#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩
রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। সাঈদ বাইকের উপর বসে আছে। রোদের কারণে সে ঘেমে একাকার। অনেকক্ষণ ধরে রাস্তায় জ্যাম। তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ইরিনা হয় তো অপেক্ষা করছে তার৷ সে সকালেই কল দিয়ে বলেছে সে আসছে বাসায় ইর্তেজার সাথে দেখা করতে। কিন্তু ইরিনা বলেছে ইর্তেজা সকাল সকালই বেরিয়ে গিয়েছে প্রতিদিনের মতো। সাঈদ বলেছে সে তবুও আসছে ইর্তেজাকে কল দিয়ে বলতে৷ বসে থেকে জ্যামের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে সে। হঠাৎ সাঈদের দিকে একটা কাগজ উড়ে আসলো। সাঈদের গায়ে লেগে কাগজটা মাটিতে পড়ে গিয়েছে। সাঈদ এক নজর কাগজটা দেখে আশে পাশে চোখ বুলালো। কিন্তু সে বুঝতে পারলো না কাগজটা কে ছুঁড়ে মেরেছে। সে ভাবছে, কাগজটা কী তুলবে? কিছুক্ষণ পর জ্যাম ছুটে গেল। সামনের গাড়ি গুলো এগিয়ে যাচ্ছে৷ সাঈদ দ্রুত কাগজটা তুলে বাইক স্টার্ট দিলো। কিছুটা দূর গিয়ে বাইক থামিয়ে কাগজটা খুলে দেখে কিছু লিখা আছে। লিখাটা পড়ে তার ভ্রু কুঁচকে গেল, “হোয়াইট শার্টে আপনাকে বেশ দেখায় মিস্টার সাঈদ ইব্রাহিম।”
সাঈদ ভাবছে কে হতে পারে। তার নাম পর্যন্ত জানে মানুষটা।
.
.
সাগরিকার মন খারাপ ভীষণ। শ্রাবণের চামচা ইর্তেজা কখনো তাকে কারো সাথে দেখা করতে দেবে না সে জানে। ইর্তেজা গাড়ি চালাতে চালাতে আয়নায় সাগরিকাকে দেখলো। প্রতিবারের মতো সে এখনো মুখ লটকিয়ে বসে আছে। ইর্তেজা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল- “ম্যাম কোথাও যাবেন?”
সাগরিকা বিরক্ত ভাব নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল। ইর্তেজা বুঝলো সাগরিকা এখন রেগে আছে। ইর্তেজা কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে বলল- “ম্যাম কারো সাথে দেখা করলে বলুন।”
“হ্যাঁ আমি দেখা করি আর তুমি আমাদের দুজনকে মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দাও তাই তো?”
ইর্তেজা হাসলো । সাগরিকা রাগী দৃষ্টি বানিয়ে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল-
“এই, এতে হাসার কি আছে। আমি কী জোকস বলেছি?”
“সরি ম্যাম, তো বলুন কী ডিসাইড করলেন?”
“বাসায় চলো”
“আর ইউ শিওর?”
“ইশশশ দুই ক্লাস পড়ে ইংলিশ ঝাড়ছে। তোমাকে লেকচার দিতে বলি নি। যা বলছি চুপচাপ তা করো।”
দুই ক্লাস? ইর্তেজা হাসলো। সাগরিকার কথার মতো গাড়ি বাসার দিকে নিয়ে গেল।
.
.
ইরিনা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। সাঈদের জন্য অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু এখনো ছেলেটা আসছেই না। ঝর্ণা ইরিনার অস্থিরতা দেখে বলল-
“আপা, মনে হয় সাঈদ ভাই আইবো না। আপনে চলেন আরাম করতে।”
“না, সে আসবে আমি জানি। ইর্তেজাকে কল করেছো?”
“ভাই তো ফোনই ধরে না।”
ইরিনা লম্বা নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলো। ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল- “ফিরনি দেখো গিয়ে বেশি শুকিয়ে গেলে পুড়ে যাবে।”
“জি আপা”
ঝর্ণা চলে গেল রান্নাঘরে। ইরিনা ভাবলো ঘরে ফিরে যাওয়া যাক। সে হুইলচেয়ার ঘুরাতেই হর্ণের শব্দ আসলো। ইরিনার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সাঈদ ভেতরে প্রবেশ করতেই ইরিনা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সাঈদ কাছে এসে সালাম দিলো ইরিনাকে। ইরিনা সালামের জবাব নিয়ে বলল- “এত লেইট হলে যে? দেড় ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”
“আপনি আমার অপেক্ষা করছিলেন?”
