#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১২)
অফিসের গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে বের হলো অমিত। যেতে যেতে চোখ পড়ল অমিতের ডানহাতের উপর পৃষ্ঠে৷ নখের দাগগুলো স্পষ্ট, দগদগে। অন্তরে সহানুভূতি জেগে উঠল আমার। ভীষণ মায়ায় ক্ষত স্থান ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো।
” চুপচাপ যে? এতদিন বাদে ক্যাম্পাসে যাচ্ছ আনন্দ হচ্ছে না? ”
অমিতের কণ্ঠে আমার মায়াভরা চোখদুটো কেঁপে উঠল। সংযত হলো মন। অনুভূতিরা গেল লুকিয়ে। আমি সামনের দিকে উদাস তাকিয়ে বললাম,
” আমি এমনই। চুপচাপ, শান্ত। ”
” আমার তেমন মনে হয় না। ”
আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলাম অমিতের দিকে। স্থিরনেত্রে চেয়ে আছেন আমার মুখটায়। তার ভাবভঙ্গি বলছে আমার ব্যাপারে তার জানাশোনা সুনিশ্চিত। আমি সে চাহনি অগ্রাহ্য করে নিরুত্তর রইলাম। তিনিও দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন কিছুক্ষণ বাদে। আমাকে অনুকরণ করেই বোধ হয় চুপ থাকলেন। আরও কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর আমি কথা বললাম,
” মনে হচ্ছে আপনি কিছু একটা বলতে ভুলে গেছেন। ”
” ভুলে যাইনি। আপু বলে দিয়েছে তাই আর আমি বলিনি। ”
আমি বিস্মিত নয়নে তাকালাম তার দিকে। পলকহীন চোখদুটিতে চোখ রেখে তিনি বললেন,
” অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমার ব্যবহারেই বুঝতে পেরেছি। এতটা পরিবর্তন এমনিতে হয় না। ”
আমি নিজেকে সামলে বললাম,
” আপনি কথার খেলাফ করেছেন। ”
” একদমই না। ”
” আবার অস্বীকার করা হচ্ছে। ”
” কিছু করলে তো স্বীকার করব। ”
আমি চোখ-মুখ শক্ত করে ফেললে তিনি নরম হয়ে বললেন,
” এই রাগটা যাতে না আসে সেজন্যই আপুকে সামনে রেখেছিলাম। ওটা জরুরি ছোঁয়া ছাড়া আর কিছুই না। ”
” জরুরি না বলুন সুযোগ। আপনি সুযোগ পেয়েই আমাকে কোলে….”
” তায়্যিবাহ? ”
কথার মাঝে আমার নাম ধরে ডাকায় আমি থেমে গেলাম। সে সুযোগে তিনি বললেন,
” অন্তত আমার সামনে অভিনয় করো না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তোমার মধ্যে একফোঁটাও রাগ নেই। কারণ, তুমিও জানো ওটা জরুরি ছোঁয়াই ছিল। ”
আমি বিব্রত হলাম। কুণ্ঠিত বদনে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। তিনি বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন বোধ হয়। আমি বুঝতে পারলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
” কিছু বললেন? ”
অমিতও অন্যদিকে ফিরে ছিল। সেদিকে মুখ রেখেই বললেন,
” হ্যাঁ। ”
” কী? ”
” বলা যাবে না। ”
” কেন? ”
” তুমি লজ্জা পাবে। ”
আমার ভ্রূজোড়া কুঁচকে এলো। বিরক্ত হতে গিয়েও কৌতূহলী হয়ে পড়লাম। ইচ্ছে হলো লজ্জা পেতে। কিন্তু জোর করতে পারলাম না।
_________
আমাকে ক্লাস পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন অমিত। পুরো দিনের ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। কাজটা নাকি খুব জরুরি। তাকে ছাড়া সম্ভব নয়। তাই অর্ধেক বেলার ছুটি নিয়েছেন জোর করে। যা আমাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যেতে যেতেই শেষ হয়ে যাবে।
আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলেই যাচ্ছিলেন তখনই তিন্নি দৌড়ে এলো কোথাও থেকে। আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত বাঁধনে। আনন্দে গলে পড়ে বলল,
” তোকে খুব মিস করছিলাম রে, তায়্যু। ”
” আমিও। ”
ভালোবাসা দেওয়া-নেওয়া শেষ হতে আমাকে ছেড়ে দাঁড়াল তিন্নি। সেসময় অমিত বললেন,
