#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৬
রাতের খাবার খেয়ে ১১ টায় সাঈদ চলে গেল। যতক্ষণ সাঈদ ছিল ইরিনা ভীষণ খুশি ছিল। সে চলে যাওয়ায় মন খারাপ করে বসে আছে। ইর্তেজা থালা-বাসন ধুয়ে রান্নাঘর গুছিয়ে বোনের ঘরে আসলো ঔষধ খাওয়ানোর জন্য। ইরিনা গালে হাত দিয়ে মাটির দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা এসে বক্স থেকে ঔষধ বের করে ইরিনার সামনে বসলো। ইরিনার হুঁশ নেই। সে এখনো মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা ঔষধ এগিয়ে দিলো। বোনকে অস্বাভাবিক দেখে ইর্তেজা চিন্তিত হলো।
“কি হলো আপু?”
ইরিনার ধ্যান ভাঙ্গলো। ইর্তেজাকে দেখে মুখে হাসি টেনে বলল- “কিছু না” হাত বাড়িয়ে ইর্তেজার থেকে ঔষধ নিয়ে খেয়ে নিলো। ইর্তেজা গ্লাস রেখে ইরিনাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
“ভাই, মনে আছে মা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতো?”
ইর্তেজা মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। ইরিনা ইর্তেজার পাশ ফিরে ইর্তেজার হাত নিজের মাথায় রেখে চোখ বন্ধ করলো। ইর্তেজা নিঃশব্দে হাসলো। তার বড়ো বোন যখন ছোটোদের মতো আবদার করে তার ভীষণ ভালো লাগে। ইর্তেজা ইরিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
.
.
শ্রাবণ বাসায় এসে দেখে সাগরিকা ঘরে নেই। ভয় পেয়ে গেল সে। সাগরিকা কী চলে গিয়েছে? হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে তার। পুরো বাড়ি খুঁজে শ্রাবণ সাগরিকাকে পেল না। অবশেষে সে ছাদে গেল। সাগরিকা মাদুরের উপর শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। গাল, চোখের নিচে পানির দাগ দেখা যাচ্ছে। কান্না করেছে মেয়েটা। শ্রাবণের বুক ধুকপুক করছে। সে চুপচাপ গিয়ে সাগরিকার পাশে শুয়ে পরলো। পাশে কেও আছে সাগরিকা বুঝতে পেয়েও চোখ খুলল না। সে জানে শ্রাবণ এসেছে। আপাতত তার চেহারা সে দেখতে চায় না। সাগরিকা ঘুরে শ্রাবণের দিকে পিঠ করে শুয়ে পরলো। হঠাৎ পেটে আর ঘাড়ে সে ছোঁয়া পেল। শ্রাবণ তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সাগরিকা দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো। শ্রাবণ মন খারাপ করলো। সেও উঠে বসলো৷ কিছু বলার আগেই সাগরিকা বলল- “তুমি প্লিজ যাও আমি আসছি কিছুক্ষণ পর।”
শ্রাবণ সাগরিকাকে টেনে বুকে ভরে নিয়ে বলল- “মাফ করে দাও আমায়। আমি রাগে কি করেছি নিজেও জানি না। আমি জানি আমি অনেক খারাপ।”
সাগরিকা শ্রাবণকে ঠেলে দূরে সরিয়ে বলল- “জানি, মাফ চাইতে হবে না। এখন যাও আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।”
“প্লিজ সাগরিকা, রাগ করে থেকো না। আচ্ছা বলো আমি কি করলে তুমি আমাকে মাফ করবে? তুমি যা বলবে আমি তা-ই করবো।”
সাগরিকা এক নজর শ্রাবণকে দেখলো। এই ২ বছরে শ্রাবণ বহুবার এই কথা বলেছে। সাগরিকা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল- “না লাগবে না। আমি রাগ করি নি৷ এসবের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে এখন।”
“আমি সত্যি বলছি। বলো আমি কি করলে তুমি খুশি হবে৷ আমাকে মাফ করে দিবে।”
সাগরিকা শ্রাবণের দিকে তাকাল। সাগরিকার চোখের কোনায় অশ্রু জমে গিয়েছে- “তাকে মুক্ত করে দাও। আমি সারাজীবনের জন্য তোমার পিঞ্জিরায় বন্দী হয়ে যাব। তুমি যা বলবে তাই করবো। ওয়াদা করছি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না।”
শ্রাবণ চোয়াল শক্ত করে ফেলল। হাত মুঠো করে রেখেছে। চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সাগরিকা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল- “এমনভাবে দেখছো যেন জানতে না আমি কি চাইব?”
