#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪)
বড় আপুর হেঁয়ালি আবদারে আমার মন ও মস্তিষ্ক সাঁঝের মতো বিষণ্ণতায় ছেয়ে এলো। কেমন এক অদ্ভুত খারাপ লাগা ছড়িয়ে পড়ল দেহের চলনে-বলনে! অসারতায় তলিয়ে গেল বাস্তব-অবাস্তব চিন্তাকুল। আমার মত-অমতের তোয়াক্কা না করেই বিবাহকার্যের প্রাথমিক কাণ্ডগুলো ঘটে চললেও চুপচাপ রইলাম। উদাস চোখে রাতের আকাশ দেখায় সময় গড়িয়ে চলছিল যখন, আমার ফোনটা বেজে উঠল ঠিক তখনই। দূর থেকেই দেখলাম অচেনা নাম্বার। আমার উন্মনা মন সে কল রিসিভ করার কোনো আগ্রহ দেখাল না। অবহেলায় ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশে দৃষ্টি স্থির করতে আবারও ফোনটা বেজে উঠল। আমি রেগে গেলাম। বিরক্তে ঠোঁট দুটো শক্তভাবে চেপে ধরে নাক ফোলালাম। গাল ছোঁয়া চুলের গোছা কানে ঢুকিয়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হতে হতে কল কেটে গেল। আমি আরেক দফা বিরক্তে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লাম। ফোন হাতে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলাম। তারও প্রায় এক মিনিট পর আবারও কল এলো। আমি ভয়ানক কয়েকটা কথা শোনানোর জন্য ফোন হাতে নিতে দেখলাম তিন্নি কল করেছে। রিসিভ করতে সে বলল,
” অমিত ভাইয়ার কল ধরছিস না কেন? ”
আমার ভ্রূ আপনাআপনি কুঁচকে এলো। বুঝতে পারলাম ঐ অচেনা নাম্বারটা অমিতের। ঝাড়ি দিয়ে বললাম,
” তাকে আমার নাম্বার দিলি কেন? ”
” চেয়েছে তাই। ”
” চাইলেই দিতে হবে? ভার্সিটির এক ভাইয়াও তো তোর নাম্বার চেয়েছিল, আমি দেইনি। কারণ, তোর অনুমতি ছিল না। অথচ তুই আমার নাম্বার বিলিয়ে বেড়াচ্ছিস। কেন? আমার সাথে কিসের এত শত্রুতা? ”
তিন্নি বোধ হয় ভয় পেল। তবুও কথা ভাঙাল,
” অমিত ভাইয়া কোনো ভার্সিটির ভাইয়া নয়। তোর হবু বর। তাছাড়া এমনি এমনিই নেয়নি। জরুরি কথা আছে তাই নিয়েছে। ”
আমি আবার খেঁকিয়ে উঠলাম,
” কিসের জরুরি কথা? জরুরি কথা বলার মতোও একটা সম্পর্ক থাকা লাগে। উনার সাথে আমার সে সম্পর্ক নেই। বলে দে, আমাকে যেন আর কল না দেয়। ”
তিন্নির কণ্ঠস্বর বদলে গেল। অনুরোধের সুরে বলল,
” এভাবে বলছিস কেন? একটু কথা বল না৷ মনে হয়, অনেক জরুরি। নাহলে আমাকে দিয়ে অনুরোধ করাত? আমি তো উনাকে চিনি। উনি এমন ধরনের মানুষ না। ”
” তুই উনাকে চিনিস আর আমি সব পুরুষকে চিনি। ”
তিন্নি চুপ হয়ে গেলে আমি বললাম,
” আর কিছু বলবি? ”
তিন্নি অনেকটা কান্নাভাবে বলল,
” কথা বললেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। একবার কথা বল, শুনে দেখ কী বলছে। তোর কাছে যদি জরুরি না লাগে কেটে দিস। তায়্যু, প্লিজ। আর না করিস না! ”
আমি বিপরীতে কিছু বললাম না। তিন্নির কলে থাকা অবস্থায় সেই অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসে কেটে গেল। হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি কারও সাথে কলে আছি। তিন্নির কল কাটার দুই মিনিট পর আবার কল দিল। আমি ধরব না ভেবেও ধরলাম। সে সরাসরি বলল,
” আপনি কি সত্যিই বিয়েটা করতে চাচ্ছেন না? ”
তার হঠাৎ প্রশ্নে আমি চমকালাম। উত্তর দিলাম না। অমিত আবার বললেন,
