#আলোছায়া
কলমে : লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব_১১
নীলু গোসল শেষ করে তৈরী হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। জুনায়েদ এতক্ষণ রুমে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। নীলুকে দেখে ওর ভ্রু কচকে গেলো। কিছুক্ষণ আগেও ওকে কেমন অসুস্থ লাগছিল কিন্তু এখন দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। বরং বেশ সুস্থ মনে হছে। জুনায়েদ বিস্ময় নিয়ে ওকে প্রশ্ন করতে গেলো কিন্তু তার আগেই নীলু ওকে তাড়া দিলো,
> হঠাৎ হঠাৎ কি হয় জানিনা। আপনি ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। দ্রুত রেডি হয়ে আসুন যেতে হবে। আমি অপেক্ষা করছি।সময় কিন্তু পাঁচ মিনিট।
নীলু কথাটা বলে বেরিয়ে গেলো। জুনায়েদ ওর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রেডি হতে গেলো। ডাইনিং রুমে নীলু বসে আছে অরিন অবাক চোখে ওকে দেখছে। গতকাল থেকে সকাল পযর্ন্ত মেয়েটাকে শাড়িতে দেখেছি কিন্তু এখন অন্য পোশাকে। মেয়েটার মধ্যে ভালোলাগার মতো অনেক কিছুই আছে। ওর কেমন হিংসা হচ্ছে। শুভ্র ওর পাশে বসে টুকটাক কথা বলছে দেখে। মনে হলো এতো বছরে ও কতবার এখানে এসেছে একবারও তো ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি। তাহলে এই বাইরের মেয়েটার সঙ্গে কেনো বলবে? অরিন ঠক করে গ্লাসটা টেবিলের উপরে ছেড়ে দিলো। সকলে চমকে উঠে ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি হয়েছে কিন্তু অরিণের কোনো ভাবান্তর হলো না। চুপচাপ খাবার মুখে পুরছে। জুনায়েদ শার্টের কলার ঝাড়তে ঝাড়তে চেয়ার টেনে বসে বলল,
>কিরে বোন টেবিলে দেখি ঝড় তুলে ফেলেছিস। ভাঙচুর কম কর।ভাইয়ার হার্ট ভীষণ দুর্বল ধকল সহ্য হবে না।
জুনায়েদের কথায় শুভ্র রেগে গেলো। ও দাঁত কটমট করে বলল,
> হতচ্ছাড়া জীবনেও মানুষ হবি না। ওর ঝড়ে আমার হার্ট এটাক হবে কোন? ও নিজেই উড়ে যাবে।
অরিন ঝাড়ি দিয়ে উঠে চলে গেলো। জুনায়েদ খাবার মুখে দিয়ে বলল,
> ভাইয়া মেয়েটা খারাপ না বিয়েটা করে ফেলো। দারুণ হবে কিন্তু।
> আমার সখ নেই তোর ইচ্ছে থাকলে কর। এমনিতেই তো লাফালাফি করছিস এইটা দিয়ে তিন নাম্বার হয়ে যাবে।
শুভ্র রাগ করে বললেও জুনায়েদ মোটেও রাগ করলো না। বরং দাঁত বের করে হেসে বলল,
> খারাপ না বেশ ভালো। আমিও ভেবেছিলাম দুইটা…
জুনায়েদ কথাটা শেষ করতে পারলো না কারণ সবার নজর ওর দিকে। শুভ্র চোখ লাল করে বলল,
> মাথায় তো কু চিন্তা ছাড়া ভালো চিন্তা নেই।
জুনায়েদ অবস্থা বেগতিক দেখে চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলো। সারা রাস্তায় ওরা চুপচাপ ছিল।ভার্সিটি সামনে নীলুকে নিয়ে ও নেমে আসলো। সামনে নীলুর ফ্রেন্ডরা অপেক্ষা করছে দেখে জুনায়েদ ওকে রেখে নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেলো। আজ পিউ এসেছে ক্লাস করতে। সামনে মাষ্টার্স পরীক্ষা। নোট নেওয়ার ছিল। জুনায়েদ ওকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছে। মেয়েটার মাথায় কি আছে ও হয়তো নিজেও জানেনা। অনিক গার্লফ্রেন্ড হারানোর শোক প্রায় কাটিয়ে ফেলেছে। আগের মতোই এর ওর পেছনে লাগছে। ছেলেটাকে এভাবে দেখতেই ভালো লাগে।কথাগুলো ভেবে জুনায়েদ ক্লাস থেকে বের হতেই পিউ ওর হাত চেপে ধরলো। ও একবার পিউয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> কিছু বলবে?