বেশ আগ্রহ নিয়ে সাঈদ প্রশ্ন করলো। ইরিনা সাঈদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটার চোখে মুখে অস্থিরতা দেখতে পেলো সে। ইরিনা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল- “না মানে, তুমি বলেছিলে ইর্তেজার সাথে দেখা করতে আসবে। কিন্তু তোমার বন্ধু কোথায় আল্লাহ তা’য়ালা ভালো জানেন। অনেকক্ষণ ধরে কল দিচ্ছি ধরছেই না।”
সাঈদ মন খারাপ করলো। সে ভেবেছিলো ইরিনা বলবে যে সে তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। কষ্টের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল সাঈদ। ইরিনা সাঈদকে বসতে বলল। সাঈদ মাথা নাড়িয়ে চেয়ারে বসলো। ইরিনা ঝর্ণাকে ডেকে বলল সাঈদের জন্য নাশতা নিয়ে আসতে। সাঈদ চুপচাপ বসে আছে। ইরিনাও কিছু বলছে না। চারপাশ নিরবতা। ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। নিরবতা ভেঙ্গে ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলল- “বাসার সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন? ঔষধ ঠিক মতো খাচ্ছেন?”
“আমিও ভালো, আর ঔষধও ঠিক মতো খাচ্ছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না ঔষধের। মনে হয় না আর কখনো চলাফেরা করতে পারবো।”
ইরিনা কথাটা হাসিমুখে বললেও সাঈদকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তার বুক জ্বলছে, খুব জ্বলছে। তার যে ইচ্ছে করছে ইরিনার সব কষ্ট সব বেদনা নিজের নামে করে নিতে। যদি সম্ভব হতো সে তাই করতো। সাঈদ মাথা নিচু করে বলল-
“আপনি একদিন নিশ্চয়ই সুস্থ হবেন। শুধু আপনার একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”
সাঈদের কথা শুনে ইরিনা তার দিকে তাকাল। কেন যেন সাঈদের কথা তাকে ভীষণ শান্তি অনুভব করালো।
.
.
সাগরিকা গাড়ি থেকে নেমে মন খারাপ করে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইর্তেজা তাকিয়ে আছে সাগরিকার যাওয়ার দিকে। কারো মন খারাপ দেখলে তার ভালো লাগে না। আচ্ছা মেয়েটা তো ভালো। তাকে দেখে মনে হয় না কোনো ছেলের সাথে দেখা করতে যেতে চায়। এমনও তো হতে পারে তার পরিবারের কেও। ইর্তেজার হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করছে সাগরিকার সম্পর্কে। কিন্তু যদি শ্রাবণ জানতে পারে সাগরিকা তার পরিবারের কারো সাথে দেখা করতে চায় সবাইকে মেরে ফেলবে। ইর্তেজা চায় না তার জন্য কারো মৃত্যু হোক। হঠাৎ ইর্তেজার মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে “Boss” লিখা ভাসছে। রিসিভ করে কানে ধরলো- “জি বস”
“তোমাকে বলেছিলাম প্রতি ঘণ্টার খবর আমাকে জানাতে। কোথায় তুমি?”
“ম্যামকে নিয়ে বাসায় আসলাম। উনি আজ কারো সাথে দেখা করার কথা বলেনি। তাই কল দেই নি আপনাকে।”
“অবাক হলাম, আজ সাগরিকা জেদ করলো না কারো সাথে দেখা করার।”
“আপনি বলায় আমি একবার হুমকি দিয়েছিলাম। সেদিন থেকেই জেদ ছেড়ে দিয়েছেন উনি।”
“যাক ম্যাডাম ধীরে ধীরে লাইনে আসছে। তোমাকে ধন্যবাদ ইর্তেজা। তুমি আমার অনেক সাহায্য করছো।”
“এটা আমার কর্তব্য বস। আচ্ছা বস শুনুন, ম্যামের খুব মন খারাপ। আজ আপনি নাহয় উনাকে ঘুরাতে নিয়ে যান। আপনি যত উনাকে সময় দিতেন তত উনি আপনার প্রতি দুর্বল হবে।”
“বাহ তুমি দেখছি লাভ গুরু-ও। তোমার কথার মতোই হবে। আজ আমি ওকে নিয়ে বাহিরে যাবো। এখনও কি মন খারাপ ওর?”
“হ্যাঁ খুব।”
“আচ্ছা এক কাজ করো। হয় তো এতে তার মন কিছুটা ভালো হবে….
.
.
