আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৬১

# আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৬১
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা

ঘড়ির কাটা তার নিজস্ব গতিতে ঘুরছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডার আমেজ। সটান খুলে রাখা উত্তরের জানালাটা দিয়ে হু হু করে হেমন্তের হাওয়া বইছে। ঠান্ডা হাওয়াটা গায়ে লেগে শরীরের লোমকূপগুলোও কাঁপিয়ে ছাড়ছে। আশেপাশের কোনো ফ্ল্যাটে ছোট্ট কোন বাচ্চা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। বাচ্চার চেঁচামেচি থেমে যেতেই ঘরময় এক ভয়ানক নিস্তব্ধতা ভর করছে। এমন এক নিস্তব্ধ ঘরের এক কোণায় পাশাপাশি বসে আছে দুই ভাইবোন। দুই জনের মাঝেই অদ্ভুত এক অস্বস্তি দানা বাঁধছে। এতো কাছে বসে, এমন হৃদয়ঘটিত ব্যাপার নিয়ে কখনো খোলামেলা আলোচনা হয় নি তাদের। সাদাফের গাম্ভীর্য আর বয়সের তফাৎ এর কারণেই হয়ত পৃথার সাথে ততটা সখ্যতা গড়ে উঠার সুযোগ হয় নি। এই একটা বছরে শুভ্রতার সাথে পৃথার যতটা সখ্যতা হয়েছে , সাদাফের সাথে গত আঠারো বছরেও তা হয় নি। তাদের এই সখ্যতা না হওয়ার পেছনে প্রাকৃতিক কারণও আছে বটে। পৃথা আধাঘন্টা যাবৎ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মনটা যথার্থই খারাপ। শুধু শুভ্রবের কথাগুলোর জন্য নয়। মনের ভেতর একটা আত্মগ্লানি, অপমানও কেমন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মনটাকে বিষিয়ে তুলছে। পৃথা কখনোই এমন ছিল না। কেন বা কিভাবে এমনটা হয়ে গেল তাও বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে এই পরিস্থিতিটা তার ভালো লাগছে না। এই দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে আর যায় হোক বেঁচে থাকা যাচ্ছে না। কিন্তু এখান থেকে বেরুবার পথও সে পাচ্ছে না। নিজেকে উত্তাল সমুদ্রের মাঝে ভেসে যাওয়া ভেলা বলে বোধ হচ্ছে। যার কোনো অতীত ছিল না, বর্তমান নেই এবং ভবিষ্যতটাও অজানা। ভেলা খামচে ধরে পড়ে থাকলেও বেঁচে যাওয়াটা নিতান্তই কল্পনা। সাদাফ ডানহাতটা পৃথার মাথায় রাখল। চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে পৃথার মুখের দিকে তাকাল। মনের ভেতর কাটা হয়ে থাকা অস্বস্তিকে ঠেলে দিয়ে মৃদু গলায় বলল,

—-” বললি না তো। খুব বেশি মন খারাপ? ফুসকা খাবি? চল দু’জনে মিলে ফুসকা খেয়ে আসি।”

পৃথা টলমলে চোখে সাদাফের দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-” এতো রাতে ফুসকা পাওয়া যায়?”

—-” যাবে না কেন?”

—-” ভাবি যে বাসায় একা থাকবে।”

—-” ও ঘুমোচ্ছে। যাবি নাকি?”

—-” তুমি তো ফুসকা খাও না।”

সাদাফ নির্মল হাসি দিয়ে বলল,

—-” আজ নাহয় খেলাম। সবকিছুর টেস্ট জানা থাকা ভালো।”

পৃথা মৃদু হাসলো। গায়ের চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

—-” যেতে ইচ্ছে করছে না।”

সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও পাশে বসে পড়ল। পৃথা এখন অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে। গুম মেরে বসে না থেকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর হুট করেই প্রশ্ন করল পৃথা,

—-” আমি কি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি ভাইয়া? আমি কি খুব খারাপ ধরনের মেয়ে হয়ে গিয়েছি?খুব খারাপ?”

সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। ঠোঁটে হাসি টেনে নিয়ে বলল,

—-” তুই কি করেছিস তা তো আমি জানি না। না জেনে কি করে বলি যে কাজটা ঠিক নাকি ভুল?”

পৃথা অবাক হয়ে বলল,

—-” তুমি জানো না?”