” তোর চোখ-মুখ এত শুকনো লাগছে কেন? ”
তিন্নির হাসি হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেল। অমিতের দিকে এক পলক চেয়েই মাথা নত করে ফেলল। সে অবস্থায় বলল,
” সামনে পরীক্ষা তো তাই পড়ার চাপ পড়েছে। ”
অমিত আর কিছু বললেন না। এক মুহূর্ত স্থির চেয়ে হেঁটে চলে গেলেন। তিন্নিও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে এমনভাবে নিশ্বাস ছাড়ল। আগের হাসি ফিরে এলো। আমাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকল গল্পের ঝুড়ি খুলতে খুলতে। টানা চারটা ক্লাস করেও সেই ঝুড়ি খালি হলো না। ছুটির ঘণ্টা পেয়ে বই-পত্র গুছিয়ে বের হলাম তিন্নির বকবকানি শুনতে শুনতে। ভবন ছেড়ে মাঠ পেরিয়ে গেটের দিকে এগুলাম দুজন অন্যমনস্কতায়। রিকশা ধরতে যাব তখনই কেউ একজন আমার নাম ধরে ডেকে উঠল। সেই ডাক অনুসরণ করে তাকাতে দুজন চমকে গেলাম। দ্রুতপদে সামনে এগিয়ে বললাম,
” আপনি যাননি? ”
অমিত হালকা হেসে বললেন,
” না। ”
” বস কিছু বলবে না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” আমার বদলে অন্য একজনকে পাঠিয়েছি। বসকে অবশ্য এখনও বলিনি। যদি কাজটা করতে পারে তারপরই বলব। আশা করছি পারবে। ”
” আর যদি না পারে? ”
অমিত উত্তরে হাসলেন। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
” খিদে পেয়েছে নিশ্চয়? ”
আমরা কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই তিনি রাস্তার ওপারে ইশারা করে বললেন,
” ঐপাশে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট দেখলাম। চলো তোমাদের হালকা-পাতলা কিছু খায়িয়ে আনি। ”
অমিত হাঁটা ধরলে আমরা পিছু নিলাম। রাস্তা পার হতেই হঠাৎ বললেন,
” আন্টির নাকি ওষুধ শেষ? তোর নিয়ে যাওয়ার কথা? ”
তিন্নি দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও। অমিত হাতের ঘড়ি দেখে বললেন,
” দুপুরের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তোর তো ফেরা উচিত। ”
অমিত উদ্বিগ্ন বদনে রাস্তার এপার থেকে ওপারে তাকালেন দ্রুত। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আশেপাশে তো খালি রিকশা দেখছি না। তুমি ভেতরে গিয়ে বসো। আমি সামনে এগিয়ে দেখি রিকশা পাই নাকি। তিন্নিকে তুলে দিয়ে আসছি। ”
আমি হ্যাঁ- না কিছু বলার সময় পেলাম না। তিনি সামনে হাঁটা ধরলেন। তিন্নিও চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে চলল।
____________
রাতে খাওয়ার পর বিছানা গুছাচ্ছিলাম আমি। তন্মধ্যেই অমিত ভেতরে এলেন। সোজা হেঁটে চলে গেলেন বারান্দায়। আমি ঝাড়ু ফেলে বারান্দার দিকে চেয়ে থাকলাম নিষ্পলক। আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিতে মন ভার হয়ে পড়ল। মনখারাপকে পাত্তা না দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। ঘুম আসার বদলে রেস্টুরেন্টে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে পড়ল। নিমিষেই বুকজুড়ে অস্থিরতার ঝড় শুরু হলো। চোখ বন্ধ করে থাকা যাচ্ছে না। বার বার চোখ পড়ছে অন্ধকার বারান্দায়। জানালায়। পর্দায়। আমি সেই অস্থিরতা সহ্য করতে পারলাম না। ফোন হাতে নিয়ে অমিতকে বার্তা পাঠালাম,
” আপনি চাইলে ভেতরে এসে ঘুমাতে পারেন। ”
সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি বার্তা আসল,
” বদ্ধ রুমের মেঝের চেয়ে খোলা হাওয়ার বারান্দার মেঝেই ভালো। ইচ্ছে হলেই আকাশ দেখা যায়, চাঁদ দেখা যায়। তারা গুণা যায়। ”
” আমি কি মেঝেতে ঘুমাতে বলেছি? ”
বার্তার উত্তর এলো না। তিনি পর্দা সরিয়ে উঁচুস্বরে বললেন,
” আলো জ্বালো তো, তোমাকে না দেখে মন পড়তে পারছি না। ”
আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। পরমুহূর্তে সামলে উঠে বললাম,
” মন পড়ার কী দরকার? যা বলার সরাসরিই তো বলেছি। ”
অমিত পর্দা ছেড়ে দিলেন। জানালার থেকে সরে গিয়ে রুমে আসলেন। বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,
” ভেবে বলছ তো? ”
আমি মুখে কিছু বললাম না। নিজ জায়গায় থেকে একটু সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিলাম। তিনি বোধ হয় বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না। পাহাড়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমি উল্টো ঘুরে বললাম,
” শুধু ঘুমানোর অনুমতি দিয়েছি আর কিছু নয়। ”
অমিত বিছানায় উঠলেন সাবধানে। বালিশে মাথা রেখে বললেন,
” আমি অল্পতেই অধিক খুশি হই। ”
তার এই সামান্য খুশিটুকুও আমার হৃদয়ে ভারী আঘাত আনল। পূর্বের অস্থিরতা বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ। তার সাথে গল্প করার জন্য ব্যাকুল হলো মন। নিশ্চুপ থাকতে পারছিলাম না কিছুতেই। কোনো এক ছুঁতোই তার দিকে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু সেই ছুঁতো বানাতেই পারছিলাম না। আমার এই ছটফটানি টের পেল অমিত। সহসা বললেন,
” ঘুম আসছে না? ”
আমি উত্তর দেওয়ার বাহানায় তার দিকে ঘুরলাম। এক হাত দূরত্বে থাকা মানুষটার মুখোমুখি হতেই বাকহারা হয়ে পড়লাম। জমে গেলাম বরফের মতো। আবছা অন্ধকারেও তিনি আরও একবার আমার মন পড়ে ফেললেন। শোয়া থেকে উঠে বসলেন সটাং। জিজ্ঞেস করলেন,
” চা না কফি? ”
আমি সপ্রশ্নে তাকালে তিনি বললেন,
” রাত জেগে গল্প করবে আর হাতে পানীয় থাকবে না? নিরামিষ লাগবে। ”
আমি উঠে বসতে বাধ্য হলাম। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
” চা না কফি? ”
” কফি। ”
অমিত বিছানা ছাড়লে আমি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি বানাবেন? ”
” হ্যাঁ, মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ”
আমি আবদার করার মতো বললাম,
” আমি বানাই? ”
” তুমি বানাতে পার? ”
অমিতের কণ্ঠে সন্দেহ। আমি খানিকটা লজ্জা পেলাম। সলজ্জায় বললাম,
” না। আমার তো বিয়ে, সংসার নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা ছিল না। তাই নিজ থেকে কিছু শিখিনি। মা শেখাতে চাইলেও আগ্রহ দেখাইনি। ”
অমিত এক মুহূর্ত চুপ থেকে সুধালেন,
” তোমার বানাতে ইচ্ছে করছে? ”
আমি ভীষণ উৎসাহ নিয়ে বললাম,
” হ্যাঁ। ”
” ঠিক আছে, তুমিই বানাবে। ”
আমি খুশি হয়েও মনখারাপ করে ফেললাম। বললাম,
” আমি তো পারি না। ”
” পার না, শিখবে। ”
” কে শেখাবে? ”
” তোমার স্বামী। ”
আমি বিস্ময় চোখে তাকালে তিনি বললেন,
” মেয়েরা রান্না শেখে মায়ের কাছে, বউমারা শাশুড়ির কাছে আর তুমি শিখবে স্বামীর কাছে। ”
অমিত আমাকে নিয়ে রান্নাঘরে এলেন। আমাকে শেখাতে গিয়ে সবটাই নিজে করলেন। আমি শুধু কফি মগে কফি ঢাললাম। তার হাতে দিতে তিনি গন্ধ নিয়ে বললেন,
” ভালো বানিয়েছ। খেতে বেশ লাগবে। ”
কফি হাতে বিছানায় বসতে গেলে তিনি বাঁধা দিলেন আমাকে। বললেন,
” বারান্দায় চলো। গল্পের ফাঁকে আকাশ দেখবে, চাঁদ দেখবে, তারা গুণবে। ক্লান্ত হয়ে পড়লেই হাওয়া এসে সতেজ করে দিবে। ”
চলবে
[] রমজান উপলক্ষে আমার লিখিত দ্বিতীয় বই ‘বউ সোহাগি’ পাওয়া যাবে মাত্র ২০০ টাকায় []
বিস্তারিত: https://www.facebook.com/102175672032505/posts/300117108905026/?app=fbl
বর্ণলিপিতে নক করলে ওনারা অর্ডার প্রসেস বলে দেবেন।
পেজ লিংক,
https://www.facebook.com/bornolipi.prokashoni/
ছবি পছন্দঃ Tahura Islam