> তোমার সঙ্গে কথা আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা।
> তোমার বাবাকে কথা দিয়েছি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো না। এখন যা বলার তুমি সবার সামনেই বলো।
> এখানে বললে তোমার সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়বে। হাতে হাতকড়া উঠবে।
জুনায়েদ ভ্রু কুচকে বলল,
> রিয়েলি? বলো শুনি কি বলবে?
পিউ বুঝলো একে ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না তাই কথা ঘুরিয়ে বলল,
> আমার কথা না শুনলে আমি কিন্তু সুইসাইড করবো। সব দোষ তোমার হবে। সারাজীবন জেলে বসে বউয়ের সঙ্গে সংসার করতে হবে।
> তোমার বোকা বোকা কথাবার্তা গুলো বন্ধ করবে? সময় নেই আমি নীলুকে আনতে যাচ্ছি।
জুনায়েদ ওকে এড়িয়ে চলে আসলো। পিউ রাগে জ্বলছে। নীলুর উপরে ওর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। এই মেয়েটার জন্যই ওর হাত থেকে জুনায়েদ ফসকে গেছে। কিছুতেই ও এসব সহ্য করবে না। একবার বিফল হয়েছে বলে বারবার হবে না। এবার ও ভয়ানক কিছু করবে। অন্যদিকে জুনায়েদ বন্ধুদের দাঁড়াতে বলে পিউকে আনতে গেলো। তিন ঘন্টা মেয়েটার খোঁজ নেই। ক্লাস করছে মাঝখানে কিছু সময় ক্লাস ছিল না। জুনায়েদ একা হেটে নীলুর ক্লাসের দিকে এগোতেই কারো সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলো। ও চমকে উঠে দেখলো নীলু ওকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। এর কিছুক্ষণ পরে আরও তিনজন ছেলে এসে ওদের সামনে দাড়ালো। জুনায়েদ নীলুকে দুহাতে আগলে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> কি হচ্ছে এখানে?
ছেলে গুলোর মধ্যে থেকে একটা ছেলে উত্তর করলো,
> এই মেয়েটা আমাকে থাপ্পড় মেরেছে । কত সাহস সিনিয়রদের গায়ে হাত তুলেছে। ওর অবস্থা যদি বেহাল না করেছি আমার নাম অভি নয়।
জুনায়েদ বিরক্তি নিয়ে নীলুকে বলল,
> কি বলছে ওরা?
নীলু ওর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থেকেই মাথা নিচু করে বলল,
> আমার ওড়নায় ও মুখ মুছতে চেয়েছি। নিষেধ করছিলাম শুনছিল না তাই রেগে এমন করেছি। তবে ভূল করিনি ঠিক করেছি।
> ও আচ্ছা।
জুনায়েদ রেগে ছেলেগুলাকে বলল,
> পড়াশোনা না করে এখানে মেয়েদের ওড়না নিয়ে টানাটানি করতে আসো তোমরা? ইউনিভার্সিটিটাকে কি বাপ দাদার সম্পত্তি পেয়েছো? অসভ্যতার একটা লিমিট আছে।নীলু বেশ করেছে। আরেকটা দিলে খুশী হতাম।
জুনায়েদের কথা শেষ হলো না কোথা থেকে অনিক বন্ধুদের নিয়ে এসে ছেলেগুলারে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো। জুনায়েদ এক হাতে নীলুকে ধরে অন্য হাতে অনিককে ফোন করেছিল। অনিক ফোনে সবটা শুনেছে। এই ছেলেগুলার সঙ্গে ও একা পারতো না তাই এই ব্যাবস্থা। নীলুর চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। জুনায়েদ হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
> এসবের আমি কিছুই জানিনা। দুপক্ষের ঝগড়া ঝামেলার মিমাংসা করতে হবে আমাকে বুঝলে? এটাই রাজনীতি।
কথাটা বলে ও নীলুকে পাশে রেখে ওদেরকে থামতে বলল। ছেলেগুলারে ইচ্ছে মতো ধোলাই করেছে। জুনায়েদের কথা শুনেও ওরা থামলো না দেখে ও দ্রুত অনিকের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে ওদেরকে চলে যেতে বলল। তারপর কাকে একটা ফোন করে বলে দিল এদিকেটা সামলে নিতে। নীলু চুপচাপ দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে দেখছিল। জুনায়েদ ওর হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে আসলো। নীলু নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো,
> আপনি ইচ্ছে করে এমন করলেন তাইনা?
