আলোছায়া পর্ব-২৪

0
1770

আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৪

অভ্র জুনায়েদের বাবা সৈয়দ সাহেবের বন্ধুর ছেলে। ওরা বহুকাল গ্রামে ছিল অভ্র সপ্তাহ দুয়েক শহরে ফিরেছে। মিসেস পারভীন ছেলেটাকে বেশ পছন্দ করেন। কয়েকবার দেখা হয়েছে এর মধ্যেই কেমন আপন হয়ে উঠেছে। জুনায়েদ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। নিজের মতো থাকে। নীলু ছেলেটার উপরে বেশ বিরক্ত হচ্ছে তবুও কাউকে কিছু বলতে পারছে না।অন‍্যদিকে আয়ানার সঙ্গে তীব্র আসতে চেয়েছিল শেষমেশ হাসপাতালের একটা কাজে তাকে বেরিয়ে যেতে হলো। পারভীন বেগম শুভ্রর কথা বিবেচনা করে অভ্রকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়েন। ছেলেটা প্রচণ্ড মুখচাপা স্বভাবের। কিন্তু নীলু পড়েছে ঝামেলায়। আসার আগে তেমন কিছু না ভাবলেও এখন বুঝতে পারছে কতটা ভুল হয়েছে। নীলু কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সামনে এগিয়ে চলেছে। চারদিকে লোকজন দেখে মনে হচ্ছে দেশ সত্যিই সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে। কারো কোনো অভাব অভিযোগ নেই। মানুষ এত শপিং কিভাবে করতে পারে আল্লাহ্ জানে। ও দুই কাপড়ে অনায়াসে বছর কাটিয়ে দিতে পারে। গ্রামে থাকতে এটাইতো করত। প্রয়োজন ছাড়া কখনও কেনাকাটার কথা ভাবেনি। অভ্রর কথায় ওর ধ‍্যান ভাঙলো।

> চলো ঘুরতে যায় ওই নীল আকাশে। যেখানে দিগন্ত ছুয়েছে সীমান্তে।

> আপনার হৃদয়ের অনুভূতি একদিন শুকিয়ে যাবে। হৃদয় হাহাকার করে গুমরে কাঁদবে কেনো বলুন তো?

> কেনো?

> আপনার এই মাত্রাতিরিক্ত বচন প্রয়োগের জন্য। আমি বিবাহিত তাছাড়া আমি মুসলমান। নিকৃষ্ট হালালের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। স্বামীকে ত‍্যাগ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

> ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঁচতে পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না। তাছাড়া প্রাকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ করেছো তুমি। মানুষের সঙ্গে কেমনে কি?

> জীবন বাঁচানো ফরজ আর আমি সেটাই করছি। আর আমাকে নিয়ে আপনার এতো ভাবতে হবে না। আমি বুঝে নিবো।

> কি বুঝবে শুনি?
অভ্র নীলুর হাত নিজের মুঠোয় বন্ধী করে নিলো। নীলু রাগে ফুসছে। আয়ানা আর শুভ্র সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। এখানে ঝামেলা হলে সবার দৃষ্টি নীলুর দিকে পড়বে এটা ও চাইছে না। নীলু যথাযথভাবে চেষ্টা করছে হাত ছাড়িয়ে নিতে হঠাৎ পেছনে থেকে কেউ একজন নীলুর হাত ছাড়িয়ে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,

> বেয়াদবি করছো কেনো?

নীলু চমকে উঠেছে। অভ্র থতমত খেয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল,

> ব্রো আসলে আমি ভাবিকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম অনেক ভীড় তো তাই। তুমি কখন আসলে? আন্টি যে বলল আসবে না?

জুনায়েদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

> না আসলে বুঝি আমার বউয়ের হাত ধরে আরও কিছুটা টানাটানি করতে পারতে? প্রথমবার তাই ছেড়ে দিয়েছি দ্বিতীয়বার কিন্তু ক্ষমা করবো না।

নীলুর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে জুনায়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে। অভ্র দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। জুনায়েদ গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> কাজের বেলায় অষ্ঠড়ম্ভা। লোকজনকে ধরে ধরে তক্তা বানিয়ে খাট তৈরী করা হয় আবার যেখানে সামান্য থাপ্পড় দরকার সেখানে চুপচাপ, বাহ কি বুদ্ধি। এরকম বউ বাংলার ঘরে ঘরে দরকার। থাকলে বুদ্ধিজীবীর সংকট কমে যেতো বাংলাদেশের থেকে।

নীলু নিচু কন্ঠে বলল,

> আমি ভদ্রলোকের বউ। লোকজনের সামনে রাস্তাঘাটে মারামারি করিনা।

> মাথায় জৈব সারের উৎপাদন দেখি বেশ হয়েছে। গবরে কাজ দিচ্ছে।

নীলু জুনায়েদের কথার মানে বুঝতে পারলো না তবে বুঝে নিলো ওকে ঘোর অপমান করা হচ্ছে। ও মুখ ফুলিয়ে বলল,

