আলোছায়া পর্ব-১

0
5136

আমি আমার স্ত্রীকে খুন করতে চাই। আমার মতো স্মার্ট ছেলের ঘাড়ে ওইরকম একটা গেয়ো পেত্নীকে আব্বু কিভাবে ঝুলিয়ে দিলেন বুঝতেই পারছিনা। মেয়েটিকে আমি ডিভোর্স দিতে পারবো না কারণ আব্বু এটা কিছুতেই হতে দিবেন না, আমাকে ত‍্যাগ করবেন। আমার পক্ষে ওর সঙ্গে থাকা সম্ভব না। গলাই কেমন কাঁটার মতো বিধে আছে। তাছাড়া আমি পিহুকে ভালোবাসি। আমার সঙ্গে ওকেই মানাই। কথাটা বলেই থামলো জুনায়েদ। শহরের নাম করা কিলার সুবাসের সামনে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো। ওর বন্ধু অনিক বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও ভাবছে ছেলেটার মাথা কি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে?আল্লাহ্ ভালো জানেন। দুদিন বিয়ে না করতেই বউকে মারার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আগে যদি এসব বলতো তবে ও কখনও এখানে আসতো না। মেয়েটার তো দোষ নেই শুনেছিল আঙ্কেল খুব স্বাদ করে নিজের বন্ধুর মেয়েকে ছেলের জন্য পছন্দ করে নিয়ে এসেছেন। উনি জানলে ভীষণ দুঃখ পাবেন। কথাটা ভেবে ও জুনায়েদকে পাশ থেকে খোচা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> তুই কি খেপেছিস? বউকে মারার জন্য কিলারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিস। ছি তুই এতো খারাপ?

> তুই থামতো, আমার সঙ্গে যা হয়েছে তোর সঙ্গে যদি হতো তাহলে বুঝতি। তুই জানিস মেয়েটা নাক ডেকে শব্দ করে ঘুমাই। কি জঘন্য শুনতে ইয়াক,আমার ঘুম আসে না। ইচ্ছে করে লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দিতে।
> সামান্য এইটুকু কারণে কেউ মানুষ হত্যা করতে পারে? পছন্দ হচ্ছে না আঙ্কেলকে বলে দিলেই হয়। বাবা মায়ের রাজকন‍্যা তাদের বুকে ফিরে যাক।
> তুই চুপ থাকবি?রাজকন‍্যা না আস্ত পেত্নী। শোন আমাকে কথা বলতে দে।

ওদের দুজনের ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে সামনের লোকটা ধমক দিয়ে উঠলো।

> দ্রুত কথা শেষ করেন। আমার হাতে অনন্তকাল সময় নেই। মেলা কাম আছে । আর হ‍্যা মাইয়ার ছবি টবি থাকলে দিয়ে জান সুবিধা হবে। একদম আপনার বাড়িতে গিয়ে মেরে আসবো।
> এই না না আমাদের বাড়িতে কিছুতেই যাওয়া চলবে না। আমি সুযোগ বুঝে ওকে বাইরে নিয়ে আসবো ঠিক তখনই আপনারা ওকে নিয়ে আসবেন। যোগাযোগ থাকবে,ফোনে সব কথা হবে।

জুনায়েদ কথা শেষ করে নিজের ফোন থেকে একটা ছবি লোকটার সামনে ধরতেই লোকটা ফোনের উপরে ঝুকে পড়লেন। তারপর বেশ সন্তুষ্ট মুখ নিয়ে মুখের মধ্যে একগাদা পান চিবাতে চিবাতে পাশের ছেলেটিকে বললেন,
> কিরে তোরাও একটু দেখে নে। বুঝলি মাইয়া সেই লেভেলের সুন্দরী।বেশ জমবো কি বলিস?
> হয় উস্তাদ।
দুজনের কথাবার্তার ধরণ দেখে অনিকের মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হচ্ছে। ওর ইচ্ছা করছে জুনায়েদকে আচ্ছা করে ধোলাই করতে। সবাইকে ভাব নিয়ে বলে বেড়ায় এই জুনায়েদ সাইদ কখনও অন‍্যায় করেনা অথচ এই খারাপ লোকগুলোর কাছে নিজের বউকে তুলে দিবে। কতটা জঘন্য হৃদয় হলে মানুষ এরকমটা করতে পারে। অনিকের ভাবনার ছেদ পড়লো জুনায়েদর কথা শুনে। ছেলেটা পকেট থেকে একটা টাকার বান্ডিল বের করে টেবিলের উপরে রাখতে রাখতে বলল,
> বাকীটা কাজ শেষ হলে দিবো। কাজ কিন্তু হওয়া চাই। কিছুতেই মিস করা চলবে না।
> আরে দূর আপনে নিশ্চিন্তে বাড়িতে গিয়ে বইয়া থাকেন কাম হইয়া যাইবো। আমি কখনও ফেল করিনা। একটা সুনাম আছে না।
> থাকলেই ভালো। আসছি এখন। দেখা হবে অচিরেই।
জুনায়েদ কথা শেষ করে গটগট করে হেটে বাইরে চলে আসলো। গ্রীষ্মের দুপুর চারদিকে সূর্যের প্রখর তাপ অথচ যেখানে এতক্ষণ গিয়েছিল রুমটা ছিল অন্ধকার। ওরা হন্তদন্ত হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। জুনায়েদ গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে গাড়ি ছেড়ে অনিককে উদ্দেশ্য করে বলল,
> তোকে ছাড়া কোনো প্লান করলে সেগুলো আমার সফল হয়না। এই জন‍্যই তোকে নিয়ে আসা। যাইহোক ওসব ছাড় আমাদের বাড়িতে যাবিতো? আম্মা বলছিল হঠাৎ বিয়ে হয়েছে তাই তোকে বউ দেখাতে পারেনি। আম্মার আক্ষেপটা মিটিয়ে দিতে যেতে পারিস। ওই এলিয়েনটাকেও শেষ দেখাটা দেখলি।