সাদাফ হেসে বলল,

—-” না জানি না। যতটুকু জানি তা নিতান্তই অল্প। তা দিয়ে তো ঠিক ভুল বিচার করা যায় না। কোনো ঘটনাকে বিচার করার জন্য সবটা শুনতে হয়, বুঝতে হয়।”

পৃথা ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। কান্নাগুলো দলা বেঁধে বুকের কাছে আটকে আটকে আসতে লাগল। ভাইয়ের চোখে-মুখে নিজের জন্য প্রশ্রয় আর বিশ্বস্ত ভরসা দেখতে পেয়ে মনের কোথাও চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। আধো মুখে ধীরে ধীরে বলল,

—-” আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ভাইয়া। শুভ্রব ভাইয়ার প্রতি কিভাবে এতোটা দুর্বল হয়ে পড়লাম আমি জানি না। কিভাবে উনাকে এতোটা হ্যারেজ করলাম তাও জানি না। আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে ভাইয়া। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি আশ্চর্য, ওই লোকটাকে আমি ভুলতে পারছি না।”

সাদাফ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। পৃথা মুখ চেপে ফুপাতে ফুপাতে বলল,

—-” আমি ভালো মেয়ে নই ভাইয়া। ভালো মেয়েরা রাস্তায় দাঁড়ায় না। এতোটা এতোটা….ছিঃ এতোটা বেহায়া কি ভালো মেয়েরা হয়? আমি এতো খারাপ কিভাবে হয়ে গেলাম ভাইয়া? আমি এসব মানতে পারছি না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। ভ.. ভ”

কান্নার বেগে কথা আটকে এলো পৃথার। ফর্সা মুখটা লাল আকার ধারণ করল। হাত-পায়ের মৃদু কম্পনটা আরো একটু স্পষ্ট হলো। সাদাফ এবার অচিন্তনীয় এক কাজ করল। জীবনের প্রথমবারের মতো বোনকে নিজের বুকে টেনে নিলো। কম্বল দিয়ে পৃথার শরীরটা ভালো করে ঢেকে দিয়ে মাথায় হাত বুলাল। ভাইয়ের থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত আদর আর প্রশ্রয় পেয়ে পৃথার কান্নার দমাক বাড়লো। সাদাফ পৃথার মাথায় আলতো চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলল,

—-“এত কাঁদলে মাথাব্যথা করবে তো রে বাবা। এইটুকুর জন্য এতো কাঁদতে হয়?”

পৃথা ধরা গলায় বলল,

—-” এটা এতটুকু?”

সাদাফ হেসে বলল,

—-” তা নয়তো কি?”

পৃথা টলমলে চোখে কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাইয়ের বুকে মুখ লুকালো। বিরবির করে বলল,

—-” এটা কখনোই এতোটুকু কোনো ব্যাপার নয়।”

সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,

—-” কাউকে পছন্দ করা বা ভালোবাসা কখনোই খারাপ কাজ নয়। মানুষ ভালোবাসে বলেই বেঁচে থাকে। কিন্তু ভালোবাসলেই যে তাকে আদায় করে নিতে হবে, জোরপূর্বক ভালোবাসতে বাধ্য করতে হবে এটা ঠিক নয়। ধর, আমি একজনকে হুট করেই ভালোবেসে ফেললাম। তার নাম, ধাম, পরিচয় না জেনেই তাকে নিজের করার চেষ্টা চালালাম তাহলে কি সেটা যুক্তিযুক্ত হবে? এমনও হতে পারে অপর পাশের মানুষটাও অন্য একজনকে আমার মতোই ভালোবাসে। অথবা সে বিবাহিত বা এনগেজড। সেক্ষেত্রে আমার ফিলিংসটা যতটা খাঁটি তারটা কি আমার থেকেও বেশি প্রখর হতে পারে না?”

পৃথা লক্ষ্মী মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। সাদাফ পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল,

—-” আমি যতটা বুঝতে পারছি শুভ্রবকে তোর হঠাৎ করেই ভালো লেগে গিয়েছিল। ওর অতীত, বর্তমান বা তার সম্পর্কে কিছুই তুই জানতিস না।তনয়া নামের যে মেয়েটাকে সে ভালোবাসে সে যদি এখনও শুভ্রবের সাথেই থাকতো তবুও হয়ত তুই এভাবেই প্রেমে পড়তি। সবটা জানার পর নিশ্চয় সরে আসতি, আসতি না?”

