#আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
অন্তিম পর্ব
আলো ঝলমলে ছোটখাট প্রায় অট্টালিকার সামনে এসে গাড়ি থামলো। জুনায়েদ নীলুকে নিয়ে নেমে আসলো। নীলুর চোখেমুখে ভয়, গলা শুকিয়ে আসছে। মিথ্যা অভিনয় করাটা বেশ কঠিন। যখন তখন সত্যিটা সামনে চলে আসতে পারে সেই ভয়ে শরীরের সমস্ত লোমকূপ খাড়া হয়ে যাচ্ছে। এমন বাজে অনুভূতির সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ঘটেনি। জুনায়েদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> যুদ্ধে নামার আগেই পরাজিত সৈনিকের মতো আচরণ করছো। নীলু শান্ত থাকতে হবে ভয় পেলে চলবে না। তাছাড়া অতিরিক্ত কিছু করবে না। জাস্ট টুকটাক কথা বলবে। হাত ধরতে যাবে না। হাসতে মানা নেই তবে সাবধান কিছুতেই শব্দ করে হাসবে না। ঠিক আছে?
নীলু ভ্রু কুচকে বলল,
> বউকে নিয়ে বেশ সচেতন তবুও এসবের দরকার ছিল?
> তোমার জীবনের প্রশ্ন না হলে কখনও এমন করতাম না। শুনো বকবক বন্ধ করো আর আমার সঙ্গে চলো। আমার হাত ধরবে না। ওকে বোঝাতে হবে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নেই।
> খারাপ আচরণ করতে পারবো না। আমি ওসব পারিনা।
> জানি।
জুনায়েদ সামনে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গিয়ে নীলুর হাতটা নিজের মুঠোয় পুরে নিলো। নীলু থতমত খেয়ে কিছু জিঞ্জাসা করতে চাইলে কিন্তু জুনায়েদ ওকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে নীলুর খোলা চুলে চুমু দিয়ে বলল,
> সাবধানে থাকবে। তোমার জন্য টেনশন হচ্ছে। ওর থেকে দুরুত্ব মেনে চলবে।
জুনায়েদ কথাটা শেষ করে দ্রুত ওকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে সামনে চলে গেলো একটুও পেছনে তাকালো না। নীলুর চোখ ছলছল করছে। ভয় কিছুটা কমেছে। আগে কখনও এমন ভয় করেনি। আজ কেনো এমন হচ্ছে কে জানে। নীলু কথাগুলো ভেবে ভেতরে চলে গেলো। জুনায়েদকে দেখা গেলো বেশ কিছু মেয়েদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নীলু ধীরগতিতে চুপচাপ এগিয়ে যেতেই হঠাৎ তীব্রের সামনে গিয়ে পড়লো। ছেলেটা হাসি মুখে ওকে বলল,
> একা কেনো? সেই মহান নায়কের কি খবর?
তীব্রের কটাক্ষ শুনে নীলুর রাগ হলো তবুও শান্ত থেকে মিষ্টি হেসে বলল,
> তুমি হয়তো ভূলে যাচ্ছো সে আমাকে পছন্দ করেনা। যদি পছন্দ করতো তাহলে অবশ্য খুন করতে চাইতো না?
> এই জন্যই বলেছিলাম এসব মনুষ্যত্বহীন মানুষের সঙ্গে তুমি থেকো না। আমার কথায় শুনছো না। ওকে ছেড়ে আমাকে বিয়ে করো। আমি তোমার সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবো। তুমি মানতেই চাইছো না। আগে তো এমন ছিলে না।
> আমি তোমাকে কখনও সেভাবে ভাবিনি।ভাই হিসেবে জেনেছি। হঠাৎ মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। আশাকরি দিনদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
> তার মানে আশাকরতে পারি?
