#আলোছায়া
কলমে : লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব: ৬
জুনায়েদ পিউরে হাত ধরে বসে আছে। মাথার উপরে ঘটঘট শব্দ করে ফ্যান চলছে। শব্দটা খুব বিরক্ত করছে। ওর ইচ্ছে করছিল ফ্যানটা বন্ধ করে রাখতে। কিন্তু করা যাবে না। হাসপাতালের মশা মাছি গুলো পিউয়ের উপরে ঝাপিয়ে পড়বে। জুনায়েদ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। এভাবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলো। হঠাৎ হাতে টান পড়াতে ও সোজা হয়ে বসতেই দেখলো পিউ নড়াচড়া করছে। ও ভ্রু কচকে তাকিয়ে খুশী হয়ে বলল,
> তুমি ঠিক আছো?
পিউ ওর ডাকে সাড়া দিল না। তবে তাকিয়ে থাকলো। জুনায়েদ আবারও বলে উঠলো,
> এগুলো করা ঠিক হয়নি। তোমাকে কতবার বললাম আমি নিজেই কিছু করবো তুমি শুনলে না। তোমাকে পিটাতে মন চাইছে। খুব রেগে আছি আমি।
পিউ এবার ছোটছোট করে বলল,
> বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু করতে চাইনি। কি থেকে কি হলো বুঝতে পারলাম না। মেয়েটা কিভাবে জানি বেঁচে…..
পিউ বাকিটা বলতে পারলোনা ওর বাবা এসে হাজির। মেয়েকে কথা বলতে দেখে উনার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। ভদ্রলোককে আসতে দেখে জুনায়েদ উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। উনি মেয়ের কাছে বসে ছলছল চোখে বললেন,
> ওকে তুই পছন্দ করিস আমাকে বললে কি এমন ক্ষতি হতো? কখনও তোর চাওয়া অপূর্ণ রেখেছি? তোর কিছু হলে আমাদের কি হতো? চিন্তা করিস না মা। আমি আজকের মধ্যেই জুনায়েদের বাবার সঙ্গে কথা বলবো তোদের বিয়ে নিয়ে ।
বাবার এমন কথায় পিউ যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। খুশীতে চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। উনি মেয়েকে রেখে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। উনি বাইরে যেতেই জুনায়েদ ওকে বাকি কথা জিঞ্জাসা করলো কিন্তু পিউ আর বলল না। এড়িয়ে গেলো। না চাইতে অনেক কিছু পেয়ে গেছে তখন এইটুকু কষ্ট সহ্য করতে ও রাজি। মনে মনে কিটনাশককে বেশ করে ধন্যবাদ দিলো। সব ঠিকঠাক দেখে জুনায়েদ বাড়ির পথে রওনা দিল। খুব এলোমেলো লাগছে নিজেকে। পিউ ঠিক আছে কিন্তু নীলু মেয়েটার কি হবে? শিকদার বাড়ির বউয়ের আরেকটা বিয়ে দাদু জানলে বাড়ি মাথায় করবেন। তাছাড়া নিজের কাছে নিজের ছোট লাগছে। হঠাৎ ভাবলো মানুষ বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে করে তো। তাছাড়া মুসলিম ছেলেদের চারটা বিয়ে করার জায়েজ আছে। কথাটা মনে মনে ভেবে নিজেই নিজের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলো। ও কিছুতেই নীলুকে ছাড়তে পারবে না। মেয়েটা যেমন ঘরে আছে থাক। ও খুশীতে গদগদ হয়ে অনিককে ফোন করলো। কল যেতে দেরী হলো কিন্তু রিসিভ করতে দেরি হলো না। মনে হলো ছেলেটা এতক্ষণ ওর ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। ওপাশ থেকে খুব চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
> ওদিকের কি অবস্থা? বাড়ির ঝামেলায় ফেঁসে গেছি তাই খোঁজ নিতে পারিনি। পিউ ঠিক আছে?
> সব ঠিক আছে। পিউ মোটামুটি সুস্থ। শোন না আমি দারুণ একটা আইডিয়া পেয়েছি। বলেতে পারিস বিনা যুদ্ধে যুদ্ধ জয়।
> তুই আবারও নীলুকে মারতে চাইছিস? খুব খারাপ আইডিয়া।
> দূর ওসব কিছু না। আমি পিউকে বিয়ে করতে চাই নীলুকে ডিভোর্স না দিয়ে। লোকজন কতগুলো বিয়ে করে আমি না হয় দুটো করলাম। সমস্যা কোথায়?