” আপনার পরিবার চায় আমার সাথে আপনার বিয়ে হোক, আমার পরিবারও। সেজন্যই হয়তো আপনার মতামতকে গুরুত্বে আনছে না, আপনার পছন্দকে মূল্য দিচ্ছে না।। কিন্তু তায়্যিবাহ, আমি যে চাই আমার জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে আপনার মতামত থাকুক। গুছানো সংসারে আপনার ইচ্ছে-অনিচ্ছারও ঠাঁই হোক। তাই সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে আমি আপনার মত শুনতে চাই। আমি যদি আপনার পছন্দ না হই তাহলে এ বিয়ে হবে না। আমি নিজে ভেঙে দেব। কারও আপত্তি শুনব না৷ ”
আমি চুপ করে তার কথা শুনছিলাম দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” তায়্যিবাহ? আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ”
আমি ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে পারলাম না। হালকা সুর করে বললাম,
” হুম। ”
তার সন্দেহ কেটে যেতেই বললেন,
” এবার বলেন আপনি কি বিয়েতে রাজি? ”
প্রশ্নটা করেই সাথে সাথে বললেন,
” আপনার উত্তর যদি ‘ না ‘ হয় তাহলে মুখে বলতে হবে না। কলটা কেটে দিবেন, আমি বুঝে নেব। ”
আমি উত্তর নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে মায়ের গলা পেলাম। চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি ভয়ে কল কেটে ফোন ফেলে দিলাম বিছানায়। তখনই মা রুমে ঢুকল। আনন্দিত গলায় বলল,
” তোর বড় আপু এসেছে! কত দিন পরে এলো বল তো? যা, দেখা করে আয়। এসেই তোর খোঁজ করল প্রথমে। ”
আমি এক মুহূর্তও দেরি করলাম না। এক দৌড়ে ছুটে গেলাম আপুর কাছে৷ বিনাবাক্যে জড়িয়ে ধরলাম নিবিড়ভাবে। কয়েক সেকেন্ড চোখ বুঝে থেকে বললাম,
” তুমি তাহলে এ বাড়িতে এলে! ”
বড় আপু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হেসে ফেলল। বাচ্চাদের মতো পিঠে আদুরে হাত বুলিয়ে বলল,
” তোর বিয়ে আর আমি আসব না, তা হয় নাকি? ”
আমি মুখ উঠিয়ে নিলাম আপুর কাঁধ থেকে। ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলাম তার কোমল শরীরটাকে। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলে সে বলল,
” আমি জানতাম তুই আমার কথা ফেলবি না। ছোট থেকে নিজের প্লেট থেকে খায়িয়ে খায়িয়ে বড় করেছি না? ”
আপুর চোখে-মুখে বিজয়ের হাসি। গর্বিত উত্তাপ। আমার গালে হাত রেখে বলল,
” আমার পাগলিটা! ”
তারপরেই জিজ্ঞেস করল,
” আরেক পাগলি কখন আসবে বলেছে কিছু? ”
আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না৷ মাথা নিচু করে দুপাশে মাথা নেড়ে না বুঝালাম। বড় আপু বুঝে নিয়ে বলল,
” চিন্তা করিস না। আমি কল দিচ্ছি, কাল সকালের মধ্যেই চলে আসবে দেখবি। ”
আমি ঘাড় একপাশে কাত করে চলে আসতে গিয়েও থামলাম। আপুর মলিন মুখটায় আনন্দের রঙের ছড়াছড়ি। আশপাশটা খুঁটে খুঁটে দেখে বলল,
” তিন বছরেই অনেক কিছু বদলে গেছে। এই বদলটা দেখার সৌভাগ্য করে দেওয়ার জন্য এক ঝুলি ধন্যবাদ বোন। কাছে আয়, আরেকটু আদর করে দিই। ”
আমি বাচ্চাদের মতোই আদরের লোভে পড়ে গেলাম। তার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আদর নিতে নিতে বললাম,
” কতদিন থাকবে, আপু? ”
” তুই যতদিন আছিস। ”
” তাহলে সারাজীবন থেকে যাই। বিয়েটা ভেঙে দিই? ”
আপু চোখ বড় করে তাকিয়ে হেসে ফেলল। সহাস্যে বলল,
” যার নাম করে ছুটি নিলাম তাই যদি মিথ্যে হয় তাহলে কি চাকরি থাকবে, বোকা মেয়ে? ”
আপু চাকরি বলতে যে শ্বশুরবাড়ি বুঝিয়েছে তা বুঝতে আমার একটুও সময় লাগল না। আমি ছলছল চোখে আপুর কাঁধে মাথা ফেললাম সেসময় মা চিৎকার করে বলল,