শ্রাবণ লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল- “তার মানে আমি কখনোই তোমার মনে জায়গা করতে পারবো না। তুমি আজও তার প্রেমের জালে জড়িয়ে আছো।”
“জানি না, আমি শুধু জানি তার পরিবার তাকে ছাড়া অচল। তার বুড়ো মা তার অপেক্ষায় আছে।”
বলেই সাগরিকা আকাশের দিকে তাকাল। শ্রাবণ রাগে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। সাগরিকা বলল- “তুমি তো পরিবার হারানোর কষ্ট বুঝো শ্রাবণ। তুমি কি অনুভব করতে পারছো না তাদের কষ্ট।”
শ্রাবণ লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল- “আমি জানি তুমি আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছো। লাভ নেই সাগরিকা। আমি কখনো তোমার এই ইচ্ছে পূরণ করবো না। যাচ্ছি আমি তুমি আসো।”
বলেই শ্রাবণ উঠে চলে গেল। সাগরিকা এক নজর শ্রাবণের যাওয়ার পথে দেখে আবার আকাশের দিকে তাকাল। কালো মেঘের আড়ালে চাঁদ একবার লুকাচ্ছে আবার উঁকি দিচ্ছে৷ সাগরিকা মুচকি হেসে বলল-
“আমার সন্ধ্যায় দেখা মেললো
তোমার নামের চাঁদ,
হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখি
নেই সেখানে আর।
পরলো মনে, হঠাৎ করে
ছিলে তুমি, জগৎ জুড়ে
সুযোগ পেলে #আর_একটিবার
রাখবো তোমায় আমার করে।”
কিছুদিন পর……
কাঠফাটা রোদের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ইর্তেজা। সে অপেক্ষা করছে সাগরিকার। সাগরিকা ভার্সিটির ভেতরে। ইর্তেজা একবার ভাবলো গাড়িতে গিয়ে বসবে। কিন্তু তার মন চাচ্ছে না। সকালে সে দেখেছে সাগরিকার শরীর ভালো না। তবুও সে ভার্সিটি এসেছে। ইর্তেজা ভার্সিটির মেইন দরজার পাশেই ঘুরাঘুরি করছে। ভার্সিটির দারোয়ান মামা ইর্তেজাকে দেখে হেসে বলল- “কি গো বাছা কারো অপেক্ষা করতাছো?”
“জি আংকেল”
“এখন ছুটি হইব চিন্তা কইরো না।”
ইর্তেজা মাথা নাড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যে ছুটির ঘন্টা বাজলো। সবাই এক এক করে এগিয়ে আসছে। ইর্তেজার দৃষ্টি সাগরিকাকে খুঁজছে। হঠাৎ খেয়াল করলো সাগরিকাকে ধরে নিয়ে এগিয়ে আসছে তার বান্ধবী। ইর্তেজা ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বলল- “ম্যাম কি হয়েছে আপনার? ঠিক আছেন আপনি?!
সাগরিকা ইর্তেজাকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। ইর্তেজা ঘামে যেন গোসল করেছে৷ সাগরিকা নাক মুখ কুঁচকে বলল- “আমি তো ঠিক আছি। তোমার এই অবস্থা কেন?”
ইর্তেজা জবাব দিলো না। সাগরিকার বান্ধবী বলল- “কেন নিজের হিরোর মতো চেহারাকে রোদে দাঁড়িয়ে কালো করছো?”
ইর্তেজা কথাটা ইগনর করে সাগরিকাকে বলল- “ম্যাম আপনি সত্যি ঠিক আছেন তো। আপনি বললে বসকে কল দিয়ে বলি? হসপিটাল যাবেন?”