> আমাদের বাড়ি বউয়ের সম্মান আছে। রাস্তায় ছেলেরা তাদেরকে নিয়ে মজা করবে এটাতো হতে পারেনা। তাছাড়া ওদের একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার ছিল। জুনায়েদ সাইদের বউয়ের ওড়নায় মুখ মুছার খুব সখ ছিল মিটিয়ে দিলাম। আমি নিজেই যেটা এখনো পযর্ন্ত করতে পারিনি সেখানে ওদের সাহস হয় কিভাবে?
নীলু অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোকটার মাথায় সত্যিই গন্ডগোল আছে। ওকে তো কখনও বউ হিসেবে মানে না কিন্তু বাইরে গেলে এক্কেবারে। নীলু বিড়বিড় করে কথাগুলো কয়েকবার বলল। জুনায়েদ ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িতে বসে নীলুর হঠাৎ করে আবারও ঘুম পাচ্ছে। ওর চোখ খোলা রাখতে না পেলে চোখ বন্ধ করলো। জুনায়েদ গাড়ি ছেড়ে কিছু বলার জন্য পাশে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা ঘুমে বিভোর। জুনায়েদ হতাশ হয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। কিছু একটা ভেবে ও হাসপাতালের দিকে এগিয়ে গেলো। নীলুর দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দে ওর সারা শরীর ফেপে উঠছে। হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামিয়ে জুনায়েদ ওকে কয়েকবার ডাকলো কিন্তু নীলু উঠলো না। ও এবার নীলুর হাত ধরে জোরে করে নাড়িয়ে দিলো। মেয়েটা ঘুম ঘুম চোখে জুনায়েদের দিকে তাকালো। এক জোড়া লাল চোখকে উপেক্ষা করে জুনায়েদ বলে উঠলো,
> এসে গেছি দ্রুত নামো। ডাক্তার চলে যাবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।
নীলু অবাক হয়ে বলল,
> এখানে কেনো?
> তোমার জন্যই এসেছি। রাতে শরীর খারাপ ছিল। যখন তখন ঘুমিয়ে যাওয়া এসব নরমাল বিষয় না।
নীলুর চোখেমুখে আতঙ্ক খেলা করছে। ও কিছুতেই ডাক্তার দেখাবে না। লোকটা এখানে আসার আগে কেনো বললো না এটা ভেবে ওর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে । ওকে এভাবে চুপচাপ ভাবতে দেখে জুনায়েদ বলল,
> কি হলো যাবে না?
