#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
” এই নিষ্ঠুর খবরটা মিথ্যা হোক। তার রাজা বাবা আবারও তাকে প্রিন্সেস ডাকুক। শুধু একবার মা তাকে বকে দিক। ”
জুভান নাস্তা করায় মগ্ন ছিল। ঐশীর আর্তচিৎকার কানে ভেসে আসতেই জুভান তাৎক্ষণিক ঐশীর দিকে তাকায়। ঐশীকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে সে কিছুটা ভরকে যায়। চটজলদি চেয়ার থেকে উঠে ঐশীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। ঐশীর দদুনো গাল হাতের মুঠোয় নিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকে,
” এই ঐশী। ঐশী ? কি হলো। ঐশী ? ”
ঐশী নিরুত্তর। দুনো চোখ বুজে রাখা। চোখের নিচ বেয়ে একটা লম্বা দাগ এসে থুতনিতে ঠেকেছে। অতিরিক্ত অশ্রু ব্যয় করার ফলস্বরূপ। জুভান ঐশীর অবস্থা বেগতিক দেখে চটজলদি সার্ভেন্ট কে পানি আনতে বলে।
” আশরাফুল হাবিব এবং তার স্ত্রীর মুখ সম্পূর্ণ ঝলসে গেছে তাই তাদের চিন্তিত করতে পুলিশ তদন্ত স্বরূপ ডিএনএ টেস্ট করিয়েছে। সেই টেস্ট থেকে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারছি যে এই দুটি দেহ আশরাফুল হাবিব এবং তার স্ত্রীর। বিস্তারিত জানতে … ”
জুভান ভ্রু কুঞ্চিত করে বৃহদাকার টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। আবারো আগুনে পুড়ে যাওয়ার খবর ? একটা কিভাবে যে মানুষ এত অসচেতন হয় ? একটু খেয়াল রাখলে ত আর এভাবে পরিবারসহ পুড়তে হতো না। জুভান এক নিঃশ্বাস ফেললো। ভারী নিঃশ্বাস। সেই নিঃশ্বাসে মিশে আছে কতশত আফসোস , হাজারো অপ্রাপ্তি।
সার্ভেন্ট জগে করে পানি আনলে জুভান তরিগরি করে সেই পানি দুহাতের আজলায় নিয়ে ছিটিয়ে দেয় ঐশীর চোখে মুখে। তবে ঐশী অনুভূতিহীন। জুভান বিরক্ত হয়। জ্ঞান হারানোর আর সময় পেলো না ? জুভান আবারও পানি ছিটিয়ে দেয়। এবারও ঐশী জাগে না। জুভান শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে ঐশীকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে নেয়। জুভানের এতে একটু অসস্তি হয়। তবে কোনো উপায় যে নেই। ঐশীর হাত মাটির দিকে অনুভূতিহীন ঝুলে আছে। জুভান একবার ঐশীর দিকে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালো। হন্তদন্ত হয়ে ঐশীকে গাড়িতে তুলে ড্রাইভারকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে যেতে বললো।
_____________________
ঐশীর হাতে স্যালাইন লাগানো। অনুভূতিহিন বেডের এক অংশ জুড়ে শুয়ে আছে। চোখ গুলো থেকে মাঝেমধ্যে টিপটিপ পানি গড়িয়ে পড়ছে। গালে , গাল থেকে বালিশ। অজ্ঞান অবস্থায় কি কাদছে মেয়েটা ? এত কষ্ট কিসের এই ছোট্ট মেয়ের ? কি নেই ওর কাছে ? একটা পরিবার আছে ? জীবনের সবটুকু সময় আগলে রাখার জন্যে একজন বাবা আছেন। তাহলে ? কিসের কষ্ট ? কিসের অপ্রাপ্তি ? জুভান সোফায় বসে ফোন হাতে নিয়ে ঐশীর দিকে তাকিয়ে আছে।
ঐশীর চোখের ভিজে পাপড়ি হালকা যেনো নড়ে উঠলো। তবে কি ঐশীর জ্ঞান ফিরছে ? ঐশী দীর্ঘসময় বুজে রাখা চোখ দুটো একটু একটু করে মেলছে। একটা সময় ঐশী সম্পূর্ণ চোখ মেলে তাকালো। ক্লান্ত দুচোখ যেন হাজারো কথা বলছে। চোখের নিচটায় লম্বাটে দাগ যেনো চিৎকার করে বলছে , ” শুনছো পৃথিবী , আমি একেবারে অসহায় হয়ে গেছি। এই নিষ্ঠুর মৃত্যু আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। সারাদিন বকে যাওয়া মা-টাকেও কেড়ে নিয়েছে। শুনছো মৃত্যু , তুমি সফল হয়েছে। একটা সন্তানের আর্তনাদ শোনার ইচ্ছে তোমার পূর্ণ হলো। এবার খুশী তো তুমি ? ”
ঐশী অনুভূতিহীন তাকিয়ে আছে মাথার উপর ঝুঁকে থাকা ফ্যানটার দিকে। হাতের রগে বহমান চঞ্চল লাল – নীল ব্যাথাটা যেনো তুচ্ছ ওর কাছে। ঐশীর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র অশ্রুর ফোঁটা।
