#আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব : ১৮
গভীর রাতে নীলুর ঘুম ভাঙলো। জুনায়েদ ওকে জড়িয়ে নিয়েই বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর কিছুক্ষণ আগেই চোখ দুটো লেগে এসেছে তাই এভাবেই ঘুমিয়েছে। নীলু ঘুমের মধ্যে ওকে আকড়ে ধরে রেখেছে ছাড়েনি। আনোয়ার চাচা খাবার রেখে গেছেন। জুনায়েদ উঠতে পারেনি তাই খাওয়া হয়নি। নীলু ঘুম ভেঙে জুনায়েদের মুখটা দেখতে পেলো। ঘরে ড্রিম লাইটের আলো জ্বলছে। তবুও ছেলেটার মুখ দেখতে ওর অসুবিধা হচ্ছে না। খোচা খোচা দাড়িটা হঠাৎ মনে হচ্ছে একটু বেশি বড় হয়ে গেছে। সঙ্গে শোভা পাচ্ছে এলোমেলো চুল। পরিপাটি ফরমাল ড্রেসের চাইতে হয়তো এটাতেই লোকটাকে বেশি সুদর্শন লাগে। লোকটা যদিও ফরমাল ড্রেসে চলাফেরা খুব কম করে তবুও আজ একটু বেশিই এলোমেলো। কথাগুলো ভেবে ও জুনায়েদের কোমর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওর মুখে রাখলো। হঠাৎ মুখে কারো স্পর্শ পেয়ে জুনায়েদের ভ্রু কুকচে গেলো। ও সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ধরে নিয়ে চট করে চোখ মেলে তাকালো। নীলু হতভম্ব হয়ে মনে মনে খুব আফসোস করলো কি দরকার ছিল এই মাথামোটা লোকটার মুখে হাত রাখার। জুনায়েদের চোখেমুখে কৌতূহল। ও দ্রুত সোজা হয়ে নীলুকে ছাড়িয়ে বসাতে বসাতে বলল,
> তুমি ঠিক আছো? খুব সরি নীলু আমার কর্মফল তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আর এমন হবে না খুব সরি।
> সরি বললেই সব ঠিক হবে না। আমি কষ্ট পেয়েছি। আপনার গার্লফ্রেন্ড দিয়ে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন। আপনি আমাকে তিনমাস পরে চলে যেতে বলেছেন।। তবুও এসব হলো তার কি হবে? একটা বুদ্ধি দিতে পারি আপনাকে শুনবেন?
> হুম বলো।
জুনায়েদ মাথা নিচু করে আছে। নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জা পেতে হচ্ছে। কি দরকার ছিল এতো কঠোর হওয়ার। ওকে এভাবে চুপচাপ দেখে নীলু খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
> গ্রামে ফিরলে সবাই আজেবাজে কথা বলবে খুব খারাপ লাগবে।তারথেকে আপনি আমার আরেকটা বিয়ে দিয়ে দিন। দেখুন শুধু শুধু কোথাও গিয়ে থাকার চাইতে বিয়ে করে থাকাই ভালো হবে। আচ্ছা আপনার বন্ধুর কি জানি নাম ছিল যে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল?
নীলু এতক্ষণ ওর দিকে না তাকিয়ে কথা বলছিল হঠাৎ জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে ও চমকে গেলো। ওর দিকে রাগী একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে। নীলু ঢোক গিলে চোখ ফিরিয়ে নিলো। কাজ হয়ে গেছে। জুনায়েদ ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> আজ থেকে তুমি আর আমি এখানেই থাকবো। আব্বুরা যখন এই বাড়িতে আসবে তখন আমরা ওই বাড়িতে চলে যাবো। তোমার ক্লাস করা বন্ধ। পরীক্ষার সময় আমি নিয়ে যাবো। আজ থেকে তুমি আমার মুখ ছাড়া আর কাউকে দেখতে পারবে না। বুঝেছো?
জুনায়েদের এমন কথায় নীলুর হাসিখুশি মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এখন আরও আফসোস হচ্ছে কি দরকার ছিল শান্ত ছেলেটাকে অশান্ত করে তোলার। ইচ্ছে করে রাগাতে গিয়ে এখন সব দরজা বন্ধ। নীলু তবুও জোরকরে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> কি সব বলছেন? পড়াশোনার জন্য ক্লাসের দরকার আর বাবা মায়ের কাছে থাকালে সমস্যা কোথায়? আপনি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন বলে মনে হচ্ছে না?
