আলোয় অন্ধকার পর্ব-৩১

0
1777

#আলোয়_অন্ধকার🍁
#Roja_islam
#part 31
পিউ আরাফ দুজন হসপিটালেরি কাছাকাছি একটি পার্কে বসে আছে। আরাফ পিউকে টিয়াকে নিয়ে কিছু প্রশ্ন করবে বলেই এখানে নিয়ে এসেছে। হসপিটাল এসব কথা বললে তার বাবা এবং পরিবারের লোকজন শুনলে প্রবলেম হতো তাই এখনে নিয়ে আসা। পিউও বুঝতে পারছে আরাফ কি জিজ্ঞেস করবে আর কেন তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সে বলতে তো পারবেনা কিছু। কেননা পিউ সঠিক কিছু না জানলেও তার আইডিয়া আছে এটা ছোটখাটো বিষয় নয়। যদি আস্ফির নাম সে বলে তাহলে প্রবলেম হয়ে যাবে। এই তিন দিনে টিয়ার আত্তিয় স্বজন সবাই টিয়ার ব্যাপারে আর টিয়ার মা অসুস্থতার বিষয়ে জেনে গেছে। এবং তারা বিষণ রেগে। কেন তাদের কিছু জানানো হয়নি। কেন এতোসবের পরেও পুলিশ এ জানানো হয়নি৷ তারা রীতিমতো ক্ষেপে আছে আরাফ এবং টিয়ার বাবা রফিক এর উপর। আর এখন যদি আরাফ আস্ফির কথা জানতে পারে সব দোষ আস্ফির কাধেই পরবে স্তব্ধকে না পেয়ে তারা আস্ফির নামেই পুলিশে কমপ্লেইন করবে। শুধু শুধু আস্ফি ঝামেলায় পরে যাবে। তবে পিউ যদি কোন ভাবে জানতো আস্ফি বা স্তব্ধ মিলে টিয়াকে কিডন্যাপ বা লুকিয়ে রেখেছে তাহলে সে অবশ্যই বলে দিতো। কিন্তু এখন সে এমন পরিস্থিতিতে দাড়িয়ে সঠিক ভাবে সে কিছুই জানেনা কি বলবে আরাফকে।

আরাফ হঠাৎই বললো,
— ” আমি একটা পানি নিয়ে আসছি বসো তুমি! ”

পিউ কিছু বললোনা আরাফ চলে গেলো উঠে বেঞ্চি থেকে পানি আনতে! সব কিছু নিয়ে চিন্তিত ক্লান্ত আরাফ বেশ উৎসুক বোনের ব্যাপারে কিছু জানতে । পিউ আরাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কি ভেবে উঠে দৌড়ে পালালো সেখান থেকে। সে আরাফের প্রশ্নের মুখে পরতে চাইছেনা। আগে সে ঠিক করে আস্ফির সাথে কথা বলে নিতে চায়। তারপর আরাফকে জানাবে যাই সে জানে। পিউ দৌড়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে রিকশা করে নিজের বাসায় চলে গেলো ভয়ে হাত পা কাপছে পিউ এর! যেমন পার্ক থেকে কোনও বাচ্চার চকলেট চুড়ি করে পালাচ্ছে সে। ধরা পরলেই বাচ্চার রাক্ষুসে মা বাবার গণপিটুনি পরবে তার উপর সেই ভয়েই হাত পা কাপছে তার।

পিউ তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই তার মা কিচেন থেকে দৌড়ে আসতে আসতে গলা উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,
— ” কিরে টিয়ার মা এখন কেমন! আচ্ছা এটা….! ”

পিউ এর মা তার কথা শেষ করার আগেই পিউ তার ঘরে ঢুকে দরজা ধপাস করে লাগিয়ে দিলো। পিউ এর মা ভেবে নিলো পিউ হয় তো ক্লান্ত তাই তিনি আর ডাকলেন না মেয়ে কিচেনে ঢুকে গেলেন। পিউ তার মার কথা আধো শুনেছে নাকি সন্দেহ সে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুম ঢুকে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে সোজা ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে আরাফ কে ছোট করে টেক্স করে ” স্যরি ”