> হুম।
নীলু চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে জুনায়েদের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। চারদিকে অসংখ্য লোকজন। সমাজের সর্ব শ্রেনীর মানুষের মিলনকেন্দ্র এটা। হাসপাতাল এমন একটা জায়গা যেখানে ধর্ম বর্ণ ধনী গরিবের কোনো ভেদাভেদ করা হয়না। সবাই রুগী নয়তো রুগীর আত্মীয়। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে এসে জুনায়েদ ওকে জিঞ্জাসা করলো,
> ডাক্তারকে সব খুলে বলবা। উনি আমার পরিচিত তোমার সমস্যা হবে না। ভয় নেই আমি আছি।
> আমার তো তেমন কিছুই হয়নি।
> গতকাল রাতে ওটা কি ছিল? অযথা তর্ক করবা না। আমি যা বলবো শুনবা।
নীলু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলো। এই ছেলেটা যখন বলেছে তখন ডাক্তার দেখিয়েই ছাড়বে। কিন্তু জুনায়েদ ওকে নিয়ে দরজায় ধাক্কা দেবার আগেই দরজা খুলে গেলো। ডাক্তার চিন্তিত মুখে বেরিয়ে এসে বলল,
> সরি বাবা আমি এখন থাকতে পারছি না। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কল এসেছে। এখুনি না গেলে একজনের প্রাণ যাবে।
> আচ্ছা আপনি জান আমি নাহয় আগামীকাল আসবো।
জুনায়েদের সঙ্গে লোকটা কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলো। নীলু যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জুনায়েদ মলিন মুখে বলল,
> দূর আবারও আগামীকাল আসতে হবে। চলো ফিরে যায়।
নীলু খুশী হয়ে মাথা নাড়লো। বাড়িতে পৌছতে ওদের আধা ঘন্টা লাগলো। সারা বাড়িতে পোলাও মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। আজ অরিন ঢুকেছে রান্না করতে। মেয়েটা রান্না করতে পছন্দ করে। পারভীন বেগম মানা করেছিলেন কিন্তু মেয়েটা শুনেনি। শুভ্র সারাদিন বাড়িতেই আছে। ঘর থেকে তেমন বের হয়নি। অরিন নিজের পছন্দ মতো রান্না করছে ওর জন্য। কোথায় একটা শুনেছিল পুরুষ মানুষের মন পেতে হলে ভালো রান্না জানতে হয়। অরিন এই সুযোগ হাতছাড়া করতে পারবে না। নীলু রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বাইরে আসলো। পারভীন বেগম ওকে কাছে ডেকে নিলেন। উনি পরম মমতায় নীলুর খোঁজ খরব নিচ্ছিলেন। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। নীলু এই মানুষটাকে খুব পছন্দ করেছে। মা হবার সব গুণ গুলো আল্লাহ্ এই মহিলার মধ্যে অতিরিক্ত দিয়েছেন বলে হনে হয়। ওরা যখন গল্প করছিল তখন অরিন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে হাত মুছতে মুছতে বলল,
> খালামনি কিছু লোক আছে তারা শুধু কথা দিয়েই চিড়া ভিজাতে জানে। কাজের বেলা শূণ্য।
নীলু বুঝে নিলো কথাগুলো ওকেই শোনানো হচ্ছে। কিন্তু ওতো রান্না করতে জানেনা। আগুনে ওর ফোবিয়া আছে তাই কখনও রান্না করার কথা কল্পণাতেও ভাবেনি। ওকে এভাবে চুপচাপ দেখে অরিন আবারও বলল,
> এই মেয়ে আমি ওখানে এতো কষ্ট করে রান্না করছি একটু সাহায্য করলে কি তোমার হাত ক্ষয় হয়ে যাবে? আসো আমার সঙ্গে।
পারভীন বেগম নিষেধ করলেন কিন্তু অরিন শুনলো না। নীলুর হাত ধরে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে আসলো। চুলায় গরম তেল ফুঁটছে। নীলু সেদিকে তাকিয়ে ঘনঘন ঢোক গিলল। গা ঘামতে শুরু করেছে সঙ্গে মাথায় যন্ত্রণা। অরিন ওর হাতে খুন্তি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
> যাও ওখানে মাছের টুকরো গুলো রাখা আছে ভেজে ফেলো। আমি সব রেডি করি।
নীলু কড়ায়ের দিকে তাকিয়ে মূহুর্ত্তের মধ্যেই ধপাস করে পড়ে গেলো। ডাইনিং রুমে জুনায়েদ কিছুক্ষণ আগেই এসে বসেছে। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে শব্দ আসার জন্য ও তাড়াতাড়ি উঁকি দিয়ে দেখলো নীলু মেঝেতে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। অরিন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে।
(চলবে)
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। সবাইকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
অসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।