> গাছেরটাও খাবি তলারটাও কুড়াবি ভালো বুদ্ধি। আমার কি মনে হয় জানিস? আন্টি ঠিক বলেন।
> আম্মু কি বলেন?
> তুই বিকৃতমস্তিষ্কের লোক। ছি এসব চিন্তা তোর মাথায় আসলো কিভাবে? শোন পিউ বড়লোকের মেয়ে ওর চিন্তা ওর বাপ করবে। তুই তোর বউকে নিয়ে ভাব। মেয়েটার অবস্থা খারাপ করতে উঠে পড়ে লেগেছিস। ওরকম সুন্দর একটা বউ পেলে না আমি দুনিয়া ভূলে যেতাম। ওকে রাখতে না পারলে আমার কাছে পাঠিয়ে দে। ভাই হিসেবে বোনকে তোর থেকে ভালো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবো।
> তুই তোর চিন্তা কর।আমার বউকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না। তোরা কেউ আমার ভালো দেখতে পারিস না।
জুনায়েদ রেগেমেগে ফোনটা রেখে দিলো। ভেবেছিল অনিক ওর কথায় সম্মতি দিবে কিন্তু দিলো না। উল্টো একগাদা কথা শুনিয়ে দিলো। ও মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, ” সবার চিন্তা আমাকে নিয়ে না আমার বউকে নিয়ে। আমাদের বাড়ির বউয়ের বিয়ে হলে মান সম্মান থাকবে না এটা কেউ ভাবছে না।” জুনায়েদ বাড়িতে ফিরে সোজা বাথরুমে চলে গেলো ফ্রেস হতে। সকাল থেকে পেটে একটাও দানাপানি পড়েনি। ও ফ্রেস হয়ে বাইরে এসে দেখলো নীলু বিছানায় পা তুলে বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। মেয়েটার গায়ে কোমলা রঙের একটা পাড় দেওয়া তাঁতের শাড়ি। বেশ মানিয়েছে। জুনায়েদ ওর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই মন খারাপ নিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। কি করবে না করবে ভেবে মাথা খারাপ হচ্ছে। হঠাৎ নীলুর কথায় ওর ধ্যান ভাঙলো,
> পিউ আপুর শরীর ঠিক আছে?
> হুম
> আহারে বেচারী আপনার জন্য কি কষ্টটাই না সহ্য করছে। আচ্ছা তরুণ ভাইয়া যা বলছিল সবটা কি ঠিক?
জুনায়েদ ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> ও তোমাকে কি বলেছে? বলেছিলাম না ওর সঙ্গে কথা না বলতে?
> আমিতো বলিনি উনি নিজেই বলল, আপনার সঙ্গে আমার কেমন সম্পর্ক। আরও বলছিল…
জুনায়েদ বেশ নড়েচড়ে বসলো নীলুর কথা শোনার
জন্য। কিন্তু হলো না বাইরে থেকে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুরু হলো। জুনায়েদ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই কাজের মেয়ে ডলি এসে বলল ওদেরকে নিচে যেতে। বাইরে থেকে লোকজন এসেছে কথা বলবে। জুনায়েদ একবার নীলুর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বেরিয়ে আসলো সঙ্গে নীলুও ওকে অনুসরণ করলো। ডাইনিং রুমের সোফায় পিউয়ের বাবা মা আর অরুণের বাবা মা বসে আছে। সঙ্গে অরুণও আছে। জুনায়েদ ওদেরকে দেখে অজানা ভয়ে কুকড়ে গেলো। না জানি আজ কি হয়। ওদেরকে দুজনকে দেখে পারভীন বেগম খুব গম্ভীর কন্ঠে বসতে বলল। জুনায়েদ অরুণের পাশে গিয়ে বসলো। আর নীলু গিয়ে পারভীন বেগমের কাছে। উপস্থিত কারো মুখে কথা নেই। হঠাৎ সৈয়দ সাহেব বললেন,
> আমাদের পরিবার নিয়ে বেশ ভাবনা চিন্তা করেছেন আপনারা। এবার আমাদের ভাবতে দিন। জুনায়েদ এসব কি শুনছি বলবে?
