#আলোছায়া
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১০
গভীর রাতে জুনায়েদ বাড়িতে ফিরে আসলো। সারা বিকালে ও অনিকের সঙ্গে ছিল। ওর মন ভালো করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। প্রায় জুনায়েদ রাত করে বাড়িতে ফিরে।এই নিয়ে তেমন কোনো ঝামেলা হয়না কারণ ওর খারাপ কোনো নেশার আসক্তি নেই। জুনায়েদ দ্রুত পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো। রুমটা অন্ধকার করা লাইট বন্ধ। মেয়েটা দরজা খোলা রেখে লাইট বন্ধ করে ঘুমানোর জন্য ওর বিরক্ত লাগছে। জুনায়েদ কথাটা ভেবে লাইট অন করতে যাবে ঠিক সেই সময় চাপা কান্নার আওয়াজ ওর কানে গেলো। বেলকনিতে কেউ কান্না করছে। এই রুমে নীলু ছাড়া আর কেউ নেই। তহলে ওখানে ওই আছে। জুনায়েদ দ্রুত সেদিন এগিয়ে গিয়ে দেখলো নীলু দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। মেয়েটার চুলগুলো এলোমেলো। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ে পড়ছে। ভয়ানক অবস্থা। জুনায়েদ অপেক্ষা করলো না দ্রুত মেয়েটার পাশে বসে ওর দুবাহু নাড়িয়ে দিয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> তুমি ঠিক আছো? নীলু কি হয়েছে?
নীলু উত্তর করলো না। ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জুনায়েদ কি করবে বুঝতে পারছে না। ও নীলুকে উঠানোর জন্য দুহাতে ওকে আকড়ে ধরে তুলতে গেলো কিন্তু হলো না। মেয়েটা চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছে। আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে হয়তো পূর্ণীমা চলছে। বেলকনিতে চাঁদের আলো উপছে পড়েছে। ওদের সারা গায়ে চাঁদের আলো। নীলু টানা করে নিশ্বাস নিয়ে বলল,
> নীল পাথরটা না পেলে আমি মরেই যাবো। ওরা আমাকে বাঁচতে দিবে না। প্লিজ আমাকে সাহায্য করো আমি মরতে চাই না।
জুনায়েদ নীলুর এমন কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। ভাবলো মেয়েটা কি অসুস্থ হয়ে পাগল হয়ে গেলো? ও আর অপেক্ষা করলো না নীলুকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েটা ওর কোলের মধ্যে ছটফট করছে হয়তো এখুনি মারা যাবে। ও নীলুকে বিছানায় রেখে বাইরে যেতে গেলো। ডাক্তার ডাকতে হবে ভেবে কিন্তু পারলো না। নীলু ওর হাতটা টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> যাবেন না প্লিজ।
জুনায়েদ ওর হাত ছেড়ে বসতে বসতে বলল,
> তোমার এজর্মা আছে? হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কেনো?
নীলু চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শান্ত। জুনায়েদ এই রহস্যময়ী মেয়েকে নিয়ে পড়লো বিপাকে। কিছুক্ষণ আগে যে মারা যাচ্ছিলো হঠাৎ সে ঘুমে অচেতন। কিভাবে কি হচ্ছে কে জানে। জুনায়েদ ওর কপালে হাত রেখে উত্তাপ অনুভব করার চেষ্টা করলো। মাথা বেশ গরম হয়তো জ্বর এসেছে। ও দ্রুত বাথরুমে গিয়ে তোয়ালে ভিজিয়ে এনে নীলুর মাথায় রেখে নিজে ফ্রেস হয়ে আসলো। মেয়েটাকে এরকম অসুস্থ রেখে ওর ঘুম ধরছে না। চাপা টেনশন হচ্ছে। তবুও ঘুমানোর দরকার ভেবে নীলুর পাশে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গলো। প্রায় শেষ রাত একজোড়া চোখ জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঘুমের মধ্যেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে তাই নড়াচড়া করে পাশ ফিরে ঘুমালো। নীলু এখনো অচেতন ঘন নিশ্বাসের জন্য মনে হচ্ছে নাক ডাকার মতো আওয়াজ হচ্ছে। জুনায়েদের কাছে এই শব্দটা জঘণ্য লাগে কিন্তু এখন বেশ মানিয়ে নিয়েছে। কিছু করার নেই। ফজরের আযান শুনে নীলুর ঘুম ভাঙলো। ও দ্রুত ফ্রেস হয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। চারদিকে আবছা অন্ধকার। কেউ ঘুম থাকে উঠেনি। নীলু সোফায় গিয়ে হেলান দিলো। শরীর বেশ ক্লান্ত হঠাৎ হঠাৎ অসুস্থতা ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে। অতিরিক্ত ঘুম ঘুম পাচ্ছে । কিছুবছর আগেও ওর চোখে ঘুম ছিল না। দিন যাচ্ছে ও ততই ঘুমের অতল গহব্বে তলিয়ে যাচ্ছে আরও যাবে। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওর খুব ভালো ধারণা আছে। ভয় আতঙ্ক আর ঘুম সব মিলেয়ে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কাজের মেয়েটা রান্নাঘরের খুটখাট শব্দ করে সকালের জন্য চা তৈরী করছে। এই বাড়িতে সবাইকে সকাল সকাল রুমে চা দিতে হয়। শুভ্র ব্লাক কফি খাই ওর খাবার মেনু আলাদা। জুনায়েদের ওসবে মাথাব্যথা নেই। চা কফি একটা হলেই হলো। তাছাড়া ওর মিষ্টি জাতির খাবার বেশি পছন্দ অন্যদিকে শুভ্র মিষ্টি দেখলে লাফিয়ে উঠে। পারভীন বেগম ভাবেন এক ঘরে এই দুই প্রজাতির আগমন কিভাবে ঘটলো।
যাইহোক অরিন সকালবেলায় উঠেছে শুভ্রকে কফি দিতে যাবার জন্য। এই সুযোগে ছেলেটার সঙ্গে যদি একটু ভাব জমানো যায় সেই আশায়। গতকাল থেকে আজ পযর্ন্ত এখনো তার মুখ দর্শন করা যায়নি। কি কাজ করে ওর মাথায় আসে না। লোকটা একদিন কাজের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে মরবে। শরীরের উপরে এভাবে নির্যাতন করাটা জুলুমের শামিল। খাটাস লোকটাকে বুঝানোর দরকার। কথাগুলো ভেবে ও সোফার সামনে এসে অবাক। এই মেয়েটা ঘর ফেলে এখানে ঘুমাচ্ছে কোন বুঝতে পারলো না তারপর ভাবলো জুনায়েদ হয়তো ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কথাটা ভেবে ওর ঠোঁটের নিচে হাসি খেলে গেলো। অরিন নীলুর পাশে বসে ধমক দিয়ে ডেকে উঠলো,
> এই মেয়ে এখানে ঘুমাচ্ছো কেনো?
হঠাৎ বিকট শব্দের জন্য নীলু চমকে উঠে বসে পড়লো। ওর শরীর কাপছে। কি হয়েছে বুঝতে পারলো না। সরল চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
> সরি ঠিক পাইনি। কিছু বলবেন?
> বলবো মানে? বাড়ির বউ হয়ে বসে আছো অথচ বাড়ির একটা কাজকর্ম করো না। শাশুড়ির সেবাযত্ন কে করবে শুনি?
নীলু চুপচাপ বসে আছে। এই বাড়িতে আসার পর শাশুড়ি আম্মার আদর যত্নই পেয়ে এসেছে তাকে কখনও কোনো কাজে সাহায্য করতে হয়নি। তাছাড়া উনি নিজেই মানা করেছেন। নীলুকে উনি নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। নীলুকে চুপচাপ থাকতে দেখে অরিন আবারও ধমক দিয়ে উঠলো,
> যাও সবাইকে চা দিয়ে আসো। চা দিয়ে এসে নাস্তা তৈরী করবা। কি কি তৈরী করতে হবে আমি সব বলে দিবো। বাড়ির বউকে এসব করতে হয়।
নীলু কি বলবে ভেবে পেলো না। শরীর বেশ দুর্বল তাই কাঁপছে। তবুও ও জোর করে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো কাজের মেয়েটা চা তৈরী করে রেখেছে। নীলু চায়ের ট্রে নিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে আসলো। ও রীতিমতো টলছে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে এসে বাধলো আরেক বিপত্তি। শাড়ির আচল মাথা থেকে পড়ে গেছে। ও হাত থেকে চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখতে গেলো কিন্তু পারলোনা সামনে থেকে একজন ধরে ফেলল। নীলু চমকে সামনে তাকিয়ে দেখলো জুনায়েদ দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখমুখ শক্ত। নীলু বুঝতে পারলো না সাত সকালবেলায় লোকটা হঠাৎ রেগে আছে কেনো। ও কিছু বলতে গেলো তার আগেই জুনায়েদ চায়ের ট্রে নিয়ে ট্রি টেবিলের উপরে রেখে বলল,
> নীলু এখানে এসে বসো। তোমার শরীর ঠিক আছে?
নীলু চোখ নিচু করা দুবার মাথা নাড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। অরিন কফির কাপ নিয়ে বাইরে এসে নীলুকে দেখে আবারও ধমক দিয়ে বলল,
> তোমার দেখি কান কাটা স্বভাব। এতো করে বললাম তবুও এখানে বসে আছো?