“ফিরনিটা দারুন হয়েছে। আমি খুব মিস করছিলাম আপনার হাতের রান্না।”
“আজ অনেকদিন পর রান্না করলাম আমি। যদিও ঝর্ণা অনেক সাহায্য করেছে।”
সাঈদ ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনাকে ধন্যবাদ উনার এত খেয়াল রাখার জন্য।”
ঝর্ণা লজ্জা পেল, “আঞ্জে অলকাম অলকাম।”
সাঈদ শব্দ করে হাসলো ঝর্ণার কথা শুনে৷ ঝর্ণা লজ্জা ভাব নিয়ে চলে গেল। ইরিনা অবাক, এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে সে বুঝলো না। সাঈদ ইরিনার চাহনি দেখে বলল- “কী দেখছেন?”
“তুমি ওর প্রশংসা করলে আর ও গলে গেল।”
সাঈদ লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিচু শব্দে বলল- “যাকে গলাতে চাই সে তো গলে না।”
“কিছু বললে?”
“জি? না কিছু না।”
সাঈদ ফিরনি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দৃষ্টি রান্নাঘরে দিতেই সে দেখে ঝর্ণা উঁকি দিয়ে সাঈদকে দেখছে। আর লজ্জামাখা হাসি দিচ্ছে। ইরিনা আরো অবাক হলো। এই মেয়েটাই কত কিছু বলছিল সাঈদের সম্পর্কে আর এখন নিজেই একা একা প্রেমের লাড্ডু খাচ্ছে। ইরিনার বিষয়টা মোটেও ভালো লাগলো না। এক কথায় বললে তার জেলাস হচ্ছে খুব। বিরক্ত ভাব নিয়ে বসে রইলো।
.
.
সাগরিকা গোসল করে বের হলো। এখন তার ভালো লাগছে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল সে মরুভূমিতে আছে। ঘরে এসে দেখে তার বিছানায় একটা বড়ো বক্স রাখা। সাগরিকা ভ্রু কুঁচকালো। শ্রাবণ তো বাসায় নেই এটা কে রাখলো এখানে? সাগরিকা বক্সটা হাতে নিলো। কিছুটা ভারী। খাটে বসে সে বক্স খুলল। একটা গাড়ো নীল রং এর গাউন। সাগরিকা হা হয়ে গাউনের উপর হাত বুলাল। জামাটা তার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। খুশি মনে গাউনটা হাতে নিলো। খুবই সিম্পল গাউনটা৷ কিন্তু খুব সুন্দর। আয়নার সামনে গিয়ে গাউন গায়ে দিয়ে দেখল। পুরো তার মাপের। নিশ্চয়ই শ্রাবণ দিয়েছে এটা। মানুষটাকে সে ঘৃণা করে ঠিক। কিন্তু তার মানতে হবে শ্রাবণ পছন্দ খুব সুন্দর। না হলে কী তাকে ভালোবাসতো? গর্বিত হলো সাগরিকা। সে মোবাইল নিয়ে শ্রাবণকে কল করলো। ধন্যবাদ না জানালে বিষয়টা বাজে দেখায়। শ্রাবণ মিটিং-এ ছিলো৷ সাগরিকার কল দেখে মিটিং থেকে উঠে কিনারায় গেল। মুচকি হেসে রিসিভ করলো-
“হ্যালো ম্যাম, আশা করছি রাগ কমেছে আপনার।”
“আমার রাগ এত সহজে কমবে?”
“তা তো অসম্ভব, তো বলুন আর কী কী করতে পারি আপনার জন্য।”
“আপাতত আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ রাখো। পছন্দ হয়েছে গাউনটা।”
“উফফ আমি ভীষণ চিন্তায় ছিলাম যে আমার ম্যাডামের জামা পছন্দ হবে কিনা। এখন আমি নিশ্চিন্তের নিশ্বাস নেবো। আচ্ছা শুনো, আজ আমরা ডিনার করতে বাহিরে যাব। জামাটা পড়ে তৈরী হয়ে থেকো।”
“ঠিক আছে, তারাতাড়ি এসো আমি অপেক্ষা করবো।”
“লাভ ইউ”
সাগরিকা উত্তর দিলো না। কল কেটে দিলো। শ্রাবণ লম্বা নিশ্বাস ফেলে মিটিং-এ ফিরে গেল।
রাতেরবেলা…..