নীলু হাসিটা প্রসস্ত করে বলল,
> কেনো না? আমার রাজ্যের জন্য উপযুক্ত লোক রেখে সাধারণ মানুষকে কেনো মেনে নিব? তাছাড়া আমার পরিবারের ভালো চাই আমি।
> নীলিমা তুমি এতোদিনে সব বুঝতে পেরেছো তাহলে? আমি তোমার উপরে সন্তুষ্ট হয়েছি।
> আমি আগে থেকেই বুঝেছি।তবে মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করতে হলে ওদের মতোই আচরণ করতে হয় বুঝলে?আচ্ছা এসব ছাড়ো, চলো ঘুরে আসি। তুমি জানো শব্দে আমার সমস্যা হয়?
তীব্র কিছু একটা ভেবে রাজি হয়ে গেলো। চোখের পলকে দুজন গায়েব। জুনায়েদ ওদের গতিবিধি সব কিছুই লক্ষ করছিল। ওদেরকে না দেখে ও আর সময় নষ্ট করলো না। দ্রুতগতিতে আয়ানাদের বাড়ির মধ্যে চলে গেলো। বাইরে অনুষ্ঠান চলছে তাই বাড়ির ভেতরে কেউ নেই। জুনায়েদ সময় নিয়ে তীব্রর রুম খুঁজে ভেতরে ঢুকে পড়লো। রুমটা বেশ বড় তবে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা। বেলিফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগছে। জুনায়েদ সময় নষ্ট না করে বিছানার চাদর তুলে,টেবিলের ড্রয়ারগুলো চেক করলো সেখানে তেমন কিছুই নেই। আলমারির চাবি বালিশের নিচে ছিল জুনায়েদ চাবি নিয়ে আলমারি খুঁলে ফেলল। পোশাক, দামি ঘড়ি আর কিছু ফাইল ছাড়া নজরে কিছুই পড়ছে না। জুনায়েদ সব কিছু দেখলো। বেশ আশা নিয়ে এখানে এসেছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব ব্যর্থ হবে। বাথরুম পযর্ন্ত চেক করলো কিছুই পাওয়া গেলো না। জুনায়েদ বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। হাতে ফোনের টর্চ লাইট জ্বলছে। রুমে বেলি ফুলের গন্ধের উৎস পেয়ে গেছে। বেলকনিতে বড় একটা টবে গাছ লাগানো আছে। জুনায়েদ লাইট ধরে গাছটা এমনিতেই দেখলো। ফিরে আসার সময় হঠাৎ একটা ফুলের দিকে ওর নজর পড়লো। সবগুলো সাদা ফুলের মধ্যে একটা গাঢ় নীল রঙের ফুল। মনে হচ্ছে ফুলটা কেমন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। জুনায়েদ লাইট বন্ধ করলো কিন্তু ফুলের ঝলমলে আলো বন্ধ হলো না। জুনায়েদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজের ডান হাতটা ফুলের উপরে রাখতেই চারদিকে আলোকিত হয়ে ওর হাতের মধ্যে কিছু একটা চলে আসলো। এতো আলোর জন্য ওর চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম। কিছু সময় এভাবেই পার হলো। জুনায়েদ মিটমিট করে চোখ খুলে অবাক হয়ে গেলো। সঙ্গে খুশীও হয়েছে। কারণ হাতের উপরে নীল স্টোনটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। জুনায়েদ হাতের মুঠো বন্ধ করে ফেলল। পাথরটা থেকে বাইরে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে তাই এটাকে লুকিয়ে রাখতে হবে ভেবে শক্ত করে হাতের মুষ্টি বন্ধ করে রেখেছে। এখনে আর এক মুহূর্তেও অপেক্ষা করা যাবে না ভেবে বেরিয়ে পড়লো। ও মনে মনে নীলুকে স্মরণ করছে।
অন্যদিকে তীব্র নীলুকে নিয়ে সমুদের তীরে হাটছিল। সমুদের ঢেউ পায়ের উপরে আছড়ে পড়ছে। ঝড়ো হাওয়া বইছে। দুজনে নানারকম কথাবার্তা বলছিল এতক্ষণ। তীব্র বেজায় খুশী নীলুকে পেয়ে কিন্তু ওর খুশীটা বেশিক্ষণ থাকলো না। ও হঠাৎ মুখ কঠিন করে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীলু জিঞ্জাসা করলো কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা। তীব্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুটকরে বলল,
> আমাকে ফিরতে হবে। এমন হবার কথা ছিল না তবুও কেনো হলো? নীলু তুমি আমার সঙ্গে চালাকি করেছো তাইনা? কাউকে ছাড়বো না আমি। সবাইকে মেরে ফেলবো।
তীব্র অদৃশ্য হয়ে গেলো। নীলুও জুনায়েদের কথা ভেবে চোখের পলকে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলো।ও কয়েক মিনিটের মধ্যে জুনায়েদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। নীলুকে দেখে জুনায়েদ ওকে দুহাতে আগলে নিয়ে বলল,
> তুমি ঠিক আছো?
