঘুম আসছে না। সাদাফ শুভ্রতাকে বুকে নিয়ে আদুরে হাতে বিলি কাটছিলো চুলে। এমন সময় দরজায় কড়াঘাত পড়ায় দু’জনেই বেশ অবাক হলো। সাদাফ নিজের মনে বিরবির করতে করতে উঠে বসল,

—-” এতো রাতে?”

শুভ্রতাও প্রশ্নমাখা দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদাফ কম্বল ঠেলে সরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই অপর পাশে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পৃথাকে চোখে পড়লো তার। মেয়েটার চোখের কোলে কালি জমেছে। শুকনো চোখ-মুখে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। সাদাফ কপাল কুঁচকে বোনের অবনত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ততক্ষণে পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে হাত খোঁপা করতে করতে সাদাফের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শুভ্রতা। তার চোখেমুখে কৌতূহলমাখা জিগ্যাসা। ভাই-ভাবির প্রশ্নমাখা দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলে উঠলো পৃথা,

—-” আমি বিয়ে করতে চাই ভাইয়া। তুমি বাবাকে বলো।”

মাঝরাতে বোনের এমন কথায় হতভম্ব চোখে তাকাল সাদাফ। পৃথার চোখ-মুখ বলছে, সে মজা করছে না। কিন্তু? মাঝরাতে বোনের এমন ধরনের কথাও তো মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। সাদাফ স্তব্ধ, নির্বাক দৃষ্টিতে নির্ণিমেষ চেয়ে রইলো। শুভ্রতা নিজের বিস্ময় কাটিয়ে নিয়ে বলল,

—-” তুমি ঠিক আছ পৃথা? হঠাৎ এতো রাতে…”

শুভ্রতার মুখের কথা কেড়ে নিয়েই উত্তর দিলো পৃথা,

—-” আমি ভালো নেই ছোট ভাবি। আমার বিয়েটা না হওয়া পর্যন্ত আমি ভালো থাকবো না। ”

পৃথার এমন উত্তরের পিঠে কোনো কথা খুঁজে পেলো না শুভ্রতা। সাদাফ গম্ভীর গলায় বলল,

—-” নিজের ঘরে যা পৃথা। আমরা এসব নিয়ে সকালে কথা বলবো।”

পৃথা নাছোড়বান্দা গলায় বলল,

—–” না। সকালে না। এখনই।”

সাদাফ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো। সাদাফের এই দৃষ্টির অর্থ পৃথা জানে। পৃথা মুহূর্তেই ভয়ে গুটিয়ে গেলো। ভয়মাখা অসহায় চোখদুটো মেলে শুভ্রতার দিকে তাকাল সাহায্যের আশায়। শুভ্রতা সাদাফের হাত টেনে ধরে বলল,

—-” তুমি ওকে ভয় দেখাচ্ছ কেন, বল তো? বাচ্চা একটা মেয়ে। শুনোই না কি বলতে চায় ও। তোমাকে ভরসা করে বলেই তো এতো রাতে তোমার কাছে ছুটে এসেছে। বাচ্চা মানুষ কত ভুলই তো করে।”

শুভ্রতার কথাকে শুনেও না শুনার ভান করে শান্ত গলায় আদেশ করল সাদাফ,

—-” তোকে রুমে যেতে বলেছি পৃথা। সকালে এই ব্যাপারে কথা বলব আমরা। দরকার হলে বাবাকেও বলব। এখন ঘুমো গিয়ে।”

পৃথা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। পৃথার এমন ব্যবহারে সাদাফ নির্বাক, হতভম্ব। এই পুচকি একটা মেয়ের এতো সাহস কি করে? সাদাফ শান্ত দৃষ্টিতে পৃথাকে নিরক্ষণ করে নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

—-” কাউকে পছন্দ করিস?”

পৃথা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। সাদাফের প্রশ্নে মাথাটা হালকা নেড়ে সম্মতি জানালো। সাদাফ কপাল কুঁচকে বলল,

—-” নাম কি? কি করে?”

পৃথা এবার মাথা তুলে তাকাল। শুভ্রতার কৌতূহলী দৃষ্টিতে চোখ রেখে ঢোক গিলল। মৃদুস্বরে বলল,

—-” শু শুভ্রব ভাইয়া।”

পৃথার মৃদু কন্ঠে বলা নামটা যেন মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটালো। সাদাফের মুখটা মুহূর্তেই থমথমে হয়ে এলো। শুভ্রতা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পৃথার অবনত মুখের দিকে। এই মেয়েটা পাগল হয়ে যায় নি তো? কি বলছে এসব?

#চলবে…..

[ রি-চেইক করা হয় নি। অনেক দিন পর দিলাম বলে দুঃখিত]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here