> আপনি না জেনে আমার উপরে রাগ দেখাতে পারেন না।

জুনায়েদ চুলগুলো সামনে থেকে পেছনে আঙ্গুল চালিয়ে ঝাড়ি দিয়ে বলল,

> আমি কি পারি আর কি পারিনা তোমাকে নিশ্চয়ই দেখাবো একদিন।

কথাটা শেষ করে ও নীলুর হাত ধরে টানতে টনতে ভেতরে নিয়ে গেল। শুভ্র আরিয়াকে নিয়ে শপিংমলের ভেতরে একটা কফিসপে বসে ছিল। জুনায়েদ ওদের সামনে নিলুর হাত ছাড়ে দিয়ে চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লো। শুভ ভ্রু কচকে ওকে দেখলো। মনে হলো ভয়ানক কিছু দেখছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ও উত্তেজিত হয়ে বলল,

> আমার মিটিংয়ের বারোটা বাজিয়ে তোকে আসতেই হলো? ভাই তুই এটা করতে পারলি?

জুনায়েদ ভাইয়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে উত্তর করলো,

> হাইপার হবার মতো কি হয়েছে?। বাংলা সিনেমার সাবানা ম‍্যাডামের মতো ডাইলগ দিচ্ছিস কেনো?

শুভ্র ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি এনে বলল,

> তুই বুঝতে পারচ্ছিস কি বলছিস? মিটিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাছাড়া এখানে আসবি আগে বললি না কেনো আহাম্মক?

জুনায়েদ আয়ানার দিকে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল,

> ভাবি একবারও কি বলেছি আমি মিটিং না করে এসেছি? এর দায়িত্ব নিয়ে তোমার অবস্থাও আমার মতো হবে আমি নিশ্চিত। ওকে বিয়ের আগেই ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করে নাও লাভ হবে।

জুনায়েদের শেষের কথাগুলো শুনে নীলুর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। রেগেও মানুষ রসিকতা করতে জানে একে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। আয়ানা মিষ্টি হেসে কফির মগে মুখ ডুবালো। এদের দুভাইকে ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। প্রথমে মনে হয়েছিল এদের সম্পর্কটা তেমন ভালো না কিন্তু তেমনটা না। এদের মধ্যে যথেষ্ট ভালোবাসা আছে তবে নরমাল না। কিছুটা লুকোচুরি আছে। আয়ানাকে হাসতে দেখে জুনায়েদ ভ্রু কুচকে বলল,

> আমি সিরায়াস কিন্তু।

আয়ানা কয়েকবার চোখের পাপড়ি নেড়ে বলল,

> আমিও সিরিয়াস। কবে করবে বিয়ে এখন? আমি অল টাইম রেডি আছি শুধু একবার নাম ধরে ডেকো চলে আসবো।

শুভ্র এদের কথাবার্তা শুনে ভড়কে গেলো। ও বুঝতে পারলো জুনায়েদ সহজে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে তাই ওকে সবাই একটু বেশিই পছন্দ করে অথচ ও দেখতে বরাবর বেশি সুন্দর আর স্মার্ট তবুও সবাই ওর থেকে দূরে থাকে। জুনায়েদ ওকে ভাবতে দেখে বলল,

> আমি নীলু নিয়ে গেলাম। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।

শুভ্র কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। জুনায়েদ দ্রুতগতিতে নীলুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। অভ্র চুপচাপ বসে আছে। মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ তবুও শান্ত থাকার অভিনয় করতে হচ্ছে।

নির্জন রাস্তার পাশে জুনায়েদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে নীলু আর জুনায়েদ আছে। জুনায়েদ এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,

> লুকোচুরি অনেক হয়েছে এবার সময় হয়েছে সব ক্লিয়ার করে বলো। সাহায্য করতে না পারি কখনও বাধা হবো না। বিশ্বাস রাখতে পারো।নাকি আমাকে বিশ্বাস করা যায়না?

জুনায়েদের কথা শুনে নীলু দৃষ্টি ঘুরিয়ে জুনায়েদের চোখে রাখলো। ছেলেটা অভিমান করেছে। ভালোবাসার মানুষের উপরে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায় না। নীলু কি একটা ভেবে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। জুনায়েদ ওকে কাঁদতে দেখে চোখ বন্ধ করে বলল,

> বলতে হবে না। তুমি তোমার মতো থাকো। আমার ভূল হয়েছে তোমার থেকে সত্যি জানার চেষ্টা করে। কান্না থামাও।

নীলু শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে কান্না থামালো। ভেতর থেকে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু থামছে না। কন্ঠ ভার হয়ে আছে। তবুও ও থমথমে কন্ঠে বলল