তারপর ১ সেকেন্ড লেইট না করে আস্ফিকে কল লাগায়। কিন্তু ফোন সুইচড অফ বলছে বারবার। পিউ বিরক্ত হয়ে রাস্তায় দিকে তাকালেই দেখতে পায় একটা পুলিশ এর গাড়ি ছুটে পিউ এর বাড়ীর দিকেই আসছে পিউ মনে হচ্ছে এখুনি মরে যাবে এই ভেবে। আরাফ তাকে ভুল বুঝে তার নামে পুলিশে কমপ্লেইন করেনিতো। ভয়ে পিউ নিচে বসে লুকিয়ে পরলো। ভয়ে হাত পা হিমালয় এর মতন হিম হয়ে আসছে। বুক দুরুদুরু করছে। ঘাম কপাল বেয়ে পরছে। মনে মনে আল্লাহ কে ডাকছে পিউ কেনোনা যদি পুলিশ সত্যি তার জন্য আসে তো বাবা মার সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। সমাজে মুখ দেখাতে পারবেনা। আমাদের সমাজে ছেদের পুলিশে ধরলেই কানাঘুষার শেষ থাকে না তাকে এবং তার ফ্যামিলিকে নিয়ে। সেই যায়গায় পিউ এর মতো যুবতী মেয়ের জন্য তার বাসায় পুলিশ আসলে পুরো ফ্যামিলির আত্মহত্যা ছাড়া বিকল্প কোনও রাস্তা নেই সমাজের কথা উপহাস থেকে বাঁচার। নানান কিছু ভেবে পিউ শক্ত হয়ে বসে রইলো বারান্দায় ফ্লোরে। কিছু সময়ের মধ্যে পিউ বুঝতে পারলো তার দেখা গাড়ীটা তাদের বাসার সামনেই থেমেছে পিউ সেটা বুঝতে পেরে আরও জমে গেলো। ভয়ে চোখ বেয়ে পানি পরছে কিন্তু অনেক সময় চলে যাওয়া পরেও যখন বুঝলো তাদের বাড়িতে কেও ঢুকেনি তখন সে আস্তে আস্তে হাটু ভর দিয়ে বসেই নিচে উঁকি দিলো। গাড়ীটা এখনো আছে একজন একজন অফিসার আর দুজন লোক তাদের বাড়ীর দিকে তাকিয়ে কি জেনো কথা বলছে! এইটুকু দেখেই পিউ দ্রুত আবার নিচে বসে পরলো৷ ভয়ে নিজের হার্ডবিট এর শব্দ পিউ নিজেই শুনতে পাচ্ছে। মনে প্রানে আল্লাহ আল্লাহ করছে পিউ লোক গুলো জেনো চলে যায়৷ আল্লাহ যেনো পিউ এর ডাক শুনতে পেলো কিছু ক্ষন পরেই পিউ আওয়াজ পেলো একটা গাড়ী শা করে চলে গিয়েছে। পিউ উঠে দাড়িয়ে নিচে দেখলো হ্যাঁ পুলিশের গাড়ীটা চলে গেছে। পিউ আর পারলোনা থামতে ভয়ে সেখানে বসেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। কিছু ক্ষন পর কান্না থামিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে পিউ৷ বুকের উপর থেকে যেনো বড়সড় একটা পাথর নেমেছে। পিউ হাতে ফোনটার দিকে তাকালো তীব্র ঘৃণা নিয়ে সেখানে আস্ফির নাম্বার একটি ছবি এবং তার নাম টা জ্বলজ্বল করছে। পিউ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বিরবির করলো,
— ” আজকের জন্য আমি তোকে কখনও ক্ষমা করবোনা আস্ফি। তুই এভাবে আমাকে একা না ছাড়লে আমি কখনও এতো ভয় পেতাম না। আই উইল নেভার ফরগিভ ইউ আস্ফি! নেভার……!