> একদম। স্টোন পেয়ে গেছেন তাইনা?
> পেয়েছি তবে এখানে থাকা যাবে না। ও ঠিক পেলে সমস্যা হবে চলো পালিয়ে যায়।
নীলু শান্ত হয়ে জুনায়েদের মুখে হাত রেখে বলল,
> ওর আর কোনো ক্ষমতা হবে না আমাদের কিছু করার। স্টোন তার উত্তরাধিকার পেয়ে গেছে। কেউ ইচ্ছে করলেও আর স্টোন নিয়ে টানাটানি করতে পারবে না বুঝলেন ?
> আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
>গাড়িতে উঠেন আপনাকে বুঝিয়ে বলবো।
জুনায়েদ নীলুকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। গাড়ি আজ বাড়ির পথে না চলছে নদীর তীরে। নীলু জুনায়েদের কাধে মাথা রেখে বলল,
> আমি তখন অবিবাহিত আবার স্টোনের অযোগ্য ছিলাম সেই সময়ে স্টোনটা পেয়েছিলাম। স্টোন পেয়ে আমি পৃথিবীতে আসি তখন এক তান্ত্রিক আমাকে আটকে স্টোনটা কেড়ে নিয়েছিল। বহুকষ্টে মুক্তি পেয়েছিলাম কিন্তু আমার স্টোন হারানোর জন্য বাবা মা সবাই পৃথিবীতে চলে আসে। তখন থেকে যুদ্ধ শুরু। কোথায় না খুঁজেছি আমি আর আমার পরিবার। সন্দেহ হয়েছে এমন সবাইকে মেরেছি। খারাপ মানুষকে দেখলেই পিটাতাম। খোঁজ পাইনি। আপনার সঙ্গে বিয়ে হলো সেসব তো জানেন।
নীলু চুপ করতেই জুনায়েদ বলে উঠলো,
> স্টোন আমার পকেটে তুমি নিবেনা?
> আপনার কাছেই রাখেন । স্টোন এখন আর চুরি হবে না।
> হেয়ালি করোনা। বিস্তারিত বলো আমি শুনতে চাইছি।
> আপনি আমার স্বামী সেই হিসেবে স্টোন আপনার পাওয়া হয়ে গেছে। যদি আপনার মনে লোভ থাকতো তাহলে এই স্টোন আপনি দেখতে পেতেন না। কথাটা আমি আপনাকে আগে বলিনি এটা আপনার পরীক্ষা ছিল। স্টোন নিজের মালিককে দেখে অদৃশ্য থেকে দূশ্যমান হয়ে জ্বলে উঠেছে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। তীব্র এটাকে নিজের ক্ষমতাই ফুল বানিয়ে রেখেছিল। যখন আমার দাদু এই স্টোন আমাকে দিয়েছিল তখনই উনি বলেছিলেন আমার বিয়ের পরে স্টোন সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে যাবে। সে যদি ভালো মনের হয় তবে স্টোন তার হবে। তাছাড়া এটা আমার কাছেই থাকবে।
> বাহ আমি তো দেখি সৌভাগ্যবান হয়ে গেলাম। রাজকন্যা সঙ্গে রাজত্ব। যাইহোক তোমার স্টোনের দরকার নেই আমার। আমি তোমাকে সারাজীবন পাশে চাই।
জুনায়েদ নীলুকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল,
> এবার কি করবে?