সাগরিকা তার ঘড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছে কোনটা পড়বে। তখনই দরজা খোলার শব্দ আসলো। সাগরিকা দ্রুত পেছনে ফিরে দেখে শ্রাবণ প্রবেশ করছে ঘরে। শ্রাবণ ঘরে এসে থমকে গেল। বেহায়া নজরে তাকিয়ে আছে সাগরিকার দিকে৷ সাগরিকা হেসে আয়নার দিকে ফিরে একটা ঘড়ি নিয়ে হাতে পড়তে পড়তে বলল-
“এখন কোনো ফিল্মি ডায়ালগ দিয়ো না। লাইক তোমাকে আসমান থেকে নেমে আসা পরী লাগছে।”
শ্রাবণ এগিয়ে এসে সাগরিকার পাশে দাঁড়াল। সাগরিকা আয়নায় শ্রাবণকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। শ্রাবণ সাগরিকার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরালো। সাগরিকা তাকাল শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সাগরিকাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে। শ্রাবণের চোখে লোভ লালসা নেই৷ আছে তো শুধু ভালোবাসা । কিন্তু সাগরিকার শ্রাবণের ভালোবাসা পছন্দ না। শ্রাবণ হাসিমুখে বলল- “আমি তো বলেছিলাম লাল রং এর গাউন নিতে। এখন তো দেখছি নীল রং বেশ মানিয়েছে তোমার উপর।”
“মানে? এই জামা তুমি দাও নি?”
“হ্যাঁ আমিই দিয়েছি। কিন্তু কিনেছে ইর্তেজা।”
সাগরিকা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। শ্রাবণ তার চাহনি দেখে হেসে বলল-
“কি হলো এভাবে দেখছো কেন?”
“তুমি বলছো এই জামা তোমার ওই চামচা কিনেছে?”
“হ্যাঁ, আমিই বলেছিলাম তোমার জন্য সুন্দর দেখে একটা গিফট নিতে। বলতে হবে ছেলেটার চয়েজ সুন্দর।”
সাগরিকার মাথায় রক্ত উঠে গেল। এক ঝটকায় নিজেকে দূরে সরিয়ে দ্রুত গাউন খুলতে নিলো। শ্রাবণ তারাতাড়ি তার হাত ধরে বলল- “পাগল হয়ে গেলে। কি করছো?”
সাগরিকা ঝাড়ি মেরে শ্রাবণের হাত সরিয়ে বলল-
“ওই ছেলের সাহস কি করে হলো আমার জন্য জামা কেনার?”
“রাগ করছো কেন? আমি বলেছিলাম তাকে।”
“তুমি আমার স্বামী কিন্তু তুমি পরপুরুষকে দিয়ে আমার জন্য জামা আনিয়েছো। কেন শ্রাবণ কেন?”
শ্রাবণ সাগরিকার হাত ধরে কাছে টেনে নিলো।
“আই এম সরি, আই এম রিয়েলি রিয়েলি সরি। আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। নাহলে নিজে গিয়ে তোমার জন্য জামা নিয়ে আসতাম। ইর্তেজাকে বলায় সে গিয়ে জামা কিনেছে। কিন্তু টাকা তো আমি দিয়েছি।”
সাগরিকার রাগ তবুও কমছে না। শ্রাবণ হেসে সাগরিকাকে বুকে ভরে নিলো। সাগরিকা বন্ধ করে নিলো দু চোখ। শ্রাবণ তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল-
“থাক জান রাগ করে না৷ আমি ওয়াদা করছি আর কখনো এমন হবে না। আজকের জন্য মাফ করে দাও প্লিজ।”
সাগরিকা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। মাথা তুলে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল-
“শেষ সুযোগ এটা।”
“ওকে ওকে”
“আর হ্যাঁ, আজই প্রথম এবং আজই শেষ। আমি আর এ জামা কখনো পড়বো না।”
শ্রাবণ হেসে সম্মতি জানালো। সাগরিকা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল শ্রাবণকে তৈরী হয়ে নিতে। শ্রাবণ হেসে চলে গেল। সাগরিকা আয়নায় নিজেকে আবার দেখলো। খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার। কিন্তু কেন সে জানে না। খাটে বসে লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো।
.
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে ইর্তেজা বাসায় ফিরলো। ইরিনা তারই অপেক্ষায় ছিল। ইর্তেজাকে দেখে সে দ্রুত হুইলচেয়ার নিয়ে এগিয়ে আসলো। ইর্তেজা বোনকে দেখে মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে বসলো।
“ঘুমোও নি?”
“আমার ভাই সময়ের মতো বাসায় না আসলে আমার ঘুম হবে?”