সন্ধ্যে হয়ে গেছে আরাফ এর ফোন বারবার লাগাতার বেজে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন আরাফ। সে এখনও সেই পার্কের বেঞ্চিতে বসে। আরাফের নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। এতো টা অসহায় সে আগে কখনও ফিল করেনি। যেদিন থেকে টিয়া মিসিং সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত একদিন শ্বাস নিতে পারেনি ভালো করে সে। কিভাবেই বা নিবে বোনের ছোট মানুষিকে তখন সাপোর্ট দিয়ে যে বোন হারাবে কখনও ভাবেনি আরাফ কখনও না। সে ভাবেইনি এতো কিছু হয়ে যাবে। টিয়া মিসিং শুনে স্তব্ধের বাসায় আরাফ চিল্লাচিল্লি করে আসলেও। সেখান থেকে আসার পথে তাকে কিছু লোক ধমকি দেত পুলিশে কেনো কাওকে কিছু না যানাতে যদি জানায় তো তার মা বাবাকেও মিসিং করে দিবে। আরাফ বোন হারিয়ে এই কথায় ভয় পেয়ে যায়। তাই সে জোর দেয়নি তার বাবাকে পুলিশে যেতে এবং তার বাবাও পুলিশে যেতে নারাজ ছিলো। যখন পুলিশে যেতে পারছিলোনা অজানা লোকদের কথায় তার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। সে কিছুই করতে পারছেনা তার বোনের জন্য। কিন্তু সে আশার আলো পেয়েছিলো যখন স্তব্ধ একদিন হঠাৎ নিজেই ফোন করে তাকে বলে সে টিয়াকে সেইফ ভাবে তার হাতে তুলে দিবে যেভাবেই হোক সেটা! সেদিন থেকেই সে চুপচাপ অপেক্ষা করছিলো। কবে স্তব্ধ টিয়াকে নিয়ে আসবে কিন্তু না। স্তব্ধ আসেনি বরং সে নিজেও স্তব্ধের বাসায় গিয়ে তাকে হাজার খুজেও পায়নি। আজ পিউকে সন্দেহ হয়েছিলো আরাফের এই ভেবে যে পিউ স্তব্ধ কোথায় সেটা জানে কিন্তু পিউ এভাবে চলে গেলো। আরাফ না আর কিছু ভাবতে পারছে না নিতে পারছে। না চাইতেও আরাফের চোখের কোণা বেয়ে পানি পরছে আজ…….! এদিকে কলের উপর কল বেজেই যাচ্ছে। মার কথা মাথায় আসতেই আরাফ ফোন পিক করে উঠে দাড়ায়,
— ” হ্যালো বাবা? বলো আসলে আমি আসছি এখুনি কিছু লাগবে কি? ”

এতোটুকু বলার পর আরাফ ওপাশ থেকে গৌণ চিৎকারই শুধু শুনতে পায়। যা কানে যেতেই আরাফ এর কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। সে বারবার বলছে,
— ” হ্যালো বাবা?? সব ঠিক আছে হ্যালো কথা বলো? হ্যালো?? ”

ওপাশ থেকে এবার তার ছোট চাচার ছেলের কণ্ঠ শোনা যায়। সে কাদতে কাদতে বলছে,
— ” আরাফ ভাইয়া জেঠিমার অবস্থা ভালো নেই তুমি দ্রুত হসপিটাল আসো! ”

আরাফ দৌড়ে পার্ক থেকে বের হচ্ছিলো। তার পা এই কথা শুনে থমকে গেলো। সে নির্বাক হয়ে ফোন শক্ত করে ধরে রইলো। পা আর চলছে না টিটু ফোন কেটে দিয়েছে। আরাফ ফোন কান থেকে নামাতে ভুলে গেছে। কিছু ক্ষন পর আরাফ কিভেবে দৌড়ে ছুটলো হসপিটালের দিকে। আরাফ এর চোখ বেয়ে পানি পরছে। হসপিটালের এর গেটে দৌড়ে ঢুকে সে। কোনও রকম মার কেবিনে যায় সে সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। অবশেষে সে একটি দৃশ্য দেখতে পায় যা সহনীয় না। তার বাবা তার মায়ের হাত ধরে পাথর হয়ে বসে আশেপাশে সবাই কাদছে….!