” তায়্যিবাহ, তোর বাবাকে পাঠিয়ে দে তো। অমিত কল করেছে। ”
আমি চকিতে আপুর কাছ থেকে সরে দাঁড়ালাম। মনে পড়ল, তাকে কিছু না বলেই কল কেটে দিছিলাম। এই কেটে দেওয়া যে আমার উত্তরের কেটে দেওয়া নয় সেটা তো তিনি জানেন না! আমি বাবাকে না ডেকেই মায়ের রুমে গেলাম। একরকম ছিনিয়ে নেওয়ার ভঙ্গিতে ফোন তুলে নিলাম। মা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” মোবাইল নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? ”
আমি মিথ্যে বললাম,
” বাবাকে দিতে। ”
মায়ের চোখের আড়াল হতেই অমিত আবার কল দিলেন। আমি সাথে সাথে রিসিভ করলাম। রুদ্ধশ্বাসে বললাম,
” এখানে কল দিয়েছেন কেন? ”
অমিত বোধ হয় বুঝতে পারলেন না। ভাবল ভুল করে আমার ফোনে কল দিয়েছে। অত্যন্ত দুঃখিত গলায় বললেন,
” সরি, আংকেলকে কল দিতে গিয়ে আপনাকে দিয়ে ফেলেছি। ক্ষমা করবেন। ”
আমি তাড়াহুড়ায় শুধরে দিলাম,
” আরে না, আপনি বাবাকেই কল দিয়েছেন। ”
আমি বাবার মোবাইলটা কানে চেপেই আমার রুমের দিকে হাঁটা ধরলাম। চাপা স্বরে সবটা বুঝিয়ে দিলে তিনি বললেন,
” মায়ের ভয়ে কল কেটে দিয়েছিলেন? এমন ভয় তো লুকিয়ে প্রেম করার সময় হয়। আমরা কি প্রেম করছিলাম? ”
এই প্রথম আমি লজ্জা পেলাম। আড়ষ্টতার দানা বাঁধল গলার ভেতর। অমিত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। জরুরি গলায় বললেন,
” এখন তো মা নেই, ভয় নেই। তাহলে উত্তরটা দিয়ে ফেলুন। ”
আমি একটু ভেবে বললাম,
” বিয়েটা আমি করব কিন্তু শর্ত আছে। ”
অমিত খুশি হলো নাকি বুঝা গেল না। চটপটে বললেন,
” সরি, তায়্যিবাহ। আমি কোনো শর্ত মেনে বিয়ে করতে পারব না। ”
তার সরাসরি নাকচতায় আমার আঁতে আঘাত হানল। দাম্ভিকতায় টান পড়ল। নিজেকে ছোট ও অযোগ্য মনে হলো। রাগে কল কেটে দেওয়ার জন্য ফোন কান থেকে সরাতেই তিনি বললেন,
” কিন্তু আপনাকে কথা দিতে পারি, আমি সবসময় আপনার মন পড়ার চেষ্টা করব, না বলা কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করব। কোনো কিছুতে জোর করব না। অধিকার ফলাতে যাব না। আপনি কষ্ট পান এমন আচরণ করব না। আর যদি ভুল করে করেও ফেলি তাহলে ক্ষমা চাইব আর নিজেকে শুধরে নেব। ”
আমার উত্তপ্ত হৃদয়টা শান্ত হয়ে গেল নিমিষেই। গভীর রাতের সাগরের ঢেউয়ের মতো দুলতে দুলতে হারিয়ে গেল অহংভাব। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মনটাকে আমানত রেখে মুক্তি পাওয়ার মতো কাউকে পেলাম।
” আমার বিশ্বাস, শুনতে না চাওয়া আপনার শর্তগুলোও অজান্তেই পালন হয়ে যাবে। তায়্যিবাহ, দয়া করে কোনো শর্ত টেনে আমাদের হতে যাওয়া সম্পর্কটাকে ছোট করবেন না। আমি মানতে পারব না। ”
আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। মানুষটার থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত শান্তিটুকুও সহ্য করতে পারলাম না। অস্থিরতা থেকে মুক্ত পেতে দ্রুত বললাম,
” ঠিক আছে। ”
তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে সুধালেন,
” কী ঠিক আছে? ”
আমি চোখদুটো বন্ধ করে নিশ্বাস থামিয়ে বললাম,
” শর্ত ছাড়াই বিয়েটা হোক। ”
অমিত অত্যাশ্চর্য হয়ে পুনরায় সুধালেন,
” তারমানে আপনি রাজি? ”
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। তাকে কলে রেখেই ফোন জানালার ফাঁকা ধাপে রেখে পালিয়ে গেলাম।
চলবে