#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩)
অমিত জুতা ফেরত নিয়েও আমার পিছু ছাড়ল না। আমার সাথেই বাসায় ঢুকল। বসার রুমে পৌঁছে বাঁক বদলাল। আমি ছুটলাম নিজের রুমে আর সে অংশ নিল বড়দের আলোচনায়। তারা কখন ফিরে গেল আমি বুঝতে পারিনি। তিন্নি বার কয়েক দরজার কড়া নেড়েছিল, কাজ হয়নি। আমি নিশ্চুপ বসে ছিলাম বিছানার ঠিক মাঝখানটায়। একসময় মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিলাম আপুকে। সে রিসিভ করতেই একছুটে নালিশ করলাম বাবা-মায়ের নামে। তারপর শক্ত আঁটে জানিয়ে দিলাম, আমি বিয়ে করব না। যদি জোরাজুরি করে তাহলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তাদের সম্মান রক্ষা করতে চাইলে বিয়ের আলাপ-আলোচনা যেন বন্ধ করে দেয়। বিপরীতে আপু তেমন কিছু বলল না। কোনো রকম উদ্বিগ্নতা দেখাল না। ছোট্ট করে ‘ আচ্ছা ‘ বলে কল কেটে দিল। আমিও মোবাইলটাকে দূরে ফেলে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঝিমাতে থাকলাম। কিছু মিনিট অতিবাহিত হতেই বড় আপুকে কল লাগালাম। সর্বসময়ের মতো এবারও সে কল ধরতে পারল না। আমার কলের পর কলে বিরক্ত হয়ে বার্তা পাঠাল, ‘ তোর এত জেদ কেন, তায়্যু? একটু অপেক্ষা কর, ফ্রি হয়ে কলব্যাক করছি। ‘ আমার শরীর জ্বলে উঠল। তীব্র বিদ্রুপ করে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ এই জীবনে কি কলব্যাক করেছ? অপেক্ষা করাতে করাতে আমি ষোল থেকে বাইশে পা দিয়েছি, তাও তুমি ফ্রি হও না৷ তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-স্বামী কয় জীবনের খাবার এ জীবনে খাচ্ছে যে তুমি রান্নাঘর থেকেই নিস্তার পাচ্ছ না? ‘ বলতে পারলাম না। বলার মতো অবস্থায় নেইও তো। তাই রা’গকে সংযত করে লিখলাম, ‘ আমি কিন্তু বিয়ে করব না, আপু। বাবাকে বলো এসব বন্ধ করতে নাহলে কিন্তু পালিয়ে যাব। ‘ আপু সে মেসেজের প্রতিউত্তর করল মাঝরাতে, ‘ যার সাথে পালাবি তার নাম-ঠিকানা দে। আমি বাবার সাথে কথা বলে দেখি কোনো সুবিধা করতে পারি নাকি। ‘ আমার ইচ্ছে হলো ফোনটা আছাড় মারি। নিজেকে শেষ করে দিই। এই অসহ্য রকম অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী? তাহলে কি সত্যি সত্যিই আমাকে পালাতে হবে? কিন্তু পালিয়ে যাব কোথায়? কার কাছে থাকব? কার কাছে নিজেকে আমানত করব? মুহূর্তে আমার চিন্তার দুনিয়া আঁধার হয়ে উঠল। সারা দিন-রাত উপোস থাকায় শরীরও দুর্বল হয়ে পড়ল। মস্তিষ্ক হলো অচল। আমি রা’গ-অভিমান ভুলে দরজার কপাট মেললাম। খাবারের খোঁজে রান্নাঘরের দিকে এগুতে বাবার রা’গা’ন্বি’ত কণ্ঠস্বর পেলাম। কোনো একটা ব্যাপারে মাকে শা’সা’চ্ছে খুব। আমার কর্ণপাত একটু মনোযোগী হতেই নিজের নামটা বাবার কণ্ঠস্বরে বেজে উঠল। সাথে সাথে আমি না জানা ব্যাপারটি বুঝে গেলাম। তাদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলতেও মায়ের কথাটা অস্পষ্ট শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন, ‘ শান্ত হও। আমি তায়্যিবাহর সাথে কথা বলব। ও বুদ্ধিমতী। বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। ‘
আমি হেসে ফেললাম। ভাত বাড়ার জন্য প্লেট নিলাম। হাড়িতে চামচ ঢুকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বললাম, ‘ বুদ্ধিমতী বলেই বুঝাতে পারবে না, মা। ‘
___________
পরের দিন সকালে মায়ের সাথে দেখা হতেই আমার বুক কেঁ’পে উঠল। আঁ’ত’কে উঠে বললাম,
” বাবা তোমাকে মে’রে’ছে? ”
মা যেন আমার থেকেও বেশি চমকাল! বিস্ফারিত চোখে বলল,
” কী বলছিস? মাথা ঠিক আছে? ”
আমি তার কপালের ডানপাশের ফোলা জায়গায় আলতো হাত রেখে বললাম,
” আমি আর ছোট নেই, মা। মিথ্যা বলা বন্ধ করো। ”
মা কিছু একটা বলতে চেয়েও পারল না। আমি পা’গ’লা ষাড়ের মতো বাবার কাছে ছুটে গেলাম। সে ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। চোখে-মুখে শ্রান্ত ভাব।
” মাকে মে’রে’ছ কেন? ”
বাবার শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। বজ্রাহতের মতো চেয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। তারপর বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠস্বরে,
” আমি তোর মাকে মে’রে’ছি? ”
” হ্যাঁ, মে’রে’ছ। ”
” তুই দেখেছিস? ”