ইর্তেজা ইরিনার পায়ে মাথা রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। এই কোলটা তার ভীষণ প্রিয়। সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। ইরিনা ইর্তেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“সাঈদ আজও এসে ফিরে গেল। তোকে কল দিলে তুই ধরিস না কেন বল তো।”
“কাজে ছিলাম আপু।”
“এটা কেমন কাজ ইর্তেজা যেখানে তোর এক মিনিটও সময় নেই বোনের সাথে কথা বলার৷ সত্যি করে বল ভাই তুই কি কাজ করিস?”
ইর্তেজা মাথা তুলে ইরিনার দিকে তাকাল। জবাবে মুচকি হাসলো। ইরিনা জানে সে আজও জবাব পাবে না। সময় আসলে ইর্তেজা নিজেই বলে দিবে। কিন্তু তার যে ভয় হয় খুব তার একমাত্র ভাইয়ের জন্য। যাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে। ইর্তেজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল-
“আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি। তারপর একসাথে খাবার খাবো।”
বলেই মুচকি হেসে ইর্তেজা চলে গেল। ইরিনা বসে আছে চুপচাপ। তার ভীষণ ভয় করছে ছেলেটাকে নিয়ে।
.
.
আজ সাগরিকার জন্য শ্রাবণ পুরো রেস্টুরেন্ট বুক করে ফেলেছে। খুব সুন্দর করে সাজানো চারপাশ। সাগরিকা বসে মুগ্ধ হয়ে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। কিন্তু শ্রাবণ কোথায়। সাগরিকা গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। হঠাৎ গানের শব্দ ভেসে আসলো। বড়ো মিউজিক বক্সে সাগরিকার প্রিয় গান “তোর মন পাড়ায়” বাজছে। শ্রাবণ এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো সাগরিকার বরাবর। সাগরিকা মুচকি হাসলো। নীল রং এর কোর্ট, প্যান্ট এবং সাদা রং এর শার্ট পড়েছে শ্রাবণ। সাগরিকার জামার রং এর সাথে মিলিয়ে। আজ তাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। কিন্তু সাগরিকা যে এই রূপের প্রেমে কখনোই পরতে পারবে না। মন তো আর একজনের কাছে অনেক আগেই দিয়ে এসেছে। খুব সুন্দর এবং মধুর সময় কাটালো দুজন। সাগরিকার চেহারায় আজ সত্যিকারের হাসি দেখতে পাচ্ছে শ্রাবণ। তার মন যেন নেচে উঠছে সাগরিকাকে খুশি দেখে। রাত সাড়ে ১২ টায় তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। সাগরিকা গাড়িতে বসে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ক্লান্ত সে এখন। শ্রাবণ মুচকি হেসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সাগরিকার দিকে। আজ তার সময় ভালো কেটেছে একমাত্র ইর্তেজার জন্য। সে-ই তো আইডিয়া দিয়েছিলো। নাহলে তো শ্রাবণ বাসায় এসেই টিভি দেখে বা অফিসের কাজ নিয়ে বসে পড়ে। সাগরিকা একা বসে থাকে নাহয় পড়াশোনা করে৷ সাগরিকার কাছে থেকেও যেন সে দূর ছিল৷ তাই হয়তো সাগরিকা তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। আজ সব কাজ রেখে সাগরিকাকে সময় দেওয়ায় তার কতটা ভালো লাগছে সে বলে বোঝাতে পারবে না৷ শ্রাবণ মোবাইল বের করে ইর্তেজাকে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠালো- “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
ইর্তেজা ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে তার সিগারেট৷ সিগারেটটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেদিকে ইর্তেজার মন নেই৷ মেসেজ টন বাজায় ইর্তেজার ঘোর ভাঙলো। হাতে থাকা সিগারেট মাটির সাথে ঘষে নিভিয়ে মোবাইল হাতে নিলো। শ্রাবণের মেসেজ দেখে মুচকি হেসে রিপ্লাই পাঠালো- “কর্তব্য ছিলো আমার, তবুও আপনাকে স্বাগতম।” মেসেজটা পাঠিয়ে ইর্তেজা তার ওয়ালপেপারের দিকে তাকাল। ওয়ালপেপারে একটি মেয়ের ছবি ভাসছে। মেয়েটা গালে হাত দিয়ে মুখ লটকিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ভীষণ অভিমান করেছে। ইর্তেজা মুচকি হেসে মোবাইল রেখে আবার আকাশের দিকে তাকাল। চোখের কোণায় পানি জমে গিয়েছে তার। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু বুকের ভেতর অনুভব করা চিনচিন ব্যাথা তাকে স্বাভাবিক থাকতে দিলো না। দু-চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরলো তার।
চলবে……