> আপনাকে আমি সবটা বলতে চাই। আজ না বললে হয়তো কখনও আর বলা হবে না।

> বলো কি বলবে।

> জুনায়েদ আমি আপনারদের মতো সাধারণত মানুষ না।

> সে আমি জানি। তোমার ব‍্যবহার দেখেই বুঝেছি মহারানি ভিক্টোরিয়া।

> মজা করছি না। সত্যি বলছি। আমি পরী সম্প্রদায়ের একজন। পৃথিবীতে আমরা অনেক বছর আগে এসেছি। আর এখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি। না নিয়ে উপায় ছিল না। আমাদের গোত্রের মূল‍্যবান স্টোন যেটা উত্তরাধিকারসূত্রে আমি পেয়েছি ওটা আমি হারিয়ে ফেলেছি সঙ্গে ক্ষমতা।

নীলু এই পযর্ন্ত এসে থামলো। জুনায়েদের মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। নীলু আবারও শুরু করলো,

> আপনার বাবা মায়ের সঙ্গে আমার বাবা মায়ের পরিচয় হয়েছিল কিছু বছর পূর্বে। একটা গাড়ি দুর্ঘটনা থেকে আমার বাবা আপনার বাবা মাকে সাহায্য করেছিল। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। আপনার বাবা আমাকে দেখে নিজের ছেলের জন্য আব্বুর আছে চেয়েছিলেন। উনি তো জানেন না আমাদের পরিচয়। আমার বাবাও কোনো কিছু না ভেবে কথা দিয়ে ফেলেন। তাছাড়া তখন আমি হন্যে হয়ে স্টোন খুঁজে চলেছি। বাবার কথা রাখতে আর স্টোন উদ্ধার করতে আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। আপনার বিষয়ে আমি সব জানতাম। পিউয়ের সঙ্গে সম্পর্কটাও। তবুও কিছু করার ছিল না।

> আচ্ছা স্টোন দিয়ে কি হবে? ক্ষমতা কমে গেছে এতো কি তোমাদের কোনো সমস্যা হয়েছে? সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করো।

> স্টোন উদ্ধার না হলে আমি বিশ বছরে পা রাখলে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাবো। কখনও আর জাগ্রত হতে পারবো না। আমার শরীর বিলীন হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিবার চিরকাল নিজেদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। পৃথিবীতে আটকে পড়বে।

জুনায়েদ দ্রুত নীলুকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত রাখলো। বুকটা কেঁপে উঠেছে ওর কথা শুনে। জুনায়েদ ওকে হারিয়ে যেতে দিবে না। নীলু ওর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

> আমার শত্রু পক্ষ চাইছে না আমি স্টোন খুঁজে পাই। ওরা আপনার উপরেও এটাক করেছিল। সেদিন রাতে যখন আপনি জঙ্গলের পাশে বসে ছিলেন তখন আমি আপনাকে রক্ষা করেছিলাম। তাছাড়া আমার গোত্রের লোকেরাও বিরোধিতা করছে আমি আপনাকে বিয়ে করেছি তাই। আমাকে যারা সাহায্য করছিল ওরা আমার বিপক্ষে। কয়েকজন ছাড়া।

> তোমাকে সাহায্য করছিল মানে? আচ্ছা সেদিন রাতে যখন তোমাকে নিয়ে আমি ওই লোকদের কাছে রেখে এসেছিলাম তুমি কিভাবে এসেছিলে?

> আমার সব ক্ষমতা হারিয়ে যায়নি। আমি মূহুর্ত্তের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করতে পারি। আপনি রেখে আসলে আমি চলে আসেছিলাম। আমার বন্ধুরা ছিল ওরাই ওদেরকে মেরে ঘটনা অন‍্যভাবে চালিয়ে দিয়েছিল। আমরা ওই খারাপ লোকদের কাছেই স্টোনের অর্ধেক খবর জেনেছিলাম তাই আপনার উপরে রাগটা আমার কম ছিল। আমি হঠাৎ হঠাৎ ঘুমিয়ে যায় এটা আপনার পছন্দ না তবুও কিছু করার ছিল না। তাছাড়া প্রথমে আপনাকে আমি ততটা গুরুত্ব দেয়নি। একটু একটু করে সব হয়েছে।

জুনায়েদ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটাকে খুন করতে চেয়েছিল ভেবেই মনটা কেমন নিভে যাচ্ছে। সেদিন যদি নীলু সাধারণ মানুষ হতো সত্যি সত্যি খুন হয়ে যেতো কি ভয়ানক ব‍্যাপার হতো। জুনায়েদ এলোমেলো ভাবছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই ও চোখ সরিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। বাসা থেকে ফোন এসেছে ওদেরকে দ্রুত বাড়িতে ফিরতে বলা হয়েছে। নীলুর বাবা মা এসেছে।

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। অসুস্থ ছিলাম তাই লিখতে পারিনি। গল্পটা আর এক পর্বে শেষ করবো ইনশাআল্লাহ।

অসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here