জুভান ঐশীর জ্ঞান ফিরতে দেখে সোফা থেকে উঠে ঐশীর কাছে চেয়ার টেনে বসলো। ঐশীর দিকে তাকিয়ে দু চারটা কড়া কথা শুনাতে গেলে দু চোখে অশ্রুর ফোঁটা দেখে দমে গেল। এক ঢোক গিলে নিজের রাগকে সামলানোর চেষ্টা করে ঐশীর দিকে তাকালো। নরম কণ্ঠে নাম নিল,
” ঐশী … ”
ঐশী ঘাড় ঘুরিয়ে জুভানের দিকে তাকালো। শুষ্ক ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বললো,
” দু. দু.দুপুর হয়ে গে.গেছে। আ. আ.আমি চলে যাবো। আর ক. কষ্ট করতে হবে না আ.আ.আপনার। ”
জুভান ঠোঁট মেলে মলিন হাসলো। ফোনটা অন করে একবার চোখ বুলিয়ে আবারও ঐশীর দিকে তাকাল। বললো,
” ১১টা বাজে। দুটো বাজে নি। তাই এখনো দুপুর হয়নি। চিন্তা নেই। ”
ঐশী উত্তর দিলো না। কোনো অনুভূতিও প্রকাশ করলো না। বরং চুপচাপ ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও ঘূর্ণায়মান ফ্যান এর দিকে তাকাল। ওর জনম দুঃখিনী চোখ জোড়ায় এই সাদা রঙের ধুলোবালি জমা ফ্যানটাই যেনো পৃথিবীর নবম আশ্চর্য।
জুভান এক উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলল। পেটের মধ্যে এতক্ষণ ধরে জমে থাকা প্রশ্ন গুলো দলা বেধে বললো,
” কি হয়েছিল তোমার ? অজ্ঞান হলে কেনো ? ভয় পেয়েছো কিছু দেখে ? আমাকে বলো। কি হয়েছে ? ”
ঐশীর দুচোখ জোরালো ভাবে বন্ধ করলো। সঙ্গেসঙ্গে দু চোখের কর্নার থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা মুক্ত অশ্রু। ঐশী গুটিকয়েক ঢোক গিলে বললো,
” বা. বা.বা.বাবা , ম.ম.মা মা.মারা গেছেন। ”
জুভান থমকে গেলো। কপালের ভাঁজগুলো খুলে সোজা হয়ে গেলো। এক দফা বিস্ময় নিয়ে বলল,
” মানে ? কিভাবে ? কখন ? ”
ঐশী দু চোখ বুজে কয়েকটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় গলায় জ্বালা ধরলো। তপ্ত হলো দু চোখ। ঐশী শীতল গলায় বললো,
” আ. আ.আগুনে পুড়ে। ”
জুভান এবারও স্তব্দ হয়ে গেলো। সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক বললো , টিভিতে দেখানো সেই পরিবার কি … ”
জুভান ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলো,
” আজ একটু আগে টিভিতে …. ”
ঐশী কথার পিঠে হ্যা বোধক মাথা নাড়ল। জুভান সব শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কাউকে কোনোদিন সান্ত্বনা দেয়নি ও। কিন্তু আজ মনে হলো , এই মেয়েকে সামলানোর জন্যে সান্তনা দেওয়া টা খুব জরুরি। কিন্তু সে তো পারেনা। তবে কি তার সান্ত্বনা দেওয়াটা শিখে নেওয়া উচিত ছিল ? জুভান ব্যর্থতার নিঃশ্বাস নিল।
” মিস্টার মির্জা ? ”
ডাক্তারের কণ্ঠ শুনে জুভান ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। জুভান চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে ডাক্তারকে ভিতরে আসতে বললো। বয়স্ক ডাক্তার গম্ভীর মুখে ভিতরে প্রবেশ করলেন। ডাক্তার ঐশীলে পর্যবেক্ষণ করে জুভানের দিকে তাকালেন। বললেন,
” মিস্টার মির্জা । রোগীর জ্ঞান ফিরেছে মানে এখন উনি বিপদমুক্ত। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবেন খুব বেশি মানুষিক চাপের কারণেই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। তাই নেক্সট টাইম যাতে কোনোরূপ প্রেসার উনার উপরে না পড়ে। আর আমি এখন কতকটা ঔষুধ প্রেসক্রাইব করে দিচ্ছি। মেডিসিন গুলো ঠিকমতো যাতে নেওয়া হয়। ”
জুভান মাথা নাড়ল।
____________________
বিকেল হয়ে গেছে। জুভান হাসপাতালের ফার্মেসিতে এসেছিল ঔষুধ নিতে। হুট করে একজন নার্স হন্তদন্ত হয়ে জুভানের কাছ আসলো। জুভান নার্সের দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই নার্স হাপাতে হাপাতে বললো,
” আপনার রোগী সুইসাইড করেছেন। ”
#চলবে
( আমি গল্প একদিন পর পর দেই। কিন্তু আপনাদের অনুরোধে আজ গল্প দিলাম। তাই আশা করি নেক্সট , নাইস না লিখে গঠনমূলক কমেন্ট করবেন। )