জুনায়েদের কথা শুনে ভীষণ বিরক্ত লাগলো অনিকের। ইচ্ছা করছে নেমে যেতে কিন্তু না মেয়েটাকে একবার দেখতে হচ্ছে। যদি কিছু উপকার করতে পারে এই চামারের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। কথাটা ভেবে ও গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> মেয়েটির জন্য তোর মায়া হচ্ছে না? জানিস তো লোকগুলো কতো খারাপ। মেয়েটার সঙ্গে কি কি করবে কোনো আইডিয়া আছে তোর?
> কিসের মায়া? আগে থেকে পরিচিত নাকি। যখনই রুমে গেছি দেখেছি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ওর জন্য আমি তিনদিন ঠিকমতো বাড়িতে যায় না।
> কাজটা ঠিক হচ্ছে না। লোক জানাজানি হলে কি হবে বলতো?
> কিছুই হবে না। কিছু টাকা ছুড়লে সব সমাধান। ছাড়া মেয়েটার বাড়ি গ্রামে ওর বাবা মায়ের ক্ষমতা হবে না আমার পেছনে পুলিশ লাগানো। এতো চিন্তা করিস না।

জুনায়েদের কথা শুনে অনিক হতাশ হলো। এই ছেলেটাকে বুঝিয়ে কিছুই হবে না। একবার যখন বলেছে তখন মেয়েটার জীবন নরক বানাতে দুবার ভাববে না। আঙ্কেলকে বুঝিয়ে বলতে হবে কিন্তু কিভাবে বলবে জুনায়েদ জানলে বন্ধুত্ব শেষ। কথাগুলো ভেবে ওর কপালের রগটা টনটন করে উঠলো। বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে জুনায়েদ ভেতরে চলে গেলো। অনিক ধীরগতিতে ওর পেছনে পেছনে ভেতরে যেতেই পারভীন বেগম হাসিমুখে বলে উঠলেন,
> অনিক তোমাকে তো আজকাল দেখাই যায়না। তোমার বন্ধু তো বিয়ে করে দেবদাস হয়ে পথে পথে ঘুরছে। তাকে একটু সঙ্গ দাও।পাশে থেকে বুঝিয়ে বলো। সংসারে মনোযোগ দিতে।
পারভীন বেগমের কথা শুনে জুনায়েদ মুখটা কঠিন করে বলল,
> আম্মু এমন ভাবে বলছো মনে হচ্ছে তোমার ছেলে বিয়ের জন্য মারা যাচ্ছিল। তুমি আর আব্বু কু-বুদ্ধি করে আমার ঘাড়ে ওই ভূতকে চাপিয়ে দিয়েছো। এই জন্য তোমাদেকে আমি কখনও ক্ষমা করবো না।
জুনায়েদ ঝাড়ি দিয়ে সেখানে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। সিঁড়ি বেয়ে গটগট করে চলে গেলো। অনিক ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে পারভীন বেগমের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
> বিয়েটা কি খুব দরকার ছিল আন্টি? কিছুইতো জানিনা। গতকাল আঙ্কেল ফোন করে বলল।
> তোমার বন্ধুর চরিত্র নিয়ে আমি বেশ সন্দিহান। কি সব মেয়েদের সঙ্গে ঘুরাঘুরি করে তাই জন্য ভালো মেয়ে পেয়ে অপেক্ষা করিনি। ওকে বুঝিয়ে বলবে।

পারভীন বেগম কথা শেষ করে কাজের মেয়েকে ডেকে বললেন নিলুকে ডেকে পাঠাতে। কাজের মেয়েটা ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোমটাই আবৃত একটা মেয়েকে নিয়ে হাজির হলো। মেয়েটা জড়সড় হয়ে অনিকের বিপরীতে গিয়ে বসলো। অনিক কৌতূহলী হয়ে চেয়ে আছে। পারভীন বেগম মেয়েটার পাশে বসে ওর ঘোমটা কিছুটা উঠিয়ে দিলেন। এক পলক তাকিয়ে অনিকের সারা মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো। এক কথায় অপূর্ব দেখতে মেয়েটা। কোনো সাজগোছ নেই। গায়ে কোনো গহনা নেই শুধু শাড়িতেই মেয়েটাকে অসাধারন লাগছে। এমন একটা মেয়েকে জুনায়েদ মারতে চাইছে ভেবেই ওর খুব আফসোস হচ্ছে। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পারভীন বেগম সরে এসে বললেন,