সাগরিকা বিরক্ত হয়ে বলল- “থামবে? কিছু হয়নি আমার। সকাল থেকে না খেয়ে আছি তাই খারাপ লাগছে। বাসায় নিয়ে চলো আমাকে।”
বলেই সাগরিকা পাশ কাটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। ইর্তেজার তবুও ভয় করছে। সাগরিকার চেহারা দেখেই সে বুঝতে পারছে সে অসুস্থ। সাগরিকার বান্ধবীকে ইর্তেজা ধন্যবাদ জানিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো। সাগরিকা সিটে পুরো গা ছেড়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ইর্তেজা গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিছু রাস্তা যাওয়ার পর ইর্তেজা সাগরিকাকে ডাকলো। সাগরিকা চোখ বন্ধ রেখেই বলল- “বলো”
“আপনি সত্যি ঠিক আছেন তো?”
সাগরিকা চোখ খুলে ইর্তেজার দিকে বিরক্ত ভাব নিয়ে তাকিয়ে বলল- “বার বার এক প্রশ্ন কেন করো বলো তো?”
“সরি ম্যাম, কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে।”
সাগরিকা কিছুটা চমকে উঠল ইর্তেজার কথা শুনে৷ ইর্তেজা একবার রাস্তা দেখছে আর একবার আয়না দিয়ে সাগরিকাকে। সাগরিকা মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল-
“হ্যাঁ আমি একদম ঠিক আছি। এখন আর প্রশ্ন করো না। প্লিজ বাসায় নিয়ে যাও আমাকে।”
“ওকে ম্যাম”
ইর্তেজা আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সাগরিকাকে নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলো।
.
.
আজ কলেজে স্যার হিসেবে প্রথম দিন সাঈদের। ভাবলো কলেজ যাওয়ার আগে ইরিনার সাথে দেখা করে যাওয়া যাক। কিন্তু ইরিনা তো এই বিষয়টা পছন্দ করে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাঈদ এসব চিন্তা করছে। ইরিনাকে না দেখলে তার দিন খারাপ যাবে। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে তৈরী হয়ে ঘর থেকে বের হলো। নাশতা করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরলো। বাইক চালাতে চালাতে ভাবছে দেখা করতে যাবে কি-না। বাইক সিগনালে দাঁড়াল। সাঈদ পরলো দোটানায়, সোজা রাস্তা কলেজ যায়। আর ডান দিকের রাস্তা ইরিনার বাসায়। সাঈদ সিগনালের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণের মধ্যে সবুজ লাইট জ্বললো। গাড়ি গুলো এগিয়ে যাচ্ছে। সাঈদ বাইক স্টার্ট দিয়ে ডান রাস্তায় বাইক নিলো।
ইরিনা বার বার ঘড়ি দেখছে। আজ থেকে সাঈদ কলেজ জয়েন করবে। কলেজ শুরু হওয়ার সময় ৯ টা। ৯ টা বাজতে আধা ঘণ্টা বাকি। এই আধা ঘন্টার মধ্যে সাঈদ না আসলে? ইরিনা জানে না ইদানীং সে কেন বার বার সাঈদকে দেখতে চায়। নিজের ভাবনা চিন্তার উপর সে লজ্জিত৷ তবুও তার বেহায়া মন মানে না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা পর সাঈদ আসলো। দরজায় টোকা পরতেই ইরিনা বুঝতে পারলো সাঈদ এসেছে। ঝর্ণা এসে দরজা খুলল। সাঈদকে দেখে সালাম দিয়ে লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে চলে গেল। ইরিনা ঝর্ণার ব্যবহার দেখে হাসলো। সাঈদ দরজার বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে। ইরিনা মুচকি হেসে বলল- “বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো।”
“ভেবে বলছেন তো?”
“তুমি কি রাগ করেছো আমার সেদিনের কথায়?”
“না তো, আমি ভাবলাম আপনি রাগ করে আছেন আমার উপর।”
“একদম না, আসো।”
সাঈদ শান্তির নিশ্বাস ফেলল। ভেতরে গিয়ে ইরিনার পাশে দাঁড়াল। ইরিনা মাথা তুলে সাঈদের দিকে তাকাল। এখন সাঈদকে এডাল্ট লাগছে। ব্লু শার্ট, ব্ল্যাক জিন্স আর চোখে নর্মাল কালো ফ্রেমের চশমা। সত্যি একজন স্যারের মতো দেখাচ্ছে তাকে৷ ইরিনা ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। কেমন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে সে দিন দিন৷ নিজেই নিজেকে বকলো মনে মনে। ঝর্ণা সাঈদের জন্য চা নিয়ে আসলো। সাঈদ ঝর্ণার হাত থেকে চা নিয়ে হেসে বলল- “তুমি জানলে কি করে আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে।”
“আমাগো মনের টান আছে এল্লেগা।”
সাঈদ ইরিনা দুজনই চমকে উঠল ঝর্ণার কথা শুনে। ঝর্ণা লজ্জা পেতে পেতে চলে গেল। সাঈদ ইরিনা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। সাঈদ হাসতে হাসতে থমকে গেল। সে ইরিনার হাসি দেখতে ব্যস্ত। ইরিনার দৃষ্টি হঠাৎ সাঈদের দিকে যেতেই হাসি থামিয়ে ফেলল সে। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। সাঈদ চেয়ারে বসে বলল- “নাশতা করেছেন আপনি?”