জুনায়েদ বাবার কথার উত্তর দিতে গেলো কিন্তু গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। ওকে এমন অবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য পিউয়ের বাবা বললেন,
> ভাই সাহেব এখন রাগারাগি করলে কিন্তু চলবে না। আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতে প্রশ্ন। ওরা যদি খারাপ থাকে তাহলে আমরা কিভাবে ভালো থাকবো। তাছাড়া নীলু মায়ের সঙ্গে জুনায়েদের ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেনি। এখন যদি ওদেরকে আলাদা করা হয় ওদের মনে তেমন কিছুই হবে না। আশাকরি বুঝবেন।
ভদ্রলোকের কথা শুনে সৈয়দ সাহেব বেশ বিরক্ত হলেন। নিজের মেয়ের জন্য দেখি খুব চিন্তা কিন্তু নীলুর বাবাকে উনি কথা দিয়েছেন মেয়েকে ভালো রাখবেন। তাছাড়া মেয়েটাকে উনি নিজের ইচ্ছেতে রেখেছেন। কথার খেলাপ হবে ভেবেই অস্থির লাগছে। তবুও উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
> জুনায়েদ তুমি কি জানো অরুণ নীলুর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে? আফসোস তোমার বন্ধু মেয়েটাকে বুঝলো অথচ তুমি বুঝলে না। এই নিয়ে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। এখন উপযুক্ত স্বামী হয়ে নিজ হাতে বউয়ের বিয়েটা দিয়ে দাও।
সৈয়দ সাহেব খুব আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বললেন। উনার উদ্দেশ্য জুনায়েদকে অপমান করা। উনি চাইলে এদেরকে অপমান করে তাড়িয়ে দিতে পারতেন কিন্তু এসব করলে ছেলেটা কিছুই বুঝবে না। ওর ভাঙা মাথায় শুধু পিউয়ের নাম চলছে। জুনায়েদ এতক্ষণ অরুণের দিকে তাকিয়ে ছিল। ছেলেটা লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে বসে আছে। জুনায়েদের সহ্য হচ্ছে না। ওর ইচ্ছা হলো উঠে গিয়ে ধুম করে বেটার মুখের উপরে একটা ঘুসি বসিয়ে দিতে। কিন্তু পারলো না। নিজের সর্বশক্তি দিতে উঠে দ্রুত কন্ঠে বলল,
> এসব বিয়ে টিয়ে কিছুই হচ্ছে না। আপনারা আসতে পারেন। আঙ্কেল অনেক ভেবে দেখলাম নীলুকে আমার বাবা মা খুব আশা নিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছেন তাই আমি ওর সঙ্গেই থাকতে চাই। আপনি পিউকে সুস্থ করে বিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। আমি কথা দিচ্ছি ওর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করবো না। আমাদের বাড়ির বউরা খুব সম্মানের। আশাকরি তাদের সম্মান নিয়ে টানাটানি করবেন না।
জুনায়েদ কথা শেষ করে গটগট করে সিঁড়ি পযর্ন্ত উঠে এসে আবারও ফিরে গেলো। ও একবার অরুণের দিকে তাকিয়ে নীলুর হাত ধরে টানতে টানতে উপরে চলে গেলো। জুনায়েদের এমন কান্ড দেখে উপস্থিত সবাই হতাশ। এই ছেলে চাইছে কি কেউ বুঝতে পারছে না। পিউয়ের বাবা সৈয়দ সাহেবের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছেন দেখে উনি বললেন,
> আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি চাই ওরা নিজেও জানেনা। ওদের অন্যায় আবদার গুলো মেনে নিয়ে যদি আমরাও ভূল করি তাহলে কেমন হয় বলুন? বাড়িতে গিয়ে মেয়েকে বুঝিয়ে বলুন এসব না করতে।
উনার কথা শুনে একে একে সবাই চলে গেলো। জুনায়েদ পায়চারি করছে। নীলু সোফায় বসে দাঁত দিয়ে নক কাটছে। ও হাটতে হাটতে জুনায়েদ নীলুর সামনে এসে বলল,
> শোনো মেয়ে আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মানতে পারছি না। জানি তুমি সুন্দরী তবুও মন বলতে একটা বস্তু আছে। ইচ্ছে করলেই সেখানে কাউকে বসানো যায় না। তোমার প্রতি আমার কোনো রকম অনুভূতি কাজ করে না। এখন তুমি ভাবো এভাবে আমাদের বাড়িতে থাকবে নাকি তোমাকে তোমার বাবার বাড়িতে রেখে আসবো?