আস্ফি মাত্রই ফোন রাখলো।সে খবর পেলো টিয়ার মা যেকোনো সময় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আস্ফি চিৎকার করে বললো,
— ” ভাই হোয়্যার আর ইউ! সব শেষ হয়ে যাচ্ছে! প্লিজ কাম ব্যাক সুন! ”




টিয়া বসে আছে বেডে হেলান দিয়ে চোখ মুখ অসম্ভব ফোলা। কিন্তু অনেক টা স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। ডেনিয়াল সেটাই একদৃষ্টিতে দেখছে। সে বেডের পাশে একটি টুলে বসে। টিয়া খুব শান্ত ভাবে বসে রইলেও তাদ বুকে ক্রমাগত চিনচিন ব্যাথাটা বারছে। সে হঠাৎ ডেনিয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” ক্যান আই হ্যাভ সাম ওয়াটার.. প্লিজ! ”

ডেনিয়াল টিয়ার এতো স্বাভাবিক কথায় কিছুটা থমকে গেলো। কিছু বাদে সে নিজেকে স্বাভাবিক করে দ্রুত বেড সাইড থেকে টিয়াকে পানি দিলো। টিয়া সুন্দর ভাবে গ্লাস টা নিয়ে পানিটা এক নিশ্বাসে পানিটা শেষ করলো। টিয়া গ্লাস রাখতেই ডেনিয়াল জিজ্ঞেস করলো,
— ” হাউ ডু ইউ ফিল নাও ??

টিয়া তার কান্না করার ফলে ভাঙা গলায় ধীরে জবাব দিলো,
— ” বেটার..! ”

টিয়ার এতো শান্ত কণ্ঠের জবাবও পছন্দ হলোনা ডেনিয়ালের! সে ক্রোধিত হয়ে বললো,
— ” যদি মাথায় কিছু ঢুকিয়ে থাকে স্তব্ধ তোমার বের করে দাও৷ আদার ওয়াইজ তোমাকেও নিজের জান দিতে হবে মাই বার্ড! ”

টিয়া কিছুটা কেঁপে ওঠে ডেনিয়ালের গলা ফাটানো কথায়। তবুও নিজেকে নরমাল রেখে সে বলে উঠে,
— ” আমার মাথায় কিছু নেই। আমি একটু ফ্রেশ হতে চাই! এই ভারি লেহেঙ্গা সহ্য হচ্ছে না আর! ”

ডেনিয়াল টিয়ার দিকে তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে চলে যায় হন হন করে রুম থেকে। তার মোটেও সুবিধের লাগছেনা টিয়াকে৷ কাল ডক্টর এলে তার চিকিৎসায় টিয়াকে মোটামুটি সুস্থ দেখায় তীব্র জোর কমে আসে। ক্ষতগুলোতে মলম পরার পর তীব্র ঘুম থেকে মাত্রই উঠে টিয়া। ডেনিয়াল এর কথা মতো সে খেয়ে মেডিসিন তার হাতেই খায় আর এখন এতো শান্ত কণ্ঠ তার। ডেনিয়াল সেটা মানতেই পারছেনা কি করে টিয়া এতো স্বাভাবিক?? হাউ??

টিয়া ডেনিয়ালের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়ায় সে। ধীরে পায়ে উঠে কাবার্ডের সামনে যায় নিজেকে আয়নায় এক নজর দেখে চোখের পানি ছেড়ে দেয় সে। স্তব্ধের পছন্দের তার বিয়ের লেহেঙ্গা টাও ক্ষতবিক্ষত আজ। নানান জায়গায় ছিঁড়ে ফেটে গেছে। শুকনো রক্ত লেগে শক্ত হয়ে আছে। রক্ত গুলোতে হাত ছোঁয়ায় টিয়া। এগুলা যে স্তব্ধের রক্ত। টিয়া আয়নার শরীরের ভার ছেড়ে কাদতে থাকে। চোখের সামনে আবার সব জেগে উঠে।

টিয়া ফিরে যায় আবার সে দিনে যেদিন স্তব্ধ ঘুমিয়েছিলো তার রুমে।
চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here