“শুধু চা খেয়েছি। আজ নাশতা খেতে ইচ্ছে করছে না।”
সাঈদ ভ্রু কুঁচকে বলল- “আপনার ঔষধ আছে ভুলে গেলেন?”
“প্রতিদিন ৫/৬ রকমের ঔষধ খেতে কার ভালো লাগে শুনি?”
“আপনাকে বোঝানো খুব মুশকিল।”
সাঈদ ঝর্ণাকে ডেকে বলল ইরিনার জন্য নাশতা নিয়ে আসতে। ইরিনা চুপচাপ বসে আছে। ঝর্ণা নাশতা নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। সাঈদ ইরিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল- “আমি ৫ মিনিটের মধ্যে চলে যাব। নাহলে বসে থেকে আপনি খাচ্ছেন কি-না দেখে যেতাম।”
ইরিনা মুখ টিপে হাসলো। সাঈদ চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে মুখ লটকালো। সাঈদ তার হাতের ঘড়ি দেখে ইরিনার দিকে তাকাতেই ইরিনা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। সাঈদ মুচকি হেসে বলল- “আজ আসি, প্রথমদিন কলেজে দোয়া করবেন।”
ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। সাঈদ সালাম দিয়ে বেরিয়ে পরলো। ইরিনা এক নজর সাঈদের যাওয়ার পথে দেখে নাশতার দিকে তাকাল। হঠাৎ তার এত ভালো কেন লাগছে বুঝতে পারছে না।
.
.
সেদিন ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগায় খুব লস হয়েছে শ্রাবণের। ভয়ে ঘাম ঝরছে তার৷ লোন নিয়ে ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র তুলেছিল সে। এখন লোন কিভাবে শোধ করবে? চোখ বন্ধ করে ভাবছে কি করা যায়। ভাবলো ফ্যাক্টরিটা বিক্রি করে দেবে। কিন্তু তার অবৈধ ব্যবসার কথা শুনলে কেও কিনতে চাইবে না। খুব রাগ হচ্ছে তার। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার কোনো না কোনো উপায় বের করতেই হবে। ভাবলো বাসায় চলে যাবে এখন। এখন কোনো প্রজেক্টও নেই যার উপর কাজ করবে। অফিস থেকে বের হয়ে শ্রাবণ বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। বাসা সামনে গিয়ে দেখে সাগরিকা ইর্তেজার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামছে। শ্রাবণের মাথায় রক্ত উঠে গেল এই দৃশ্য দেখে। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে এগিয়ে গেল। ইর্তেজা শ্রাবণকে দেখে কিছু বলার আগেই শ্রাবণ ইর্তেজার ধরে টেনে সজোরে চেহারায় ঘুষি মেরে দিলো। ইর্তেজা ঠোঁট ধরে কিছু কদম পিছিয়ে গেল। মাথা ঝিমঝিম করছে তার। সাগরিকা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ আবার এগিয়ে গেল। ইর্তেজাকে ধরে এলোপাথাড়ি ভাবে মারতে লাগলো। সাগরিকা দৌড়ে গেল। সে দুজনকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। শ্রাবণ রাগের মাথায় সাগরিকাকে ধাক্কা মেরে দিলো। সাগরিকা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। ইর্তেজার দৃষ্টি সেখানে যেতেই দেখে সাগরিকা পেট ধরে চিৎকার করছে। ইর্তেজা শ্রাবণকে ধাক্কা দিয়ে সাগরিকার দিকে গেল। সাগরিকার ছটফট দেখে শ্রাবণও এগিয়ে আসলো। শ্রাবণকে দেখে সাগরিকা কান্না করতে করতে বলল- “শ্রাবণ আমার খুব ব্যাথা করছে পেটে।”