জুনায়েদ ভ্রু কচকে উত্তর করলো,
> তুই হঠাৎ বাংলা সিনেমার ভিলেন শাশুড়ির মতো আচরণ করছিস কেনো? নীলুর কাজ করতে মানা। আম্মা জানলে তোকে এখুনি বের করে দিবে তখন আফসোস করিস।
জুনায়েদের এমন খাপছাড়া কথায় অরিন ভীষন ক্ষেপে গেলো। এই বাড়িতে ও সেই ছোট থেকে আসছে। এটা ওর একমাত্র খালার বাসা। ও মনে করে নীলুর থেকেও ওর অধিকার বেশি। দুদিনের মেয়ের জন্য খালমনি ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কখনও করবে না। কথাটা ভেবে ও ঝঙ্কার দিয়ে বলল,
> তুই দিনদিন বউ পাগলা হয়ে যাচ্ছিস। ওকে সামান্য চা দিতে বলছি।
> ডলি খালা আছে না চা দেবার জন্য। তুই শুধু ভাইয়ার চিন্তা কর। নীলুকে নিয়ে ভাবার মতো আম্মু আছেন।
জুনায়েদ কথাটা বলে চায়ের কাপে মুখ ডুবালো। অরিন রাগে ফুলছে। অচেনা এই মেয়টার সামনে খুব অপমানিত ফিল হচ্ছে। ও আর অপেক্ষা করলো না। ধপধপ পা ফেলে শুভ্রর রুমের সামনে গিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করলো। বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর শব্দে শুভ্রর ঘুম ভাঙলো। সারারাত জেগে কাজ করে ভোরে ঘুমিয়েছে। আজ অফিস নেই তাই ভেবেছিল দেরীতে উঠবে যেটা আগেই পারভীন বেগম কে জানিয়ে রেখেছিল। তবুও কেনো ডাকছে ওর মাথায় আসছে না । ও একঘর বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলেই অরিণের মুখখানা দেখে জ্বলন্ত উল্কা পিণ্ডের মতো জ্বলে উঠলো। মেজাজ সেই লেভেলের খারাপ হচ্ছে। এই মেয়েটাকে ওর একটুও সহ্য হয়না। সব বিষয়ে এর পাকামো করতে হয়। শুভ্র কিছুটা ভেবে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
> কি চাই?
> তোমার জন্য কফি এনেছি। ভাবলাম তুমি সকালবেলায় কফি খেয়ে ঘুম থেকে উঠো। অনেক যত্ন নিয়ে তৈরী করেছি খেয়ে দেখো ভালো লাগবে।
শুভ্র রাগে চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়ে নিজেকে শান্ত করে উত্তর দিলো,
> তুই খা আমার লাগবে না। শোন আমার ঘরের আশেপাশে একদম উঁকিঝুকি মারবি না। বেহুদ্দা মহিলা।
শুভ্র ধপ করে দরজা বন্ধ করে আবারও বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম পুরোপুরি না হলে মাথায় যন্ত্রণা করবে। ওর ঘুম হওয়াটা অতি জরুরি। অন্যদিকে অরিন লজ্জাই অপমানে কেঁদে ফেলল। অগ্রহ নিয়ে কফি দিতে এসেছিল। এমন ভাব করলো মনে হলো ও কফির বদলে বিষ দিয়ে দিয়েছে। ও কান্না করতে করতে পারভীন বেগমের দরজায় নক করলো। পারভীন বেগম এতক্ষণ কোরআন পড়ছিলেন। উনি দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই অরিন উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
> তোমার ছেলেগুলার খুব খারাপ। সব সময় আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। নীলু দুদিনের মেয়ে হয়ে আমার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। তুমি ওদেরকে বকে দাও নয়তো কখনও আর তোমাকে দেখতে আসবো না।
পারভীন বেগম ওকে থামতে বললেন। উনি মোটামুটি সব শুনেছেন। কিছুক্ষণ আগে ডলি সব বলে গেছে। তে উনি বেশ জুনায়েদের উপরে সন্তুষ্ট। ওদের সম্পর্কটা সামনে এগোচ্ছে। কথাটা ভেবে উনি অরিনের মাথায় হাত রেখে বললেন,
> জানিস তো ছেলেগুলা একটু ত্যাড়া টাইপের। ওদেরকে এড়িয়ে চলবি। আমি সবাইকে খুব বকে দিবো। তুই রুমে গিয়ে রেস্ট কর আমি দেখছি।
অরিন পারভীন বেগমের কথায় ভরসা পেলো বলে মনে হলো না। উনাকে ছাড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।নীলু সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। জুনায়েদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলো মেয়েটার কোনো অসুখ বিশুখ নেইতো? হয়তো শরীর খারাপের জন্যই এভাবে ঘুম পাচ্ছে। কথাটা ভেবে ও আস্তে করে ডাক দিলো,
> নীলু তোমার কি খুব খারাপ লাগছে?আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবে?
নীলু সামান্য চোখ খুলে আস্তে করে বলল,
> আমি ঠিক আছি। গোসল দিলে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবো
> আচ্ছা রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নাও। আজকে ক্লাসে যেতে হবে না।
> যেতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। তাছাড়া আমি সুস্থ আছি কিছু হবে না।
জুনায়েদ কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। নীলু ক্লান্ত শরীরে ধীরগতিতে রুমের দিকে চলে গেলো।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।