আমি সরাসরি হ্যাঁ বলতে পারলাম না। খানিকটা দুর্বল গলায় বললাম,
” আমি শুনেছি, মাঝরাতে মাকে ব’ক’ছিলে। ”
বাবা বিছানা থেকে নেমে এসে বললেন,
” তো ব’ক’ব না? তার আদরেই তো তুই বে’য়া’দ’ব হয়েছিস। ”
আমার চোখজোড়া ধপ করে জ্বলে উঠল। মান্য করা ভঙ্গি ছুটে গেল। বাবার চোখে চোখ রাখতে একটুও সময় নিল না। প্র’তি’বাদ করে উঠলাম,
” আমি যদি বে’য়া’দ’ব হয়ে থাকি তাহলে তোমার জন্য। সব দায় তোমার। তাহলে মাকে কেন ব’ক’বে? ”
বাবার শক্ত মুখ আরও শক্ত হয়ে উঠল। অনেকটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার পূর্বক্ষণ! আমি একটুও দমলাম না। বললাম,
” কিছু একটা হলেই মাকে দো’ষী মনে হয় কেন, বাবা? আমরা কি শুধু তার সন্তান নাকি আমাদের লালন-পালন দায় একমাত্র তার? যদি তাই হয় তাহলে তোমাকে বাবা ডাকা ছেড়ে দিই। এতে করে মা এবং আমরা সকলেই তোমার শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার থেকে মুক্তি পাব। তুমি যদি আমাদের খারাপ গুণগুলোকে গ্রহণ করতে না পার তাহলে ভালো গুণকেও গ্রহণ করবে না। ”
” তায়্যিবাহ! ”
বাবা প্রচণ্ড হুং’কার ছাড়লেও আমাকে টলাতে পারল না। ক্রো’ধে কম্পিত চোয়ালে চেয়ে থেকে বললাম,
” যার দো’ষ তাকে শা’স’ন করো অন্যকে নয়। ”
____________
বাবাকে ভ’য়া’নক রা’গি’য়ে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। টিকেট কেটে, বাসে চেপে সোজা হাজির হলাম বড় আপুর শ্বশুরবাড়ি। বসার রুমে ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর আপুর মুখদর্শন করতে পারলাম। সে আমার সামনে নাস্তা-পানি রেখে ব্যস্ত গলায় বলল,
” আসার আগে ফোন দিবি না? আমার বড় ননদ জামাই নিয়ে এসেছে। সেবা-যত্ন না করলে হয়? ”
” বাবা মাকে মে’রে’ছে। ”
বড় আপু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। সেকেন্ড কয়েক পর বলল,
” ফাজলামো করতে এসেছিস? ”
” আমি সত্যি বলছি, আপু। ”
বড় আপু শরবতের গ্লাস আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” তুই দেখেছিস? ”
” না। ”
” তাহলে জানলি কী করে? ”
” কাল রাতে মাকে ব’ক’ছি’ল। ”
” বাবা তো প্রায়শই মাকে ব’কে। ”
” তারপর মা’রে। ”
বড় আপু আমার দিকে সন্দেহি চোখে তাকাল। বলল,
” আমি তো কখনও দেখিনি। ”
” মা দেখায়নি তাই। ”
” তোকে দেখিয়েছি? ”
” না, আমি নিজেই দেখেছি। কপালের একপাশ অনেকটাই ফোলা ছিল। ”
বড় আপু একটু চুপ থেকে বলল,
” ফোলা দেখেই ভেবে নিলি বাবা মে’রে’ছে? তোর ভাবনায় তো ভুলও হতে পারে? ”
শেষ কথাটায় আমার অমিতের কথা মনে পড়ল। সেও তো এমনটায় বলেছিল! তার আস্থাভরা মুখটা মনে পড়তেই আমার শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে গেল। মেজাজ খারাপ হলো খুব। ক্ষ্যাপে গিয়ে বললাম,
” আমার কোনো ভুল নেই। আমি সঠিক। তুমি বিশ্বাস না করলেই আমি ভুল হয়ে যাব না। সব এক। সবাই মেয়েদের দুর্বলতাটাকেই মোক্ষম অস্ত্র বানায়। আমার বাবাও তাই করেছে। যার ফল তোমরা ভোগ করছ। ”
বড় আপুর চোখে-মুখে অসন্তুষ্ট ফুটে উঠল। আমার প্রতিবাদী চেতনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
” বাবা-মাকে দেখি না বছর হবে। বাড়ি যাই না প্রায় তিন বছর ধরে। বিয়ের পর তো তিনবোনে একসাথে বসতেই পারলাম না! তায়্যু শোন না বোন, এসব পাগলামি বাদ দিয়ে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যা। এই উপলক্ষে আমার একটু ছুটি হোক। এক, দুইটা রাত নির্ঘুমে কাটুক। আমরা সবাই মিলে খুব আনন্দ করব। খুশির স্মৃতি তৈরি করব। কে জানে, হয় তো এরপরে আর কখনও এমন সুযোগ আসবে না! ”
আমার প্রতিবাদী মনটা শান্ত হয়ে গেল নিমিষে। রা’গ ঝরে গেল আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো। মনে পড়ে গেল ছোটবেলার সেই আনন্দ ঘন মুহূর্ত গুলো। প্রকৃতি কাঁপা হাসিগুলো। আকাশ রাঙিয়ে দেওয়া খুশিগুলো।
” আমি খবর নিয়েছি। অমিত ছেলেটা খুব ভালো। তোর দুলাভাইদের মতো না। ”
আমি মনখারাপের গলায় বললাম,
” এমন করে তো বাবাও তোমাদের বলেছিল। ”
বড় আপু থেমে গেল। চোখ সরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ঘড়ির দিকে তাকাল। উঠে পড়ার ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
” একবার ভাগ্যের সাথে লড়ে দেখ। ”
চলবে