শ্রাবণ ভয় পেয়ে গেল। সে রাগের বশে সাগরিকাকে কষ্ট দিলো। দ্রুত সাগরিকাকে কোলে তুলে নিলো। ইর্তেজা গাড়ির দরজা খুলে দিলো। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। গাড়ি কিভাবে চালাবে। সাগরিকার কষ্ট দেখে সে সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। শ্রাবণ সাগরিকার মাথা তার বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ইর্তেজা কোনো মতো গাড়ি চালিয়ে হসপিটাল নিয়ে গেল। সাগরিকাকে কোলে নিয়েই শ্রাবণ হসপিটালের ভেতরে গেল। সাগরিকা দাঁতে দাঁত চেপে কাঁদছে ব্যাথায়। ডাক্তার এসে সাগরিকাকে নিয়ে গেল। শ্রাবণ আর ইর্তেজা করিডরে দাঁড়িয়ে আছে। ইর্তেজা হসপিটাল থেকে বের হলো। দোকান থেকে পানির বোতল কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়েই চেহারা ধুয়ে নিলো। সাগরিকার চিন্তায় সে নিজের ব্যাথার কথা ভুলে গিয়েছে। ইর্তেজা আবার হসপিটালের ভেতরে গেল। শ্রাবণ চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইর্তেজা শ্রাবণের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শ্রাবণ ইর্তেজার দিকে তাকাতেই ইর্তেজা বলল-
“আমি কি জানতে পারি আপনি কেন এমন করলেন?”
শ্রাবণ জবাব দিলো না। ইর্তেজার রাগ হলো। কিন্তু শান্ত গলাতেই বলল-
“ম্যামকে আপনি অনেক ভালোবাসেন তাই না? তবুও এত সন্দেহ কেন করেন? আমি আপনার জন্য কাজ করি। ম্যামের বডিগার্ড আমি। একজন বডিগার্ডের সাথে সন্দেহ? ছি, প্রথমবারের মতো আমার ঘৃণা হচ্ছে আপনাকে দেখে।”
শ্রাবণ এখনো জবাব দিলো না। তার মনে হলো ইর্তেজা সত্যি বলছে। তার সন্দেহর কারণে আজ সাগরিকার এই অবস্থা। ইর্তেজা আবার বলল-
“কিছুদিন ধরে আপনার স্ত্রী অসুস্থ খেয়াল করেছেন? সারাদিন তো কাজ নিয়ে পড়ে থাকেন। অনেক তো ভালোবাসা দাবী করেন।”
শ্রাবণ ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল-
“ভুল হয়ে গেছে। ব্যবসা এত বাজে যাচ্ছে যে মাথা ঠিক নেই আমার।”
“টাকা আসবে যাবে আপনার স্ত্রী চলে গেলে আর ফিরে আসবে না মনে রাখবেন।”
শ্রাবণ লম্বা নিশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আসলো। শ্রাবণ উনাকে দেখে ভীতু গলায় জিজ্ঞেস করলো- “ডাক্তার আমার স্ত্রী কেমন আছে? ঠিক আছে তো সে?”
“আপনি কী জানতেন উনি প্রেগন্যান্ট?”