> আমি ছোট থেকেই খুব হিংসুটে। নিজের নামে দেওয়া জিনিস গুলো কাউকে দিই না। সেখানে বউকে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। লোকজন বলবে জুনায়েদের প্রাক্তন বউ আরেকজন স্ত্রী। কখনও হবে না। আমি মারা গেলেও না। আমি প্রচণ্ড খারাপ, একটুও ভালো না। পচা তবুও তোমাকে আমার সঙ্গেই থাকতে হবে। তোমার উপরে এখন আমি বিরক্ত। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছি।
জুনায়েদ কথাটা বলে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে খাবার গুলো নিয়ে আসলো। নীলু চুপচাপ জুনায়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আগে কখনও ছেলেটাকে এভাবে দেখা হয়নি। আজ যখন আগুনের মধ্যে ছিল তখন ছেলেটাওকে রক্ষা করেছে। নীলু মনে মনে বদ্ধপরিকর এই ছেলেটা ওকে ছেড়ে দিলেও ও কখনও একে ছাড়বে না। এতদিন ওর জুনায়েদকে ভাবনা ছিল না। জুনায়েদ ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খাবার ওর মুখের সামনে ধরে বলল,
> সারাজীবন এই মুখটা দেখেই কাটাতে হবে। দেখার অনেক সুযোগ পাবে। আগে খেয়ে নিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।
নীলু চুপচাপ খাবার খেয়ে নিলো। জুনায়েদ ওকে খাওয়ানো শেষ করে বাইরে বেরিয়ে গেলো। আনোয়ার চাচার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাছাড়া বাড়িতে বলতে হবে ওরা এখানে আছে আর নীলু ঠিক আছে। ডাক্তার তীব্র ছেলেগুলার সঙ্গে কি করেছে জানা দরকার। কিন্তু এসব ঝামেলায় ওর নাম্বার নেওয়া হয়নি। সকাল ছাড়া দেখা করার উপায় নেই। জুনায়েদ আনোয়ার চাচার সঙ্গে কথা বলে রুমে আসলো। নীলু সেভাবেই বসে আছে। জুনায়েদ ফোন হাতে নীলুর পাশে গিয়ে বসলো। ও নজর ফোনের দিকে রেখে নীলুর কপালে হাত রেখে বলল,
> জ্বর তো নেই, ঘুম পাচ্ছে তোমার?
> না। আপনি ঘুমাবেন না?
> তুমি জানো ডাক্তার তীব্র এসেছিল তোমাকে যখন ওখান থেকে আনতে গিয়েছিলাম? কেমন জানি কৌতূহল হচ্ছে। লোকটা ওদেরকে কি করলো এটাও জানতে হবে। তুমি এখানে একা থাকতে পারবে আমি একটু দেখে আসি।
জুনায়েদ কথাটা বলতে দেরী নীলুর ওকে চিপকে ধরতে দেরি হলো না। ওকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> আমার খুব ভয় করবে । আপনি যাবেন না। আসুন ঘুমাবেন।
নীলু ওকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। ছেলেটার শরীর খারাপ ছিল নীলু বুঝতে পেরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জুনায়েদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। নীলু কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে আসলো বেলকনিতে। এখন ঘুম আসছে না। আকাশে অর্ধেক চাঁদ উঠেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস হচ্ছে।। এভাবেই রাত পার হলো।
সকাল আটটা বাজে জুনায়েদ বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে আসলো। নীলু চুপচাপ নিউজ দেখছে টিভিতে। নীলু হঠাৎ ওকে চিৎকার করে ডেকে উঠলো,
> এইযে দেখুন টিভিতে নিউজ হচ্ছে গতকালের ঘটনা নিয়ে কি সব বলছে।
জুনায়েদ ভয়ে ভয়ে টিভির সামনে বসলো। নিউজ চলছে,
“মেয়ে পাচার চক্রের একটা গ্রুপ আটক করা হয়েছে। গতকাল গভীর জঙ্গলে ওদের আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ, অস্ত্র আর মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে। পুলিশের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে কয়েকজন নিহত বাকিদের অবস্থা আশঙ্কাজনক”
জুনায়েদ হা করে দেখছে। কি হচ্ছে মাথায় ঢুকছে না। তবে যে ওরা জব্বার ফেঁসেছে এটা ভালো বুঝতে পারছে। একটা ভালো দিক হচ্ছে সেখানে নীলু বা জুনায়েদের নাম উল্লেখ নেই। পিউকে নিউজে দেখা যাচ্ছে না। আদো বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে কে জানে। জুনায়েদের জানার ইচ্ছাও নেই। নীলু হতাশ কন্ঠ বলল,
> আপনার গার্লফ্রেন্ডে তো ইন্নালিল্লাহ, কি হবে এখন?
জুনায়েদ ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
> বাচাল মেয়ে চুপ থাকতে পারো না? দেখলে ওই মেয়েটা এই ছেলেগুলার ভবিষ্যৎ কিভাবে অন্ধকার করলো? সবার জন্য খারাপ লাগছে। ওই মেয়েটার জন্য সব হয়েছে। একটা শিক্ষা হওয়া দরকার ছিল। একদম ঠিক হয়েছে আমি খুশি ওর জন্য। সব সময় কুটিল বুদ্ধি মাথায়।
জুনায়েদ রীতিমতো রেগেমেগে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। নীলু হতাশ এই ছেলের আচরণ দেখে তবে ও বেশ খুশী হয়েছে। জুনায়েদ হন্তদন্ত হয়ে গেটের কাছে আসতেই দেখলো ডাক্তার তীব্র দাঁড়িয়ে আছে। জুনায়েদ ভ্রু কুচকে এগিয়ে গিয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> আপনি এখানে? কিভাবে জানলেন আমরা এখানে এসেছি?