-‘তোমার বন্ধুর মতিগতি ভালো নেই। সে অসুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী। আমার পেটে ওরকম একটা হতচ্ছাড়ার জন্ম কিভাবে হলো ভেবে পাচ্ছি না। হয়তো সে বাপের মতো হয়েছে।

অনিক পারভীন বেগমের কথায় কর্ণপাত করলো না। উনি সব সময় এমনিই বলেন। জুনায়েদের সব দোষ গিয়ে আঙ্কেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। এখানে আঙ্কেল থাকলে একঘর ঝগড়া লেগে যেতো। অনিক কিছুটা ভেবে বলল,
> আন্টি আজ তাহলে উঠছি। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব আপনি চিন্তা করবেন না।

পারভীন বেগম ওকে খাওয়ার জন্য বেশ চাপাচাপি করলেন কিন্তু ও এখানে কিছুতেই থাকতে পারলো না। মনের মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করছে। বাড়িতে গিয়ে বুদ্ধি করে জুনায়েদকে বুঝাতে হবে। কথাটা ভেবে ও বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। অন‍্যদিকে জুনায়েদ রুমের মধ্যে পাইচারি করছে। কিভাবে এই মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করা যায়। হঠাৎ ঘুরতে যাচ্ছি বললে তো আম্মু সন্দেহ করবে। মেয়েটার সঙ্গে ও তেমন কথাও হয়নি। নামটা আম্মুর থেকে শুনেছিল। অনেক ভেবে ও একটা বুদ্ধি পেলো। সেই ভাবনা অনুযায়ী ও মায়ের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> আমার বন্ধুরা তোমার বউমাকে দেখতে চাই। আজকে একটা পার্টি আছে সেখানে ওকে নিয়ে যেতে বলেছে।

> বাইরে যাবার কি দরকার ওদেরকে বাড়িতে ডেকে নিলেই হয়।

> বন্ধুর জন্মদিন ফেলে সবাই এখনে আসবে পাগল তুমি? ওকে নিয়ে গেলে ওকি ফুরিয়ে যাবে?

> অনিক যাচ্ছে সঙ্গে ?

> আম্মা তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?
> দূর তোর বউকে তুই নিয়ে যাবি সন্দেহ কিসের। আসলে নতুন বউকে এভাবে রাতে বাইরে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি। আচ্ছা যা সমস্যা নাই।

জুনায়েদ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এটাইতো সুযোগ। ও এই সম্পর্কে অনিককে কিছুই বলল না। সন্ধ্যায় পারভীন বেগম খুব যত্ন নিয়ে বউমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে জুনায়েদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। ভাবলেন ছেলেটা বুঝি ভালো হয়ে গেছে। মেয়েটাকে মেনে নিয়ে সংসার করবে। কথাগুলো ভেবেই উনি শান্তিতে চোখ বন্ধ করলেন।

জুনায়েদ গাড়িতে বসে ফোন বের করে একটা টেক্সট করে পাশফিরে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। বিরক্তিতে জুনায়েদের সারা মুখটা কুচকে গেলো। ও মনে মনে গালি দিয়ে বলল, কুম্ভকর্ণ একটা। ইচ্ছে করছে লাথি দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেই। পূর্ণীমা রাত আকাশে চাঁদ উঠেছে। শনশন দক্ষিণা বাতাসে গাড়ির কাচে গাছের শুকনো পাতাগুলো উড়ে এসে লুটিয়ে পড়ছে। জুনায়েদ গাড়ি শহর থেকে বের করে জঙ্গলের দিকে নিয়ে চলল। দূরে শেয়াল ডাকছে। রাস্তার দুধারে ঝিঁঝিঁপোকার কান ফাটানো চিৎকার। জুনায়েদ নির্দিষ্ট জায়গাই গাড়ি থামিয়ে লোকগুলোকে আরেক দফায় টেক্সট করলো। ঠিক সেই সময় কাছেই একজনের ফিসফিস কন্ঠ ওর কানে গেলো। জুনায়েদ বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে নেমে যেতেই লোকগুলো মেয়েটার নাকে রুমাল আটকিয়ে নিজেদের গাড়িতে তুলে নিলো। জুনায়েদ নিজের চুলগুলো এলোমেলো করে গাড়ির কাচে হাত মুঠো করে ঘুষি দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো। নিজেকে মোটামুটি প্রস্তুত করে বাড়ির পথে রওনা দিলো। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে যা দেখলো তাতে ওর চোখটা কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। ওর সারা মুখজুড়ে আতঙ্ক।

আলোছায়া
কলমে : লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুস নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here