জুনায়েদ কথাগুলো বলে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ওর কথা শুনে নীলুর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। ও যেমন ভাবছিল তেমনি ভাবতে ভাবতে বলল,
> আচ্ছা যদি আপনার মধ্যে আমার জন্য অনুভূতির সৃষ্টি হয় তবে কি আপনি আমাকে মেনে নিবেন?
> অবশ্যই মানবো। কিন্তু এমন কখনও হবে না। আমাকে আমি জানি।
> আমার বাবা মা গ্রামে নেই। তিনমাস পরে উনারা আসবেন তখন আমি সেখানে ফিরে যাবো। ততদিন দয়াকরে এখানে থাকতে দিন। তখন আমি নিজে থেকেই চলে যাবো।
> যদি না যেতে চাও?
> কথা দিচ্ছি। আমাদের সমাজের নিয়ম কথা দিলে কথা রাখে। সেই সময় আপনি বললেও আমি থাকবো না।
> আমিও তোমাকে বলবো না এটা নিশ্চিত থাকো।
সেদিন দুজনের মধ্যে কথা হলে তিনমাস মেয়েটা এই বাড়িতেই থাকবে। এর মধ্যে আর কোনো ঝামেলা অশান্তি হবে না। যখন নীলু চলে যাবে তখন ও সবাইকে বুঝিয়ে বলবে। জুনায়েদ যেনো প্রাণ ফিরে পেলো। অবশেষে ভালো একটা সমাধান। ও বেশ শান্তি নিয়ে ঘুমালো। নীলু মলিন হেসে সোফায় বসে আছে। কিছু বন্ধনে ইচ্ছে করে জড়াতে হয়না। আপনা আপনি জড়িয়ে যেতে হয়। এভাবেই রাত পার হলো। পরদিন সকালবেলায় জুনায়েদ ফ্রেস হয়ে সোফায় বসতে বসতে শুনলো পারভীন বেগম বলছেন,
> নীলু ইউনিভার্সিটি জীবনের প্রথম দিন খুব ভালো করে ক্লাস করবা। কারো সঙ্গে অকারণে তর্কাতর্কি করবা না। বিশেষ করে আমার ছেলের সঙ্গে একদম না। তোমার দিনটা খারাপ হবে মা।
কথাটা জুনায়েদের কানে মনে হলো ঘন্টার মতো বেঁজে উঠলো। ওর সঙ্গে এতবড় একটা প্রতারণা করা হয়েছে ভাবতে পারলো না। ও রেগে মায়ের সামনে গিয়ে বলল,
> নীলু কোথায় যাচ্ছে? ও না অশিক্ষিত লেখাপড়া জানেনা।
> তোকে কে বলেছে ও অশিক্ষিত? আমিতো বলেছিলাম মেয়েটা স্বল্প শিক্ষিত। ওকি পড়াশোনা শেষ করেছে যে বলবো ও বিরাট শিক্ষিত অদ্ভুত।
> তাহলে ওই কবিতা গুলো?
> মেয়েটা পড়তে পছন্দ করে। বাড়িতে তেমন বই নেই তাই সময় কাটানোর জন্য দিয়েছিলাম। যাইহোক কথা বলে সময় নষ্ট করিস না। ওকে পৌঁছে দিয়ে আই। তোদের ভার্সিটি এই জন্য একটু স্বস্তিতে আছি।
জুনায়েদ মায়ের কথা শুনে বোকা বনে গেলো। এই মেয়েটাও খুব চালাক। সব রাগ গিয়ে জমা হলো নীলুর উপরে।
(চলবে)
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। ভৌতিক কাল্পনিক গল্প তাই খারাপ লাগলে বাজে মন্তব্য না করে ইগনোর করুণ।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।