পৃথা দ্বিধা নিয়ে মাথা নাড়ল। সাদাফ আবারও বলতে শুরু করল,

—-” গুড। এখনও পরিস্থিতিটা ঠিক সেরকম।”

পৃথা মৃদু গলায় বলল,

—-” কিন্তু ওই আপুটার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। শুভ্রব ভাইয়া নিজে বলেছেন।”

—-” মানুষটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভালোবাসাটার তো হয় নি।”

পৃথা বুঝতে না পেরে বলল,

—-” মানে?”

সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—-” শুভ্রব তনয়াকে ভালোবাসে। হাজারে একজন প্রেমিক যেমন ভালোবাসে ঠিক তেমনভাবে। তনয়ার থাকা না থাকাটা তার ভালোবাসার ওপর এফেক্ট ফেলছে না। তনয়া তার সাথে থাকতে সে তাকে যতটা ভালোবেসেছে হয়ত তার অনুপস্থিতিতে সেই ভালোবাসাটা আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।”

পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” এমনটা হয়? একজন চলে গেলে কি মানুষ অন্য একজনকে আপন করে নেয় না? ভালোবাসার চেষ্টা করে না?”

—-” তনয়া তো যায় নি। শুভ্রব তাকে যেতে বাধ্য করেছে। তাছাড়া সবার আবেগ-অনুভূতি তো একরকম হয় না। আচ্ছা? তোর কি ধারণা? তোর ভাবিকে কতটুকু ভালোবাসি আমি?”

পৃথা না ভেবেই বলল,

—-” অনেক বেশি।”

—-” তোর কি মনে হয়? তোর ভাবির কিছু হয়ে গেলে আমি অন্যকোনো মেয়ের সাথে সংসার করতে পারতাম?”

পৃথা একটু ভেবে বলল,

—-” মনে হয় না।”

সাদাফ হাসল। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল,

—-” আমার আর তোর ভাবির সাক্ষাৎ বেশি হলে মাত্র দুই বছরের। আর শুভ্রব-তনয়া একে অপরকে ভালোবাসে আজ চারবছর। আমাদেরই যদি এমন ফিলিংস হয় তাহলে ওদের অবস্থাটা ভাব।”

পৃথা অসহায় কন্ঠে বলল,

—-” কিন্তু ওরা তো আলাদা হয়ে গিয়েছে।”

—-” আলাদা হলেই কি সব শেষ হয়ে যায়? তাহলে তুই আর শুভ্রব কখনো এক না হয়েও এতোটা কষ্ট পাচ্ছিস কেন? ওর সাথে তোর দেখাটা বড়জোড় চার কি পাঁচমাস, তাই না? তুই নিজের ব্যাপারটা মন দিয়ে এবং শুভ্রবের ব্যাপার মস্তিষ্ক দিয়ে চিন্তা করছিস বলেই তোর কাছে নিজের কষ্টটাই বড় বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতাটা তা নয়।”

পৃথা আনমনা হয়ে বসে রইল। ভাইয়ের থেকে খানিকটা সরে বসে খানিক ভাবল। চিন্তিত গলায় বলল,

—-” তাহলে কি উনাকে ভালোবাসাটা অন্যায়?”

—-” অন্যায় কেন হবে? ভালোবাসা কখনও অন্যায় না। কিন্তু অপরপক্ষের চাওয়া-পাওয়ার গুরুত্ব না দেওয়াটা অন্যায়। শুভ্রব এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাইছে, তাই থাকতে দে। নিজের ভালোবাসার বোঝাটা ওর ওপর চাপানোটা ঠিক হবে না এখন। এতে তোর প্রতি ওর বিতৃষ্ণা বাড়বে বৈ কমবে না ৷ তাছাড়া, ম্যান্টাল প্রেশারও বাড়বে। ভালোবাসা মানেই যে পেতে হবে তা তো নয়। আমি শুভ্রবকে আরো পাঁচ/ছয় বছর আগে থেকে চিনি। ও ভীষণ চঞ্চল আর সেন্টিমেন্টাল ছেলে। এই হঠাৎ ধাক্কা তাকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। তনয়াকে সে সহজে ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা সে হয়ত তনয়াকে ভুলতেই চায় না। ওর প্রতি কোনো আশা না রাখাটাই ভালো পৃথা। তবুও তোর যদি মনে হয়, তোর অপেক্ষা করা উচিত তাহলে করতেই পারিস। আমি তোকে নিষেধ করব না। কিন্তু সেই অপেক্ষা যেন জোর খাটানোর পর্যায়ে না চলে যায়। সেই অপেক্ষা হতে হবে আশাহীন অপেক্ষা। এবার, ভেবে দেখ।”

কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল সাদাফ। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল,

—-” আমরা সবাই তোকে অনেক বেশি ভালোবাসি পৃথা। আমরা জানি আমাদের মেয়েকে দুর্বলতা গ্রাস করতে পারে না। তার সাহস, আত্নসম্মান আর আবেগ নিয়ন্ত্রণের মতো মনের জোর আছে। কি, আছে না?”

পৃথা এতোক্ষণ নির্বিকার বসে থাকলেও ভাইয়ের কথায় মুখ তুলে তাকাল। মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ল। সাদাফ মৃদু হেসে বলল,

—-” নারীর আত্মসম্মানটা কখনো ভঙ্গ হতে নেই৷ আত্মসম্মানটাই তাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। একবার আত্মসম্মানের বাঁধ ভেঙে গেলে আসে আত্মগ্লানি। আর আত্মগ্লানি থেকে আত্মহত্যা অর্থাৎ মৃত্যু। কথাগুলো মনে রাখিস। থাকবে মনে?”

পৃথা মাথা নেড়ে ভারি আত্মবিশ্বাসের গলায় বলল,

—-” মনে থাকবে ভাইয়া।”

সাদাফ ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পৃথা ভাইয়ের যাওয়ার দিকে দৃষ্টি রেখে মনে মনে হাজার বার ধন্যবাদ জানাল। শুভ্রবের জন্য হওয়া কষ্টটা না কমলেও ভয়ানক অগোছালো জীবনটাতে কোথাও একটা কোমলতার আভা পড়ল। মনে হতে লাগল, এইতো তার কেউ আছে। তার একটা আশ্রয় আছে। বিশ্বস্ত এক আশ্রয়।

_______________________

ক্যাম্পাসের মাঠে বসে আছে তমাল। ঘাসের ডগাগুলো শিশিরে টুইটম্বুর হয়ে আছে। জামা-কাপড়ের অনেকাংশ ভিজে যাওয়ায় ভীষণ ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। তার পাশেই লম্বা হয়ে শুয়ে আছে শুভ্রব। শিশিরভেজা ঘাসে শুয়ে আয়েশ ভরে সিগারেট টানছে। তমাল বিরক্ত হয়ে বলল,

—-” ধুশ্ শালা। তোর কি শীত টিত করছে না? এম্নে ভটকা মেরে পড়ে আছিস কেন? বাড়ি যাবি না?”

শুভ্রব উদ্বেগহীন গলায় প্রশ্ন করল,

—–” কয়টা বাজে?”

—-” একটা বিশ।”

—-” অনেক রাত। তুই বাড়ি চলে যা। আন্টি টেনশন করবেন।”

তমালের বিরক্তি এবার আকাশ ছুঁল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—-” আমার মায়ের কথা তোরে ভাবতে কইছে কে? তুই তোর মায়েরটা ভাব আর বাড়ি যা। এই ঠান্ডায় পড়ে থাকলে মরে যাবি শালা।”

শুভ্রব ঠাট্টার গলায় বলল,

—-” কথায় কথায় শালা ডেকে আমার বোনকে বিয়ে করার ইচ্ছে পোষণ করার প্রয়োজন নেই। বোন আমার অলরেডি ম্যারিড। দুই দিন বাদে মামা হবো।”

তমাল ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” শুনে বহুত খুশি হইলাম। এখন তুই বিয়ে করে আমাকে চাচা বানিয়ে দে তাহলেই আমি ধন্য ।”

শুভ্রব জবাবে অদ্ভুত হাসল। তমাল খানিকটা মিইয়ে গিয়ে বলল,

—-” কি লাভ হচ্ছে বল তো? তনয়ার তো বিয়ে হয়েই গিয়েছে। এভাবে কি জীবন চলে? চাকরীও তো পেয়ে গিয়েছিস এখন। তাছাড়া যে হারে পড়াশোনা করছিস বিসিএসও হয়ে যাবে দেখিস। এবার তো বিয়েশাদি কর। যত একা থাকবি তত দুঃখ বাড়বে।”