শ্রাবণ চমকে উঠল। সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তারের কথা শুনে। ডাক্তার শ্রাবণের চেহারা দেখেই উত্তর পেয়ে গেল।
“আপনার ওয়াইফের প্রেগ্ন্যাসির দেড় মাস চলছিল। আঘাত খুব জোরে লাগায় মিসগ্যারেজ হয়ে গিয়েছে। উনার প্রেসার লো এবং রক্ত শূন্যতাও আছে। ১ দিন হসপিটালে থাকতে হবে উনার।”
বলেই ডাক্তার চলে গেল। শ্রাবণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি এত বাজে হয়ে উঠেছে যে শ্রাবণ ইর্তেজার দিকে তাকাতে পারছে না লজ্জায়। ইর্তেজা বুঝতে পারলো শ্রাবণ লজ্জিত। কিন্তু কি বলে শ্রাবণকে শান্তনা দেবে বুঝতে পারছে না সে। ইর্তেজার গাল আর পেট ব্যাথা করছে। শ্রাবণ খুবই জোরে মেরেছে। শ্রাবণ ধীরে ধীরে নজর তুলে ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। তার মনে হচ্ছে কেও তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। ইর্তেজা শ্রাবণের সামনে এসে বলল-
“আশা করছি ম্যামকে একবার সন্দেহ করে আপনার শিক্ষা হয়েছে।”
“একবার না, এই নিয়ে বহুবার। জানো আমি, আমি একজন ভালো স্বামী হতে পারছি না।”
“আগে একজন ভালো মানুষ তো হয়ে নিন।”
শ্রাবণ ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে রইল। এই কথার পাল্টে জবাব বলতে তার কাছে কিছু নেই। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ডাক্তার শ্রাবণকে পারমিশন নিলো কেবিনে যাওয়ার। শ্রাবণ দৌড়ে গেল ভেতরে৷ ইর্তেজা করিডরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে চাইলেও ভেতরে যেতে পারবে না।
শ্রাবণ ভেতরে গিয়ে দেখে সাগরিকা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। চুপচাপ গিয়ে সাগরিকার পাশে বসলো। সে জানে না সাগরিকা এসব জানার পর কি করবে। যতটা ঘৃণা করতো তার থেকেও বেশী করবে হয়তো। শ্রাবণ সাগরিকার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। সে কিছু ভাবতে পারছে না এখন। পুরো মাথা শূন্য হয়ে গিয়েছে তার। সাগরিকা চোখ খুলে শ্রাবণকে দেখলো৷ শ্রাবণ সাগরিকার চাহনি দেখে মাথা নিচু করে বলল-
“আবারো তোমার কাছ থেকে তোমার আপন মানুষকে দূর করে ফেললাম। আমি খুব…”
“লজ্জিত?”
শ্রাবণ পুরো কথা বলার আগেই সাগরিকা তার মুখের কথা কেড়ে নিলো। শ্রাবণ চোখ তুলে সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“আমি এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না শ্রাবণ। তুমি মাফ চাইতে চাইতে ক্লান্ত আর আমি মাফ করতে করতে। একটা পরামর্শ দেই। আজকের পর থেকে যত ভুল, সরি পাপ করবে সেটার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে না। কারণ তোমাকে আমি মাফ করি বা না করি। জীবন আমার তোমার সাথেই কাটাতে হবে। এখন সেটাতে আমার ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক।”
“আমি যথেষ্ট চেষ্টা করি তোমার মনের মতো হওয়ার। কিন্তু সবসময় ফেইল হয়ে যাই।”
“তোমার কোনো প্রয়োজন নেই কারো মনের মতো হওয়ার। মনে আছে একবার বলেছিলাম যে তোমার জীবনে এমন কেও আসবে যে তোমাকে তোমার মতো করেই ভালোবাসবে? যদি সেদিন আমার কথা মেনে নিতে আমাদের এই দিন দেখতে হতো না। না তুমি একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করতে, না আমি।”
“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
“জানি, আচ্ছা তোমার কি মনে হয় না তুমি এমন একজন মানুষ ডিজার্ভ করো যে তোমাকে অনেক ভালোবাসবে অনেক।”
“আমার যে তোমার ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা।”
“আচ্ছা এই জন্মে সম্ভব হলে পেয়ে যাবা।”
শ্রাবণ তাকিয়ে রইল সাগরিকার দিকে। সাগরিকার কথাগুলো বেশ অদ্ভুত লাগছে তার৷ সে ভেবেছিল সাগরিকা হয় তো অনেক রাগ করবে। কিন্তু না, সে তো অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলছে। শ্রাবণ যেন এই সাগরিকাকে চিনতে পারলো না। সাগরিকা ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কান্না তার গলায় আটকে আছে৷ ভাবলো কান্না করলে সব আগের মতো হবে না। তাই সবসময়ের মতো নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। সাগরিকা চোখ খুলল। শ্রাবণ মাথা নিচু করে বসে আছে তার হাত ধরে। সাগরিকা চোখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই থমকে গেল। দরজায় থাকা গোল কাঁচের ওপারে দেখা যাচ্ছে ইর্তেজাকে। ইর্তেজার চোখে মুখে ভয়, অস্থিরতা স্পষ্ট। সাগরিকা তাকিয়ে রইল ইর্তেজার দিকে।
চলবে…..