> আপনার বাসা থেকে জেনেছি। আন্টি বলল আপনি এখানে তাই নীলু ম্যাডামকে দেখতে এসেছি। চলুন দেখে আসি।
তীব্রর কথা শুনে মনে হচ্ছে গতকাল কিছুই হয়নি। জুনায়েদ কৌতূহল চাপিয়ে রাখতে না পেরে বলল,
> ডাক্তার আপনি ওদের সঙ্গে কি করেছেন? পিউ কোথায়?
> আপনাকে এটা বলতেই আরও এসেছি। আসলে আপনারা চলে আসলে আমিও চলে এসেছি কারণ সেখানে পুলিশ এসে গিয়েছিল সবকিছু ওরাই করেছে। আমি কিছুই করিনি।
কথা বলতে বলতে ওরা বাড়িতে প্রবেশ করলো। জুনায়েদ নীলুকে ডেকে নিলো। তীব্রর কথাবার্তা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না তেমন। জুনায়েদ কিছু একটা ভেবে ফট করে জিঞ্জাসা করলো,
> ডাক্তার আপনি সেখানে কি করতে গিয়েছিলেন এটা ঠিক ক্লিয়ার না।
> আমি ওই রাস্তায় যাচ্ছিলাম হঠাৎ আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে পিছু নিয়েছিলাম।কাকতলীয়ভাবে দেখুন না আপনাদের বিপদে ঠিক পৌঁছে গেলাম। যাইহোক এতো প্রশ্ন না করে বসতে তো বলুন।
জুনায়েদ এতক্ষণে খেয়াল হলো লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। ও লোকটাকে বসতে দিয়ে নিজেও নীলুর সঙ্গে বসে পড়লো। বেশ কিছু সময় ওদের গল্প চলল। তীব্র লোকটা নীলুর দিকে কেমন শীতল চাহনিতে তাকিয়ে আছে। জুনায়েদ মাঝেমাঝেই বুঝতে পারছে। তবে লোকটার সমস্যা কি ওর বুঝে উঠতে সমস্যা হচ্ছে। হঠাৎ জুনায়েদ বলল,
> ডাক্তার আজ আপনার হাসপাতালে নেই?
জুনায়েদের কথা শুনে লোকটার এতক্ষণে হাসপাতালের কথা মনে পড়লো। উনি আর বসলেন না হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। নীলুও রুমে যাবার জন্য ছুটলো। দুপুরে আনোয়ার চাচা রান্না করে দিয়ে গেলেন। জুনায়েদ নীলুকে রেখে অফিসে গিয়েছিল একটা মিটিং ছিল। ও বিকালে ফিরে এসেছে। নীলু সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। শরীর বেশ ক্লান্ত। জুনায়েদ ওর আশেপাশের থাকার চেষ্টা করেছে। রাতে খাবার খেয়ে দুজনে ঘুমাতে গেলো। জুনায়েদের ঘুম পাচ্ছে না ও ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে আছে। নীলু একপা দুপা করে জুনায়েদের পাশে গিয়ে বসলো। ওকে এভাবে বসতে দেখে ও ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল,
> শুনো আগামীকাল থেকে ওসব শাড়ি টারি আর পড়বে না। আমি তোমার জন্য কিছু ড্রেসের অর্ডার করেছি।
> শাড়ি পড়লে সমস্যা কোথায়? আচ্ছা স্মার্ট হওয়াটাই কি মূখ্য বিষয়? মনের কোনো গুরুত্ব নেই?
> নীলু তুমি শাড়ি পড়তেই জানোনা আবার শাড়ি নিয়ে কথা বলছো। এভাবে কলাগাছ জড়িয়ে থাকলে তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে। দরকার হলে খুব সাধারণ পোশাক পড়ো তবুও শাড়ি পড়তে যাবেনা প্লিজ।
নীলু মুখ ভার করে ফেলল। শাশুড়ি আম্মা বলেছিল ছেলের মন পেতে হলে শাড়ি পড়ে সামনে সামনে ঘুরতে হবে কিন্তু উনার ছেলে তো শাড়ি দেখলে হাইপার হয়ে যায়। নীলুকে এভাবে ভাবতে দেখে জুনায়েদ এক হাত দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিলো। নীলুর দৃষ্টি জুনায়েদের দিক কিন্তু ছেলেটা ল্যাপটপের দিকেই তাকিয়ে আছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো নীলু মুখটা জুনায়েদের কাধের দিকে এগিয়ে নিলো। ওর নিশ্বাস জুনায়েদের কাধে আছড়ে পড়ছে। জুনায়েদ ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালো।কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটার ঠোঁট ওর গলাতে গভীরভাবে বিচরণ করছে। জুনায়েদ হতভম্ব মেয়েটার আচরণ দেখে। ওর শরীর কাপছে তবে বুঝতে পারলো না এটা ভয় নাকি আতঙ্ক। নীল এবার নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ওর কাধে নিজের ধারালো দাঁত বসিয়ে দিলো। জুনায়েদ আস্তে করে চিৎকার দিয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়লো।
(চলবে)
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।