শুভ্রব ফিচেল হেসে বলল,

—-” আমার জন্য তোর এতো চিন্তা হয় জানতাম না তো।”

তমাল বিতৃষ্ণ গলায় বলল,

—-” আল্লার দোহাই লাগে ফাজলামোটা বন্ধ করে সিরায়াস হ। একটা বিয়ে কর নয়তো প্রেম।”

শুভ্রব দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলল,

—-” হবে না।”

তমাল চেতে উঠে বলল,

—-” কেন হবে না? এই দুনিয়ায় কি অন্যকারো প্রেমিকার বিয়ে হচ্ছে না? তারা কি তোর মতো বিরহে মরে যাচ্ছে?”

শুভ্রব হেসে বলল,

—-” মরে কই যাচ্ছি? এই তো বেঁচে আছি। সিগারেট টানছি, অফিস করছি, বাবা-মাকে দেখছি।”

তমাল অসহায় গলায় বলল,

—-” এটাকে কি জীবন বলে দোস্ত? মেয়েটার বিয়ে হয়েছে প্রায় আট নয় মাস হতে চলল। এখনও এতোটা….”

শুভ্রব হেসে বলল,

—-” তুই যেমনটা ভাবছিস ব্যাপারটা আসলে তা নয়। আমি যে শুধু তনয়ার শোকে কাতর হয়েই বিয়ে করছি না, তা সম্পূর্ণ ঠিক না। তনয়া একটা কারণ বটে তবে এর মাঝে আরেকটা ব্যাপার আছে।”

তমাল ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” কি ব্যাপার?”

—-” আমি আসলে মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছি না। চেয়েও পারছি না। পুরুষ হিসেবে নারীদের প্রতি যে স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে তা যেন মরে গিয়েছে। কিছুতেই কোনো ফিল টিল আসছে না। না শরীরে আর না মনে।”

তমাল বিস্মিত হয়ে বলল,

—-” এমনটাও হয়?”

শুভ্রব নিরুদ্ধেগ গলায় বলল,

—-” আমার তো হচ্ছে। ছোটাচ্চুরও হয়। এটা হয়ত আমাদের বংশের ধারা, বুঝলি? প্রত্যেক প্রজন্মে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে যাওয়ার মতো কিছু মানুষ থাকতে হয়।”

কথাটা বলে খুব হাসে শুভ্রব। কিন্তু তমালের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হয় না। শুভ্রবকে সে চিনে। ছোট্ট বেলার বন্ধু হওয়ার দায়ে এই হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা অনেক কিছুই সে আঁচ করতে পারে। তমাল হুট করেই প্রশ্ন ছুঁড়ল,

—-” তনয়ার প্রতিও ফিল আসে না? ওর কথা ভাবলে?”

শুভ্রব কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে যায়। তারপর মৃদু হেসে বলল,

—-” বাজে কথা বাদ দে তো। তোর না আগামী মাসে বিয়ে? বউয়ের সাথে গালগল্প না করে এইখানে মাথা খাচ্ছিস কেন বল তো?”

তমাল হঠাৎই উৎসুক হয়ে বলল,

—-” তুই এখনও তনয়াকে চাস? চাস ও ফিরে আসুক?”

শুভ্রব থমথমে মুখে তমালের দিকে তাকাল। শক্ত গলায় বলল,

—-” না।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বিরবির করে বলল,

—-” ওর সংসার সুখের হোক। ভালো থাকুক। আমার সুখগুলোও তার হোক।”

তমাল উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ নামক পোকাগুলো দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে তার। শুভ্রবকে মেরে ধরে নদীতে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এতটুকু সুখের প্রত্যাশাও কি করতে পারে না এই ছেলে? এই একটা মেয়েকে ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করাটা কি এতোই কঠিন? তমালও তো কম প্রেম করে নি। কই? তার তো এমন অনুভূতি হয় নি কখনও। তাহলে শুভ্রবই কেন? কেমন একটা অচেনা ব্যথায় বুকটা চিনচিন করে ওঠে তমালের। উফ, কি অশান্তি!

#চলবে….

[ দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত। কাল আরেকটা পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করব।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here