> আপনার সঙ্গে প্রেম করবো। এতোকিছু হয়ে গেলো প্রেম ট্রেমের সুযোগ পেলাম না।
> অভ্র আর তীব্রর ব্যাপারটা?
> আপনার কি মনে হয় স্টোন পেয়েছি এটা কেউ জানেনা? সবাই বুঝতে পেরেছে।
> কিভাবে?
> ক্ষমতা পেয়েছে তো। বলেছিলাম না এর জন্য সবাই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। অভ্র লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে এতক্ষণে। আর তীব্র ওকে আমি কঠিন শাস্তির দিবো।
নীলুর চোখে আগুন জ্বলছে। জুনায়েদ ওর মাথায় হাত
রেখে বলল,
> শান্ত হও। ওকে শাস্তি দিতে হলে ফিরতে হবে তো।
> ওর পরিধি আমার জানা আছে। আমার রাজ্যে বসবাস করে আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে্ ওর শাস্তি মৃত্যুতে শোধ হবে। সবাইকে আইন মানতে হবে।
>আমি ও কিন্তু তোমাকে খুন করতে চেয়েছিলাম। তুমি আমাকে শাস্তি দিবে না?
> পেয়ে যেবেন। জুনায়েদ আমরা সহজে কারো প্রেমে পড়িনা যদি একবার পড়ি তবে তাকে কখনও ছাড়িনা।আপনি আমাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মেয়ের দিকে তাঁকাতে পারবেন না। আপনি বিরক্ত হয়ে যাবেন। এটাই আপনার শাস্তি।
জুনায়েদ সরল মুখ করে বলল,
> এটা আবার কেমন কথা?
> এটাইতো কথা। এতোদিন আপনাকে একটুও বিরক্ত করিনি। এবার দেখবেন। চলুন বাড়িতে ফিরে যায়। সব সমস্যার তো সমাধান হলো।
> আচ্ছা এই স্টোন দিয়ে আমার কি কাজ বললে না তো?
> এর সাহায্যে আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের রাজ্যে যেতে পারবেন। আপনার ইচ্ছে পূরণ করবে এই পাথর। আপনি যখন যা চাইবেন পাবেন। তান্ত্রীক এটার লোভেই আমার থেকে এটা কেড়ে নিয়েছিল। কিন আফসোস এই পাথর তখন সাধারণ পাথরের মতোই ছিল। আপনার হাতে পড়ে এর কার্যকারিতা প্রকাশ পেয়েছে।
> তোমার লাগবে না এটা?
নীলু জুনায়েদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
> আপনি আর আমি কি আলাদা নাকি? আপনি মানেই তো আমি। এসব ছেড়ে বাড়িতে চলুন। শুভ্র ভাইয়ার বিয়েতে মজা করবো না?
জুনায়েদ ওর কাধে থুতনি রেখে বলল,
> চলো।
জুনায়েদ নীলুকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। নীলু জুনায়েদের কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। জুনায়েদ ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে নিজের ঠোঁট পরিস্কার করে বাঁকা হাসলো। ওর চোখ দুটো হঠাৎ নীল বর্ণ ধারণ করছে। আকাশে পূর্ণীমার চাঁদ উঠেছে। চারদিকে জোছনা ছড়িয়ে পড়ছে। দূর থেকে নিশাচর পাখির ডাক ভেসে আসছে। নীলু এখনো চোখ খোলেনি। জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে আবারও খুললো। চোখে রঙ বদলে ধীরে ধীরে লাল বর্ণ নিচ্ছে। জুনায়েদের ঠোঁটে আজ হাসি লেগেই আছে। মনে হচ্ছে বহু কাঙ্ক্ষিত কোনো বস্তু প্রাপ্তি ঘটেছে।এই হাসির অর্থ সে ছাড়া কেউ জানে না। জানতেও পারবে না। আলোছায়ার এই খেলা চলছে আর আগামীতেও চলবে।
সমাপ্ত
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। এতোদিন যারা পাশে ছিলেন সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। জানিনা গল্পটা কেমন হয়েছে। ভুলত্রুটি থাকলে জানিয়ে দিবেন শুধরে নিবো ইনশাআল্লাহ।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।